জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —২০/সুমিত্রা ঘোষ

লোকমাতা রানি রাসমণি —২০
সুমিত্রা  ঘোষ

নানা ব্যাপারে দেশে অশান্তি মাথা চাড়া দিত। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের আগে থেকে বিদ্রোহের দামামা বাজাতে থাকে। বাংলায় বসবাসকারী বাঙালিদের কী পরিণতি হতে পারে তাই নিয়ে আলোচনা শুরু হল। দেশের রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন হতে চলেছে। জমিদারদের চিন্তাভাবনা একটু বেশী কারণ বিষয় সম্পত্তি বলতে স্থাবর-অস্থাবর উভয় প্রকার নিয়েই চিন্তা করতে হয়। রানি রাসমণি জমিদারনী। সারাবাংলায় তাঁর তালুক আছে। তাছাড়া টাকা-পয়সা হীরা-জহরত কোম্পানীর কাগজ ইত্যাদি তো আছে। সিপাহি বিদ্রোহের সময় রানির পরামর্শদাতারা বললেন, দেশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কিছু বলা যায় না। সিপাহি বিদ্রোহের পর ইংরেজ সরকার বেশিদিন থাকবে না, তখন কোম্পানীর কাগজের মূল্য থাকবে না, এই বেলা কোম্পানীর কাগজ বেচে দিন। রানি পরামর্শদাতার কথায় কান দেননি। তাঁর দূরদর্শিতারও প্রশংসা করতে হয়, তিনি হয়তো অনুমান করেছিলেন সিপাহি বিদ্রোহ হলেও ইংরেজ চট করে এই  দেশ ছেড়ে যাবে না।
সেই সময় গোৱা সৈনিকদের মধ্যে অনেকে অত্যাচারী ছিল। ভারতীয় নাগরিকদের উপর তারা অযথা অত্যাচার করে আনন্দ লাভ করত। গোরা সৈনিকরা রাজচন্দ্র দাসের বর্তমান অবস্থায়ও বেশ কয়েকবার জানবাজারের বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর করে লুঠপাঠ করেছে। লেঠেলরা পরিস্থিতি সামাল দিত।
🍂

 জানবাজারের জমিদারবাড়িতে লাঠিয়ালরা বড় রকমের ভরসাস্থল ছিল। বিপদের সঙ্কেত পেলেই লাঠি ও মশাল নিয়ে রাত্রে বেড়িয়ে যেতেও কুণ্ঠিত হয়নি।
সিপাহী বিদ্রোহের সময় রানির বিষয়জ্ঞানের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা আজকের দিনে ভাবলে অবাক হতে হয়। সিপাহী বিদ্রোহের সময় এবং তার পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনীতিতে  কী ঘটতে পারে, বাঙালির ভবিষ্যৎ কী হতে পারে- এই সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা হয়েছিল। তিনি বুঝেছিলেন সিপাহী বিদ্রোহের পর ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছেড়ে যাবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই ।
তিনি ছিলেন দূরদর্শী মনোভাবাপন্ন অশেষ গুণবতী। তাই সিপাহী বিদ্রোহের সময় লোকের পরামর্শ মতো কোম্পানীর কাগজ বিক্রি করেননি বা ইংরেজ সরকারের সঙ্গে অহেতুক বৈরি মনোভাবও পোষণ করেন নি।
রানির আমলে স্কুল স্ট্রিটে গোরা সৈনিকদের একটা ঘাঁটি ছিল, সৈনিকরা পথচারী ও প্রতিবেশীদের ওপর অহেতুক অত্যাচার করতো। রানির কানে খবর পৌঁছাল এবং রানি দারোয়ানদের ব্যবস্থা নিতে আদেশ করলেন। জানবাজারের বাড়ির দারোয়ানরা অত্যাচারী গোরাদের কয়েকজনকে ধরে বেশ কয়েক ঘা পিটিয়ে দিল। গোরা সৈন্যরাও থেমে থাকেনি। তারা বিরাট বাহিনী নিয়ে জানবাজারে বাড়িতে ঢুকে অত্যাচার চালাতে লাগল। এমন অত্যাচার গোরা সৈন্য রাজচন্দ্র দাসের আমলেও করেছে। লাঠিয়ালরা বহু কষ্টে সামাল দিত। এবারও গোরাসৈন্যরা জানবাজারের বাড়িতে প্রবেশ করে ঘরে জিনিসপত্র ভাঙচুর, লুটপাঠ, গৃহপালিত পশুপাখিদের নির্বিচারে হত্যা করতে লাগল। অত্যাচারের পরিস্থিতি দেখে রানি আর স্থির থাকতে পারেননি আবার বিন্দুমাত্র ভীতও হননি। রানি বাড়ির আত্মীয় পরিজন, দাস-দাসী-ঠাকুর-কর্মচারি সকলকে আদেশ করলেন, তোমরা যে যেখানে পার পালিয়ে যাও। এরপর রানি হাতে একখানি অস্ত্র তুলে নিয়ে ঠাকুর ঘরে রঘুনাথ জীউর সামনে এসে দাঁড়ালেন, ইংরেজ পল্টনের অফিসারদের তাণ্ডবলীলা চালানো বন্ধ করালেন। যে সমস্ত সৈনিকরা এত সময়  ধরে ভাঙচুর-লণ্ডভণ্ড করছিল তারা শান্ত হল। সেই সময় একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটল। যে সমস্ত গোরা সৈন্য অত্যাচার চালাচ্ছিল জানবাজারের বাড়ির অন্দর মহলে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছত্রভঙ্গ হয়ে রানির বাড়ির পাহারায় বসল, রানির কী অসীম ক্ষমতা!
রানি রাসমনি নামে জমিদারনী, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন প্রজাদরদী, তাদের মা। তিনি প্রজাদের সুখ-সুবিধার দিকে সর্বদা নজর রাখতেন। রানি কোনদিন জাতপাতের ভেদাভেদ করেননি। ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সমস্ত শ্রেণির প্রজাই রানির কাছে সন্তানতুল্য ছিল।

 সংগ্রহ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ -৯৭৩২৫৩৪৪৮৪

Post a Comment

0 Comments