দেশের পতাকায় গুবরে পোকার রঙ
চিন্ময় দাশ
( ব্রাজিল—দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় দেশ। সবুজ, সোনালী, নীল আর সাদা-- চার রঙের মিশেলে তৈরি হয়েছে সে দেশের পতাকার নকশা। তার কারণ নিয়ে একটি গল্প শোনা যায় ব্রাজিলে। সে গল্পটিই আজ শুনবো আমরা। )
এক সময় ব্রাজিলের গুবরে পোকারা দেখতে ভারি সুন্দর ছিল। সুন্দর মানে, তাদের পিঠের মজবুত শক্ত খোল ছিল ঝকমকে। এতটাই সুন্দর যে, মেয়েদের গয়নায় ঠাঁই পেয়েছিল সেগুলো। মাথার কাঁটায় শুধু নয়, গলার নেকলেস-এও খোলগুলো ব্যবহার করা হোত।
গুবরে পোকাদের এমন বাহারি খোল কিন্তু চিরকাল ছিল না। হাজার হাজার বছর আগে, এত সুন্দর ছিল না গুবরে পোকারা। খোল ছিল একেবারেই সাধারণ। ম্যাড়মেড়ে ধূসর রঙের।
প্রথম তাদের রঙ কী করে পাল্টেছিল, সেটা আগে বলি। একবার একটা গুবরে পোকা মেঝের উপর দিয়ে হেঁটে চলেছে। সবাই জানে, গুবরে পোকাদের গতি অতি মন্থর। তারা দ্রুত চলতে পারে না। তখনই একটা ধেড়ে ইঁদুর বেরিয়েছে গর্ত ছেড়ে। পোকাটাকে দেখে ভারি কৌতুক হোল তার। ব্যঙ্গ করে বলল—ওহে ভায়া, এই গতিতে চলাফেরা করলে, আদৌ পৌঁছতে পারবে কোথাও? গতি কাকে বলে, দেখবে? লক্ষ্য করো আমাকে।
বলেই এক ছুট। ওপাশের দেওয়াল ছুঁয়ে, মূহুর্তেই আবার এপাশে ফিরে চলে এলো। পোকাটা ততক্ষণে আঙুলখানিক এগিয়েছে মাত্র।
ইঁদুর বলল—তোমার কখনো ইচ্ছে করে না, আমার মত জোরে দৌড়তে?
গুবরে পোকা বলল—আমি মেনে নিচ্ছি, তুমি খুব ভালো দৌড়বাজ। এবার হোল তো? পোকাটার গলা খুব মোলায়েম, মার্জিত। মার্জিত গলায় কথা বলতে শিখিয়েছে তার মা। মা বলত—কখনও কারও সাথে অমার্জিত সুরে কথা বলবে না। যে গুবরে পোকা প্রকৃত মার্জিত, নিজের ক্ষমতা নিয়েও কোন দিন অহঙ্কার করে না সে।
ইঁদুর বলল—তবুও, একটা প্রতিযোগিতা হয়ে যাক দুজনের। শুনল বটে, গুবরে পোকা কোন জবাব দিল না এ কথার।
কাছেই একটা আমগাছ। একটা টিয়াপাখি বসেছিল গাছটার ডালে। আহা, গায়ের রঙের কী বাহার তার! ঘন সবুজের উপর সোনালী রঙ।
দুজনের আলাপ শুনছিল সে। পাখিটা ইঁদুরকে বলল—ঠিক কী রকম প্রতিযোগিতা চাইছ তুমি?
ইঁদুর মুখ তুলে তাকাল পাখির দিকে। বলল--পাশের ঝোপে যে টুনটুনির বাসা, তার ঠিক পরেই থাকি আমি।
টিয়া বলল— প্রতিযোগিতা বললেই তো আর হোল না, সেটাকে বেশ মজাদার করে তোলা দরকার।
ইঁদুর বলল—প্রতিযোগিতা হলে তো, পুরষ্কারও চাই তাতে।
টিয়া বলল—অবশ্যই। পুরষ্কার না থাকলে, সেটা প্রতিযোগিতাই নয়। আমি বলছি, তোমাদের দৌড়ে যে জিতবে, তাকে একটা উজ্বল রঙের কোট উপহার দেব আমি। এছাড়াও, কেউ যদি বিশেষ কোন রঙ চাও, তাও পেয়ে যাবে।
ইঁদুর তো ধরেই নিয়েছে, দৌড়ে সে-ই জিতবে। সে বলল—আমার হলুদ রঙের কোট চাই। তার উপর কালো রঙের ডোরা কাটা। ঠিক যেমনটি বাঘেদের গায়ে থাকে।
বলেই, নিজের ধূসর রঙটার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল ইঁদুর। যেন লড়াইটা সে জিতেই গিয়েছে।
গুবরে পোকা বলল—নতুন আর জমকালো রঙের কোট আমারও পছন্দ।
সেকথা শুনে, ইঁদুরের সে কী হাসি! হাসি আর থামতেই চায় না তার। হাসি থামলে, বলল—মানে? তোমার কি ধারণা, তুমি লড়াইটা জিতে যেতে পারো?
টিয়া তাদের থামিয়ে দিয়ে, বলল—ঐ যে দূরে বাঁধের ওপর তালগাছটা দেখছো, ওটাই হোল খুঁটি। তোমাদের ভিতর যে আগে ওখানে পৌছতে পারবে, সে বিজয়ী।
দুজনের দৌড় শুরু করিয়ে টিয়া উড়ে গেল তালগাছের দিকে। সেখানে বসেই, দুই প্রতিযোগীকে নজর রাখবে সে।
সবাই জানি, দৌড় আছে ইঁদুরের পায়ে। ভারি দ্রুত দৌড়তে পারে সে। শুরুও করে দিয়েছে খুব জোরে। তবে, খানিকটা পথ দৌড়বার পর, তার খেয়াল হোল, আচ্ছা বেকুব তো আমি! লড়াই তো একটা গুবরে পোকার সাথে। তাহলে, আমি এমন হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়চ্ছি কেন? গুবরেটা তো দৌড়তেই পারে না, জিতবে কী ! তেমন উপযুক্ত কোন দৌড়বাজ হলে, তখন অন্য কথা ছিল।
দৌড়ের গতি কমিয়ে দিয়েছে ইঁদুর। খানিক বাদে, তার নিজের মন বলে উঠল- দৌড়ও দৌড়ও। থেমে থেকো না। তখন আবার গতি বাড়িয়ে দিল ইঁদুর।
উঁচু বাঁধের মাথায় তালগাছ। সেখানে পৌঁছে, আকাশ ভেঙে পড়ল ইঁদুরের মাথায়। উজ্বল সবুজ আর সোনালী রঙের টিয়াপাখিটা বসে আছে তালগাছের তলায়। তার ঠিক পাশটিতে হতচ্ছাড়া গুবরে পোকাটা বসে আছে চুপ করে।
জীবনে এমন চমক কখনও খায়নি ইঁদুর। মাথায় কিছু ঢুকছে না তার। জিজ্ঞেস করেই বসল—ব্যাপারটা কী, বলো তো? তুমি এত তাড়াতাড়ি পৌঁছলে কী করে এখানে?
গুবরে পোকার মুখে মিটিমিটি হাসি। পিঠের ঢাকনা আলগা করে, ছোট্ট দুটো ডালা মেলে ধরল সে। বলল—এগুলোয় ভর করে, উড়ে উড়ে এলাম। দৌড়েই আসতে হবে, বা ওড়াউড়ি চলবে না-- একথা তো বলা হয়নি। তাই আমি উড়ে চলে এলাম।
ইঁদুরের এখন ঢোঁক গেলার অবস্থা। কোন রকমে বলল—তুমি উড়তে পারো, জানাই ছিল না আমার।
টিয়া বলল—এর পর থেকে, কাউকে তার বাইরের চেহারাটা দেখে, বিচার করতে যেও না,বন্ধু। তুমি জানোই না, কখন কোথায় কার দুটো ডানা আবিষ্কার হয়ে যেতে পারে! যাকগে, তুমি বাপু এ লড়াইটা হেরে গিয়েছ।
আজও ব্রাজিলের ফুল-ফল, পাখ-পাখালি, জীব-জন্তু, পোকা-মাকড়দের কত সুন্দর সব জমকালো রঙ আছে। কিন্তু ধেড়ে ইঁদুরদের রঙ সেই একই ম্যাড়মেড়ে ধূসর রঙের।
এবার গুবরে পোকাকে টিয়া পাখি জিজ্ঞেস করল—তুমি লড়াইটা জিতেছ। অতএব তুমি বলো, কোন রঙের নতুন কোট তোমার চাই?
ছোট্ট পোকাটা প্রথমে টিয়ার দিকে তাকালো। ঘন সবুজ রঙের ওপর সোনালী পোঁচ। তালগাছটা ঠিক মাথার উপরে। এখন তাল পাকবার সময়। সেদিকে চেয়ে দেখল, বড় বড় সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে, সোনালী হয়ে ওঠা পাকা তালের কাঁদি চকচক করছে। দূরের আমগাছে দেখল, সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে পাকা আমের উজ্বল সোনা রঙ।
সুর্যদেব অস্তে যাচ্ছেন দূরে সবুজে মোড়া পাহাড়ের মাথায়। কেউ যেন বালতি বালতি গলানো সোনা ঢেলে দিয়েছে সবুজের ওপর।
গুবরে পোকা বলল—আমার কোট যেন সবুজ আর সোনালী রঙের হয়।
ভারি মিষ্টি করে হাসল টিয়াপাখি—আচ্ছা, আচ্ছা। তাই হবে।
সেদিন থেকে গুবরে পোকাদের রঙ হয়ে গেল সবুজ আর সোনালী। তার পর থেকে শত শত হাজার হাজার বছর ধরে, গুবরে পোকারা গর্ব করেছে তাদের গায়ের রঙের জন্য। সবাই পছন্দ করে এসেছে রঙ দুটোকে। যেমনটা করেছিল ইঁদুরের সাথে লড়াই জেতা পোকাটি।
তার পর একদিন ছোট্ট একটা গুবরে পোকা ভারি বিরক্ত হয়ে উঠল গায়ের রঙের ওপর। রঙ দুটো আদৌ পছন্দ নয় তার।
🍂
প্রায়ই আকাশের নীলের দিকে চোখ মেলে চেয়ে থাকে পোকাটা। পা বাড়ালেই আটলান্টিক সাগর। সাগরের ধারেও চলে যায়। কত দূর ছড়িয়ে থাকা অগাধ নীল জল আচ্ছন্ন করে রাখে তাকে।
সে ধরে বসল, এই পুরাণো রঙের কোট চলবে না তার। নীল রঙের কোট চাই।
দিন রাত একই কথা ঘ্যানর ঘ্যানর করলে, কত আর ভালো লাগে? তার মা একদিন খুঁজে খুঁজে এক টিয়াপাখির কাছে হাজির হোল। এই পাখিটাও ‘দর্জিপাখি’ টুনটুনির বাসার কাছেই থাকে।
মা-গুবরে পোকার মুখে সব শুনে, টিয়া বাচ্চাটাকে বলল—সবুজ বদল করে, নীল রঙের কোট তুমি পেতে পারো। তবে, তার জন্য কিছু হারাতেও হবে তোমাকে।
--সবুজের বদলে নীল কোট পেলে, অনেক কিছুই ছাড়তে তৈরি আছি আমি।
নতুন কোটের রঙ ভারি পছন্দ হয়েছে ছোট্ট পোকাটার। গাঢ় নীল রঙ। উপরে রূপোলী সাদার আভা। যেন তারারা ফুটে আছে রাতের আকাশে।
কোটটা গায়ে চড়িয়ে, অন্য রকম লাগল পোকার। আগেকার সবুজ কোটের মত শক্ত বা মজবুত নয় এটা।
সেদিন থেকেই নীল রঙের গুবরে পোকাদের পিঠের খোল আর শক্ত রইল না। সেজন্য খোলগুলো মেয়েদের গয়নাগাটিতে ব্যবহার করা, বেশ ঝামেলার ব্যাপার হয়ে উঠেছে।
সেদিন থেকে ঘটেছে আরও একটা ব্যাপার। নীল রঙের কোট গায়ে চাপাবার পর থেকে, শরীর ছোট হয়ে গেছে নীল রঙের গুবরে পোকাদের। সবুজ পোকাদের মত বড় শরীর আর নাই তাদের।
এদিকে হয়েছে কী, ব্রাজিল তাদের দেশের জাতীয় পতাকা বানিয়েছে বড় আর চারকোণা সবুজ রঙের কাপড় নিয়ে। পূর্বকালে গুবরে পোকাদের যে সবুজ রঙ ছিল, একেবারে ঠিক তেমন রঙটি দিয়ে। সেই সবুজের ওপর রেখেছে সোনালী হীরের ছাঁদ, যেমনটি দেখা যেত সবুজ গুবরে পোকাদের পিঠের ওপর।
তারপর পতাকায় সেই হীরের ছাঁদের ওপর বড়সড় একটা বৃত্ত আঁকা। বৃত্তটার রঙ ঘন নীল, নীল গুবরে পোকাদের কোটের মতোটি একেবারে। নীলের ওপর আঁকা হয়েছে ছোট ছোট বিন্দুর আকারে রূপোলী সাদা রঙের তারা, নীল পোকাগুলোর কোটের মতই।
আসলে, ব্রাজিলের জাতীয় পতাকার এই নীল বৃত্তটা হোল-- আমাদের পৃথিবীরই গোল ছাঁদ। তার ওপর আড়াআড়িভাবে একটি সাদা পটি আঁকা । ব্রাজিল দেশের মূল মন্ত্রটি লেখা আছে সেই পটির ওপর—শৃঙ্খলা আর অগ্রগতি (‘ওর্ডেম এ প্রগ্রেসো’)।
0 Comments