জ্বলদর্চি

কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা/ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৯৬
কোজাগরী লক্ষ্মী

কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা

ভাস্করব্রত পতি

"লক্ষ্মী নারায়ণ ব্রত সর্বব্রত সার, 
এ ব্রত করিলে ঘোচে ভবের আঁধার। 
বন্ধ্যা নারী পুত্র পায়, যায় সর্বদুখ, 
নির্ধনের ধন হয়, নিত্য বাড়ে সুখ"।। -- 
কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা নামক লৌকিক উৎসবটি মূলতঃ আশ্বিন মাসেই উদযাপিত হয়। দুর্গাপূজার পর বাঙালিদের কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার ধুম পড়ে। সেসময় প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে লক্ষ্মীদেবী পূজিতা হন। কো (কে) জাগরী (জেগে আছে) হল 'কোজাগরী'র অর্থ। 
কোজাগর (পুং শব্দ) -- [কঃ (কে) জাগর (জাগিতেছে)—এই পূর্ণিমায় কে জাগে]
এটি আশ্বিনী পূর্ণিমা তিথি, দ্যূতপূর্ণিমা, লক্ষ্মীপূর্ণিমা। দাশরথি রায়ের পাঁচালীতে আছে, “ঘুমে লক্ষ্মী হন বিরূপা, জাগরণে লক্ষ্মীর কৃপা, নৈলে কেন জাগে কোজাগরে"। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, "লক্ষ্মী বলেন, এই পূর্ণিমায় যে জাগে, তাহাকে ধন দিব। এই তিথিতে অক্ষক্রীড়া নারিকেল জল পান ও চিপিটক ভক্ষণ বিহিত (তিথ্যাদিতত্ত্ব)"। ধন ঐশ্বর্য ও পুত্রলাভের কামনায় মহিলারা পালন করেন। 

যাঁরা লক্ষ্মীপূজার রাতে জেগে থাকেন, দেবী তাঁদের প্রতি প্রসন্ন হন। একসময় লক্ষ্মীর পটচিত্র পূজিত হত এইসময়। পরবর্তীতে লক্ষ্মী প্রতিমার চল আসে। এখন কোথাও কোথাও লক্ষ্মী প্রতিমার পরিবর্তে কুলুঙ্গিতে লক্ষ্মীসরা রেখে পূজার আয়োজন করা হচ্ছে। সরাশিল্পীরা লক্ষ্মীসরার জন্য তথাকথিত ব্যবহৃত সরাকে বড় বড় থালার মতো করে বানানো শুরু করে। এবার এর গভীর সমতল অংশে লক্ষ্মীদেবী, বাহন প্যাঁচা, ধানের শীষ এবং অন্যান্য দেবেদেবীর ছবি আঁকা শুরু করে। একসময় বাংলাদেশের ঢাকা, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুরে লক্ষ্মীসরা তৈরির কাজ হত খুব। এখন বিলুপ্তপ্রায়। ড. ওয়াকিল আহমেদ লক্ষ্মীসরার উদ্ভব সম্পর্কে জানিয়েছেন, "কোজাগরী পূর্ণিমাকে ভিত্তি করেই বাংলাদেশের ফরিদপুর ও ঢাকা অঞ্চলের লক্ষ্মীসরার উৎপত্তি ঘটে। আগে ঘরে ঘরে লক্ষ্মীর পট বসিয়ে পূজা হতো। কালক্রমে ঢাকা ও ফরিদপুরের গ্রামীণ সংস্কৃতিতে লক্ষ্মীসরা সেই স্থান দখল করে নিয়েছিল"।

দেবীর সামনে আলপনা অঙ্কন এর মূল এবং গুরুত্বপূর্ণ উপচার। লক্ষ্মীর আলপনায় থাকে নানা ধরনের লতাপাতা। সেইসাথে পদ্ম এঁকে ঘর সাজিয়ে তোলা হয়। এই লক্ষ্মীপূজার আলপনার মূল বিষয় হল লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, লক্ষ্মীপেঁচা এবং ধানের ছড়া অঙ্কন। আসলে দেবী লক্ষ্মী হলেন ধন সম্পদ ও সৌভাগ্যের দেবী। লক্ষ্মীমাতাকে যে আবাহন গীতের মাধ্যমে ডাকা হয়, তা হল -- "এসো মা লক্ষ্মী, বসো মা লক্ষ্মী, / উড়ায়ে কনক অঞ্চল খানি। / দু'-হাতে বিতরি করুণাসিদ্ধি, / দারিদ্র্য দুঃখ নাশ নাশিনী॥ / থাকো মা' গৃহেতে হইয়া অচলা, / পূজিব তোমার চরণ কমলা, / তোমারি কৃপায় লভিব সকলি, / অকূলে তার ‘মা’ (ওমা) তারিণী। / এসো মা' কমলা হ'য়ো না নিদয়া, / নিবারণে মাগো দেহ পদছায়া, / পাই যেন তব অপার করুণা, / তুমি মোরে মাগো ছেড়ে যেও না, / তোমারি ও দু'টি চরণস্পর্শে, / হৃদয়ে জাগিবে শক্তি হর্ষে, / রাখিব তোমারে সবারি শীর্ষে, / পূজিব চরণ কমলখানি। / আমা পানে চাও, করুণা নয়নে, / দাও মাগো শান্তি তাপিত পরাণে, / শেষের দিনে রেখো মা চরণে, / ও ভব পারের ওই তরণী"॥

মানুষের বিশ্বাস যে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় রাতে ঘুমোনো চলে না। তাহলেই লক্ষ্মী ছেড়ে চলে যাবে। এই লক্ষ্মীর হাতে থাকে ধানের শীষ। চৌকাঠে থাকে পিটুলিগোলা। আর ঘরের মেঝেতে আঁকা থাকে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন। সমুদ্রমন্থনের সময় এই দেবীর উত্থান হয়েছিল বলে একে বলা হয় 'সমুদ্রকন্যা'। শারদ পূর্ণিমা থেকে বর্ষা বিদায় নেয় এই বছরের মতো। চারিদিকে ভরে ওঠে আউস ধানের গন্ধে। 

ড. শীলা বসাক কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার উপচার সম্পর্কে লিখেছেন, "আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে এই ব্রত পালন করা হয়। ব্রতীকে সকালবেলায় স্নান সেরে সারাদিন উপবাসে থাকতে হয়। বিকেলবেলায় ঘি বা তিলের তেলে জ্বালানো নানা প্রদীপ দিয়ে বাড়ি সাজানো হয়। সম্ভব হলে একলক্ষ, না হলে এক হাজার অথবা অন্তত একশ বাতি প্রজ্জ্বলিত করতে হয়। তারপর লক্ষ্মী প্রতিমা স্থাপন করতে হয় এবং নারিকেল, বিভিন্ন ফল, ধূপবাতি, মিষ্টান্ন, ফুল, ধানের শীষ, স্বর্ণমুদ্রা এবং রঙিন মালা দিয়ে সাজিয়ে পূজা করা হয়। ব্রতীকে এর পর ডাবের জল পান করতে হয় এবং সারারাত জেগে ‘জুয়া-পাশা’ ইত্যাদি খেলে নিশিযাপন করতে হয়। পরের দিন সকালে শুচি হয়ে অর্থাৎ স্নান করে শুচিবস্ত্রে ভগবান ইন্দ্রকে পুজো করতে হয় এবং ব্রাহ্মণকে খাদ্যদ্রব্য ও দক্ষিণা দান করতে হয়। এই ব্রত করলে ব্রতীর দীর্ঘজীবন লাভ এবং মৃত্যুর পর আত্মার স্বর্গবাস হয়। পার্থিব জীবনে দারিদ্রমোচন, সুস্থ ও সম্পদশালী জীবন লাভ হয়"। তবে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা প্রসঙ্গে বলেছেন, "লক্ষ্মীব্রতটি মেয়েদের একটি খুব বড়ো ব্রত। আশ্বিনপূর্ণিমায় যখন হৈমন্তিক শস্য ঘরে আসবে, তখনকার ব্রত এটি। সন্ধ্যার সময় লক্ষ্মীপূজা। সকাল থেকে মেয়েরা ঘরগুলি আলপনায় বিচিত্র পদ্ম, লতাপাতা এঁকে সাজিয়ে তোলে। লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, লক্ষ্মীপেঁচা এবং ধানছড়া হল আলপনার প্রধান অঙ্গ। বড়ো ঘর, যেখানে ধানচাল, জিনিসপত্র রাখা হয়, সেই ঘরের মাঝের খুঁটির — মধুম খামের গোড়ায় নানা আলপনা দেওয়া লক্ষ্মীর চৌকি পাতা হয়৷ আলপনায় নানা অলংকার, এবং চৌকিতে, লক্ষ্মীর সম্পূর্ণ মূর্তি না লিখে, কেবল মুকুট আর দুখানি পা কিম্বা পদ্মের উপরে পা— এমনি নানারকম চিত্র দেওয়া হয়। খুঁটির গায়ে লক্ষ্মীনারায়ণ আর লক্ষ্মীপেঁচা বা পদ্ম, ধানছড়া, কলমীলতা, দোপাটিলতা, লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আঁকা থাকে। চৌকির উপরে ডোল ও বেড় — ডালা ও বিড়ে"। 

শ্রীব্রহ্মবৈবর্ত্ত মহাপুরাণের প্রকৃতিখণ্ডে নারায়ণ নারদ সংবাদে যে মহালক্ষ্মী স্তোত্র রয়েছে, তা উচ্চারণ করতে হয় পূজোর সময়। স্তোত্রটি হল -- "নমঃ কমলাবাসিন্যৈ নারায়ণ্যৈ নমো নমঃ। কৃষ্ণপ্রিয়ায়ৈ সারায়ৈ পদ্ময়ৈ চ নমো নমঃ৷৷ পদ্মপত্রেক্ষণায়ৈ চ পদ্মাস্যায়ৈ নমো নমঃ। পদ্মাসনায়ৈ পদ্মিনৈ বৈষ্ণব্যৈ চ নমো নমঃ৷৷ সৰ্ব্বসম্পৎস্বরূপায়ৈ সৰ্ব্বদাত্র্যৈ নমো নমঃ। সুখদায়ৈ মোক্ষদায়ৈ সিদ্ধিদায়ৈ নমো নমঃ৷৷ হরিভক্তিপ্রদাত্রৈ চ হর্ষদায়ৈ নমো নমঃ। কৃষ্ণবক্ষঃস্থিতায়ৈ চ কৃষ্ণেশায়ৈ নমো নমঃ৷৷ কৃষ্ণশোভাস্বরূপায়ৈ রত্নপদ্মে চ শোভনে। সম্পত্যধিষ্ঠাতৃদেব্যৈ মহাদেব্যৈ নমো নমঃ।। শস্যাধিষ্ঠাতৃদেব্যৈ চ শস্যায়ৈ চ নমো নমঃ । নমো বুদ্ধিস্বরূপায়ৈ বুদ্ধিদায়ৈ নমো নমঃ । বৈকুণ্ঠে যা মহালক্ষ্মীলক্ষ্মীঃ ক্ষীরোদসাগরে। স্বর্গলক্ষ্মীরিন্দ্রগেহে রাজলক্ষ্মীন্ন পালয়ে৷৷ গৃহলক্ষ্মীশ্চ গৃহিণা গেহে চ গৃহদৈবতী। সুরভিঃ সা গবাং মাতা দক্ষিণা যজ্ঞকামিনী।। অদিতিদেবমাতা ত্বং কমলা কমলালয়ে । স্বাহা ত্বঞ্চ হবিদানে কব্যদানে স্বধা স্মৃতা।। ত্বং হি বিষ্ণুস্বরূপা চ সর্ব্বাধারা বসুন্ধরা। শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপা ত্বং নারায়ণপরায়ণা।। ক্রোধহিংসা বর্জ্জিতা চ বরাদ চ শুভাননা। পরমার্থপ্রদা তঞ্চ হরিদাস্যপ্রদা পরা। যয়া বিনা জগৎ সৰ্ব্বং ভস্মীভূতমসারকম্। জীবস্মৃতঞ্চ বিশ্বঞ্চ শবতুল্যং যয়া বিনা।। সৰ্ব্বের্ষাঞ্চ পরা মাতা সৰ্ব্ববান্ধবরূপিণী। যয়া বিনা ন সংভাষ্যো বান্ধবৈৰ্ব্বান্ধবঃ সদা।। ত্বয়া হীনো বন্ধুহীনঃ তয়া যুক্তঃ সবান্ধবঃ। ধৰ্ম্মার্থকামমোক্ষাণাং ত্বঞ্চ কারণরূপিণী। যথা মাতা স্তনন্ধানাং শিশূনাং শৈশবে যথা। তথা তং সৰ্ব্বদা মাতা সৰ্ব্বের্ষাং সৰ্ব্ববিশ্বতঃ৷৷ মাতৃহীনঃ স্তনত্যক্তঃ স চেৎ জীবতি দৈবতঃ। ত্বয়া হীনো জনঃ কোঽপি ন জীবত্যেব নিশ্চিতম্।। সুপ্রসন্নস্বরূপা ত্বং মাং প্রসন্না ভবাম্বিকে। বৈরিগ্রস্তঞ্চ বিষয়ং দেহি মহাং সনাতনি।। বয়ং যাবৎ ত্বয়া হীনং বন্ধুহীনাশ্চ ভিক্ষুকাঃ। সৰ্ব্বসম্পদ্বিহীনাশ্চ তাবদেব হরিপ্রিয়ে। রাজ্যং দেহি শ্রিয়ং দেহি বলং দেহি সুরেশ্বরি।। কীর্তিং দেহি ধনং দেহি যশো ভাগ্যং চ দেহি মে৷৷ কাম্যং দেহি মতিং দেহি ভোগান্ দেহি হরিপ্রিয়ে। জ্ঞানং দেহি চ ধৰ্ম্মঞ্চ সৰ্ব্বসৌভাগ্যমীপ্সিতম্।। প্রভাবঞ্চ প্রতাপঞ্চ সর্ব্বাধিকারমেব চ। জয়ং পরাক্রমং যুদ্ধে পরমৈশ্বর্য্যমেব চ৷৷ ইত্যুক্ত্বা চ মহেন্দ্রশ্চ সর্ব্বৈঃ সুরগণৈঃ সহ। প্রণমামি সাশ্রুনেত্ৰো মূৰ্দ্ধা চৈব পুনঃ পুনঃ। ব্রহ্মা চ শঙ্করশ্চৈব শেষো ধর্ম্মশ্চ কেশবঃ৷৷ যযুৰ্দ্দেবাশ্চ সন্তুষ্টাঃ স্বং স্বং স্থানঞ্চ নারদ। দেবী যযৌ হরেঃ ক্রোড়াং হৃষ্টা ক্ষীরোদশায়িনঃ৷৷ যযতুশ্চৈব স্বগৃহং ব্রহ্মেশানৌ চ 'নারদ। দত্তা শুভাশিষং তৌ চ দেবেভ্যঃ প্রীতিপূর্ব্বকম্।। ইদং স্তোত্রং মহাপুণ্যং ত্রিসন্ধ্যং যঃ পঠেন্নরঃ। কুবেরতুল্য স ভবেৎ রাজরাজেশ্বরো মহান্৷৷ সিদ্ধস্তোত্রং যদি পঠেৎ সোহহি কল্পতরুর্নরঃ। পঞ্চলক্ষজপেনৈব স্তোত্রসিদ্ধির্ভবেন্থণাম্।। সিদ্ধস্তোত্রং যদি পঠেন্ মাসমেকঞ্চ সংযতঃ। মহাসুখী চ রাজেন্দ্রো ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ"৷৷
 কোজাগরী লক্ষ্মী ব্রতের আলপনা, ছবি -- ড. শীলা বসাক

কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় একটি আবশ্যিক কাজ হল ব্রতীনী কতৃক ব্রতকাহিনী শোনা। অনেকেই লক্ষ্মী চরিত্র পাঠ করেন। আশুতোষ মজুমদার কতৃক কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার যে ব্রত কাহিনী উল্লিখিত হয়েছে, তা হল -- একসময় খুব দয়ালু এক রাজা ছিলেন। রাজার রাজ্যে প্রজারা খুব সুখে ছিল। তাঁর হুকুম ছিল, রাজপুরীর ভিতর যে মস্ত বাজার হয়, সেখানে দেশ-বিদেশ হ’তে যে সমস্ত জিনিসপত্র বিক্রির জন্য আসবে, যদি তার মধ্যে কিছু বিক্রি না হয়, তাহ'লে রাজা মশাই নিজে উচিত দাম দিয়ে তাই কিনে নেবেন।

একদিন সেই বাজারে অন্য রাজ্যের একজন কামার, একটি লোহার মেয়ে তৈরি ক’রে বিক্রি করতে আনে। কিন্তু সে আর কেউ কিনতে চায় না। তখন সেই কামার লোহার মুর্তিটা নিয়ে, রাজ্যের পথে পথে ফিরিওয়ালাদের মত ফিরি ক'রে বেড়াতে লাগলো, আর বলতে লাগলো, “ওগো, কেউ তোমরা অলক্ষ্মী কিন্‌বে গো”? রাজার কানে এ খবর যেতেই, রাজা কামারকে ডাকিয়ে ন্যায্য দাম দিয়ে সেই মেয়ের মূর্ত্তিটি কিনে, একটা ঘরের ভিতর রেখে দিলেন।

রাজা সন্ধ্যার সমর হাত পা ধুয়ে ঠাকুর ঘরে পূজা করতে যাবেন, এমন সময় শুনতে পেলেন যেন একটি মেয়ে কাতরে কাতরে খুব কাঁদছে। রাজা তখনই সেই স্বর লক্ষ্য ক'রে গেলেন — গিয়ে দেখেন যে, ঠাকুর ঘরে একটি পরমা সুন্দরী মেয়ে, ঘর আলো করা লক্ষ্মীর মত দেখতে, মাটিতে ব’সে দু'হাতে মুখ চেকে কাঁদছে৷ রাজা খুব আশ্চর্য্য হ'লেন, তখন সেই মেয়েটিকে বললেন, “কেন মা, কাঁদছ? তুমি কে মা? তোমার কিসের দুঃখ”? 
তখন মেয়েটি আস্তে আস্তে বললে, “আমি এই রাজ্যের লক্ষ্মী, আমায় রাজলক্ষ্মী বলে। কিন্তু আমায় রাজ্য ছেড়ে যেতে হবে ব'লে আমার বড় দুঃখ হচ্ছে। কেননা, অনেক দিন তোমার রাজ্যে আছি। ত। তিন দিন পরে যেতে হবে, তাই কাঁদছি।” রাজা তখন কাতর ভাবে বললেন, “কেন মা! রাজ্য ছেড়ে চলে যাৰে কেন? তোমার চরণে আমরা তো কোনো অপরাধ করিনি মা”। 

রাজলক্ষ্মী বললেন, “অপরাধ না করলে আমার সাধ্য কি যে, তোমাকে ছেড়ে যাই? তুমিই আমাকে তাড়াতে আজ অলক্ষ্মী কিনেছ, কাজেই আর আমার এখানে থাকা হবে না। তবে যাবার আগে তোমার এই বর দিয়ে যাচ্ছি যে, তুমি কীট, পতঙ্গ, পশু ও পাখীদের সমস্ত কথা বুঝতে পারবে”। রাজা কি বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় দেখলেন যে, মা লক্ষ্মী আর সেখানে নেই, অন্তৰ্দ্ধান হ'য়ে গেছেন।

সেদিন রাজার মন খুব খারাপ হ'য়ে গেল। সমস্ত রাত ঘুম হ'ল না। তার পরদিন দেখলেন, একটি মেয়ে আস্তে আস্তে রাজপুরী থেকে রাত্রে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাজার কেমন সন্দেহ হ'ল, তিনি তাড়াতাড়ি এসে জিজ্ঞাসা কল্লেন, “কে তুমি এত রাত্রে যাচ্ছ"? মেয়েটি বললে, “আমি তোমার ভাগ্যলক্ষ্মী। তুমি অলক্ষ্মীকে ঘরে এনেছ ব'লে আমি আর থাকতে পারলেম না, তাই চ’লে যাচ্ছি”। এই বলে ভাগ্যলক্ষ্মী ও চ'লে গেলেন। রাজা ভাবতে ভাবতে ফিরে আসছেন, এমন সময় দেখলেন — আর একটি মেয়ে ঘোমটায় মুখ ঢেকে ফটকের দিকে আছে। রাজা সরে দাঁড়ালেন। মেয়েটি কাছে এলে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কে মা? এত রাত্রে কোথায় যাচ্ছ”? মেয়েটি বললে, “আমি যশোলক্ষ্মী। তোমায় ছেড়ে যাচ্ছি কেন তা বোধ হয় বুঝতে পেরেছ। অলক্ষ্মীর জন্য আমার থাকা হ'ল না”। রাজা কোন কথাই বললেন না। তার পরদিন রাজা দেখলেন যে, একজন পুরুষ ও একজন রমণী চুপি চুপি রাজপ্রাসাদ হ'তে চ'লে যাচ্ছে। রাজা এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা কে? এত রাত্রে কোথায় যাচ্ছেন"? রমণী বললেন, “আমি তোমার কুললক্ষ্মী। তুমি অলক্ষ্মী এনেছ ব'লে তোমার ছেড়ে যাচ্ছি”। পুরুষমূৰ্ত্তি বললে, “আমি ধর্ম্মরাজ, তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি, তুমি অলক্ষ্মীকে ঘরে এনেছ ব'লে”। 
                   লক্ষ্মীসরা

রাজা তখন ধৰ্ম্মকে বললেন, “ধর্ম্মরাজ! আমার কোন দোষ নাই। আপনি জানেন— আমি প্রতিজ্ঞা ক'রেছি, যাঁর যে কোন দ্রব্য বিক্রি হবে না, আমি তা কিনবো। সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য অলক্ষ্মীকে কিনেছি। আমি কেমন করে ছাড়বো? আপনার ভরসাতে রাজলক্ষ্মী, ভাগ্যলক্ষ্মী, যশোলক্ষ্মীকে যাবার সময় বাধা দিই নাই। কুললক্ষ্মীও আপনার সঙ্গে যাচ্ছেন। তাঁকেও আমি বাধা দিই নাই। কিন্তু আপনাকে আমি বাধা দিচ্ছি। আমি ধৰ্ম্ম ত্যাগ করি নাই, আমি ধর্ম্মের মর্য্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছি। সুতরাং আপনার যাওয়া হবে না"। রাজার কথায় ধর্ম্ম আর যেতে পারলেন না, কুললক্ষ্মী চ'লে গেলেন।

এমনি ক'রে কিছুদিন যায়। রাজার অবস্থা দিন দিন খুবই খারাপ হতে লাগলে। রাণীর মহা ভাবনা হ'ল। রাণী কাছে বসে রাজাকে খাওয়াতেন। রাজা যখন খেতে বসতেন, তখন কালো পিঁপড়ে এসে রাজার পাতের চারিদিকে জমা হ'ত। রাজার মুখে কিছু ভাল লাগে না। তিনি একদিন খেতে খেতে রাণীকে বললেন, “দেখ, রাঁধুনিকে ব'লে দিও, যেন আমার কোন তরকারীতে সে ঘি না দেয়”। রাত্রিতেও যখন রাজা খেতে বসলেন, তখন সেই সব পিঁপড়েরা পাতের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। পিঁপড়েদের ভেতর যে বড় ছিল, সে অন্যদের বললে, “দেখ ভাই ! অলক্ষ্মী কিনে আমাদের রাজা গরীব হ'য়ে গেছে। আহা, কি কষ্ট! রাজার ভাগ্যে ঘিও জোটে না”! রাজা শুনে তো হেসে ফেললেন। রাণী সুমুখে ব'সে ছিলেন, হঠাৎ রাজাকে হাসতে দেখে বললেন, “একি! মহারাজ! খেতে খেতে হঠাৎ অমন ক'রে হাসলেন কেন?" রাজা বললেন, “রাণী! সে কথা শোনবার উপায় নেই। ব'ললেই আমার মৃত্যু হবে”। রাণীর বিশ্বাস হ'ল না, তিনি কিছুতেই ছাড়লেন না, বললেন, ওসব আমি শুনবো না। আপনাকে ব'লতেই হবে”। রাজা বললেন, “বেশ, যদি তুমি আমায় না চাও, আর আমার মৃত্যুতে সুখী হও, তবে চল গঙ্গার তীরে যাই, সেখানে সব কথা ব'লবো”। 

রাণী সেই রাত্রিতে রাজার সঙ্গে গঙ্গার ঘাটে এসে রাজাকে বললেন, “এইবার বলুন”। রাজা বললেন, “তাহ'লে তুমি আমায় চাও না? হাসবার কারণটাই শুনতে চাও”? রাণী বললেন, “নিশ্চয়ই আমি জানতে চাই, কেন আপনি খেতে খেতে হেসে উঠলেন”। এমন সময় ঘাটের পাশে জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা ছাগলী চরতে চরতে একটা ছাগলকে বললে, “দেখ, দেখ, ঐ গঙ্গার জলে কেমন এক বোঝা ঘাস ভেসে যাচ্ছে! আমায় এনে দাও না, আমি বেশ মনের সুখে খাব”। ছাগল বললে, “ক্ষেপেছিস্? অগাধ জলে ঘাস ভেসে যাচ্ছে। কে আনবে? শেষে কি প্রাণটা দেব? আমি ত আর ঐ রাজার মত বোকা নই যে, মেয়ে মানুষের কথায় প্রাণ দেব”! এই কথা শুনে রাজার কেমন চমক ভেঙ্গে গেল। তখন তিনি রাণীকে সেই জঙ্গলের মধ্যে ফেলে, রাজ্যে ফিরে এলেন। রাণীর কোন খোঁজই নিলেন না। রাণীর কষ্টের সীমা নাই, কেঁদে কেঁদে সেই জঙ্গলের মধ্যে বেড়ান।

এমনি ক'রে কিছুদিন যায়, একদিন সেই জঙ্গলের ভেতর থেকে রাণী খুব শাঁখ কাঁসরের বাজনা শুনে, তাড়াতাড়ি সেই দিকে গিয়ে দেখলেন, ঋষিদের অনেকগুলি মেয়ে পিটুলী দিয়ে লক্ষ্মীঠাকুর গ'ড়ে তাতে সব রঙ মাখিয়ে ফুল নৈবেদ্য দিয়ে পূজো করছে। নৈবেদ্যর পাশে চিঁড়ে, নারকেলের জল, তালের ফোঁপর ও পাটালি সব সাজান। রাণী এই সব দেখে বললেন, “হ্যাঁ গা বাছা, তোমরা এ কি পূজো করছো”? ঋষিদের মেয়েরা বললে, “ওমা! সেকি! তুমি বুঝি জান না যে, আজ আশ্বিন মাসের কোজাগরী পূর্ণিমা, এদিনে যে লক্ষ্মীপূজো ক'রতে হয়”! রাণী বললেন, “এ পূজোয় কি ফল হয়”? কন্যারা বললে, “এই পূজো ক’রে লক্ষ্মীর কাছে যে যা বর চায় তাই পায় —অলক্ষ্মী যায়, লক্ষ্মীর কৃপা হয়"। রাণী তখন তাঁদের কাছ থেকে একটু পিটুলী নিয়ে লক্ষ্মী ঠাকুর গ’ড়লেন। তাঁদের সঙ্গে ফুল চন্দন দিয়ে ভক্তিভরে মা লক্ষ্মীর পূজো ক'রলেন। তারপর লক্ষ্মীর প্রসাদ চিঁড়ে, নারকেল, তালের ফোঁপর ও ফলমূল খেয়ে, মেয়েদের সঙ্গে সেইখানে সমস্ত রাত জেগে রইলেন।

এদিকে রাজবাড়ীতে যে অলক্ষ্মী ছিল — আপনি সে দূর হ'য়ে গেল। আগেকার মত হাতি, ঘোড়া, লোক লস্কর, ধন রত্ন হ'ল। রাজা সকালে উঠে অবাক্! ভাবলেন, আমার এসব আবার কোত্থেকে এল? এমন সময় ধৰ্ম্মরাজ এসে বললেন, “মহারাজ, আপনার সেই অলক্ষ্মী এতদিনে বিদায় হয়েছে। কেন, তা বোধ হয় জানেন না। রাণী কাল রাত্রে ঋষির মেয়েদের সঙ্গে কোজাগরী লক্ষ্মীর পূজা ক'রে নিশি জাগরণ করেছেন। সেই পূজার ফলে আপদটা গেছে। এতদিন পরে রাজলক্ষ্মীর আবার কৃপা হ'ল”। রাজা তখন ধর্ম্মরাজকে ভক্তিভরে নমস্কার ক’রলেন। লোকজন সঙ্গে ক'রে নিজেই রাজা গঙ্গার ঘাটে গিয়ে রাণীকে খুঁজে খুব আদর ক'রে রাজপুরীতে ফিরিয়ে আনলেন। রাণী বছর বছর খুব ঘটা করে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা ক’রতে লাগলেন। দেখতে দেখতে সুখ সমৃদ্ধি উথলে উঠলো। ভাগ্যলক্ষ্মী, যশোলক্ষ্মী, কুললক্ষ্মীরা আবার সবাই ফিরে এলেন। সেই অবধি এই কোজাগরী লক্ষ্মীর পুজা পৃথিবীতে প্রচার হ'ল।

এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলা যায়, কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার ব্রতকথা অনুসারে অলক্ষ্মীর জন্যেই লক্ষ্মীকে গৃহচ্যুত হতে হয়েছিল। কেননা, কখনোই একটি ঘরের মধ্যে লক্ষ্মী এবং অলক্ষ্মীর সহাবস্থান সম্ভবপর নয়। তাইতো বাংলা প্রবাদে শোনা যায় -- "ভিতরে ইন্দুর থইয়া গাতার মুখ মুজান"।
🍂

Post a Comment

0 Comments