বিজন সাহা
অন্তবিহীন পথ
আমাদের এই দীর্ঘ ভ্রমণে শুধু বিভিন্ন শহরই ছিল না, ছিল অন্তবিহীন পথ। পথেও ছিল জীবন, ছিল গল্প। তাই এবার আমরা পথের গল্প একটু করে নেই। আমরা শুরু করেছিলাম মস্কো থেকে। মস্কো রেজিওন থেকে তভের প্রবেশ করি। ভোলগার উৎস থেকে কালিয়াজিন পর্যন্ত আমরা এই তভের রেজিওনেই অবস্থান করি। উগলিচ থেকে শুরু হয় ইয়ারোস্লাভল রেজিওন। এরপর আমরা কস্ত্রোমা রেজিওন পার হয়ে আসি ইভানভা রেজিওনে। এখনও পর্যন্ত আমরা মস্কোর উত্তরপূর্বে অবস্থান করছিলাম, তবে ইতিমধ্যে রাস্তায় দু’ দিকে বনের পরিবর্তে খোলা মাঠ বা চাষের জমি দেখা যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল ল্যান্ডস্কেপ। এই এলাকায় অনেক জায়গায় শস্য তুলে ফেলা হয়েছে। এক সময় আমাদের একটা বাগান বাড়ি ছিল। তখন দেখেছি এই এলাকায় জুনের ১৩ তারিখ পর্যন্ত আর আগস্টের ২০ তারিখের দিক থেকে রাতের বেলা তাপমাত্রা শূন্যের নীচে নামতে পারে। তাই এসব এলাকায় ফসল তোলার কাজ শেষ হয় আগস্টের মধ্যেই। মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছে খড় জড়ো করা, তবে আমাদের দেশের মত নয়, বাণ্ডিলের পর বাণ্ডিল সাজিয়ে রাখা হয়েছে মাঠের মধ্যে।
কস্ত্রোমা থেকে বেরুনোর পথেই চোখে পড়ল তরমুজ ভর্তি এক গাড়ি। এক ভদ্রলোক এখানে দাঁড়িয়ে তরমুজ বিক্রি করছিলেন। আসলে রাশিয়ায় এখন তরমুজের সিজন। আমাদের দেশে যেমন আম কাঁঠালের সিজন আছে এদের তেমনি আছে তরমুজ বাঙ্গির সিজন, যখন সবাই এসব ফল কেনে। আগে যদি মূলত আগস্ট সেপ্টেম্বরে তরমুজ উঠত তবে এখন সারা বছর না হলেও বছরের বিভিন্ন সময়ে তরমুজ পাওয়া যায় – তাও আবার শুধু লাল নয়, হলুদ রঙের তরমুজ। এসব ল্যাটিন আমেরিকা বা অন্য কোন দেশ থেকে আসে। তবে এখনও পর্যন্ত আস্ত্রাখানের তরমুজ এখানে সবচেয়ে জনপ্রিয়। আমি নিজেও এক সময় ১২ থেকে ১৫ কেজি ওজনের তরমুজ কিনে আনতাম, তবে এখন বাড়ির সবাই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় এত বড় তরমুজ খাবার লোক নেই।
দিলীপ নামতে চাইলে দু’ জনে গেলাম তরমুজ বিক্রেতার কাছে। উনি মধ্য এশিয়ার লোক। বললেন খাঁটি আস্ত্রাখানের তরমুজ। তবে সত্য মিথ্যা কে জানে? তাছাড়া আমরা সাধারণত রাস্তা থেকে তরমুজ কিনি না। লাইসেন্স ছাড়া তরমুজ কিনে আবার কি ঝামেলা হয় কে জানে। ঝামেলা মানে পেটের সমস্যা। শুনেছি অনেকেই কেমিক্যালস ব্যবহার করে তরমুজের রঙ লাল করতে।
খুব মিষ্টি তরমুজ। নিয়ে যান।
আমরা কখন কোথায় থাকি তার ঠিক নেই, তাই তরমুজ কিনব না। আপনি বরং বলুন কোত্থেকে তরমুজ আনেন? আপনার কি নিজের খামার নাকি কারও হয়ে বিক্রি করছেন?
কিন্তু উনি এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হলেন না। তবে তরমুজ হাতে ছবি তুলতে রাজি হলেন। আমরা ছবি তুলে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাস্তায় নামলাম।
পথে আমার সাথে দেমিদের কথা হয় রুশ ভাষায়, দিলীপের সাথে বাংলায়। আর যেসব কথা সবার জানার দরকার সেটা আমরা ইংরেজিতে বলি। দেমিদের সাথে আমার পরিচয় বছর দশেক। অনেক কমন পরিচিত আমাদের আর ছবি আমাদের কমন হবি। তাই আমাদের গল্পের থিমের অভাব নেই। দিলীপের সাথেও ইতিমধ্যে কমন ল্যাংগুয়েজ পেয়ে গেছি। প্রথমত ও ঢাকায় যেখানে কাজ করত সেখানে আমার বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাম ছোট ভাই কাজ করে। তাছাড়া এক সময় ও নক্সাল আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিল। এর প্রতি আমার সব সময়ই আগ্রহ ছিল। কারণ আমার দাদা নক্সাল করত। ওর সাথে কয়েকবার দেখা হলেও এ নিয়ে কথা হয়নি। যা জানি, তা মূলত গল্পের বই পড়ে। তাই একজন জলজ্যান্ত নক্সাল কর্মী এখন সাথে, কিছু জানব না সেটা তো হয় না। কিন্তু দিলীপ নিজেও এ ব্যাপারে তেমন কিছু বলে না যদিও ইতিমধ্যে জেনে গেছি আমার দাদার আর ওর বেশ কিছু কমন বন্ধু ছিল। এছাড়াও দিলীপ প্রায়ই ভোম্বলের গল্প বলে। ভোম্বল ওর কুকুর। যেহেতু আমাদের বাসায়ও অনেকগুলো কুকুর আছে তাই নিজে কমবেশি এ ব্যাপারে জানি। আমার ছেলেমেয়রা বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলে ফোন করে আমরা কেমন আছি সেটা জিজ্ঞেস করার আগে জানতে চায় ওদের কুকুর বা বিড়াল কেমন আছে। মনিকা বাইরে গেলে ওর বিড়াল জানালায় বসে থাকে ওর অপেক্ষায়।
প্লিওসের পথে দেখলাম এক লোককে ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করতে। নেমে কথা বলার চেষ্টা করালাম। খুব একটা আগ্রহ দেখাল না। তবে এটুকু জানা গেল যে এই জমি তার ব্যক্তিগত। এখন এক ধরণের সব্জি চাষ করছেন। এটা যে সবজি তা জানতাম না। দুবনার পথের ধারে এসব ফুল ফোটে আর আমি সেগুলো বাসায় নিয়ে ছবি তুলি। শীতে এসব থাকবে পুরু বরফের নীচে আর বসন্তে মাথা তুলে সবাইকে স্বাগত জানাবে। দিলীপ আরও অনেক প্রশ্ন করতে চেয়েছিল, তবে তিনি আর আগ্রহ না দেখিয়ে ট্রাক্টরের ধোঁয়া ছেড়ে চলে গেলেন নিজের কাজে। আমাদের দেশে লোকজন গল্প করতে ভালবাসে, এরা যে ভালোবাসে না তা বলব না, তবে অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে একেবারেই পছন্দ করে না। আবার তাদের ব্যাপারে বিশেষ করে অপরিচিত কেউ নাক গলাক সেটাও এরা পছন্দ করে না।
প্লিওস থেকে বেরিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম নিঝনি নভগোরাদের দিকে। এখানে আমার মাথায় এই নাম নিয়ে নানা প্রশ্ন জাগল। যদিও পরে জেনেছি আমার ধারণা ঠিক নয় তারপরেও শেয়ার করি। ইংরেজরা যেমন বিভিন্ন দেশে গিয়ে নিজেদের দেশের শহরের নামের সাথে নিউ বা অন্য কোন বিশেষণ যোগ করে নতুন জায়গার নামকরণ করেছে, এক্ষেত্রেও মনে হয় সেটাই ঘটেছে। নিঝনি নামে নীচের বা বর্তমান কন্টেক্সটে ভাঁটির। আর নভগোরাদ নাম এসেছে এ দেশের অন্যতম প্রাচীন শহর নভগোরাদ থেকে যা বর্তমানে ভেলিকি বা গ্রেট নভগোরাদ নামে পরিচিত। এই ভেলিকি নভগোরাদের লোকেরাই এক সময় স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে রিউরিককে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসে নভগোরাদের রাজা হিসেবে। পরে তিনি কিয়েভ দখল করেন এবং শাসনের সুবিধার জন্য সেখানে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। সেখান থেকেই রিউরিকোভিচ ডাইনাস্টির শুরু, শুরু কিয়েভস্কায়া রুসের। এর বংশধরদের হাত ধরেই এ দেশে আসে অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্ম, প্রতিষ্ঠিত হয় মস্কো কেন্দ্রিক রুশ সাম্রাজ্য। তাই নিঝনি নভগোরাদ নাম হয়তো এই ভেলিকি নভগোরাদের নামেই রাখা হয়েছে। তবে এটা এখনও পর্যন্ত আমার অনুমান মাত্র। আর তো মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ। ওখানে গিয়েই না হয় নিঝনির নামের রহস্য জানব।
এখন আর আগের মত বন নেই রাস্তার দু’ ধারে। কিন্তু কোন গ্রামগঞ্জের দেখাও নেই কোথাও। মাঝে মধ্যে কিছু কিছু গাছ আর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ আর মাঠ। হঠাৎ চোখে পড়ল গির্জা। একেবারে রাস্তার পাশে। এক সময়ে পরিত্যাক্ত ছিল। এখন নতুন করে মেরামত করা হচ্ছে। নেমে ছবি তুললাম আর ভাবলাম এমন জনশূন্য জায়গায় ঈশ্বরের দেখাভাল কে করবে? ইতিমধ্যে প্রায় ছয়টা বেজে গেছে। দেমিদ বলল গির্জা যেহেতু আছে নিশ্চয়ই আশেপাশে কোন জনপদ আছে। এখানে নেট খুব একটা ভালো কাজ করছে না, কোন জনপদে গিয়ে নিঝনিতে কোন বাসা ভাড়া করতে হবে। এগিয়ে যাবে গাড়ি। আমি আর দিলীপ গল্প করব। ও বলবে বিভিন্ন সময়ে ওর ছবি তোলার কথা। কীভাবে আদভানির ছবি তুলেছিল সেই কথা বলবে। দিলীপ রিপোর্টার। মানুষের ছবি তোলে। মানুষের ঠিক নয় ঘটনার। আমি যখন যা তুলতে ইচ্ছে করে তার ছবি তুলি। এটা মানুষ হতে পারে, হতে পারে এক চিলতে আলো, একটা ঢেউ অথবা গাছের কচি পাতা। আমি ছবি তুলি মনের আনন্দে অথবা দুঃখে। ছবি তুলি তোলার আনন্দে। ১৯৮৩ সালে, যখন আমি ছবি তুলতে শুরু করি সে সময় এটা ছিল পরে দেশে ফিরে এই ছবির মাধ্যমে অতীতে ফিরে যাবার এক মাধ্যম। ২০০৮ সাল থেকে আমি বেশ কিছুদিন একা ছিলাম। তখন ছবি তোলা ছিল একাকীত্বের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য। আবার অনেক সময় আমি ছবি তুলি মানুষের ভিড় থেকে একাকীত্বে হারিয়ে যাবার জন্য। ছবি তুলি নিজের মত করে থাকার জন্য। আসলে আমার বন্ধুরা, যারা অনেকেই খুব ভালো ছবি তোলে সবাই সেটা করে মনের শখে ও সুখে – ছবি তোলার প্রক্রিয়াটা উপভোগ করার জন্য। পেশাদার ফটোগ্রাফার দিলীপ হয়তো অবাক হয়। বিশেষ করে আমি যখন আমার ফটো গ্যালারি ওপেন করে ওকে দেখতে দিই। মনে পড়ে আমাদের ইনস্টিটিউটের ফটোগ্রাফার ইউরি তুমানভের কথা। খুব নামকরা ফটোগ্রাফার। একবার আমার এক্সিবিশনে ওনাকে আমার ছবি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় উনি বলেছিলেন – “ওর ছবি একেবারেই অন্য রকম। আমি হয়তো পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যেতাম খেয়ালই করতাম না।” আসলেও তাই। আমার অনেক ছবির বিষয়বস্তু রাস্তার পাশের ফুল বা পাতা বা ঘাস বা শিশির কনা। এক্সিবিশনে এসে যখন জিজ্ঞেস করে কোথায় তুলেছি, জেনে বলে আমরাও তো এ পথ দিয়েই যাই আসি, কখনও দেখি না তো।
রাস্তার ছবি পাবেন এখানে
0 Comments