শখ
স্বপন কুমার দে
এই পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন বছর বয়সে বিকাশবাবুর বাতিক দেখে বাড়িময় শোরগোল পড়ে গেল। কে তাঁকে এই বদ্ বুদ্ধি দিল,জানতে পারলে না হয় দেখা যেত। কিন্তু সেটাও তো জানা গেল না।দীর্ঘদিন এস,ডি,ও অফিসের লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক হয়েই কাটিয়ে দিলেন।সারাটা জীবন অফিস আর বাড়ি ছাড়া কিছুই
জানেন না।কী করে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত গড়া যায়,কীভাবে পয়সা বাঁচিয়ে ভবিষ্যতের জন্য কিছু রাখা যায় সেই চিন্তাতেই ব্যস্ত ছিলেন।এই তো কিছুদিন আগেই দু'কাঠা জমি কিনে রাখলেন ছেলের নামে।তাছাড়া মাসে মাসে টাকা জমিয়ে ছ'মাস ন'মাস ছাড়া গয়না কেনা তো আছেই।
সেই বিকাশবাবু কি না এই প্রায়বৃদ্ধ বয়সে গিটারের প্রেমে পড়লেন। নতুন করে তিনি গিটার শিখবেন এবং সেজন্য একটা গিটার কেনার কথা ভাবছেন।
কথাটা প্রথম শুনেই গিন্নি কেমন যেন অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন।স্বামীর মনের সুস্থতা নিয়ে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগল।তারপর হঠাৎ ব্যঙ্গের হাসি হেসে ছেলেমেয়েদের ডাকলেন ,'ওরে বুলান!ওরে মিষ্টু!আয় শুনে যা।তোর বাবা এই বুড়ো বয়সে বলে কী!
ছেলেমেয়েদের উৎসুক চোখের সামনে আর গিন্নির ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যঙ্গে বিকাশবাবু ধরা পড়ে যাওয়া ছিঁচকে চোরের মতো অসহায় চোখে চেয়ে রইলেন।
''তোদের বাপ,যার কিনা গনায় তুলসীমালা ঝুলিয়ে নামগাল করার কথা--সে আবার গিটার শিখতে চায়!''
স্বামীকে বলেন, ''বলি,মাথাটা গেছে না কি?নতুন কোনো রোজগারের মুরোদ নেই ,শুধু খরচ আর খরচ। বলি,তোমার মতলবটা কী?''
"না মানে,আমি ছোট বয়সে ভালোই বাজাতে পারতাম। সেই কবে ছেড়ে দিয়েছি--কিন্তু মনের কষ্টটা রয়ে গেছে।তাই ভাবলাম-----"
"ওই সব পাগলামো ভাবনাগুলো ছাড়ো।তাছাড়া অফিস থেকে আসার পর তোমার অনেক কাজ থাকে।সেগুলোর কী হবে?নাও এখন আমাকে একটু সাহায্য করো দেখি।সারাদিন খেটে খেটে আমার গায়ে গতরে ব্যথা হয়ে গেছে।কাজে হাত লাগিয়ে একটু উবগার করো দেখি।"
নিতান্ত নিরাশ হয়ে বিকাশবাবু গৃহকর্মে যোগ দেন। একে একে সংসারের কথা উঠে আসে।মেয়েটা দিন দিন বড় হয়ে উঠছে।তার বিয়ের জন্য টাকা জমাতে হবে।ছেলেটা কবেই অনার্স পাশ করে বাউন্ডুলে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।তার একটা চাকরির ব্যবস্থা দেখতে হবে। অফিসের বড়বাবুকে বলে যদি একটা ক্যাজুয়েল পোষ্টে চাকরি পাওয়া যায়,তার জন্য উমেদারি করতে হবে।সেসব না ভেবে এমন আজগুবি শখ করে কেউ কখনও? তাও আবার এই বয়সে?
এইসব কথা শুনতে শুনতে বিকাশবাবুর মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছিল। ভেতরে ভেতরে ক্রমশ পুড়ছিলেন। আক্ষেপের শেষ ছিল না।
কম বয়সে গরিব বাবা-মা'র ছেলেমেয়েদের শখ থাকতে নেই।
মাঝ বয়সে সংসারের দায়িত্ব সামলাতে সামলাতে তার শখ থাকতে নেই।
বেশি বয়সে শখ মানায় না বলে শখ করতে নেই।
তাহলে------?
এই প্রশ্নের উত্তরটা খুঁজতে গিয়ে তাঁর মাথায় একটা জেদ চেপে গেল।
অল্প বয়সে গান বাজনার প্রচণ্ড ইচ্ছা ছিল বিকাশবাবুর। খালি গলায় ভারি সুন্দর গান গাইতেন। ইচ্ছা ছিল, কারো কাছে তালিম নিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ করবেন। কিন্তু দারিদ্র্য জর্জরিত পরিবারে সে কথা সে কোনদিনও বলতেই পারেন নি।অনেক কষ্টে বাবা তাঁকে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করিয়েছেন। কেবল এক বন্ধুর বাড়িতে কয়েকদিন গিটার বাজিয়েছিলেন। তাদের বাড়ির লোকজন খুব নাম করেছিলেন তাঁর।
তারপর একদিন বাবা চলে গেলেন। সংসারের পুরো চাপ এসে পড়ল তাঁর উপর। ভাগ্যিস কোনও ক্রমে কেরানীর চাকরিটা পেয়েছিলেন, তাই সব দিক রক্ষা করতে পারলেন। বোনের বিয়ে দিলেন, ছোটভাইটাকে লেখাপড়া শেখালেন।তার চাকরিও হল। তারপর নিজের বিয়ে-সংসার-ছেলেমেয়ে।সবকিছু সামলাতে সামলাতে কবে যে তার গায়ের রংটা সাদা থেকে তামাটে হয়ে খয়েরি হয়ে গেল, তিনি টেরও পেলেন না।প্রথম প্রথম অফিস থেকে ফেরার পথে কয়েকটা বাড়িতে টিউশনও পড়িয়েছেন।তারপর আর শরীর আর টানেনি। এখন শুধুই অফিস।
এক ছুটির দিনে বাড়িতে ছেলেমেয়েরা নেই দেখে তিনি আবার একবার কথাটা পাড়লেন,
" বলছি,আমার ওই গিটার কেনার ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখলে হয় না?"
"বলি তোমার কি মতিচ্ছন্ন হয়েছে?হাড়হাভাতে মিনসে!আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ না করলে তোমার চলছে না?"
বিকাশবাবু আমতা আমতা করে বললেন, "খুব বেশি টাকা লাগবে না।একটু চেষ্টা করলেই----"
ততোধিক হুঙ্কার দিয়ে গিন্নি বললেন, বেরিয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে।আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না।আমিও ঘর থেকে পালিয়ে যাবো।"
তারপর একটু দম নিয়ে আবার শুরু,"বাড়তি রোজগারের চেষ্টা নেই। শুধু খরচ আর খরচ। শনি,শনি।এমন অলক্ষ্মী আর দু'টি নেই। বাপের জন্মে এমন শখের কথা শুনি নি।"
ঝগড়া আরও বাড়ত। বিকাশবাবু বিরস বদনে স্নান করতে চলে গেলেন।
ছেলেমেয়েরা বাড়িতে এসে দেখল,বাবা-মা দু'জনেই চুপচাপ। যে যার কাজে ব্যস্ত। তাদের বুঝতে অসুবিধা হল না যে একটা ঝড় বয়ে গেছে।এ নিয়ে আর কোনো কথা হয় নি।
পরের দিন অফিস থেকে ফিরতে বিকাশবাবুর রাত হয়ে গেল। প্রায় সাড়ে আটটা।মেয়ে জিজ্ঞেস করলো ,"বাবা,আজ তোমার এত দেরি কেন?মা চিন্তা করছিল।" বাবা বললেন, "এবার থেকে আমার একটু দেরিই হবে মা। অফিসের নতুন বড়সাহেব খুব কড়া।প্রতিদিনের কাজ যতটা সম্ভব সেই দিনেই শেষ করতে বলেছেন। তাই ফিরতে একটু দেরি হবে।তোরা আবার এ নিয়ে চিন্তা করিস না।"
"ঠিক আছে,হাত পা ধুয়ে এবার চারটি টিফিন করো তো।"
"সে কী রে মা? এরপর তো রাতের খাবার সময় হয়ে গেল। এখন টিফিন খেলে কি চলবে?তোর মায়ের রান্না কি হয়ে গেছে?
গিন্নি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বললেন,"ওই সব কিছুই নয়।সংসারের কাজ যাতে না করতে হয় তাই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে দেরিতে বাড়ি ফেরা।আমি ওসব চালাকি বুঝি না? তরকারিটা বসিয়েছি, - হলেই খেয়ে নেবে।সংসারের ভাবনা ভেবে কাজ কী?বিছানায় পড়লেই তো নাক ডাকিয়ে ঘুম। জীবনটা আমার শেষ করে দিল। "
পুরানো বাড়ির রং চটে গিয়ে পলেস্তারা খসে গেলে যেমন দেখায়,বিকাশবাবু দেখলেন তাঁর জীবনটাও অনেকটা সেইরকম। বাড়িটার প্রয়োজন আছে ,সবাই বোঝে কিন্ত তাকে সংস্কারের চেষ্টা কেউ করে না।সম্পর্কের বাঁধনটা আলগা হতে হতে আজ কোথায় দাঁড়িয়েছে!দায়িত্ব -কর্তব্যের খুঁটিটা যদি না থকত তাহলে কবেই সব ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। নেহাৎ প্রাত্যহিক অভ্যাসের মতো সংসারের রথের চাকাটা এগিয়ে চলেছে।
তারপর চার পাঁচ মাস কেটে গেল পুজো আসছে।ছেলেমেয়েরা যে যার মতো জামাকাপড়ের খরচ হাতে পেয়ে গেল। গিন্নিও পুজোর স্পেশাল অফারে গয়না কেনার টাকা পেলেন। সবাই মোটামুটি এই ভেবে শান্তি পেলো যে মায়ের বকুনির জন্যই বদ্ খেয়ালের ভূত মাথা থেকে নেমেছে।
মানুষের জীবনে কখন কী বদল ঘটে ,তা বাইরে থেকে কেউ অনুমানও করতে পারে না।একটা গড়পড়তা হিসাব করে নেয়।এই লোকটা কেমন আর,--এতদিন যেমন দেখে এসেছে,তাই হবে।আজীবন কর্তব্যের দাস হয়ে থাকতে থাকতেই কখন যে জীবনটা শেষ হয়ে যায়,সে নিজেও বুঝতে পারে না।আসলে আমরা তো বেশিরভাগই বৃত্তের বাইরে বেরোতে পারি না।তাই হয়তো বিকাশবাবুর এই পরিবর্তনটাকে 'বদ্ খেয়াল 'বা 'ভীমরতি' বলে আখ্যা দেয়। দৃষ্টি বদলাতে কেউ চায় না।
সেদিন মহাপঞ্চমী।প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে মা দুর্গার আগমন ঘটে গেছে।কোথাও কোথাও উদ্বোধনও হয়ে গেছে।কাল থেকেই অফিস ছুটি পড়ছে।পুজোর শেষ দু'দিন মাসির বাড়ি যাওয়া ঠিক আছে।মেয়েটা বলল,"রাত ন'টা বেজে গেল, বাবা এখনও এল না কেন?" তার মুখের কথা শেষ হল না,বাড়ির কলিং বেলটা বেজে উঠল।দরজা খুলতেই মেয়ে দেখল,পাড়ার সীতেশ কাকু।তিনি রীতিমত নার্ভাস গলায় বললেন, "তোর বাবা জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় পড়ে গেছেন। আমরা তাঁকে ধরে ক্লাবঘরে শুইয়ে দিয়েছি। তোরা শিগগির আয়।হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।" মা,ছেলে,মেয়ে -তিনজনেই ছুটতে ছুটতে গিয়ে দেখলেন,অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন বিকাশবাবু। ক্লাবের ছেলেরাই অ্যাম্বুল্যান্স ডেকেছে।বিকাশবাবুকে তাড়াতাড়ি তোলা হল। ছেলেমেয়েরা গাড়িতে চাপল, ক্লাবের কয়েকটা ছেলেও সঙ্গে গেল।
🍂
ক্লাবের সেক্রেটারি বুবকা,বিকাশবাবুর স্ত্রীর হাতে একটা নতুন গিটার তুলে দিয়ে বলল,"কাকিমা, এটা কাকুর হাতে ছিল। আপনি এটা বাড়িতে নিয়ে যান ।বোধহয়,ছেলের জন্য কিনেছিলেন। আর আপনি চিন্তা করবেন না।আমরা তো আছি।কাকু ভালো হয়ে যাবেন।"
ঘরের এক কোণে গিটারটা রেখে বিকাশবাবুর স্ত্রী খাটের উপর ধপ্ করে বসে পড়লেন। জীবনের কত কথাই মনে পড়ল তাঁর। মনে পড়ল বিয়েবেলার কথা।যাতে কোনও অসুবিধা না হয় সে জন্য বিকাশের চিন্তার শেষ ছিল না।তাঁর যাতে বেশি খাটুনি না হয় সে জন্য প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরেই রান্নার কাজে হাত লাগান,ইত্যাদি ইত্যাদি ।তারপর যখন ছেলে মেয়ে হল তখন ঐ স্বল্প আয় থেকেও আয়া ঠিক করেছিলেন। এখন মনে হল, মানুষটা সারাজীবন নিজের জন্য কিছুই করেন নি।আমিই বরং তাঁকে,-----
ঘণ্টা দুয়েক পরেই ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে তাদের কাকিমা হাসপাতালে গেলেন। বিকাশবাবুর দেহটা তখন সাদা চাদরে ঢাকা।সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছিল। তাঁকে আর বাঁচানো যায়নি।
দু'-তিন দিন পর অফিসের দু'জন সহকর্মী বিকাশবাবুর বাড়ি এলেন,সান্ত্বনা দিতে।একথা সেকথার পর তাঁরা বললেন,"এমন কাজপাগল মানুষ আমরা দুটো দেখিনি বৌদি।সব সময় ফাইলে মুখ গুঁজে বসে থাকতেন। আমরা বরং বলতাম "বিকাশদা,এই বয়সে আর এতটা চাপ নেবেন না।উনি শুনতেন না।" বৌদি ভাঙা গলায় বলতে গেলেন, "হ্যা,তাছাড়া নতুন বড়সাহেব আবার কাজের চাপ বাড়িয়ে দিলেন। বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যেত। " একজন সহকর্মী অবাক হয়ে বললেন, "নতুন বড়সাহেব!কী যে বলেন বৌদি? কেন আমরা সবাই পাঁচটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়তাম।" আরেকজন তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন, আপনাকে বলা হয়নি বৌদি।মাফ করবেন। বিকাশদাই কথাটা গোপন রাখতে বলেছিলেন। আজ বলছি।গত চার মাস ধরে রোজ অফিস থেকে বেরিয়ে বিকাশদা লোকের বাড়িতে টিউশন পড়াতে যেতেন। তার গিটার কেনার জন্য তো বাড়তি টাকার দরকার ছিল। "
বৌদির মুখ থেকে আর কোনো কথা বেরোল না।শুধু গিটারটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। তাঁর দুটো চোখ তখন ছল্ ছল্ করছিল।
0 Comments