জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৯৩
ডাকাত রাজা থেকে চৈতন্য দাস
সূর্যকান্ত মাহাতো
বিষ্ণুপুর 'মল্ল' রাজবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন বীর হাম্বীর। দস্যুবৃত্তি ও লুণ্ঠনের জন্য তিনি 'ডাকাত রাজা' নামেও পরিচিত ছিলেন। সে 'ডাকাত রাজা'-ই 'বৈষ্ণব ধর্ম' গ্রহণ করে বিষ্ণুপুরে বৈষ্ণব ধর্মের প্লাবন ছুটিয়ে ছিলেন। সেই প্লাবনে প্লাবিত হয়ে গোটা বিষ্ণুপুর যেন বৃন্দাবনে পরিণত হয়েছিল। তাই তো 'জয়ানন্দ দাস' বনবিষ্ণুপুরকে 'গুপ্ত বৃন্দাবন' আখ্যা দিয়েছিলেন। (মদনমোহন বন্দনা/ জয়কৃষ্ণ দাস।) স্বয়ং রাজা 'ক্ষাত্র ধর্ম' পরিত্যাগ করে গ্রহণ করেছিলেন 'বৈষ্ণব ধর্ম'। 'অসি' ছেড়ে ধরেছিলেন 'মসি'। রাজা 'বীর হাম্বীর' থেকে হয়ে উঠেছিলেন 'চৈতন্য দাস'।
রাজা বীর হাম্বীরের বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা গ্রহণকে 'বিনয় ঘোষ' একটি 'বৈপ্লবিক ঘটনা' বলে উল্লেখ করেছেন। (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, প্রথম খন্ড/ পৃষ্ঠা- ৩৩৬) বিনয়বাবু কেন 'বৈপ্লবিক' শব্দটা ব্যবহার করেছেন কিংবা ঠিক কোন অর্থে বীর হাম্বীরের 'বৈষ্ণব ধর্ম' গ্রহণকে বৈপ্লবিক বলেছেন, তার একটা উত্তর অবশ্য রজতকান্ত রায়ের মত থেকেই পাওয়া যায়। তার মতে ঐ ঘটনা সমাজ বিপ্লবের সূচনা ঘটিয়েছিল। যদিও রথীন্দ্রমোহন চৌধুরী সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন যে কীভাবে ব্রাহ্মণ প্রধান ধর্মরাজ্য সমাজ বিপ্লব নিয়ে আসার পক্ষে সহায়ক হয়ে উঠতে পারে! (বাঁকুড়া জনের ইতিহাস সংস্কৃতি, পৃষ্ঠা- ৬৯) শুধু বৈপ্লবিক ঘটনা নয়, বিনয় ঘোষ একে যুগান্তকারী ঘটনা বলেও উল্লেখ করেছেন। কারণ রাজা বীর হাম্বীর 'ক্ষাত্র ধর্ম' ত্যাগ করে যেভাবে 'বৈষ্ণব ধর্ম' গ্রহণ করেছিলেন সেটা কোনও এক ক্ষুদ্র ঘটনা ছিল না। 'ও মেলি'-র মতে রাজা বীর হাম্বীরের সময়কাল ছিল ১৫৯১ থেকে ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।( বাঁকুড়া জনের ইতিহাস সংস্কৃতি, পৃষ্ঠা- ৬৫) আবার 'মল্লভূম বিষ্ণুপুর' গ্রন্থে বলা আছে ১৫৬৫ থেকে ১৬২০ খ্রিস্টাব্দ। (মল্লভূম/ মনোরঞ্জন চন্দ্র,পৃষ্ঠা- ১৩৫) যদিও এটা সঠিক নয়, কারণ রাজা বীর হাম্বীর ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে মারা গিয়েছেন বলে 'তরুণদেব ভট্টাচার্য'ও উল্লেখ করেছেন। (সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, তৃতীয় সংখ্যা, পৃষ্ঠা ৩২)
🍂
রাজা 'বীর হাম্বীর' কীভাবে 'ডাকাত রাজা' থেকে 'চৈতন্য দাসে' রূপান্তরিত হয়েছিলেন তারও একটি ইতিহাস আছে। রাজা বীর হাম্বীরের রাজসভায় এক জ্যোতির্বিদ ছিলেন। নাম দেবনাথ বাচস্পতি। তিনি গণনা করে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন কিছুদিনের মধ্যে বিষ্ণুপুরের উত্তর পশ্চিম সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে ধন সম্পদ পারাপার হবে। রাজা সেগুলো লুন্ঠনের অভিপ্রায়ে সেরকমই নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন। রাজার নির্দেশ মতো সেই পথ দিয়ে আসা গোরুর গাড়ি বোঝাই করা বাক্স ও পেকেটগুলো তাই লুণ্ঠন করা হয়েছিল। লুন্ঠিত বাক্সগুলোতে থরে থরে সাজানো ছিল হাতে লেখা 'বৈষ্ণব পুঁথি' সম্ভার। লুন্ঠিত বাক্স খোলার পর রাজা রাশি রাশি পুঁথি দেখে নাকি প্রচন্ড অনুতপ্ত হয়েছিলেন। এমনকি 'ভক্তিরত্নাকর' গ্রন্থে বলা হয়েছে রাজা বীর হাম্বীর নাকি সেগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছিলেন--- "অহে ভাই মো পাপির মনে এই হয়/মোরে অনুগ্রহ তেঁহ করিব নিশ্চয়।।/এত কহি দূত পাঠাইয়া অন্বেষণে/গাড়িসহ গ্রন্থ রত্ন রাখিল যতনে।" গ্রন্থ চুরির এই ঘটনা 'প্রেমবিলাস' 'ভক্তিরত্নাকর' এবং 'কর্ণানন্দ' গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে। বিশিষ্ট লেখক রজতকান্ত রায় এই লুন্ঠনের সময়কালকে ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দ বলে মনে করেন। (বাঁকুড়া জনের ইতিহাস সংস্কৃতি/রথীন্দ্র মোহন চৌধুরী, পৃষ্ঠা- ৬৯)
সুদূর বৃন্দাবন থেকে শ্রীজীব গোস্বামীর নির্দেশে শ্রীনিবাস আচার্য, নরোত্তম ও শ্যামানন্দ গৌড়ে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের জন্য ১২১টি পুঁথির গ্রন্থ সম্ভার নিয়ে গৌড়ে তাদের গন্তব্যে যাচ্ছিলেন। এগুলোই রাজা বীর হাম্বীরের সৈন দ্বারা লুণ্ঠিত হয়েছিল। শ্রীফকির নারায়ণ কর্মকার বলেছেন, সেই পুঁথিগুলো 'মনিমঞ্জুষা' নামক বৈষ্ণব গ্রন্থ ছিল। তাদের মধ্যে ছিল 'হরিভক্তি বিলাস', 'হরিভক্তি রসামৃত সিন্ধু', 'চৈতন্য চরিতামৃত', 'উজ্জ্বল নীলমণি', 'ললিত মাধব', 'বিদগ্ধ মাধব', 'দানকেলি কৌমুদী' প্রভৃতি।( বিষ্ণুপুরের অমর কাহিনী/ শ্রীফকির নারায়ণ কর্মকার, পৃষ্ঠা- ৩৩)
বৃন্দাবনে কৃষ্ণদাস কবিরাজের সদ্য সমাপ্ত 'চৈতন্যচরিতামৃত' পাণ্ডুলিপিও ছিল লুন্ঠিত ঐ বাক্সগুলোর মধ্যে। লুণ্ঠনের সংবাদ পেয়ে তিনি নাকি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। এমনকি এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু ঘটেছিল। (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, প্রথম খন্ড/ বিনয় ঘোষ, পৃষ্ঠা- ৩৩৮) যদিও পুঁথি চুরির খবর পেয়ে কৃষ্ণদাস কবিরাজ যে রাধা কুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে মারা গিয়েছিলেন বলে কথিত আছে, এমন কথার কোন ঐতিহাসিক সত্যতা নেই বলেই মনে করেন তরুণদেব ভট্টাচার্য। (সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, তৃতীয় সংখ্যা)
যাই হোক, রাজা বীর হাম্বীরের 'বৈষ্ণব ধর্ম' গ্রহণে এই পুঁথিগুলোর ভূমিকা যতটা না ছিল, তার চেয়েও এর পিছনে আসল কারিগর ছিলেন বৈষ্ণব সাধক 'শ্রীনিবাস আচার্য'। লুণ্ঠিত পুঁথিগুলির অনুসন্ধানে তিনি 'দেউলী' গ্রামের 'কৃষ্ণবল্লভ চক্রবর্তীকে' সঙ্গে নিয়ে যখন রাজসভায় পৌঁছেছিলেন, তখন সভাপন্ডিত শ্রীব্যাস চক্রবর্তী রাজাকে 'ভ্রমরগীতা'-র 'রাসপাঞ্চাধ্যায়ী' অংশ পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন এবং তার কিছুটা ভুল ব্যাখ্যা করছিলেন। সভাপন্ডিতের ভুল ব্যাখ্যা শুনে শ্রীনিবাস আচার্য আর নিশ্চুপ থাকতে না পেরে এর প্রতিবাদ করেছিলেন। এবং রাজা ও সভাপন্ডিতকে সঠিক ব্যাখ্যাটা অপূর্ব দক্ষতা ও জ্ঞানের সঙ্গে শুনিয়েছিলেন। শ্রীনিবাস আচার্যের মুখে সঠিক ব্যাখ্যা শুনে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়ে সভাপন্ডিত সর্বপ্রথম শ্রীনিবাস আচার্যের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং 'ব্যাসাচার্য' নামে পরিচিত হয়েছিলেন। তারপর শিষ্যত্ব বা দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন সেখানকার সুধী সমাজ। যেমন- শ্রীরাম মজুমদার, গোপাল মজুমদার, বল্লভী কবিরাজ, বল্লভ ঠাকুর, করুনাকর দাস প্রমুখ। সবশেষে আষাঢ় মাসের তিন তারিখে শ্রীনিবাস আচার্যের উপর প্রচন্ড প্রভাবিত হয়ে রাজা বীরহাম্বীর সপরিবারে তার কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন।( তরুনদেব ভট্টাচার্য, সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, ৩য় সংখ্যা) শ্রীনিবাসের কাছ থেকে রাজা বীর হাম্বীর ১৬০০খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে এই দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।(বাঁকুড়া জনের ইতিহাস সংস্কৃতি/ রথীন্দ্র মোহন চৌধুরী, পৃষ্ঠা- ৬৮) দীক্ষা নেওয়ার পর তার নতুন নামকরণ হয়েছিল। 'প্রেমবিলাস' অনুসারে নাম হয়েছিল 'হরিচরণ দাস', 'ভক্তিরত্নাকর' অনুসারে নাম হয়েছিল 'শ্রী চৈতন্য দাস' এবং 'কর্ণানন্দ' অনুসারে 'শ্রী গোবিন্দ দাস'।(তরুনদেব ভট্টাচার্য, সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, ৩য় বর্ষ) এদিকে রথীন্দ্রমোহন চৌধুরীর মতে রাজা 'বীর হাম্বীর', চৈতন্য দাস' উপাধি বৃন্দাবনে তীর্থ করতে গিয়ে শ্রীজীব গোস্বামীর কাছ থেকে লাভ করেছিলেন। (বাঁকুড়া জনের ইতিহাস সংস্কৃতি, পৃষ্ঠা- ৬৯) যাই হোক শ্রীনিবাস আচার্য রাজা বীর হাম্বীরকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, "কৃষ্ণ পদে মতি হোক।"
কিন্তু কে এই শ্রীনিবাস আচার্য? মনোরঞ্জন চন্দ্র উল্লেখ করেছেন শ্রীনিবাসের আদি বাসস্থান ছিল নবদ্বীপের চাকন্দী গ্রামে।( মল্লভূম বিষ্ণুপুর, পৃষ্ঠা- ১৪৪) শ্রী ফকির নারায়ণ কর্মকারের রচিত 'বিষ্ণুপুরের অমর কাহিনী' গ্রন্থে শ্রীনিবাসের যেটুকু পরিচয় পাই তা হল, শ্রীনিবাসের পিতার নাম গঙ্গাধর ভট্টাচার্য। পিতাই তাকে নবদ্বীপের লীলাক্ষেত্রগুলির সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন। এমনকি চৈতন্য মাতা শচীদেবীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎলাভও ঘটেছিল। (পৃষ্ঠা- ৩৭) চৈতন্যের পার্শ্বচর গদাধরের কাছে ভাগবত পাঠ করবেন বলে দেখা করেছিলেন। পরিশেষে চৈতন্য পত্নী জাহ্নবী দেবীর উপদেশ লাভ করেছিলেন। (পৃষ্ঠা- ৩৭-৩৮) জাহ্নবী দেবীই তাকে বৃন্দাবনে রূপ ও সনাতন গোস্বামীর কাছে গিয়ে 'ভক্তিশাস্ত্র' পাঠ করার উপদেশ দিয়েছিলেন। শ্রীনিবাসের সেই বৃন্দাবন যাত্রা বিশেষত 'কাশি' সহ অন্যান্য লীলাক্ষেত্রগুলো পরিদর্শন করে তিনি আরো বেশি করে চৈতন্যপ্রেমী হয়ে উঠেছিলেন। যদিও বৃন্দাবনে পৌঁছানোর পূর্বেই রূপ ও সনাতন গোস্বামীর দেহাবসান ঘটেছিল। তাই শ্রীজীব গোস্বামী তার শিক্ষা দীক্ষার ভার গ্রহণ করেছিলেন।
রাজা বীরহাম্বীর, গুরু শ্রীনিবাসকে বিষ্ণুপুরে স্থায়ীভাবে রাখার জন্য বহু অর্থ ও উর্বর ভূমি দান করেছিলেন। এবং বনবিষ্ণুপুরের কাছেই গোপালপুর গ্রামের রাঘব চক্রবর্তীর কন্যা পদ্মাবতীর সঙ্গে শ্রীনিবাসের বিয়েও দেন। এটি ছিল শ্রীনিবাসের দ্বিতীয় বিবাহ। তখন তার বয়স ষাটোর্ধ। প্রথম পত্নী ছিলেন যাজিগ্রামের (শ্রীনিবাসের মাতুলালয়) গোপাল দাস চক্রবর্তীর কন্যা দ্রৌপদী। বিবাহ পরবর্তী নাম 'ঈশ্বরী'। তিনি সেখানেই থাকতেন। দ্বিতীয় বিবাহের কথা শুনে গুরু গোপাল ভক্ত এই ঘটনাকে 'স্খলৎপাদ' বলে মন্ত্যব্যও করেছিলেন। (বাঁকুড়া জনের ইতিহাস সংস্কৃতি/ রথীন্দ্রমোহন চৌধুরী, পৃষ্ঠা- ৬৮)
শেষ অংশ পরবর্তী পর্বে...
তথ্যসূত্র: ১) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, প্রথম পর্ব/ বিনয় ঘোষ
২) বিষ্ণুপুরের অমর কাহিনী/ শ্রী ফকির নারায়ণ কর্মকার
৩) বাঁকুড়া জনের ইতিহাস সংস্কৃতি/ রথীন্দ্রমোহন চৌধুরী
৪) মল্লভূম বিষ্ণুপুর/ মনোরঞ্জন চন্দ্র
৫) ভক্তিরত্নাকর/ নরহরি চক্রবর্তী
৬) সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, ৩য় সংখ্যা
0 Comments