জ্বলদর্চি

পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে/পর্ব-৩/সুদীপ সেন

পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে

পর্ব-৩

সুদীপ সেন

আমাদের চারপাশে আগে কত নাম জানা বা না জানা পাখি দেখা যেত। কিন্তু ক্রমবর্ধমান নগরায়নের দরুন আমরা নিজেদের বাসস্থানের জন্য স্থান সংকুলানের প্রয়োজনে নির্বিচারে গাছপালা বন জঙ্গল কেটে চলেছি। আমাদের নিজেদের বাসস্থানতো হচ্ছে ( ছোট বাড়িই হোক আর লাক্সারি বাংলো বা হাইরাইজ এপার্টমেন্টই হোক ) কিন্তু কেটে ফেলা গাছপালাগুলো যেসব পাখিদের দীর্ঘদিনের স্বাভাবিক বাসস্থান ছিল, খাবার সংগ্রহের আধার ছিল সেই পাখিগুলো এখন ঘরছাড়া হয়ে কোথায় যাবে, কি খাবে তা কি আমরা একবারও ভাবি ! 

আমাদের প্রয়োজনে যখন বিনা দোষে বাচ্চাকাচ্চাসহ পাখিগুলোকে খাদ্যহীন বাসাহীন করে দিই তখন পাখিগুলোর জন্য কোনও বিকল্প বাসস্থান বা খাবারের ব্যাবস্থা করা কি আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না ? অবশ্যই পড়ে, কিন্তু আমরা এসব বিষয়কে অতি তুচ্ছ জ্ঞান করি কারণ আমরা নিজেদের নিয়েই বুঁদ হয়ে আছি। আমরা নিজেরা ছাড়া আর কে বাঁচল, কে মরল সেসব নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যাথা নেই। 

অথচ আমরা একটু উদ্যোগী হলেই কিন্তু আমরা এই অনিবার্য নগরায়নের মধ্যেও পাখিদের বেঁচে থাকার বিকল্প ব্যবস্থা করে দিতে পারি। বাড়ির – ছাদের – বাগানের – রাস্তার গাছে যেখানে সুযোগ পাওয়া যায় সেখানে কয়েকটা মাটির হাড়ি বা কাঠের ছোট বাক্স বা এক মুখ খোলা টিনের কৌটো বেঁধে দিলে ওরা নিজেদের মত ঘর বেঁধে নেবে। আর দেখতে হবে যেন ওদের এই নতুন বাড়িতে কেউ বিরক্ত না করে, ভয় না দেখায়। আর নিয়ম করে রোজ অন্তত একবার কয়েকমুঠো ভাঙ্গা গম বা চালের খুদ ছড়িয়ে দিলে বা একটা দুটো পাকা ফল খেতে দিলে ওরা ওদের মত খেয়ে নেবে। সেই সাথে একটা পাত্রে কিছুটা পরিস্কার জল রাখতে পারলে ওরা পিপাসার সময় খাবার জলটুকুও পেয়ে যাবে।  

🍂

এরপরে আসে পাখিদের উপর আলো এবং শব্দের অত্যাচার। পাখিদের রাতের বেলার স্বাভাবিক আশ্রয় বড় বড় গাছের অন্ধকার শান্ত পরিবেশ, এখানেই ওরা সংসার পাতে, বিশ্রাম নেয় বা একটু ঘুমায়। এখন আমরা নিজেদের প্রয়োজনে চড়া LED ষ্ট্রীট লাইট লাগাচ্ছি যেগুলোর উচ্চতা মোটামুটি বড় গাছের সমান বা কাছাকাছি। ফলে রাতের বিশ্রাম ও ঘুমের জন্য পাখিদের আর অন্ধকার নিরিবিলি জায়গা মিলছে না। তার সাথে থাকছে ল্যাম্প পোস্টে বাঁধা  মাইকের তীব্র আওয়াজ। ভাবুন তো এখনও টিকে থাকা সামান্য যা কিছু পাখিরা আছে, রাতের বেলায় তারা  যেখানে আশ্রয় নেয় সেই গাছগুলোর কাছাকাছি মাইক লাগালে তাদের কি অসহায় অবস্থা ! তাদের বাচ্চাগুলো ওই তীব্র আওয়াজ, ওই ল্যাম্প পোস্টের চড়া আলো সহ্য করে বাঁচতে পারবে ! এরপরে আবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা আনন্দে মেতে উঠবো, রকেট – শেল – তুবড়ি – চকলেট বোম ফাটিয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যাবো। নিজেদের আনন্দ উদযাপনের সময় একবারও কি ভাববো যে এই রকেটগুলো যখন তীব্র গতিতে মুখে আগুন নিয়ে হুইসল দিতে দিতে গাছের মাথায় কোনও পাখির বাসার দিকে ছুটে যায়, বা বাসার কাছে গিয়ে সশব্দে বিপুল আলো - আগুনের ঝল্কানি আর বিষাক্ত ধোঁয়ায় আকাশের চারিদিক ভরিয়ে দেয় তখন উড়তে না শেখা বাচ্চাগুলোকে নিয়ে মা পাখিদের অসহায়তার কথা ! আমাদের উল্লাসের শব্দে ঢাকা পড়ে যায় কত শত পাখির মৃত্যুভয়ের উৎকণ্ঠা বা মরন যন্ত্রণার আর্তনাদ। আমরা যদি পাখিদের প্রতি একটু সহমর্মী হই, ওদের দুর্দশা একটু লাঘব করতে চাই তাহলে বাজি – মাইক – চড়া আলোর ব্যবহার কিছুটা আমরা কমাতেই পারি, অন্তত সেইসব ক্ষেত্রে যেখানে এগুলো আমাদের প্রয়োজন নয়, বরং বাহুল্য আর আড়ম্বরের পরিচয়। আর এর থেকে যেটুকু টাকা বাঁচবে তার  অর্ধেকও যদি পাখিদের জন্য বাসা আর খাবারের জন্য খরচ করি তাহলে এই নগরায়নের মধ্যেও পাখিরা সপরিবারে আনন্দে বাঁচতে পারবে।    

আমাদের বাস্তুতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সব পশুপাখি, মাছ, গাছপালাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে তাদের প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক জীবনধারণের মধ্যে রেখে। সবাইকে অবজ্ঞা অবহেলা করে একা সর্বসুখে বাঁচার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে চোখে ঠুলি বেঁধে দৌড়নো নয় বরং পৃথিবীর সব থেকে উন্নত মস্তিস্ক এবং মননের অধিকারী হিসাবে পৃথিবীর বাকি সব অধিবাসীকেই যত্ন করে সাথে নিয়ে এবার এগিয়ে চলার পালা।  

"প্রকৃতি - পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, মানুষ বাঁচলে তবেই বাকি সবকিছু কাজে লাগবে"। 

Post a Comment

0 Comments