শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
প্রীতম সেনগুপ্ত
কৃস্টিন ছিলেন অত্যন্ত পবিত্র ও শুদ্ধ স্বভাবাপন্না। আর স্বামীজী এটাই চাইতেন বেশি করে। যে কর্মযজ্ঞের ভাবনা তাঁর মধ্যে ছিল তাতে সামিল হওয়ার প্রাথমিক শর্ত ছিল পবিত্র ও শুদ্ধ হৃদয়ের হওয়া। এই বিষয়ে শ্রীমতী ফাঙ্কি স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন এইরকম -- “তাঁর এক শিষ্যার ( কৃস্টিন) প্রতি স্বামীজীর প্রত্যাশা ছিল অপরিসীম। তিনি তাঁর মধ্যে বৈরাগ্য ও আত্ম- নিবেদনের বিশাল সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আমাকে একদিন একান্তে পেয়ে তাঁর জীবন ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্বন্ধে নানারকম প্রশ্ন করেছিলেন। আমি সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিলাম। তখন তিনি আশান্বিতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সে খুব শুদ্ধ, তাঁর অন্তঃকরণও খুব পবিত্র। নয় কি?’ আমি সহজভাবে উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ স্বামীজী, সে খুব পবিত্র-হৃদয়।’ তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং চক্ষুদুটি দিব্যপ্রভায় জ্যোতিষ্মান হয়ে উঠল। তিনি উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘আমি জানি, আমি এটা অনুভব করি -- আমি ওকে কলকাতায় আমার কাজের জন্য চাই।’ তারপর তিনি ভারতীয় নারীদের সম্পর্কে তাঁর পরিকল্পনা ও সম্ভাবনার কথা বললেন। ‘শিক্ষাই তাদের সর্বাগ্রে প্রয়োজন তিনি বলতেন, ভারতবর্ষে অবশ্যই আমাদের একটা বিদ্যালয় থাকবে’।” ( দেববাণী, ইং, পৃঃ ২৩ )
ভারতে এসেছিলেন কৃস্টিন। তাঁর সামনে আদর্শের রূপরেখাটি সম্যকভাবে তুলে ধরেছিলেন স্বামীজী। হিমালয়ে একটি আশ্রম গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথাও বলেছিলেন কৃস্টিনকে। বলছেন --“ আমি খুব তাড়াতাড়ি পাশ্চাত্যদেশীয় বন্ধুদের জন্য একটা কেন্দ্র হিমালয়ের আলমোড়ার নিকটবর্তী কোন অঞ্চলে শুরু করতে চাই। আমি কাজ করে করে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি -- এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যা হোক করে চলে যাচ্ছে। এখন চাই সম্পূর্ণ বিশ্রাম এবং গভীর প্রশান্তি। আমি শিগগির পাব তো?” ( স্বামীজীর কৃস্টিন, উদ্বোধন কার্যালয়)
🍂
১৯০২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভারত অভিমুখে পাড়ি দেন কৃস্টিন। মার্চ মাসের প্রথমে কৃস্টিনের চিঠি থেকে সেকথা জানতে পারেন স্বামীজী। এই সময় বারাণসীতে অবস্থানরত স্বামীজী খুবই অসুস্থ ছিলেন। তাঁর ভয় ছিল ‘কন্যা’ কৃস্টিনকে স্বাগত জানাতে স্থূল দেহে হয়তো আর থাকবেন না। তাই ৪ মার্চ একটি পত্রে নিবেদিতাকে লিখছেন -- “যদি আমি মরে যা যাই আমাকে লেখা তার চিঠিগুলো পড়ো। মেয়েটিকে স্বাগত অভ্যর্থনা জানিও এবং আবার বাড়ি পাঠিয়ে দিও। যদি ফিরে যাবার মতো টাকাকড়ি তার না থাকে তাহলে তাকে পথ খরচা দিয়ে দিও। যদি তোমাকে ভিক্ষে করে দিতে হয়, তাও দেবে।... আর আমি যদি স্থূল দেহে থাকি তাহলে, সে কখন পৌঁছবে, সে খবর আমি তোমায় জানিয়ে দেব।” ( প্রবুদ্ধ ভারত, নভেম্বর, ১৯৭৭, ভগিনী কৃস্টিন)
যাই হোক শেষ পর্যন্ত ১৯০২ সালের ৭ এপ্রিল কৃস্টিন ভারতে এসে পৌঁছলেন। ভারত অর্থাৎ কলকাতায়। পরদিন সকালেই বেলুড় মঠে গিয়ে স্বামীজীর চরণপ্রান্তে উপনীত হলেন। সারাদিন কাটিয়েছিলেন স্বামীজীর সঙ্গে। এরপর আরও ছ’দিন ( ১৮, ২৩, ২৫, ২৬ এপ্রিল এবং ১ ও ৪ মে ) আসেন মঠে এবং স্বামীজীর সঙ্গে অতিবাহিত করেন সারাদিন। ( তথ্যসূত্র -- তদেব ) এই সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল। প্রচণ্ড গরমের হাত থেকে রক্ষা পেতে স্থির হয়েছিল পাশ্চাত্যদেশীয় মহিলারা হিমালয়ে মায়াবতী যাবেন। সঙ্গে স্বামীজীও যাবেন। পরে অবশ্য এই পরিকল্পনা বদল হয়। এই বিষয়ে সিস্টার নিবেদিতা কলকাতা থেকে ১৯ এপ্রিলের একটি পত্রে মিস ম্যাকলাউডকে ( স্বামীজীর পাশ্চাত্য দেশীয় অনুগামিনী, যিনি ‘বিবেকানন্দ'জ ফ্রেণ্ড’ বলে নিজের পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন ) লিখছেন -- “কৃস্টিন ও আমি মে মাসের প্রথম পর্যন্ত এখানে আছি। আমি ভেবেছিলাম স্বামীজী আমাদের সঙ্গে আসবেন কিন্তু তিনি আমাদের সঙ্গে আসছেন না, আমরা একসঙ্গে মায়াবতীতে আসতে পারি। আমার মনে হয় এটা কৃস্টিনের জীবনের লক্ষ্য -- হিমালয়ে ধ্যানরত অবস্থায় একবছর বা তারও বেশি সময় কাটানো। ( এই চিন্তা আমাদেরও করা উচিত ) -- এটাই হোক তাঁর শক্তি।” ( নিবেদিতার পত্রাবলী -- ১ম খণ্ড, পৃ: ৪৫৮-৫৯ )
স্বামীজীর কাছ থেকে কৃস্টিন শেষ পত্রটি পান ১৯০২ সালের ২১ জুন। এর কয়েকদিন পরেই স্বামীজী মহাসমাধিতে প্রবেশ করেন। কৃস্টিন তখন মায়াবতীতে রয়েছেন মাদার সেভিয়ারের কাছে। রসপ্রাচুর্যে পরিপূর্ণ পত্রটি। তিনি লিখেছেন -- “তোমার চিন্তা করার বিন্দুমাত্র কারণ নেই। আমি যেভাবেই হোক সেরে উঠছি -- এখন যথেষ্ট জোর পাচ্ছি। পথ্যের ব্যাপারে আমি দেখছি নিজেকেই কড়া হয়ে নিষেধ করতে হবে।... যদি ছেলেরা কোন জায়গায় ‘আমলকি’ ফল যোগাড় করতে পারে, তুমি তাদের জিজ্ঞাসা করবে? ফলগুলি টক-কষা-কাঁচা হতে পারে কিন্তু ফলগুলি আচার করা গেলে খুব সুস্বাদু। নিবেদিতা বেশ গুছিয়ে তার বিদ্যালয় শুরু করার পর তোমাকে বাগবাজারে নিয়ে আসার কথা ভাবছি। ততদিন চুপ করে থাক এবং ভাল করে খাওয়া দাওয়া কর। তোমাকে আমার ভালবাসা, ছেলেদের ও মা-কেও ( মাদার সেভিয়ার ) আমার ভালবাসা; --বিবেকানন্দ
“পুনশ্চ: আমি মেদবহুল কোষগুলির জন্যই বেঁচে আছি -- বিশেষ করে পেটের দিকে -- এটা দেখতে বেশ ভীতিপ্রদ। ( স্বামী বিবেকানন্দের অপ্রকাশিত পত্রাবলী, প্রবুদ্ধ ভারত, ১৯৭৭, সেপ্টেম্বর, পৃঃ: ৪৩০ )
এর কয়েকদিন পর, ৪ জুলাই তারিখে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে বেলুড় মঠে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মহাসমাধিতে প্রবেশ করলেন স্বামীজী। এই খবর কৃস্টিন পেলেন নিবেদিতার লেখা পত্রে। হিমালয়ের নৈঃশব্দ মুহূর্তে অন্তর্হিত হল, কৃস্টিনের জীবনদেবতা আর ইহজগতে নেই!
0 Comments