সম্পাদকীয়,
পুজো পুজো একটা গন্ধ পাচ্ছ কি? মা দুর্গার আগমণের সুর শুনতে পাচ্ছ নিশ্চয়ই? তাই তো আমরা বাঙালিরা আনন্দে মেতে উঠেছি। কেউ নতুন জামা কাপড় কিনছি। কেউ বেড়াতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কেউ প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখার প্ল্যান করছি। প্ল্যানের কি শেষ আছে? শ্রীরাধা আর ফতিমা পুতুলের বিয়ে দেবার প্ল্যান করছে দিলীপ জেঠুর গল্পে। সুকুমার জেঠুর উপন্যাসে প্রবাসী ছোটোকাকুর সঙ্গে বইমেলা গিয়ে বই কেনার প্ল্যান করছে কারা? বলব না পড়ে নাও। মনে রেখো বইমেলাও একটা উৎসব কিন্তু। কুহেলী পিসির ভাল্লাগেনা ছড়াটা পড়ে নিও। আর সপ্তদ্বীপা পিসির গল্পে চন্দন কোথায় গেছে পড়ে নাও। স্বপ্ননীল আঙ্কেলের ছড়া পড়ে জেনে নাও ফণীরাজ কী কী করে। তপশ্রী আন্টির গল্পের অর্ধেন্দু স্যারকে চেনো কি? চেনা চেনা লাগছে তাই তো? চেনা জানার কি আর শেষ আছে? মৌসুমী আন্টির ছড়ায় জানকী আম্মাকে চিনে নাও। উনি একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী৷ বানীয়া দিদি, অহনা আর সাথী তোমরা তিনজনে যে সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকে পাঠিয়েছো তা দিয়ে আমাদের ছোটোবেলা সেজে উঠেছে দেখেছো তো। এবারের উৎসব সংখ্যার সব আয়োজন যার প্রচ্ছদে মুড়ে তোমাদের দিলাম সে তোমাদের প্রিয় মৃণাল আঙ্কেল। আগমণীর সুরে ভেসে তোমরা সেজে গুজে ব্যাগ গোছাও আমরা পরের সংখ্যায় আসছি বেড়ানোর গল্প নিয়ে। টা টা...... মৌসুমী ঘোষ।
ধারাবাহিক উপন্যাস
ছোটোকাকুর কান্ডকারখানা
পর্ব ২
সুকুমার রুজ
দুই
ছোটকাকুর সঙ্গে আজ বইমেলায় গিয়েছিল তিতলি আর সুমন। তাই এবারের মজাটাই আলাদা। অন্যান্য বার ওদের বাপির সঙ্গে ওরা বইমেলায় যায়। আসলে, অন্যান্য বার কাকু তো এসময় কলকাতায় থাকেন না। প্রতিবছর বড়দিনের ছুটিতে কাকু ফ্লোরিডা থেকে আসেন, আর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই ফিরে যান। এবার বড়দিনের সময় কাকু স্পেস-সিটিতে ছিলেন তাই আসতে পারেননি। এসময় কাকু আসাতে সুমন আর তিতলির আনন্দ উপচে পড়ছে। বিশেষত কাকুর সঙ্গে বইমেলা যাওয়ার পর তো আনন্দে আত্মহারা।
বাপির সঙ্গে বইমেলা এলে তেমন মজা হয় না। খানকতক বই কেনা হতে না হতেই বাপি বলেন —এবার চল, আর ঘুরতে হবে না, অনেক বই কেনা হয়েছে।
দামী বই পছন্দ হলে বাপি বলেন, 'না না, এখানে কিনতে হবে না! পাবলিশার্স আর বইয়ের নাম টুকে রাখ, কলেজ স্ট্রিট থেকে এনে দেব। এখানে টেন পারসেন্টের বেশি কমিশন দেয় না। কলেজ স্ট্রিটে সস্তা হবে।'
ছোটকাকুর ওসবের বালাই নেই। যে বই পছন্দ হচ্ছে, সেটাই কিনে দিচ্ছেন কাকু। সুমন বই কিনতে কিনতে ভাবছে, মানুষ বিজ্ঞানী হলেই এমন উদারমনা হয়! নাকি ফ্লোরিডাতে থাকলেই এমন হয়! ও আরও ভাবে, ছোটকাকুর মতো একজন পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী, ওদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বইমেলায়, কেউ চিনতেও পারছে না। অথচ সায়েন্স জার্নালে কাকুর ছবিসহ আর্টিকেল বেরোয় — 'উত্তর মেরুর গবেষণাগারে উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ড. শুভদীপ রায়ের বিরাট সাফল্য।'
দু’ভাইবোন মিলে দু’টো বিগ-সপার ভর্তি করে বই কিনেছে এবার। ড্রয়িংরুমে সমস্ত বই বের করে খুশি খুশি চোখে দেখছে দু’জনে। মনে মনে বেশ গর্ববোধও হচ্ছে; স্কুলের বন্ধুদের কাছে অনেক বই কেনার গল্প করতে পারবে। তিতলি কিনেছে গাদাখানেক রচনাবলী। বিখ্যাত বিখ্যাত সাহিত্যিকের বই। আর সুমন কিনেছে গাদাগুচ্ছের মহাকাশ বিজ্ঞানের বই। ‘মহাকাশের বিস্ময়’ নামের ঢাউস বইখানাতে আদর করে হাত বুলোতে বুলোতে বলে — জানিস দিদি! এই বইখানা এবারের সেরা বই। যা দারুণ দারুণ ছবি আছে না! মহাকাশ সম্পর্কে খুঁটিনাটি সব আছে।
তিতলি বলে — তা তো আছে। কিন্তু ওই একখানা বই শেষ করতেই তোর ছ’মাস লেগে যাবে। তুই যা স্লো।
হুঁ! তোর মতো খালি পাতা উলটে যাব নাকি! বুঝে বুঝে পড়তে হবে তো! তোর মতো গল্পের বই পড়া নয়, এ হলো বিজ্ঞান, বুঝেছিস!
তিতলি তেতে ওঠে — আমি শুধু পাতা ওলটাই কে বললো তোকে! পড়ার পর পুরো গল্পটা তোকে শুনিয়ে দিতে পারি। তাড়াতাড়ি পড়তে জানতে হয়! আমি তো তবু বেশ কিছুটা সময় নিই। কাকু কী তাড়াতাড়ি পড়ে, দেখিস! জানিস, বিবেকানন্দ শুধু পাতায় একবার চোখ মেলতেন, আর পাতাটা পড়া হয়ে যেত। পড়া শেষ হলে গড়গড় করে সব বলে দিতে পারতেন।
হুঁ! গড়গড় করে সব বলে দিতে পারতেন! বিবেকানন্দকে মহামানব বানাতে ওসব গল্প তৈরি হয়েছে। এমন সম্ভব নয়।
ছোটকাকু, মানে উদ্ভিদবিজ্ঞানী ড. শুভদীপ রায় এতক্ষণ পাশের ঘরে বসে ল্যাপটপ খুলে ই মেল চেক করছিলেন। ইনবক্সে পল হ্যারি নামের একজনের একটা মেল এসেছে।
মনে পড়ে যায়, পল হ্যারি একজন ফিলোলজিস্ট। চেস্টারহোমের ইন্টারন্যাশনাল ফিলোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির অ্যানসিয়েন্ট ল্যাটিন স্ক্রিপ্ট্ বিভাগের প্রধান হলেন পল হ্যারি। আলাপ হয়েছিল চেস্টারহোমে। সেখানে কোনও এক দুর্গের ভেতরে বহু পুরোনো আসবাবপত্র ও মাটির কলসীর মধ্যে পাথরে পরিণত হয়ে যাওয়া শস্যদানা পাওয়া গিয়েছিল। সেই শস্যদানার নাম গোত্র বের করার জন্য ফ্লোরিডার স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউট থেকে ওকে পাঠানো হয়েছিল। ওখানে কিছু প্রাচীন লিপিতে লেখা চিঠিপত্র পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলোর ভাষা ও তার মর্ম উদ্ধার করার জন্যই পল হ্যারির ডাক পড়েছিল।
চেয়ারে বসে ই মেল চেক করছিলেন ঠিকই। কিন্তু কান ছিলো ভাইপো-ভাইঝির কথাবার্তায়। উনি বলে ওঠেন — না সুমন! তুমি ঠিক বলছো না, পেরজাপতিই ঠিক বলছে। বিবেকানন্দ শুধু পাতায় একবার চোখ মেলতেন, আর পাতাটা পড়া হয়ে যেত। এমনটা সম্ভব এবং বিজ্ঞানভিত্তিক।
সুমন জিজ্ঞেস করে — কী করে সম্ভব কাকু?
কী করে সম্ভব বুঝিয়ে দিচ্ছি। তুমি তোমার হাতের বইটার যে কোনও একটা লাইন পড়!
সুমন পড়ে — শহর গড়ে তোলার উপযুক্ত জায়গা হলো চাঁদের ‘ক্লেভিয়াস বেস’ অঞ্চল। ওখানে...!
ব্যস ব্যস! এতেই হবে। এবার শোন! এই যে, লাইনটা তুমি ঝর ঝর করে কথা বলার মতো পড়ে ফেললে। এখন একটা শিশুশ্রেণির বাচ্চাকে ওই লাইনটা পড়তে দিলে, সে বানান করে পড়বে শ হ র শহর, এমনভাবে। তুমি কিন্তু একবার তাকিয়েই ‘শহর’ ‘ক্লেভিয়াস’ এসব শব্দ পড়ে ফেলতে পারছ। অর্থাৎ অনেকদিনের অভ্যাসের জন্য এক-নজরে দু-তিনটে শব্দ পরতে পারছ। তোমার দিদি ওর অভ্যাসগুণে এক নজর তাকিয়ে একটা গোটা লাইন পড়ে ফেলতে পারে। তাই ওর এক পাতা পড়তে তোমার চেয়ে কম সময় লাগে। আমি যেমন একঝলকে একটা ছোট প্যারাগ্রাফ পড়ে ফেলতে পারি। আমার একপাতা পড়তে আরও কম সময় লাগবে। তেমনি বিবেকানন্দ তাঁর নিরলস অধ্যবসায় ও অভ্যাসের দ্বারা একবার চোখ মেলে একপাতা পড়ে নিতে পারতেন। তাই মনে হতো পাতা ওলটাচ্ছেন। এবার বুঝলে ব্যাপারটা কতখানি বিজ্ঞানসম্মত।
তিতলি হাঁ করে শুনছিলো বিজ্ঞানীকাকুর কথা। ও ফোড়ন কাটে — এবার বুঝলে হাঁদারাম!
সুমন দিদির খোঁচাটাকে গুরুত্ব দেয় না এখন। ও গম্ভীর হয়ে বলে — হ্যাঁ, বুঝলাম কাকু। তাহলে এটা তো একটা আবিষ্কারের বিষয় হতে পারে।
কী আবিষ্কারের?
বিজ্ঞানীরা গতি বাড়ানোর জন্য কত যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। তাহলে পড়ার গতি বাড়ানোর জন্যও তো একটা যন্ত্র আবিষ্কার করা যেতে পারে!
তিতলি বলে ওঠে — ঠিক বলেছিস ভাই। সে যন্ত্রটা তোর খুব কাজে লাগবে।
ছোটকাকু সুমনের পিঠ চাপড়ে বলেন — বাঃ! দারুণ ভেবেছ তো। এটাই তো অনুসন্ধিৎসা, যা বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য প্রাথমিক শর্ত! তোমার মনে যে এমন ধরনের ভাবনা এসেছে, এটাই তোমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তোমার লক্ষ্যে। তবে সুমন, তোমার জেনে রাখা দরকার, এমন এক ছোট্ট যন্ত্র এর মধ্যে আবিষ্কার করে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা।
সুমনের চোখেমুখে হতাশার ছাপ — যাঃ! এটাও হয়ে গেছে।
কাকু সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বলেন — তাতে কী! আবিষ্কারের কি শেষ আছে! এই যন্ত্রকে তুমি আরও উন্নত থেকে উন্নততর করতে পার। সেটাও তো একটা আবিষ্কার।
তিতলি শুধোয় — কাকু! সত্যিই কি পড়ার গতি বাড়ানোর যন্ত্র আছে?
হ্যাঁ, আছে তো! সিনেমায় যাঁরা অভিনয় করেন, তাদের কাজে লাগে। যন্ত্রটা আর কিচ্ছু না, একটা উন্নতমানের কনট্যাক্ট লেন্স। যেটা চোখের মণিতে লাগিয়ে নিতে হয়।
কনট্যান্ট লেন্স কীভাবে পড়ার গতি বাড়ায় কাকু?
বলছি বলছি। শোন মন দিয়ে। তার আগে বল তো সুমন, কোনও বস্তু দেখার সময় বস্তুটা দৃষ্টিপথ থেকে সরে গেলেও সেই বস্তুর প্রতিবিম্বটা চোখের রেটিনায় কতক্ষণ থাকে?
সুমন একটু ভেবে বলে — এক সেকেন্ডের দশভাগের একভাগ সময় প্রতিবিম্বটা থাকে।
র-র-রাইট! ঠিক বলেছ। এই সময়ের মধ্যে আবার যদি বস্তুটা সেই অবস্থানে চলে আসে, তাহলে তার স্থান পরিবর্তন বোঝা যায় না। যেমন খুব জোরে ফ্যান ঘুরতে থাকলে মনে হয় ফ্যানটা ঘুরছে না। কিংবা আস্তে ঘুরছে।
হ্যাঁ কাকু! ইনডাস্ট্রিয়াল মিউজিয়ামে দেখেছিলাম প্রচণ্ড জোরে ফ্যানটা ঘুরছে, অথচ দেখে মনে হচ্ছে থেমে রয়েছে।
হ্যাঁ, এটা হয় রেটিনা বা অক্ষিপটে কিছু সময় ফ্যান-ব্লেডের প্রতিবিম্বটা থেকে যাওয়ার জন্য। তো ওই কনট্যাক্ট লেন্স-এর কাজ হলো রেটিনার ওই প্রতিবিম্ব-ধারণ ক্ষমতার সময়টাকে বাড়িয়ে দেওয়া। যদি রেটিনাতে প্রতিবিম্বটা একটু বেশি সময় থাকে, তাহলে মস্তিষ্ক সেটা অনুধাবন করতে পারে সহজেই। এছাড়া ওই বিশেষ ধরনের লেন্স-এর আর একটা কাজ হলো — চোখের ওয়াইডনেস বা দৃষ্টির ব্যাপ্তিটাকে বাড়িয়ে দেওয়া।
এখন ওই লেন্স লাগিয়ে তুমি একটা লাইনের পরিবর্তে একঝলকে একটা অনুচ্ছেদ দেখে নিতে পারবে। আর সেটা লেন্স-এর কারিকুরিতে একটু বেশি সময় অক্ষিপটে থাকবে। মগজও সেটা পড়ে নিতে পারবে সহজে। অর্থাৎ তখন তুমি একনজরে এক লাইনের পরিবর্তে এক অনুচ্ছেদ পড়ে ফেলতে পারবে।
সুমন উচ্ছ্বসিত — দারুণ তো কাকু! কী নাম ওই লেন্স-এর।
ওটার নাম র্যাপিড রিডিং লেন্স। সংক্ষেপে আর আর এল। তবে, এটার আর একটা ব্যবহারিক নামও আছে। সেটা হলো — স্পিডভিশন। বাংলায় বলা হয় দ্রুতদর্শন।
তিতলি বলে ওঠে — আচ্ছা ছোটকাকু! সিনেমার অভিনেতাদের ওই লেন্স কী কাজে লাগে?
এটা বুঝতে পারছ না পেরজাপতি! অভিনয় করতে গেলে কখনও সখনো একনাগাড়ে অনেকখানি সংলাপ বলতে হয়। সবটা মুখস্ত করে বলা অনেক সময়ের ব্যাপার। তাই ওই স্পিডভিশন লেন্স চোখে লাগিয়ে, সংলাপ বলার ঠিক আগের মুহূর্তে স্ক্রিপ্ট-এ একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই বেশ কিছুক্ষণ চোখে ভাসে অক্ষরগুলো। ব্যস! তখন সেই সংলাপ খেলিয়ে বলা যায়।
সুমনের চোখেমুখে উত্তেজনা — আচ্ছা কাকু! ওই দ্রুতদর্শন লেন্স চোখে লাগিয়ে বই পড়লে মুখস্ত হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি?
না, তা হবে না। মুখস্তটা তো মস্তিষ্কের ব্যাপার। এটা শুধু পড়ার গতিবেগকে বাড়িয়ে দেয়। তাৎক্ষণিক ব্যাপার।
তিতলি মজা করে বলে — ভাই! তুই কাকুকে বল তোকে একজোড়া ওই 'দ্রুতদর্শন' কিনে দিতে। তাহলে তোর ওই একগাদা বই তিনমাসে পড়ে ফেলতে পারবি। তবে, বিবেকানন্দর মতো সেগুলো মগজে ধরে রাখতে পারবি না, এটাই যা আফসোস।
সুমন দিদিকে ভেংচিয়ে ওঠে — হুঁ! এটাই যা আফসোস! তোমার মুন্ডু।
(ক্রমশ)
প্রবাসে দুর্গাপুজো
বন্দনা সেনগুপ্ত
আমার ছোটবেলা এবং মেয়েবেলা কেটেছে জামশেদপুরে।
শিল্প নগরী জামশেদপুরের নাম শুনেছ নিশ্চয়ই। অধুনা এই শহরটি ঝাড়খন্ডে পড়লেও, তখন বিহারের ধলভূম জেলায় পড়ত। প্রথম থেকেই এখানে বাঙালির সংখ্যাধিক্য। আর, হবেই বা না কেন! ময়ূরভঞ্জ জেলায় যে প্রভূত লোহার আকর আছে, সেকথা তো একজন বাঙালি, শ্রীযুক্ত পি এন বোস মহাশয়, মিস্টার জামশেদজি টাটাকে জানান। তারপরেই তো সেই জঙ্গল কেটে প্রথমে কারখানা ও পরে বসতি স্থাপন করা হয়। তখন থেকেই রুজি রোজগারের প্রয়োজনে ওখানে ঢল নামে বাঙালিদের। বলতে না পারলেও, ওখানে মোটামুটি সবাইই বাংলা বুঝতে পারে। বাংলা স্কুলও আছে। রবীন্দ্র ভবন আছে। সব সময় না হলেও, প্রায়ই বাংলা সিনেমাও দেখা যায়। ইস্কুলে ইস্কুলে রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী উদযাপন হয়।
এই পরিবেশে আমার ক্রমশ বড় হয়ে ওঠা। বাংলা স্কুলে পড়ি। দিব্যি আছি বন্ধু বান্ধব নিয়ে। বছরে একবার পিকনিক হয়। কখনও সুবর্ন রেখা নদীর তীরে। কখনও সুবর্নরেখা আর খরকাই নদীর সঙ্গম দোমোহনীতে। পয়লা বৈশাখেও বেশ মজা হয়।
আসল মজা দুর্গাপুজোয়। পঞ্চমীর দিন ক্লাস করে ছুটি হয়ে যেত। চতুর্থী শনিবার পড়লে একদিন বেশী ছুটি পাওয়া যেত। আর, সেদিন কিন্তু বেশি পড়াশুনা হত না। দ্বিতীয় অর্ধে একটু গান বাজনা হত, মাস্টার মশাইরা একটু দেবীমাহাত্ম্য ইত্যাদি বলতেন। প্রথম অর্দ্ধ যেত প্রস্তুতিতে। তারপর স্কুল খুলবে একেবারে ভাই ফোঁটার পরে। কি মজা, বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই। শুধু যে লম্বা ছুটি তাই নয়, এখনের মত স্কুল খুলেই পরীক্ষার চাপও ছিল না।
পুজোর অন্তত এক মাস আগে থেকে শুরু হত কেন কাটা। কারখানায় বোনাস পাওয়া যেত। যখন এক দম কমে গেছিল, তখনও এক মাসের মাইনে বোনাস দিত। কি মজা, তাই না! কিন্তু, সেটা পাওয়া যেত পঞ্চমী বা ষষ্ঠীর দিন। (হয়ত সামান্য আগেও হতে পারে, এত দিন পরে সঠিক মনে নেই)। তাই বেশির ভাগ বাড়িতেই আগে কেনাকাটা শুরু করে দিত। যা সামান্য জমা থাকত, তাই দিয়েই শুরু হত। অথবা, ধার বাকিতে কেনা হত। বোনাস পেলে শোধ দেওয়া হত।
মনে রাখতে হবে তখন কিন্তু মাগ্যি গন্ডার দিন। প্রায় কারুর কাছেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা পয়সা থাকত না। তাই এই পুজোর সময়েই সারা বছরের মত জামা, জুতো, ছাতা, সাজু গুজুর জিনিস পত্র, হিসেব করে করে সব কিনতে হত। শুধু তো নিজেদের জন্যেই নয়, আত্মীয় স্বজনদের দেওয়া থোওয়ার সময়ও ছিল এটাই। যাদের বাড়িতে বড় মেয়ে থাকত তারা এর মধ্যেই কষ্ট করে একটু সোনা কিনতে চাইত। মোট কথা ভাদ্র আশ্বিন মাস থেকে নিয়ে শুরু হয়ে যেত পুজোর প্রস্তুতি। দোকান পসারগুলিতেও লাগত সাজো সাজো রব। এটাই তো তাদেরও ব্যবসার সময়। সারা বছরের বিক্রি বাটার বেশিটাই তো এই সমযটুকুতেই হত।
তখন রেডিমেড জামা কাপড়ের বেশি চল ছিল না। দর্জি দিয়ে বানাতে হত। তার মানেই হল দর্জির কাছে দৌড়াদৌড়ি। জানোই তো দর্জি আর মুচির কথার কোনও ঠিক নেই। আজকাল তো আমরা মোবাইলে খবর নিয়ে তারপর ডেলিভারি নিতে যাই। তখন তো আর সেই সুবিধা ছিল না।
আমাদের বাড়িতে অবশ্য আমার মাসী বানাতেন। আমি জন্মের আগেই পিতৃহারা, তাই মাসী, দাদু আর দিদিমনির কাছেই মানুষ। তা মাসী খুব ভালো সেলাই জানতেন। উনি কাপড় কিনে এনে আমার জামা ফ্রক স্কার্ট ইত্যাদি বানিয়ে দিতেন। যখন প্রথম চুড়িদার বা সালোয়ার কামিজ এল, তাও বানিয়ে দিয়েছেন। একটু বড় হওয়ার পর থেকে পুজোর সময় একটা করে শাড়ি দিতেন, তার পেটিকোট ব্লাউজ ইত্যাদিও উনিই বানাতেন। বিভিন্ন ফ্যাশন ম্যাগাজিন বা কাগজ দেখে দেখে ডিজাইন করতেন। ওই ভাবেই সোয়েটার কার্ডিগান বা কাজ করা শালও বানাতেন। সবার এই সৌভাগ্য না হলেও, খরচ কমানোর জন্য অনেকেই অন্তত ঘরে পরার জামা কাপড় বাড়িতেই বানিয়ে নিত। বাইরে বা অনুষ্ঠানে পরার জন্যে একটি দুটি দর্জিকে দিয়ে বানিয়ে নিত। তখন প্রত্যেক অনুষ্ঠানে নতুন পরার চল ছিল না। আবার, এই সময়েই আত্মীয়রাও সবার জন্য না পারলেও, অন্তত ছোটদের জন্যে নতুন জামা কাপড় উপহার দিতেন। এই ভাবে প্রায় প্রত্যেকেরই পুজোর সময় বেশ কয়েকটি করে নতুন জামা হয়ে যেত। আমরা ছোটরা প্রতিদিন জামাগুলি দেখতাম আর প্ল্যান করতাম কোনদিন কোনটা পড়ব। তবে সবচেয়ে ভালোটা থাকত অষ্টমীর অঞ্জলীর জন্য। আর, সেই বিশেষ রাতটির জন্য।
জামশেদপুরে অনেকগুলি দুর্গা পুজো হত। কালি মন্দিরগুলোতে পুজো হত। বিহারী অ্যাসোসিয়েশন ও উড়িয়া অ্যাসোসিয়েশনগুলিতে পুজো হত। অনেক গুলি বাঙালি পুজো হত।
আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে একটা মন্দির ছিল। গৌড়ীয় মঠের রাধা কৃষ্ণের মন্দির। সেখানের খানিকটা জমি নিয়ে একটা শিব মন্দির ছিল। তার সংলগ্ন ছিল এক বেশ বড় নাট মন্দির। সেখানেই দুর্গা পুজো হত। পুজোর কমিটি থাকলেও দুজন কাকু এই বিশাল কর্ম যজ্ঞ পরিচালনা করতেন, পাড়ার লোকজন বিশেষত কিশোর ও সদ্য যুবক ছেলেরা সাহায্য করত। মাসখানেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত চাঁদা তোলা। মূর্তি ওখানেই বানানো হত। আমার অবশ্য বিশেষ একটা ঠাকুর বানানো দেখতে যাওয়া হত না, কারণ স্কুলে এবং পড়ায় ব্যস্ত থাকতে হত। পঞ্চমীর দিন ছুটি হয়ে গেলে তারপর আর পায় কে! বন্ধুরা কেউ থাকলে তো ভালই, নাহলে একাই দৌড়। ওই মন্দিরে আমার খুব যাতায়াত ছিল। আমাদের বাড়িতে অনেক ফুল হত গরমের সময় জবা আর বেলিফুল এবং পুজোর সময় স্থল পদ্ম আর শিউলি অনেক ফুটত। একটু বড় হওয়ার পর থেকেই আমি সেই ফুল মন্দিরে দিয়ে আসতাম। তাই মন্দিরের পুরোহিত এবং সন্ন্যাসীরা আমাকে খুব ভালো চিনতেন ও ভালোবাসতেন। তাই আমি সহজেই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে যেতে পেরেছি। আর, তাছাড়া আমার খুব ভালও লাগে পুজোর কাজ। ছোটবেলায় তো শুধু ফুল পৌঁছে দিতাম। একটু বড় হয়েই পুজোর কাজে জুটে যেতাম। সে পুজোর থালা সাজিয়ে রাখা হোক, প্রণামী সংগ্রহ করা হোক, ফুল ধুয়ে গুছিয়ে দেয়া, মালা গাঁথা, ভোগের সবজি কাটা, সবেই হাত লাগিয়েছি। এটা ছিল সকাল বেলার প্রোগ্রাম। তারপর অঞ্জলী দেওয়া, ফলপ্রসাদ বিতরণ, প্রসাদ খেয়ে বাড়ি। ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম। উত্তেজনায় ঘুম তো আসত না। বিকেল হতেই নতুন জামা পরে সেজেগুজে রেডি। ঠাকুর দেখতে যাওয়া হবে। আমি, মাসী আর দিদিমনি একসঙ্গে যেতাম। এক এক দিন এক এক দিকে যাওয়া হত। আমাদের পাড়াতেই আমাদের মন্দিরের পুজো ছাড়াও, একটা বিহারী অ্যাসোসিয়েশন আর একটা উড়িয়া অ্যাসোসিয়েশনের পুজো ছিল। তাছাড়া আরেকটা বারোয়ারী পুজো ছিল। প্রত্যেকটা পুজোর সঙ্গেই ছোট্ট করে মেলা বসত। কিছু খাবারের দোকান, কিছু খেলনা, ফুচকা, ইত্যাদি। কিন্তু, একটা এরিয়ার মধ্যে চারটে পুজো! বুঝতেই পারছ কি জমজমাট ব্যাপারটা হত। তখন কিন্তু মাইকের উপদ্রব একেবারেই ছিল না। পরের দিকে অঞ্জলীর আগে সকলকে ডাকার জন্যে আর মন্ত্র পাঠের জন্যে মাইকের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। একদিন বন্ধুদের সঙ্গে বেরোনো হত। একদিন কালী মন্দিরগুলোতে যাওয়া হত। একদিন বিশেষ বিশেষ নামকরা পুজোগুলিতে যাওয়া হত।
সন্ধ্যার দিকে থাকত আরতি, ধুনুচি নাচ, দেদার আড্ডা। বেশি রাতের দিকে যাত্রা থাকত। অন্তত এক দিন তো থাকতই, চাঁদা ভাল হলে বেশীও থাকত।
এইভাবেই নবমী এসে যেত আর শুরু হত বিজয়ার প্রস্তুতি। নারকেল কুরিয়ে নাড়ু হত। চিঁড়ে, বেসন, বাদাম সব মিলিয়ে সুস্বাদু চানাচুর বানানো হত। কুচো নিমকি, গজা হত। বুঁদে বা মিহিদানার লাড্ডু বানানো হত। বিজয়ার দিন কোন কোন বছর পাটিসাপটা বা অন্য কোন পিঠে হত। কখনও বা লুচি ঘুগনি বা আলুর দম অথবা ছোলার ডাল হত।
দশমীর দিন দর্পণে বিসর্জনের পর ছিল ঠাকুরের পায়ে বই খাতা ছুঁইয়ে তাঁর আশীর্বাদ নেয়া। বড়দের মধ্যে হত সিঁদুর খেলা। তখনও অনেক মিষ্টি খাওয়া হত। বিকেল হতেই যেতাম ভাসানের মিছিল দেখতে। সব ঠাকুর এক জায়গায় জড়ো হয়ে প্রসেশন করে যেত ভাসানের ঘাটের দিকে। সারা রাস্তায় দুধারে নামত মানুষের ঢল। আর, শেষ দিনের মেলা। আমরা সন্ধ্যে সন্ধ্যে ফিরে আসতাম।
এবার শুরু হবে বিজয়া। পাড়ার সবাই সবার বাড়ি যেত, এমনকি অবাঙ্গালীরাও। সবার অফিসের লোকজন আসত। আমরাও যেতাম। বুঝতেই পারছ, এ পর্ব একদিনে সাঙ্গ হবার নয়। কখনও কখনও লক্ষ্মী পূজা গড়িয়ে যেত, বিজয়া সারতে।
তাই আমাদের পুজোর আনন্দ পুজো আসার অনেক আগে আরম্ভ হয়ে পুজোর অনেক দিন পর পর্যন্ত চলত।
ফণীরাজের খেতাব / স্বপ্ননীল রুদ্র
সত্তরে পুরো ফিট ফণীরাজ সরকার
গাছে উঠে তাল পাড়ে, নেই কোনও ভয় তার
দড়ি বেঁধে দুই পায়ে তরতর উঠে যায়
মগডালে পৌঁছেই একখানি বিড়ি খায়
তাল পাড়ে টপাটপ, গোটা গোটা কাঁদি কাঁদি
টাকেতে বরফ রাখে, আরামে ঠাণ্ডা চাঁদি
গ্রামে সেরা তার তাল, একবার কেউ যদি
বড়া ভেজে খায় তবে ভাসবে সুখের নদী
তালগাছে উঠবার আগে ফণী লোক ডাকে
চায় সে বাড়ুক ভিড়, ধরে আনে একে তাকে—
'গাছে উঠবার খাসা ছবি ও ভিডিও চাই
ফেসবুকে হবে পোস্ট প্রতিদিন দু'বেলাই'
পোস্ট ও স্ট্যাটাস দেখে বন্ধুরা হতবাক
কেউ বলে, 'স্কিলফুল', কেউ বা 'খতরনাক!'
'ফণী তো সুপারম্যান', কেউ বলে, 'দ্যাখো খেল!'—
গিন্নি ইমোজি দেয়, 'কাঠবিড়ালিও ফেল...!'
বড়ো গল্প
অর্ধেন্দু স্যার ও গুরুদেব
তপশ্রী পাল
অর্ধেন্দু মুখুজ্জে বছর ছাব্বিশের যুবক। ঝকঝকে চেহারা, চটপটে বুদ্ধি। এম এ, বি এড পাশ করেই সোনাডাঙ্গার একমাত্র সরকারী ছেলেদের স্কুলে চাকরী পেয়ে গেলেন। কয়েকমাসের মধ্যেই স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে অর্ধেন্দু স্যারের পপুলারিটি দারুণ! স্যার কি স্মার্ট! কি সুন্দর ইংলিশ বলেন! কতো সহজে চটপট সব বুঝিয়ে দেন! সব ছেলেদের সঙ্গে স্যারের বন্ধুর মতো সম্পর্ক! একটু উঁচু ক্লাসের ছেলেদের আইকন হলেন স্যার! ছেলেরা অর্ধেন্দু স্যারের মতো চুল কাটতে লাগলো, হাঁটতে লাগলো স্যারের মতো, বাঁ হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে! এমনিতে তো সোনাডাঙ্গার এই বয়েজ স্কুলের খ্যাতি চতুর্দিকে, প্রত্যেক বছর খুব ভালো রেজাল্ট করে স্কুল, তার ওপর নতুন টিচারের জন্য সুনাম আরো ছড়িয়ে পড়লো! এক বছর কেটে গেলো। প্রচুর ছেলের ভর্তির দরখাস্ত পড়তে লাগলো আসপাশের সব ছোটবড়ো জায়গা থেকে। হেড স্যারও খুব খুশী।
কিন্তু অন্য টিচাররা বেশ হিংসে করতে লাগলেন অর্ধেন্দু স্যারকে। তার মধ্যে প্রধান হলেন অংক স্যার গোলোকবাবু । ঝাঁটার মতো গোঁফে তা দিতে দিতে, সদ্য পাড়া বেলের মতো চকচকে টাকে হাত বুলোতে বুলোতে, গোলোকবাবু ফন্দি আঁটতে লাগলেন অর্ধেন্দু স্যারকে জব্দ করার। একদিন স্টাফরুমে ফাঁকা পেয়ে অর্ধেন্দু স্যারকে বললেন “মাস গেলে ভালোই তো মাইনে আসছে পকেটে! বিয়ে টিয়ে করেননি, কোন ঝক্কি নেই – এই তো টাকা জমানোর বয়স!” অর্ধেন্দু স্যার সরল ভাবে ঘাড় নেড়ে বললেন “হ্যাঁ, জমাই তো, ব্যাঙ্কে আর পোস্টঅফিসে একখানা করে বই খুলেছি।“ “ভায়া, ওখানে আর ক পয়সা সুদ? সারা জীবন জমিয়েও কিস্যু হবে না! টাকা ঢালতে হয় মার্কেটে! একেবারে সিঁড়িভাঙ্গা অংকের মতো টাকা বাড়বে !” বলেন গোলোক স্যার। “মার্কেটে বলতে?” অর্ধেন্দু স্যার চোখ গোল করে বলেন। “আরে মার্কেটে মানে শেয়ারে! বেছে বেছে শেয়ার কিনবে! এই আমি যেমন কিনি আর কি! কদিন পরেই সেই শেয়ারের দাম পাঁচ টাকা থেকে বেড়ে পঞ্চাশ টাকা হয়ে যাবে! হুঁহুঁ বাবা, দেখে বুঝবে না! নোংরা জামা পরে চালাই! কিন্তু দেশে দশ বিঘে জমি কিনে ফেলেছি এই শেয়ার কেনা বেচা করে! বাড়িও করিচি একখানা! একদিন নিয়ে যাবোখন! দেখবে!” চোখ অর্ধেক বুজিয়ে বলেন গোলোক স্যার।
অর্ধেন্দু স্যারের ভারী ইচ্ছে একখানা ঝাঁ চকচকে গাড়ি কেনেন! কিন্তু স্কুলে কাজ করে আর পোস্টফিসে টাকা জমিয়ে কতদিনে যে সেই স্বপ্নপূরণ হবে কে জানে? অর্ধেন্দু স্যার রাজী হয়ে যান গোলোক স্যারের প্রস্তাবে। গোলোক স্যার শেয়ার বেছে দেন আর অর্ধেন্দু স্যার কেনেন। প্রথম প্রথম বেশ লাভ হলো এক দুটো শেয়ার কিনে বেচে! উত্তেজিত হয়ে স্যার আরো বেশী কিনতে লাগলেন গোলোক স্যারের কথামতো! তারপর হঠাত মার্কেট গেলো ধপ করে পড়ে আর সঙ্গে সব টাকা ভোজবাজীর মতো হাওয়া হয়ে গেলো অর্ধেন্দু স্যারের। স্যার কাঁদো কাঁদো হয়ে গোলোক স্যারকে বললেন “এটা কি হোলো গোলোকবাবু! আমার এতো কষ্টের উপার্জন সব হাওয়া হয়ে গেলো যে!” গোলোকস্যার বললেন “সবই আপনার ভাগ্যের দোষ! মার্কেটে ওঠা পড়া আছেই! চিন্তা নেই – আপনাকে গুরুদেবের কাছে নিয়ে যাচ্ছি!”
২
গোলোক স্যারের সঙ্গে অর্ধেন্দু স্যার বারাসত ছাড়িয়ে নকুড়্গঞ্জে গেলেন গুরুদেবের সন্ধানে। নকুড়গঞ্জের হাট ছাড়িয়ে এক কালীমন্দির লাগোয়া গুরুদেবের বিশাল বাড়ি। গোলোক স্যার বললেন “এ বাড়ি এক বিদেশী ভক্তের দান!” বাড়ির বৈঠকখানার তক্তপোষে দুদিকে বালিশ নিয়ে জমিয়ে বসে এক মধ্য চল্লিশের ভদ্রলোক। কাঁধ পর্যন্ত চুল, মাঝে টেরি করা । বড়ো বড়ো চোখদুটি যেন স্বপ্ন দেখছে । সামনে অন্ততঃ গোটা চল্লিশ লোকের ভীড়! গুরুদেবের এক চ্যালা এক একজন করে নাম লিখে কাগজে একটি করে নম্বর দিয়ে বসতে বলছে। ঐ নম্বর ডাকলে তবে গুরুদেবের সাথে কথা বলা যাবে। গুরুদেব এক একজনের কথা শুনছেন আর মোটামুটি এক মিনিট পরপর ঢেকুর তুলে চলেছেন। কথা শেষে চ্যালার কানে কানে কিছু বলছেন আর চ্যালা তাকে নিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে ওষুধ বিষুধ মাদুলী ইত্যাদি দিচ্ছে। অর্ধেন্দু স্যারের ডাক আসলো প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর। স্যার এগিয়ে গুরুদেবের সামনে গিয়ে বসলেন। তারপর কথাবার্তা খানিক এরকম হলো –
গুরুদেব – (একবার গোলোক স্যারের সঙ্গে চোখাচোখি করে) (ঘ্যাক) অর্ধেক চাঁদ উঠেছে! পূর্ণ চন্দ্র উঠতে এখনো দেরী আছে (ঘ্যাক)!
অর্ধেন্দু – আ-আ-আমার নাম অর্ধেন্দু! কি করে জা-জা-জানলেন?
গুরুদেব – আমি অতীত, আমিই বর্তমান, আমিই ভবিষ্যত! আমার অজ্ঞাত (ঘ্যাক) কিছু নেই! টাকা গেছে? (ঘ্যাক)
অর্ধেন্দু – আজ্ঞে –
গুরুদেব – ঝুঁকি নিয়েছো তাই গেছে! (ঘ্যাক) জীবনে যা করবে – (ঘ্যাক) – অনেক ভেবে – অনেক পরিকল্পনা করে করবে! (ঘ্যাক) ভেবে দেখবে! যাতে এতোটুকুও ঝুঁকি আছে (ঘ্যাক) তা করবে না।
অর্ধেন্দু – (গোলোক স্যারের দিকে আঙুল দেখিয়ে) ও-ও-ওনার কথাতেই তো –
গুরুদেব – ও তো নিমিত্তমাত্র! নিজের বিবেচনার ওপর নির্ভর করবে – (ঘ্যাক) – অন্যের জন্য যা ভালো তা তোমার জন্য ভালো নাও হতে পারে – (ঘ্যাক) – কিসের দাম সবচেয়ে বেশী জানো?
অর্ধেন্দু – না তো!
গুরুদেব – মূর্খ! জীবন! জীবনের দাম সবচেয়ে বেশী! (ঘ্যাক) তাই জীবনকে আগে সুরক্ষিত করো! তোমার মৃত্যুযোগ আছে! তাই জীবনবিমা করো! গোলোক এখন আমার প্রেরণায় জীবনবিমা করায় ! (ঘ্যাক) ও তোমাকে করিয়ে দেবে! আর সবসময় চিন্তা করো – (ঘ্যাক) যা করতে চলেছো তাতে কোন ঝুঁকি নেই তো? থাকলে কোর না। যে জিনিস আসতে চলেছে (ঘ্যাক) তার জন্য পরিকল্পনা করে আগে থেকে তৈরী হও। কিছু হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তা ঘটার সুযোগই দিও না!
অর্ধেন্দুবাবু গুরুদেবের অমৃত বাণী শুনে, ওনার ফি দিয়ে চলে এলেন! তারপর যা টাকাপয়সা ছিলো তা দিয়ে প্রথমেই একটি জীবনবীমা করে ফেললেন! তারপর পাগলের মতো চিন্তা করতে লাগলেন জীবনে আর কী কী ঝুঁকি আছে ।
৩
মাস তিনেক কেটে গেলো। তারপর যা ঘটলো স্কুলে, তা দেখে শুধু হেড স্যার কেন, সব টিচারদের আক্কেল গুড়ুম! হঠাত একদিন, প্রথম ক্লাসের ঘন্টা পড়তেই, দলে দলে ছেলে ক্লাস নাইন টেন থেকে বেরিয়ে বাইরের গেটের দিকে যেতে শুরু করলো। দারোয়ান তাদের আটকে হেড স্যারকে খবর দিতে গেলো! হেডস্যার রেগেমেগে বললেন “কি ব্যাপার! তোমরা কোথায় চললে?” ক্লাস নাইনের অবিনাশ বলে উঠলো “আমরা আর পড়াশোনা করতে চাই না স্যার – তাই বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।“ অবাক বিস্ময়ে হেডস্যার বলেন “মানে!” “স্যার আমরা অনেক বিবেচনা করে দেখলাম, পড়াশোনা করলেই পরীক্ষা দিতে হবে, আর পরীক্ষা দিলেই স্যার, যতই পড়াশোনা করি, খারাপ রেজাল্ট করার বা ফেল করবার একটা সম্ভাবনা তো থেকেই যায় – সেটা তো একটা ঝুঁকি, না স্যার? কারণ নম্বর তো আমাদের হাতে নয়। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রচুর টেনশন! আর আমাদের টেনশন মানেই বাড়ির লোকেরও টেনশন! বিবেচনা করুন -আমাদের নাহয় বয়স কম, বাবা মায়ের তো বয়স হয়েছে – টেনশন থেকে স্যার হার্ট অ্যাটাক হতেই পারে – আর সেক্ষেত্রে স্যার মৃত্যুও হতে পারে! অ্যাতো রিস্ক কি নেওয়া উচিৎ স্যার? জীবনে সময় ও পয়সা ইনভেস্টমেন্ট করা উচিৎ রিস্ক ছাড়া! তাই ঠিক করলাম পড়াশোনা আর করবো না।“ বক্তৃতার ঢঙে বলে চলে অবিনাশ। অন্য ছাত্ররা সবাই ঘাড় দোলায়।
হাঁ হয়ে গিয়ে চোখ পাকিয়ে হেডস্যার বলেন “বটে! আমার সঙ্গে মস্করা হচ্ছে? স্কুল পালিয়ে কোন সিনেমা হলে ঢোকার মতলব না কী? এতোদিন এই স্কুলে পড়ছো, উঁচু ক্লাসে উঠে গেছো – কই এতো অপূর্ব বিবেচনা তো আগে কোনদিন দেখিনি! এক্ষুণি সব ক্লাসে গিয়ে বসো নইলে কিন্তু কাল গার্জেন কল !”
“স্যরি স্যার, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আর, কারো কথায় জীবনের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা উচিৎ নয়।“ বলে ক্লাস টেনের সমীরণ।
সেদিনের মতো ছুটি ঘোষণা করে মেঘের মতো মুখে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডস্যার পরিমল বাবুকে ডেকে পাঠান হেডস্যার। বলেন “পরিমলবাবু, ছেলেদের মাথায় এসব পাগলামো এলো কি করে? কে বলেছে ওদের এসব কথা!”
পরিমলবাবু মাথা চুলকে বলেন “স্যার, আমি দু একজন ছেলের সঙ্গে কথা বলেছি আলাদা করে। সবাই বলছে অর্ধেন্দু স্যার নাকি ওদের কি সব বুঝিয়েছেন!”
চোখ ছোট করে হেডস্যার বলেন “অর্ধেন্দু স্যার! তিনি তো দারুণ শিক্ষক! ছেলেরা তার নামে পাগল! সে ছেলেদের এই সব বলেছে? উঁহু, বিশ্বাস হয় না। দাঁড়াও তো আমি অর্ধেন্দুকে ডাকছি!”
খানিক পরে অর্ধেন্দু স্যার কেমন এক ঘোরের মধ্যে এসে দাঁড়ালেন। কোথায় তাঁর সেই চটপটে ভাব? হেডস্যারের জিজ্ঞাসার উত্তরে অর্ধেন্দু স্যার বললেন “আমি শুধু ছেলেদের বলেছিলাম আমার গুরুদেবের কথা!”
“তোমার গুরুদেব! তিনি আবার কে?” হতভম্ব হেডস্যার বলেন।
হাত জোড় করে মাথায় ঠেকিয়ে অর্ধেন্দু স্যার বলেন “গুরুদেব বলেছেন - জীবনের যে কোন সিদ্ধান্ত প্ল্যান করে নেবে। যে কোন কাজ করার আগে অনেক বিবেচনা করবে । রিস্ক নেবে না! রিস্ক নেবে না! রিস্ক নিলে ডুবে যাবে!” আঙুল নেড়ে কথাগুলো বলতে বলতে পা টেনে টেনে বেরিয়ে গেলেন অর্ধেন্দু স্যার!
হেডস্যার এবার অন্য সব স্যারদের ডেকে পাঠালেন। ভূগোলের স্যার সুধীরবাবু বললেন “স্যার, অর্ধেন্দু স্যারের তো মাথার ব্যামো হয়েছে – জানেন না? মাস কয়েক হলো – নিজের সাইজের চেয়ে অনেক বড়ো জামা পরে স্কুলে আসছেন – সবাই দেখেছে। একদিন জিজ্ঞাসা করতে বললেন “গুরুদেব বলেছেন –সব সময় আগে থেকে প্ল্যান করে, ভবিষ্যতের কথা ভেবে কাজ করতে হয়। বয়স বাড়বেই – আর বাড়লেই মানুষ মোটা হবে - ভুঁড়ি হবে! আর তা হলে জামা লাগবে অনেক বড়ো সাইজের – তা সেই বড়ো সাইজের জামা যখন একদিন পড়তেই হবে – এখন থেকে অভ্যেস করাই ঠিক!”
উত্তেজিত হয়ে বিজ্ঞানের স্যার সুনির্মলবাবু বললেন “ঠিক স্যার! এখন মনে পড়লো! মাসখানেক আগে আমার একটা দাঁতে খুব ব্যাথা হওয়ায় দাঁত তুলতে ডাক্তারের কাছে যাই। সেখানে অর্ধেন্দুবাবুর সঙ্গে দেখা! বললুম ‘দাঁতের ব্যাথা বুঝি?’ বললে ‘না, না বেশ ভালোই আছি।‘ বললুম ‘তা হলে?’ বললে ‘দেখুন সুনির্মলবাবু, গুরুদেব বলেছেন - যে কোন কাজ ভবিষ্যত ভেবে করা উচিৎ। বয়স বাড়লেই দাঁত ক্ষয়ে যাবে, ব্যাথা হবে! সে ব্যাথার ওপর তো হাত নেই। দাঁত থাকলেই দাঁত ব্যাথা। তাই আগে থেকেই সব দাঁত তুলে দিতে চাই। দাঁতও থাকবে না – দাঁত ব্যাথাও হবে না!’”
অংকের স্যার গোলোকবাবু কেমন বিশ্রী খ্যাকখ্যাক করে হেসে উঠলেন ।
হেডস্যার বললেন “না, না এ তো বদ্ধ পাগল! এমন শিক্ষক থাকলে আমাকে স্কুলে তালা লাগাতে হবে! কালই এর একটা বিহিত করতে হবে। অর্ধেন্দু স্যারকে আর স্কুলে রাখা নিরাপদ নয়!”
অচিরেই অর্ধেন্দু স্যারের চাকরী গেলো। অংকের গোলোক স্যারকে সেদিন দ্যাখে কে? স্যার সেদিন দু হাঁড়ি রসগোল্লা কিনলেন। এক হাঁড়ি গুরুদেবের জন্য আর এক হাঁড়ি নিজের বাড়ির জন্য।
৪
চাকরী গিয়ে দু দিন ভারী মুষড়ে পড়লেন অর্ধেন্দু স্যার। তারপর ঠিক করলেন স্কুলের চাকরী আর নয়। খুব মাথা খাটিয়ে অর্ধেন্দু স্যার ঠিক করলেন যে চাকরীতে ঝুঁকি সবচেয়ে কম, চাকরী যাবার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম, তা হলো সরকারী চাকরী! নেহাত চুরি না করলে চাকরী যায় না! অতএব এবার উঠে পড়ে লেগে আই এ এস টা পাশ করতে হবে। নাওয়া খাওয়া ভুলে লেগে পড়লেন অর্ধেন্দু স্যার! আই এ এস-এর পড়াশোনা করতে!
বাড়িতে তো অর্ধেন্দু আর তার বিধবা মা। আর সাত কূলে কেউ নেই। মাকে এসব কথা ঘুণাক্ষরেও বলে নি। বললেই সেই ঝুঁকি! মা কান্নাকাটি শুরু করে দেবে। বিরক্ত করে মারবে জিজ্ঞাসা করে যে কেন চাকরী গেলো। নাঃ এসব ঝুঁকি নেওয়ার কোন মানে হয় না। অর্ধেন্দু মাকে বললো সে সরকারী চাকরীর পরীক্ষা দেবে বলে তিনমাস ছুটি নিয়েছে। কিন্তু কি গেরো! তাতে হলো আর এক বিপদ!
একদিন সকালবেলা অর্ধেন্দু বই খাতা খুলে বসেছেন, এমন সময় মা গরম গরম তালের বড়া ভেজে নিয়ে এসে দাঁড়ালেন! বড়ার গন্ধে চারিদিক ম ম করে উঠলো। তালের বড়া অর্ধেন্দুর বড়ই প্রিয়। তাই তার মনসংযোগ বড়ই বিঘ্নিত হতে লাগলো। অতঃপর অর্ধেন্দু চোখের কোণ দিয়ে একবার মা একবার বড়ার দিকে তাকাতে লাগলেন । এমন সময় মা বলে উঠলেন “নে তোর জন্য গরম গরম কটা তালের বড়া ভেজে আনলাম। জানি তুই ভালোবাসিস –“ তারপর ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন “কিন্তু খুব চিন্তা হয় –“ অর্ধেন্দু স্যার ততক্ষণে বড়া চিবিয়ে গলাধঃকরণ করতে শুরু করেছেন। বললেন “কেন? কেন? চিন্তা কিসের? চিন্তা করা খুব খারাপ। এতে স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার রিস্ক থাকে। আর তোমার শরীর খারাপ হলেই আমার রিস্ক – না না, এসব রিস্ক নেওয়া যাবে না। শীগগিরই বলো তোমার কিসের চিন্তা!” মা এবার বললেন “আমি আর কদিন বাঁচবো? আমার পর তোকে কে এমন বড়া করে খাওয়াবে তাই ভেবেই যত চিন্তা-“
অর্ধেন্দু বুঝলেন মা কোন লাইনে কথা নিয়ে যাচ্ছেন। তাই তাড়াতাড়ি বললেন “না, না আমি কোন রিস্ক নিতে পারবো না। তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেই না। তার আগে আমিই পটল তুলবো!”
মা বললেন “বোকা ছেলে! কেউ কি চিরদিন বাঁচে? তাই সময় থাকতে এবার একটা সুন্দর দেখে বৌ আন দেখি! এই তো এখন ছুটি রয়েছে। এই দ্যাখ আমি কটা মেয়ের ছবি বেছে রেখেছি। যা, দেখে আয়। এরা সব রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী! যাকে তুই পছন্দ করবি তার সঙ্গেই বিয়ে দেবো!”
অর্ধেন্দু ঘোড় আপত্তি জানিয়ে বললেন “না না, সামনে পরীক্ষা! এখন এ সব রিস্ক একদম নেওয়া যাবে না! বিয়ে হলো গিয়ে একটা সারা জীবনের ব্যাপার! সে কি হুট বলতে করলেই হলো?” তারপর চোখ ছোট করে বললেন “বিয়ে করতে হবে অনে—ক প্ল্যান করে! মেয়ে সিলেক্ট করতে হবে অনেক ভেবে চিন্তে! ও সব – মা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। এখন আমি বিয়ে করতে পারবো না।“
মা চোখ পাকিয়ে বললেন “বেশ! তবে এই আমিও বলে রাখলুম। তুই যদি আমার কোন কথা না শুনিস, তবে আমিও তোর এই সংসার দেখতে পারবো না। আমি কাশী, পুরী কোথাও একটা চলে যাবো!”
অর্ধেন্দু স্যার বললেন “বেশ, আমি এর মধ্যে থেকে তোমার যেটা পছন্দ সেই মেয়ে দেখতে যাবো । কিন্তু এক্ষুণি আমি কিছুতেই বিয়ে করতে পারবো না।“
মা ভাবলেন ছেলে একবার দেখতে গেলে এই মেয়ে পছন্দ হবেই আর তখন ঠিক মানিয়ে নেবেন বিয়ের জন্য । বললেন “বেশ, বেশ, তাই হবে।“
নির্দিষ্ট দিনে অর্ধেন্দু গেলেন পাত্রী দেখতে। তারপর এই রূপ কথোপকথন হলো –
“আপনার নাম?”
“পূর্ণিমা”
“এ মা! খুব চিন্তার ব্যাপার! আমার নাম অর্ধেন্দু – মানে অর্ধেক চাঁদ! আর আপনি পূর্ণিমা! উঁহু, মিলছে না, মোটে মিলছে না! পূর্ণিমার সঙ্গে অর্ধেক চাঁদ – না না, একেবারে মিলছে না। রিস্ক থেকেই যাচ্ছে!”
“তালের বড়া বানাতে জানেন?”
“তালের বড়া! না, কই – মানে আমি তো এম এ পড়ছি! আমার তো রান্নাঘরে যাওয়ার বেশী সময়ই হয় না! আর আমাদের বাড়িতে কেউ তাল খায় না!”
“এ মা! আবার ঢ্যাড়া পড়লো! না না এতো একদম প্ল্যান করা যাবে না! আমি তো বিয়ে করতে চাইই না – মানে চাইছিই না! নেহাত মা তালের বড়ার কথা বললো তাই – মানে আমি খুব তালের বড়া ভালোবাসি কি না –“
এবার মেয়ের বাবা বললেন “কি বলছো বাবা? আজকালকার কোন মেয়ে কি তালের বড়া করতে পারে? ও বিয়ের পর শাশুড়ির কাছে ঠিক শিখে নেবে আর কি! তোমার মা আমার স্ত্রীর বন্ধু! আর পূর্ণিমাকে তো দেখলেই! তাহলে আমরা এগোই?”
“না না না, এগোবেন মানে? একেবারে এগোবেন না! প্ল্যান করে সব না ভেবে কোথায় এগোবেন? আমার বয়স সবে আটাশ বছর! তা চাকরী পেতে - ভালো ভাবে ভবিষ্যত প্ল্যান করতে – কি কি রিস্ক আছে ভাবতে – তা বছর দশেক তো কিছুই নয়! তাই এখন যদি আমার পছন্দও হয় তাও অন্তত বছর দশেকের আগে আমি বিয়ে করছি না! ততদিনে আপনি মেয়ের আরো ভালো পাত্র পেয়ে যাবেন – আসি আজকে। আমার আবার অনেক পড়া বাকি!” বলে অর্ধেন্দু কেটে পড়লো।
অচিরেই অর্ধেন্দুর বিয়ের চিন্তা ত্যাগ করলেন মা!
৫
কঠোর অধ্যাবসায়ে পড়াশোনা করে আই এ এস পাশ করলেন অর্ধেন্দু ! পড়াশোনায় মাথা তো তার কোনদিনই খারাপ ছিলো না! অতএব সহজেই উড়িষ্যার গোপালপুরে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরী পেয়ে গেলেন। কিন্তু গুরুদেবের প্রভাবে এরপর যা ঘটলো তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলো না!
গোপালপুরে পোস্টিং পেয়ে অর্ধেন্দু তো খুব খুশী! যাক কলকাতার হিংসুটে লোকগুলোর থেকে তো বাঁচা গেলো! অর্ধেন্দু ভাবলেন এই দায়িত্ব পালনের জন্য এই জেলাটাকে খুব ভালো ভাবে জানতে হবে! জানতে গিয়ে দেখলেন এই জেলা সমুদ্রের একেবারে লাগোয়া! অতীতে বহুবার এখানে বন্যা, সুনামী ইত্যাদি হয়েছে! প্রচুর লোকের মৃত্যু হয়েছে! অর্ধেন্দুর তো মাথায় হাত! এ তো রিস্কই রিস্ক! এতো রিস্ক নিয়ে তিনি চাকরী করবেন কি করে! গুরুদেব বলেছেন জীবনে সবকিছু বহু আগে থেকে প্ল্যান করে করতে হবে! কোন রিস্ক নেওয়া চলবে না! অনেক কষ্টে এই সরকারী চাকরী পেয়েছেন! কোন কারণেই তা হারাতে রাজী নন অর্ধেন্দু। অতএব, এই রিস্ক যে করেই হোক কমাতে হবে। কী করে? কী করে? ভেবে ভেবে অর্ধেন্দু রোগা হয়ে গেলেন।
তারপর ঠিক করে ফেললেন পরিকল্পনা। এই জেলার সব বাসিন্দা, যারা সমুদ্রের কাছাকাছি থাকেন তাঁদের সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে এক্ষুণি! একজন লোকও নীচু এলাকায় থাকবেন না। যে কথা সেই কাজ! বড় বড় মাইক নিয়ে চারিদিকে ঘোষণা হতে লাগলো যে যারা সমুদ্রের কাছাকাছি বাস করেন তাঁদের সবাইকে উঠে যেতে হবে। লোকজন তো অবাক হয়ে গেলো! কই কোন ঝড়ের ঘোষণা তো নেই! বৃষ্টি নেই বাদল নেই! অকারণে তাঁরা বাড়িঘর ছেড়ে, চাষবাস ছেড়ে যাবেন কোথায়? সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে গুজগুজ ফুসফুস করতে লাগলেন। কিন্তু অর্ধেন্দু অটল। সবাইকে সরিয়ে তবে তার শান্তি! কিন্তু এতো লোক যাবে কোথায়? সব স্কুল, কলেজ, মন্দির, মসজিদ ভরে যেতে লাগলো! গ্রামকে গ্রাম ভূতের মতো জনশূণ্য হয়ে যেতে লাগলো।
অচিরেই খবর গেলো মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। তিনি ছুটে এলেন! দেখলেন সত্যি এই কান্ড! তিনি অর্ধেন্দুকে ডেকে পাঠালেন। অর্ধেন্দু সব রিস্ক বর্ণনা করে লোকজনের জন্য অন্য নিরাপদ জায়গা চাইলেন। মুখ্যমন্ত্রী বললেন “আপনি কি পাগল? ভারতবর্ষে কোটি কোটি মানুষ! তাঁদের জন্য অন্য জমি কোথায় পাওয়া যাবে? নিজের জমি লোকে ছাড়বে কেন? কোন ঝড়ের পূর্বাভাষ ছাড়া এরকম কাজ আপনি করেছেন কেন?”
অর্ধেন্দু তার গুরুদেবের উপদেশাবলী ব্যাখ্যা করতে যাচ্ছিলেন! মুখ্যমন্ত্রী দু একলাইন শুনে বললেন “আপনি আমার জন্য এক বড় রিস্ক! তাই এক কথায় আপনি এই মূহূর্তে রাজ্য ছেড়ে চলে যান! আপনার মাথার ঠিক নেই! আপনাকে আমি লম্বা ছুটিতে পাঠালাম! এই কাজ আপনার জন্য নয়!”
কি যে ভুল করেছেন যার জন্য এতো প্ল্যান করে পাওয়া তার সরকারী চাকরীটি যাওয়ার মুখে তা বুঝতে না পেরে অর্ধেন্দু কলকাতায় ফিরে এসে গুরুদেবের কাছে ছুটে গেলেন।
উদ্ভিদবিদ জানকী -- তোমরা তাকে জান কি?
মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস
স্বাধীনতার সূর্য তখনও পায় নি দেশে প্রকাশ,
একশ জনেও একটি নারী
চিনতো না বই কলম খড়ি!
ঘরকন্যাই জীবন মরণ
বাধ্য হয়ে করতো বরণ,
ভারতীয় নারীর জন্য কোথায় শিক্ষা-বিকাশ?
জানকী আম্মাল ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া,
উনিশটি ভাই বোনের মাঝে
মগ্ন হলেন পড়ার কাজে,
কেরালার সেই মেধাবী মেয়ে
উঠলো বেড়ে আকাশ চেয়ে,
উদ্ভিদ বিজ্ঞানে হলো স্নাতকোত্তর সারা।
মিচিগানের পাঠশেষে যোগ দিলেন শিক্ষকতায়,
মাদ্রাজের উওম্যানস্ কলেজে
থাকতে থাকতে ডাক এলো যে
মিচিগানে আবার যাওয়ার,
সৌভাগ্য ডি এস সি পাওয়ার,
জীবনব্যাপী কর্মকাণ্ডে হলেন এবার রতা।
শিক্ষকতা ছেড়ে দিলেন গবেষণায় যোগ,
দেশি আখের মিষ্টতা কম,
আমদানি হয় হরেক রকম,
সুগারকেন ব্রিডিং স্টেশন
কোয়াম্বাটুরে নিযুক্ত হন,
গবেষণায় কমলো আখ-চাষীদের দুর্ভোগ।
বাগানবাসী উদ্ভিদদের ক্রোমোজম ম্যাপ করে
লন্ডনে বসে লিখলেন বই,
ডালিংটন সহযোগী-সই,
জন ইনস্ , রয়েল হর্টিকালচার
হলো তার প্রিয় গবেষণাগার,
পলিপ্লইডি থাকে কাজের সিংহভাগ জুড়ে।
কলচিসিনের প্রয়োগে হলো দুরন্ত কামাল,
ম্যাগনোলিয়ার নতুন জাতি
হয় নি তো আর রাতারাতি!
ইংল্যান্ডের কিউ বাগানে
আজও ফোটে ভোরের গানে
তাজা ম্যাগনোলিয়া কোবুস জানকী আম্মাল।
আবার ফেরা দেশের টানে স্বাধীনতার পর,
দেশ বিদেশের নানা সম্মান,
পদ্মশ্রীর পদক মহান
লাভ করেও মহীয়সী
শেষ বয়সে প্রায় সন্ন্যাসী,
বিজ্ঞানের সাধনাতে হয় না যে নড়চড়।
উদ্ভিদবিদ জানকীকে প্রণাম জানাই আজ,
কুসংস্কার পরাধীনতা,
শুনছি নারীর দুঃখের কথা
আজও যখন দেশে দেশে,
সেই কবে বিজ্ঞানীর বেশে
ফুল ফুটিয়ে জানকী গড়েন নারীর জয়ের তাজ।
(উদ্ভিদবিদ ই. কে. জানকী আম্মাল ১৮৯৭ -১৯৮৪)
ছোটগল্প
পুতুলের বিয়েকাণ্ড
দিলীপকুমার মিস্ত্রী
শ্রীরাধা আর ফতেমা দুই বান্ধবী। দু’জনের মধ্যে একেবারে গলায় গলায় ভাব। ওরা শহরের একটি নামকরা স্কুলে পড়ে। সবে ক্লাস থ্রিতে প্রমোশন পেয়েছে। ওদের এই বন্ধুত্বের বিষয়ে, ওদের বাড়ির লোকজন অবশ্য কেউ কিচ্ছু জানেনা। কারণ ওদের দুজনের মেলামেশা যা হয় সেটা স্কুলে। দুজনের বাড়ি তো ঢের দূরত্বে। আসা-যাওয়াও হয় স্কুলবাসে। তাও আবার দুজনের বাস এক নয়।
শ্রীরাধা আর ফতেমার বন্ধুত্বের কথা সারা স্কুল জেনে গেছে। ওরা দু’জন রোজদিন একবেঞ্চে পাশাপাশি বসে। টিফিনের সময়, একসাথে বসে টিফিন খায়। তাও আবার বাড়ি থেকে আনা টিফিন দু’জন নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে। স্যার-ম্যাডাম ওদের একজনকে কোন কারণে শাস্তি দিলে অপরজনের চোখে জল টল্-টল্ করে। ওদের এসব কান্ড দেখে স্কুলের অনেকেই নানাভাবে ব্যাঙ্গ করে। কেউ কেউ নাক-চোখ কুঁচকে বলে,’দুই ন্যাকাপিসি’।
কিন্তু স্কুলের স্যার-ম্যাডামরা ওদের দু’জনকে খুব ভালোবাসে। প্রিন্সিপালস্যারতো ওদের দু’জনকে না দেখে একদিনও থাকতে পারেন না। তাই নানা অছিলায়, প্রতিদিন অন্তত একবার ওদের দু’জনের ডাক পড়বেই তাঁর ঘরে। অন্য ছাত্রছাত্রীরা প্রিন্সিপালস্যারের ডাক পেলে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে, না জানি কী বিপদে পড়তে হবে। অথচ শ্রীরাধা ফতেমা খবর পাওয়া মাত্র খুশিতে নাচতে নাচতে দে-ছুট্। তাই স্কুলে ওদের হিংসে করার লোকেরও অভাব নেই।
একদিন স্কুলে টিফিনবেলায়,দুইবন্ধু বসে ঠিক করল,তাদের দুজনের দুই পুতুলের মধ্যে বিয়ে দেবে। বন্ধুত্বটা তাহলে আরও আঁটোসাঁটো হবে। শীতটা একটু কমলে হবে বিয়ের অনুষ্ঠান। খুব ঘটা করে হবে পুতুলের বিয়েটা। স্কুলের প্রিন্সিপাল,স্যার-ম্যাডাম এবং ক্লাসের সববন্ধুদেরও নেমন্তন্ন করা হবে। হবে প্যান্ডেল। আলো,ফুল দিয়ে খুব করে সাজানো হবে বিয়ের আসর। সানাই,বাজনাও আনা হবে। একবার শুধু দুইবন্ধু তাদের বাবা-মাকে রাজী করাতে পারলেই হল। ব্যাস,সবকিছু ঠিকঠাক,সময়মতো হয়ে যাবে।
শ্রীরাধা পরদিন বাড়িতে মায়ের কাছে কথাটা পাড়ল। মা সব শুনে, হ্যাঁ না কিছুই বলল না। শুধু গম্ভীরভাবে বলল,’ফেব্রুয়ারি শেষে তোমার অ্যানুয়াল এগজাম। হাতে আর মাত্র আড়াইটা মাস। এখন একটু লেখাপড়ার দিকে মন দাও। মিডটার্মে নেচার-স্টাডিজে তুমি এইট্টি পারসেন্টও পাওনি। সেটা মনে আছে তো ? ইংলিশে নাইন্টির ঘরে থাকলেও বাংলায়, কম্পিউটারে এইট্টির উপরে উঠতে পারনি। বাঙালির মেয়ে, বাংলায় কেন ফুলমার্কস পাবে না ? শুনি তো ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরা একটু চেষ্টা করলে এটা সবাই পেয়ে যায়! তুমি কেন পাবে না শুনি ?’
ফতেমাও যথারীতি বাড়িতে আম্মুর কাছে কথাটা পাড়ল। আম্মু তাকে দু’হাত দিয়ে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরল। খুব করে আদর করল। তারপর তার মুখের দিকে চেয়ে উদাস-চোখে বলল,’পুতুলের সাদি নিয়ে এতো চিন্তা করে কি হবে শুনি ? আর ক’বছর পর আব্বুজান তোমারই সাদির তোড়জোড় শুরু করে দেবে। তখন যতখুশি আনন্দ করে নিও। পুতুলের সাদি নিয়ে অতো মাথাব্যথা করে লাভ নেই ফতু। বরং মন দিয়ে লেখাপড়াটা করে যাও। ভালো রেজাল্ট না করলে,আব্বুজান তোমার সাদিটাই জলদি দিয়ে দেবে। তাই সেটা আটকাতে হলে, প্রতিবছর তোমাকে ভালো নাম্বার নিয়ে পাশ করতেই হবে। এখন সেই চেষ্টাটাই কর।‘
দুইবন্ধু স্কুলে গিয়ে দু’জনের মায়ের কথা নিজেদের মধ্যে শেয়ার করল। দু’জনেরই মনটা একটু খারাপ হল। কিন্তু দু’জনেই ঠিক করল,সামনের এগজামে তারা রেজাল্ট খুব ভাল করবেই। আর সেটা করতে পারলে,তখন তাদের আব্দার বাড়িতে ঠিক টিকে যাবে। তখন আর কেউ আপত্তি করবেনা। দুইবন্ধু জোরকদমে নেমে পড়ল ভাল রেজাল্ট করতে। শেষমেশ তারা সেটা করেও ফেলল। শ্রীরাধা এবং ফতেমা এবার ক্লাস থ্রির ফাইনাল পরীক্ষায় জয়েন্ট-ফার্স্ট।
দু’জনের বাড়িতে এখন উৎসবের পরিবেশ। রোজ কত লোকজন ছুটে আসছে। দু’জনকে কাছে টেনে আদর করছে। অভিনন্দন, শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। এসেছেন স্কুলের স্যার-ম্যাডামরা,প্রিন্সিপালস্যারও। ওদের বাবা-মা, পরিবারের সকলেই তাই ভীষণ ভীষণ খুশি। শ্রীরাধা এবং ফতেমা,দু’জনের বাবা-মা’ই খুশিতে একেবারে টইটুম্বুর। আবেগের বশে তারা মুক্তকন্ঠে ঘোষণা করে দিল,মেয়েকে খুশি করতে তারা কোনভাবেই কার্পণ্য করবে না। তারা জানিয়ে দিল,বাচ্চার যেকোনো আব্দার পূরণ করতে তারা রাজী। ঠিক সেই সুযোগেই দুইবন্ধু জানিয়ে দিল তাদের একমাত্র আব্দারটি- ‘ধুমধাম করে তাদের পুতুলের বিয়েটা দিয়ে দিতে হবে শিগগির।‘
সবই ঠিক ছিল,সমস্যা হয়ে দাঁড়াল বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে। শ্রীরাধার পরিবার চাইছে,পুতুলের বিয়েটা হোক তাদের আচার মতে। আবার ফতেমার বাড়ির লোকজন বলছে,সেটা কি করে হয়! পুতুলের বিয়েটা হোক তাদের আচার মতে। দুই পক্ষই অনড়। অর্থাৎ সামান্য পুতুলের বিয়ে নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে যাবার উপক্রম। বিষয়টি জানতে পেরে,একদিন দুই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আলোচনায় বসলেন,স্কুলের প্রিন্সিপালস্যার। সঙ্গে রইল কয়েকজন স্যার-ম্যাডাম এবং দুইপাড়ার কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষ। আলোচনা সভাটা ডাকা হল স্কুলে।
প্রথমে দুই পরিবারের কথা শোনা হল। শোনা হল প্রতিবেশী,বিশিষ্টজনদের কথাও। সব শুনে প্রিন্সিপালস্যার হাসতে হাসতে বললেন, ‘আপনারা দুটি পরিবারই যথেষ্ট শিক্ষিত, অবস্থাপন্ন এবং সংস্কৃতি-সচেতন। সামান্য শিশুদের পুতুলের বিয়ে নিয়ে আপনাদের এই গোঁড়ামি আমার কাছে সঠিক মনে হচ্ছে না। তাছাড়া,আপনারা প্রতিবছর লক্ষাধিক টাকা খরচ করে, মেয়েদের শহরের সেরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াচ্ছেন। তাতে কী লাভ হবে ওদের ? ভবিষ্যতে,আমাদের এই সমাজইবা কী পাবে ওদের কাছ থেকে ?’
প্রিন্সিপালস্যার একটু থামলেন। তারপর, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজনকে ভেতরে ডেকে সকলের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তাদের দেখিয়ে,তিনি আবার বলতে শুরু করলেন।
‘শ্রীরাধা যার কাছ থেকে পুতুলটি কিনেছে,সেই লোকটি এদের একজন। সে ধর্মমতে ভিন্ন। আর ফতেমা যার কাছ থেকে পুতুলটি কিনেছে,সেও ধর্মমতে ফতেমাদের থেকে ভিন্ন। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়,ওই পুতুলদুটি যার কারখানায় তৈরি হয়েছে,সেই লোকটি ওদের দুই পরিবারের থেকে ভিন্ন ধর্মমতের। তাহলে,এবার আপনারা বলুন তো,পুতুলদের ধর্মটা কী হবে ?’
সবাই চুপটি করে বসে থাকল। কা’রও মুখে কোনও কথা নেই। হঠাৎ শ্রীরাধা-ফতেমা দু’জনে একসাথে লাফিয়ে ওঠল। তারা নাচতে নাচতে,উচ্চস্বরে বলতে লাগল,’পেয়েছি,পেয়েছি, আমরা খুঁজে পেয়েছি। আমাদের পুতুলের জাত-ধর্ম হচ্ছে পুতুল।‘ এরপর তারা আবার তাদের মায়ের কাছে গিয়ে,চুপটি করে বসে পড়ল।
এখনো কা’রও মুখে টু-শব্দটি নেই। প্রিন্সিপালস্যার আবার সকলের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন,’পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির সময় সে কোনও জাতধর্ম নিয়ে জন্মায়নি। এগুলো অনেক অনেক বছর পর আমারাই সৃষ্টি করেছি। আমরা সবাই আসলে জাতিতে একটিই--মানুষ জাতি। আর আমাদের সকলের ধর্ম,সংস্কৃতিও একটিই হওয়া উচিৎ;সেটি হলো— মনুষ্যত্ব লালন এবং পালন। আমরা সবাই যদি নিজেদের এমন করে ভাবতে পারি,তাহলে পৃথিবীতে কোনদিন জাত-ধর্ম নিয়ে কোথাও কখনও সমস্যা দানা বাঁধবে না। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মেকে নিশ্চিতরূপে একটি ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে যেতে পারব,চিরকালের জন্য। প্লিজ, আপনারা একটু ভাবুন। এই ছোট্ট-ছোট্ট শিশুদের মুখের দিকে তাকিয়ে অন্তত--!’
প্রিন্সিপালস্যারের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীরাধা এবং ফতেমার বাবা উঠে দাঁড়াল। দু’জনেই হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে প্রিন্সিপালস্যারের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল। এখন তাদের দু’জনের চোখের পাতায় জল থৈ থৈ করছে। অন্যদের চোখও ছল্ ছল্। কিন্তু কেউ আর কোনও কথা বলতে পারছেনা। প্রিন্সিপালস্যার,শ্রীরাধা ও ফতেমার বাবার কাঁধে তাঁর দু’হাত রেখে একগাল হেসে বললেন,’তাহলে, এবার সমস্যাটা তো মিটেই গেল। আপনারা শীঘ্রই পুতুলের বিয়ের আয়োজনটা সেরে ফেলুন। সেদিন আমরা সবাই গিয়ে,আনন্দ করে আসব ! খেয়েও আসব খুব জমিয়ে।“
শ্রীরাধা ও ফতেমার মায়ের মুখেও এখন লাফিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে মিষ্টি মধুর হাসি। তারাও মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে খুব করে আদর করল। বাঁধভাঙা আনন্দে তারা দু’জনে শেষ পর্যন্ত কেঁদেই ফেলল।
ভাল্লাগেনা কিছু
কুহেলী দাশগুপ্ত
কোন কাজে মন লাগেনা, ভাল্লাগেনা কিছু,
মন চায় না ঘুরতে এমন , বইয়ের পিছু পিছু।
ব্যাগ কাঁধে , ওই ভারি বোঝা এগিয়ে চলি তাই,
আটকে আছি লেখা , পড়া আর মেধা পরীক্ষায়।
মন খুলে চাই বাঁচতে এবার , বাইরে আকাশ নীল,
খোলা মাঠে, সবুজ ঘাসে আলোর ঝিলমিল।
পথের ধারে সেই ছেলেটা ধূলো কাদা মেখে,
মা গেছে তার আনতে খাবার, একলা অমন রেখে!
ক্ষিদের মানে বুঝিনি তো,সাজানো পরিবেশন,
আগলে রাখে চারিপাশে , ভালোবাসার জন।
একলা পথে চলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে যদি,
মন ছুটে ধায় বাড়ির পথে , চক্ষে ভাসে নদী।
অল্পে কাতর অমন হলে, কিসের জীবন দেখা!
ফুল বিক্রির পশরা সাজায়, সেই মেয়েটাও একা।
পথেই যাদের রোজনামচা, জীবন দেখে ভিন্ন,
আমরা কেবল আদর মেখে , তুলছি মুখে অন্ন।
চন্দনের ফেরা
সপ্তদ্বীপা অধিকারী
আজ অষ্টমী। চন্দন এতদিনে রাগে ফেটে পড়ল। বাবাকে বলল--
"ক্লাসে আমার সবার আছে
আইফোন একখানা
আমার কেবল এই পচা ফোন
দেখোনা তা,কানা??"
বাবা বলেন--
" এতো বেশি ফোন দেখে না
আর করো না ক্রন্দন
পড়াশুনার সাথে খেলো
লক্ষ্মী ছেলে চন্দন!"
সে বাবার কোনো কথাই কানে তোলে না!
সে তো অনেক আগে থেকেই বাবা কে বলে রেখেছিল যে এবার পুজোয় তার আই ফোন চাই। চাইই চাই।বাবা বলেওছিলেন যে তিনি চেষ্টা করবেন। কিন্তু আজ তিনি বললেন যে তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন, আই ফোন কিনতে পারেন নি। অনেক দাম! চন্দনের সেই থেকে মন খারাপ। সে রাগ করে খাওয়া বন্ধ করেছে। বাবার সাথে কথাও বলছে না। মা অনেকবার ডেকেছেন খেতে। সে যায় নি। মামাবাড়ি থেকে দিদুন ফোন করেছিলেন। কী কী যেন তিনি বলছিলেন। চন্দন মন দিয়ে শোনেওনি। বরং তার মনটা আরো বিষিয়ে উঠল। মা তার মানে দিদুনকে তার নামে নালিশ করেছেন! চন্দন আরো রেগে টং হয়ে গেল!
তার বাবা ইচ্ছে করলেই একটা আইফোন কিনতেই পারতেন।কিন্তু তা তিনি কিনে দেবেন না! এদিকে সামান্য রাধুনিকেও তিনি অনেক বেশি টাকা দেন,চন্দন সব জানে।সে রেগেমেগে ঘর থেকে বেরিয়ে হনহন হনহন করে হেঁটে চলল।কোথায় যাচ্ছে, কোনদিকে যাচ্ছে কোনো কিছুই সে খেয়াল করল না। বেশ খানিকটা হাঁটার পর তার খেয়াল হয়েছে যে সে পাশের বস্তিতে চলে এসেছে। ইসসস! কী নোংরা এরা! ছিহ! চন্দনের ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল! চারিদিকে নোংরা আর দুর্গন্ধে তার গা যেন গোলাতে লাগল। বাড়িগুলো সব মাটির। কোনো কোনো বাড়ির উপরে খড়ের ছাউনিটুকও নেই।বারান্দায় ছেঁড়া ছেঁড়া আর নোংরা কাপড় বা লুংগি ঝুলছে। ঝুলকালি মাখা ন্যাকড়া টাইপের ঝুলঝুলে জামা পরা একটা মেয়ে একদম হঠাৎ ওর সামনে এসে পড়ল! মেয়েটা প্রচণ্ড হাসছে। হি হি হি হি হি হি। খিলখিল খিলখিল খিলখিল। সে যেন থামতেই পারছে না। চন্দনের মনে হলো এই একফোঁটা মেয়েটা যেন তাকেই ব্যাঙ্গ করছে। এখানে তো কেউ নেই।তাহলে ও হাসছে কেন?? একা একা কি কেউ হাসে??পিছনেও কেউ ওকে তাড়া করছে না! তাহলে ও ছুটছে কেন?? আর মুখে ইচ্ছে করে কি ও কালি মাখেনি?? নইলে মুখটা অতো কালো কেন?? কাজলের মতো?? চুলে জীবনেও তেল বা শ্যাম্পু দিয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না! কী জট পাকানো চুল রে বাবা! সেই চুলই পিঠ ছাপানো। চন্দনের মনে হল এই চুল নির্ঘাত ইচ্ছে করে এমন করা! অথবা ফলস। সে এখানে এসেছে বলে তাকে দেখানোর জন্যই মেয়েটা এসেছে এইরকম সেজে। সে মেয়েটার চুলের মুঠি চেপে ধরে বলল---
" এই মেয়েটা ছুটিস কেন
কে করেছে তাড়া??
পিছনে তোর কেউ কি আছে??
দিস নে কেন সাড়া??"
মেয়েটা ছুটছিল। সেই অবস্থায় চন্দন তার চুলের মুঠি চেপে ধরেছে! ফলে মেয়েটার বেশ ব্যথা লেগেছে। সে চুলের গোঁড়ায় হাত দিয়ে বলে--
"চুল ছেড়ে দে নইলে দেবো
একটা চাটি চটাশ
কী দোষে তুই চুল টেনেছিস
ওরে কুমড়োপটাশ! "
চন্দনের প্রথমে খারাপ লেগেছিল।সে বুঝতে পারেনি যে তার চুল ধরায় এভাবে মেয়েটা ব্যথা পাবে।কিন্তু মেয়েটা তাকে তাই বলে কুমড়োপটাশ বলবে?? শুধু তাইই নয়, সে চন্দনের পেটের দিকে চেয়ে আবার খিলখিল খিলখিল হেসে উঠল।চন্দনের এবার সত্যিই খারাপ লাগল। সে এখন ক্লাস এইট। তাকে দেখে এভাবে হাসা মানে সে ঠিকই বুঝতে পারল! রাগে তার সারা শরীর রি রি করে জ্বলে উঠল।
সে বলল--
"কুমড়োপটাশ নাহয় আমি
তুই তাহলে কীরে!
ফু দিলেই তো উড়ে যাবি
পেত্নি হাড় জিরজিরে! "
মেয়েটা তবুও জোরে জোরে হাসে আর বলে--"কুমড়োপটাশ... কুমড়োপটাশ...! "
চন্দনের এবার বেশ লজ্জা লজ্জা করে। সত্যিই তার কী বেঢপ একটা চেহারা।বাবার কথা মনে পড়ল তার। মায়ের কথাও। তাঁরা কতোবার বলেছেন--"ওরে একটু খেলাধুলা কর।জানিস যারা শহরে থাকে তারা এইরকম খেলার মাঠ পায় না।তারা একটুখানি ঘরেই শরীর চর্চা করে। জিম করে! এভাবে সবসময় মোবাইলে গেম খেলিস না। কার্টুন দেখিস না!"
সে মনে মনে ভাবল, নাহ এবার থেকে একটু কম কম গেম খেলবে। তার চেহারা দেখে কার না হাসি পায়! যেখানে-সেখানে চর্বি থলথল করছে।আর এই যে এত্তো সুন্দর, দামি একটা জামা পরেছে তাতো কোনো কম্মেরই নয়! উপর থেকেই তো বোঝা যাচ্ছে বেশ নাদুসনুদুস একটা ভুড়ি রয়েছে তার!
সে কিছু বলতে যেতেই দেখে দূর থেকে মালতি মাসি আসছে।মালতি মাসি তাদের বাড়িতে রান্না এবং অন্যান্য কাজ করে।
মালতি মাসি বলল--"তুমি এখানে কেন বাবা?? আমাকে ডাকতে এসেছো?? কিন্তু আমি তো ভোরে ভোরে গিয়ে সব কাজ করে দিয়ে এসেছি!"
মেয়েটা বলল--"মা,তুমি বুঝি এই কুমড়োপটাশের বাড়িতে কাজ করো?? হিহি হিহি!"
মালতি মাসি বলল--"এ আবার কেমন কথা ছুটকি?? আজ আমরা যে এত খুশি তা কিন্তু এই চন্দনের বাবার দেওয়া টাকাতেই। মনে রাখিস!"
এক মুহূর্তেই মেয়েটার মুখটা চুপসে গেল!
সে শুধু ক্ষমাই চাইল না! সে চন্দনের সামনে এসে হাঁটু মুড়ে বসল। কাঁদতে কাঁদতে বলল--"তুমি সুনন্দ আঙ্কেল আর সুনীতা আণ্টির ছেলে?? প্রণাম তোমাকে...! "
চন্দন অবাক হয়ে চেয়ে রইল। এই একফোঁটা নোংরা মেয়েটা যেন তার গালে সপাটে সত্যিই এক চড় কষাল! সে তো স্কুলেও যায় না! কতোই বা বয়স হবে! তার চেয়ে অনেকটাই ছোটো! আজ পুজোর অষ্টমীর দিন এইরকম ছেঁড়া জামা পরেও ও এত্তো খুশি কেমন করে হয়?? এক সেকেণ্ড আগে এই পুচকি মেয়েটা তাকে কুমড়োপটাশ, চটাশ করে চড় মারবে এইসব কতো কিছুই না বলছিল! অথচ মুহূর্ত পরেই সে তার কাছে ক্ষমা চাইছে! প্রণাম করছে!কাঁদছে!
মালতি মাসি বলল--"ছুটকির বাবার মস্ত বড়ো অসুখ করেছিল।টাকা জোগাড় করা অসম্ভব ছিল আমার পক্ষে! তোমার বাবা-ই মাসে মাসে একটু একটু করে মাইনের অতিরিক্ত কিছু টাকা দিয়ে আমার ছুটকির বাবার অপারেশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তোমার বাবা আমাদের কাছে ঈশ্বর, জানো চন্দন বাবা!"
ছুটকি বলল--"আমাদের বাসা খুব নোংরা। তবুও বলছি, যাবে?? একবার চলো। দেখবে আমার বাবা হাসছে! কথা বলছে। খাচ্ছে! আজ পুজোর এই মহাষ্টমীর দিন এমন পাওনায় আমাদের মন ভরে গেছে চন্দনদাদা!" বলে মেয়েটা দুহাত ছড়িয়ে নেচে উঠল। হিহি হিহি খিলখিল করে হাসতে লাগল।খুশিতে কেঁদে ফেলল।
বলল--"চলো না চন্দন দাদা! একবারটি!"
চন্দন, এই বস্তিতে ঢুকে যার বিশ্রী লেগেছিল।বমি পাচ্ছিল। এই মেয়েটার হাসিকে বিদ্রূপ মনে হয়েছিল, সে-ই চন্দন এখন মালতি মাসির পিছন পিছন যাচ্ছে।ছুটকির আনন্দ দেখছে আড়ে,আড়ে। আর অবাক হয়ে ভাবছে যে সে তো আসলেই খুব বাজে ছেলে। অত্যন্ত বাজে সে।কী নোংরা ছুটকি আর মালতি মাসির বাড়ি। একটাই ঘর।ঢিবি হয়ে আছে বাসন-কোসন আর জামাকাপড়।সমস্ত জামা-কাপড়ই শতচ্ছিন্ন! ঘরে ঢুকেই ছুটকি তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরল।
বলল--"বাবা??"
বিছানায় রুগ্ন লোকটা শুয়ে রয়েছে। কোটরাগত চোখ দুটো।বিছানার সাথে যেন মিশে আছে।ছুটকির ডাকে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ভদ্রলোকের চোখদুটো। মেয়ে বাবার বিছানায় বসে পড়ল।তারপর চকাস করে চুমু খেল বাবার গালে। বাবা হাসতে হাসতে উঠে বসল। তারপর বালিশের তলা থেকে বহু ভাজে নরম হয়ে যাওয়া কয়েকটা টাকা মেয়ের হাতে দিয়ে ভদ্রলোক বলেন--"মা রে,একটা জামা কিনে আন। আজ এই মহাষ্টমীর দিন ওই ছেঁড়া জামা পরে থাকিস নে মা!"
বলে ভদ্রলোক মুখ নিচু করে।মনেহয় কাঁদছে সে। মালতি মাসি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা চন্দনকে বলে--" ভিতরে আসো বাবা। বাপ-মেয়ের এই নাটক আজকে নতুন নয়। বাপ মেয়েরে দেবে আর মেয়ে তা নেবে না। মেয়ে বলে তার পরুনের জামাটা তো পেরায় নতুনই রইয়েচ। তা তুমি কি বলো নতুন নয়??"
বলে মালতি মাসি হেসে ওঠে। হেসে ওঠে ছুটকিও।
তারপর চন্দনের দিকে ফিরে বলে--"তুমি ভিতরে এসো না!"
চন্দন কী বলবে আর কী করবে বুঝে উঠতে পারে না! ছুটকির বাবার দেওয়া সেই টাকা কয়টা ছুটকি বাবার বালিশের তলেই রেখে দিয়েছিল। এবার সেটা তুলে নিল হাতে।বলল--"দাদা, ভিতরে এসে বসো না।"
বলে জোর করে চন্দনের হাত ধরে টেনে ঘরে বসায়। চন্দন অসুস্থ বৃদ্ধের বিছানাতে বসে পড়ে অসহায়ভাবে।মালতি মাসি একটা কাচের গ্লাসে এক গ্লাস জল দেয়।চন্দন জলের গ্লাস ধরে পাশে রাখে। খেতে পারে না। একটু পরে ছুটকি ফেরে। তার হাতে একটা পলিথিনের প্যাকেট। সেখানে চিনির রসে ভাসছে চারটি রসগোল্লা। চন্দনকে লুকিয়ে ছুটকি সেই প্যাকেট তার মায়ের হাতে দেয়।মা একটা প্লেটে চারটি রসগোল্লা এবং দুটি নিমকি সাজিয়ে চন্দনের সামনে ধরে দেয়।বোঁটকা গন্ধ ঘরের বাতাসে।বিছানায় চলতে না পারা রুগি।কিন্তু চন্দন তবুও একটা রসগোল্লা গালে তুলতে গেল। এই নোংরা পরিবেশে যে ঈশ্বর আরাধনার যোগ্য সুগন্ধ আছে তাকে সে অস্বীকার করতে পারল না। তাই সে একটা রসগোল্লা গালে তুলেছিল।
কিন্তু হঠাৎ সে হাউহাউ কান্নায় ভেঙে পড়ল। তারপরই উঠে পড়ল।চন্দন এখন চোখ মুছছে।আর ছুটছে।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে বাড়ি ফিরতে হবে।
0 Comments