জ্বলদর্চি

পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে/পর্ব-৫/সুদীপ সেন

পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে
পর্ব-৫

সুদীপ সেন 

আমাদের চারপাশের প্রতিটি প্রানীর উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমরা নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক খাদ্যশৃঙ্খল ও প্রানীদের স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস আমাদের স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্র বাঁচিয়ে রাখতে মুল ভুমিকা নেয়। কিন্তু আমরা যে লোভের দাস, ক্ষমতার কাঙাল আর দম্ভের মালিক। তাই অন্যান্য প্রানীদের স্বাভাবিক জীবনকে প্রভাবিত করে তাদের উপর রকমারি পরিবর্তন আমরা চাপিয়ে দিচ্ছি, সুদুরপ্রসারী ফলালফলের কথা না ভেবে। 

কুকুর সাধারণভাবে আমাদের বাড়ি বা পাড়ায় মানুষের সাথে মিলেমিশে থাকা এক বন্ধু প্রানী , রান্না করা ভাত – রুটি -  মাছ – মাংস এদের খাদ্য। কাঁচা রক্তমাখা মাংস কিন্তু আমাদের ঘরের পাশে থাকা কুকুরের স্বাভাবিক খাদ্য নয়। কিন্তু আজকাল দেখা যায় পাড়ায় পাড়ায় মুরগির মাংসের দোকান আর বাজারে আছে তার সাথে পাঁঠার মাংসের দোকান। এইসব দোকানদাররা অনেক সময়ই রক্তমাখা ছাঁট মাংস বা অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রাস্তার কুকুরদের খেতে দেন। মানুষের হাত থেকে চিরকাল খাবার পেয়ে আর খাবার খেয়ে ওদের বিশ্বাস আর প্রত্যাশার বিস্তার এতটাই হয় যে যেহেতু মানুষরা খেতে দিচ্ছে তাই কুকুররা ভাবে ওগুলো বোধ হয় ওদের খাবার। খাবারের অপ্রতুলতার কারণে এদিকে পেটে প্রবল খিদে, ওদিকে সামনে অচেনা হলেও খাবার, এই অবস্থায় ধীরে ধীরে পথকুকুররা রক্তমাখা কাঁচা মাংস খেতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে । আর একবার দীর্ঘদিন ধরে এই অভ্যাস গড়ে উঠলে রক্ত – কাঁচা মাংস পথকুকুরের স্বাভাবিক খাদ্যে পরিনত হবে। এমনিতেই স্থান সঙ্কুলান ( আজকাল কুকুরদের হামেশাই এক মানুষ উঁচু পাঁচিল টপকাতে বা পাঁচিলের উপর দিয়ে স্বচ্ছন্দে হেটে যেতে দেখা যায়), বাসস্থান নেই ( আজকাল বাড়ির কার্নিশে উঠে কুকুরদের ঘুমাতে দেখা যায়), কারও বাড়িতে ঢুকলেই তাড়িয়ে দিচ্ছে – গায়ে জল ঢেলে দিচ্ছে, আবার রাস্তায় এলে গাড়ির দাপাদাপিতে যেকোনোসময় চাপা পড়ার আতঙ্ক, নিরিবিলিতে একটু ঘুমানোর জায়গা পাওয়া দুস্কর। এর মধ্যে যখন পেটে খাবার থাকবে না তখন এই কাঁচা রক্ত – ছাঁট মাংস খেতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া কুকুররা তো পথচলতি মানুষকেই কামড়াবে। কিছু কিছু এলাকায় কুকুরে কামড়ানোর ঘটনা ইতিমধ্যেই অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে । পরিস্থিতির অবাঞ্ছিত এই পরিবর্তন আমরাই ডেকে আনছি, তাই এই প্রবনতা ঠেকানোর দায়িত্বও আমাদের সবার। কুকুরদের স্বাভাবিক খাদ্য পরিবর্তন করিয়ে আমরা আমাদের বিপদ বাড়িয়ে তুলবো না এই সচেতনতার বিস্তার এখন জরুরী হয়ে উঠছে । 
সংগ্রহ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ -৯৭৩২৫৩৪৪৮৪


আবার অন্যদিকে গরু, মাছ বা মুরগির স্বাভাবিক খাবারের পরিবর্তে অতি দ্রুত বৃদ্ধি আর লাভের সীমাহীন লোভের জন্য আমরা গরু, মুরগি বা মাছের ফার্মে বিভিন্ন নতুন নতুন খাবারে ওদের অভ্যস্ত করে তুলছি ( এমনকি তৃণভোজী গরুকে অন্য প্রানীর হাড়ের গুড়োও খাওয়াচ্ছি, পুকুরের মাছকে মুরগির নাড়িভুঁড়ি খাওয়াচ্ছি ), উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ওষুধ – ইনজেকশনও যথেচ্ছ ব্যবহার করছি। অন্য উপায় নেই তাই যা দেয়া হচ্ছে ওরা তাই খাচ্ছে, যেভাবে রাখছি সেইভাবে থাকছে। আমাদের লক্ষ্য যে কোন উপায়ে মুনাফার পরিমান বাড়িয়ে তোলা, তাতে অবলা নিরীহ প্রানীদের উপর যত খুশি অত্যাচার হোক বা ওদের স্বাভাবিক জীবন সম্পূর্ণ লুণ্ঠিত হোক সেটা নিয়ে ভাবার বিলাসিতা আমরা করি না। কিন্তু এর পরিনাম তো এসে পড়ছে সেই আমাদের খাদ্য শৃঙ্খলে। ফসল বা উৎপাদন বেশি হচ্ছে এটা ঠিক কিন্তু খাদ্যগুন বা খাবারের স্বাদ দুটোই অনেক হ্রাস পাচ্ছে লক্ষনীয় ভাবে, উপরি পাওনা হিসাবে বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ, মাছ – মাংস – দুধ – সবজি – ফলের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে আমাদের জীবনে নিত্যনতুন অসুখ আমদানি করছে। একটা অসুখ সারাতে গিয়ে যে ওষুধ খেতে আমরা বাধ্য হচ্ছি , সেই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অন্য অসুখের সুত্রপাত হচ্ছে। একটার থেকে আর একটা শারীরিক / মানসিক  অসুখের মধ্যে দিয়ে আমাদের জীবনযাত্রা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলেছে।    
🍂
১৯৫৮ সালে চিনের প্রশাসকরা নজর করেন যে চড়াই পাখিরা প্রচুর দানা শস্য খায় । ব্যস, আমরা মানুষ, আমরা ছাড়া অন্য কেউ খাবে না এই ভাবনার থেকে আদেশ এলো সব চড়াই পাখিকে বিনা দোষে মেরে ফেলার। কয়েকশো কোটি পাখি মরল শুধু মানুষের খামখেয়ালী সিদ্ধান্তের জন্য। কিন্তু প্রাকৃতিক খাদ্য শৃঙ্খলে ছোট্ট চড়াইয়েরও তো অসীম গুরুত্ব। চড়াই খাদ্য শস্য যেমন খেত সেইসাথে প্রচূর পোকামাকড়ও খেত। এখন দেশে  আর চড়াই পাখি নেই, ফলে পোকামাকড় এত বেড়ে গেল যে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই বোঝা গেলো যে চড়াইয়ের থেকে কয়েকগুন বেশি শস্য পোকামাকড় নষ্ট করছে। ফলস্বরুপ খাদ্যের অভাবে কয়েক কোটি মানুষ অনাহারে মারা যায়। শেষমেশ ১৯৬০ সালেই চড়াই পাখি মারার আদেশ ফেরত নেয়া হয়, এমনকি দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে রাশিয়া থেকে নতুন করে ২.৫ লাখ চড়াই পাখি নিয়ে গিয়ে চিন দেশে ছাড়া হয়।  আমাদের এই বিনোদন – উন্নয়ন – আন্দোলন – আস্ফালনে ভরা জীবন ছোট্ট চড়াই পাখির অবর্তমানে মৃত্যুমুখে এসে দাঁড়ায়, আর এইরকম আত্মঘাতী হটকারি কর্মকাণ্ডের উদাহরণ পৃথিবীতে প্রচুর পাওয়া যায় । 

আমাদের বাস্তুতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সব পশুপাখি, মাছ, গাছপালাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে তাদের প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক জীবনধারণের মধ্যে রেখে। পৃথিবীর সব থেকে উন্নত মস্তিস্ক এবং চিন্তাশীল মননের অধিকারী হিসাবে সমগ্র জীবজগতের স্বাভাবিক জীবনধারণের নুন্যতম পরিবেশটুকুর খেয়াল রাখার দায়িত্ব স্বীকার করেই এবার আমাদের সবাই মিলে এগিয়ে চলার পালা।   
 "প্রকৃতি - পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, মানুষ বাঁচলে তবেই বাকি সবকিছু কাজে লাগবে"।

Post a Comment

0 Comments