পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৯৩
ক্ষেত্র ব্রত
ভাস্করব্রত পতি
অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের বৃহষ্পতিবারে ধান চাষের মাঠে এই ক্ষেত্র পূজো করতে হয়। ছেলে মেয়ে উভয়েই করতে পারে। আসলে তা লক্ষ্মীদেবীর পূজা। নানা রকম ফলমূল, চিঁড়ে, মুড়কি, নাড়ু দিয়ে ক্ষেত্র দেবীর নৈবেদ্য সাজাতে হয়। এই লৌকিক উৎসবটি পালন করা হয় অগাধ ঐশ্বর্য্যের অধিকারী হওয়ার জন্য।
আশুতোষ মজুমদার এই ক্ষেত্র ব্রতের যে ব্রত কাহিনী শুনিয়েছেন তা এরকম --- "এক দেশে এক গরীব ব্রাহ্মণ ছিল, সে হঠাৎ মারা যায়। ব্ৰাহ্মণী তখন তাঁর ছোট পাঁচ বছরের ছেলেটিকে নিয়ে ভাইয়ের কাছে এল।
ব্রাহ্মণীকে তাঁর ছেলের সঙ্গে আসতে দেখে ভাজ, তাঁর ঝিকে জবাব দিলে এবং ননদকে দিয়ে দাসীর কাজ সব করাতে লাগলো। একটা রাখাল ছোঁড়া ছিল, সে গরু চরাতো, কিছু দিন পরে তাকেও তাড়িয়ে দিয়ে ননদের ছেলেকে গরু চরাতে ছিল। ছেলেটির নাম বিষ্ণুপদ। এমনি দুঃখে কষ্টে বিষ্ণু ও তা্র মা দিনরাত প্রাণপাত করে সংসারের ছড়া ঝাঁট, রান্নাবান্না, গোয়াল পরিষ্কার করা, ঘুঁটে দেওয়া, বাসন মাজা, সবই করতে থাকে। ক্রমে বিষ্ণু বড় হল, তখন একদিন তাঁর মামা বিষ্ণুর মামীর সঙ্গে পরামর্শ করে বলে, “ওরে বিষ্টে! খালি গরু চরালে চলবে না— বয়স তো হচ্ছে, বসে বসে খেলে হবে না। এবার থেকে চাষ করতে হবে, বুঝলি? ভাত অমনি আসে না।”
বিষ্ণু বললে, “মামা, যা বলবে তাই করবো— তুমি ভিন্ন আমাদের তো আর কেউ নেই”। মামা সেই দিনই লাল গরু আর লাঙল কিনে দিলে, বিষ্ণু মাকে বলে চাষ করতে গেল। বিষ্ণুর আর কষ্টের সীমা নেই, সমস্ত দিন রোদবৃষ্টি মাথায় করে মাঠে কোদাল পাড়ে, ঘাস কাটে, লাঙল দেয়, তারপর যখন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি আসে, তাঁর শুকনো মুখ দেখলে অতিবড় শত্রুরও প্রাণে মায়া হয়৷
বিষ্ণুর মা ছেলের কষ্ট সইতে পারতো না। বিষ্ণুর মামী বিষ্ণুকে আধ পেটা খেতে দিত, কোন কোন দিন তরকারীও দিত না, খানিকটা নুন দিত। বিষ্ণুর কষ্টে, তাঁর মা কেবল কাঁদতো, আর একমনে ছেলের জন্য সেই অনাথনাথ দীনবন্ধুকে ডাকতো। সকাল হলেই, রোদ ওঠবার আগে, বিষ্ণু ছাগল গরু নিয়ে লাঙল কাঁধে করে মাঠে যায়, আর সেই সন্ধ্যার সময় আসে। দুপুর বেলা এলে চাষের ক্ষতি হবে— মামা মামী বকবে, কাজেই আসতে পায় না।
বিষ্ণুর মা ছেলের কষ্ট সহ্য করতে পারে না, বারোটা বাজতে না বাজতেই বিষ্ণুর জন্যে এক ঘটি জল, মুড়ি মুড়কি, চালভাজা, শসা, কলা — যা যেদিন পেত, তাই নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাঠে ছুটে গিয়ে বিষ্ণুকে খাইয়ে আসতো। বিষ্ণু হাত মুখ ধুয়ে, ক্ষেত্রদেবীকে উৎসর্গ করে তবে সেই প্রসাদ খায়। বিষ্ণুর বরাবর ঠাকুর দেবতায় খুব ভক্তি। তাঁর মাও বামুনের ঘরের বিধবা, সেও রাত দিন ছেলের জন্যে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে একমনে ভগবানকেই ডাকে।
একদিন বিষ্ণুর খাবার বড় কষ্ট হল। পাতের কুড়ানো ভাত, তাও শুকিয়ে চাল হয়ে গেছে। তরকারী নেই। দুধ জ্বাল দেওয়া ছিল, বিষ্ণুর মা তারই একটু সর তুলে ছেলের পাতে দিল। তাঁর মামী তাই দেখতে পেয়ে রেগে আগুন! যাচ্ছেতাই করে ননদকে শুনিয়ে দিলে। তারপর ঘরে গিয়ে বিষ্ণুর মামাকে ননদের নামে খুব বেশি করে লাগিয়ে বলে, “তোমার বোনের অত্যাচার আর সহ্য হয় না। দুধটুকু জ্বাল দেওয়া থাকলেই সবটুকু ছেলের পাতে দেবে, ভালমন্দ যা কিছু জিনিস হবে, মাগী চুরি করে সব আদুরে ছেলেকে খাওয়াবে। কেন ও আপদ পোষা? ওঁদের পুষতে যা খরচ হয়, তার সিকিতে দাসী ও রাখাল রাখলে তোমার ওর চেয়ে অনেক বেশী কাজ হবে”। বিষ্ণুর মামা ত’ শুনে খুব রেগে গেল। পরদিন বিষ্ণুকে বলে, “তুমি কাজে যেও ন৷”—বৌকে বললে, “তুমি সংসারের কোন কাজে হাত দিও না। আজ থেকে তোমাদের অন্ন আর এখানে হবে না”।
সেদিন একে অগ্রহায়ণ মাস, তাতে আবার শুক্লপক্ষের বৃহস্পতিবার। বিষ্ণু ও তাঁর মা সমস্ত দিন কিছু খেতে না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাঠের ধারে গিয়ে এক গাছতলায় বসলো। ক্ষেত্রদেবী তাঁদের কষ্ট দেখতে না পেরে, বুড়ো বামনির বেশে এসে, বিষ্ণুকে বললেন, “বাবা, কাঁদছো কেন? তোমার কোন ভয় নেই, তোমার শাপে বর হয়েছে, তোমার এবার সব কষ্ট দূর হবে, ভাবনা কি? এই ধানগুলি নাও – এর অর্দ্ধেকগুলি কোন মুদির দোকানে দিয়ে মুড়ি, চিঁড়ে আর মুড়কি এনে খাও। আর ঐ যে দূরে মাঠের পাশে জলার ধারে একটা কুঁড়েঘর আছে, ঐখানে মায়ে পোয়ে আজ রাতের মত শোওগে। আর ধানের যে বীজগুলি রইলো, ঐগুলি কাল সকালে উঠে জলার চারিদিকে আর ঐ মাঠের আশেপাশে ছড়িয়ে দাও। তাহলে তোমাদের সকল অভাব, সকল কষ্ট দুর হবে”। এই বলে ক্ষেত্রদেবী চলে গেলেন।
বিষ্ণু ধানের বীজগুলি মার আঁচলে দিয়ে ধান নিয়ে মুদির দোকানে দিলে। মুদি অমন ভাল ধানের বীজ দেখে বললে, “কি চাই ঠাকুর?" বিষ্ণু তখন বললে যে, তাঁদের সমস্ত দিন খাওয়া হয়নি, তাই ধান দিয়ে চিঁড়ে, মুড়কি নিতে এসেছে। মুদি তখন খুব যত্ন করে, দুধ, চিঁড়ে, মুড়কি, মুড়ি, বাতাসা, কলা, কত কি এনে দিলে! বিষ্ণু সেই ধানের বদলে অত ভাল ভাল সব জিনিস দেখে, ভগবানকে ধন্যবাদ দিতে দিতে মায়ের কাছে এনে দিলে।
বিষ্ণুর মা ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে সন্ধ্যার আগে কুঁড়েতে এসে ঝাঁট দিয়ে সব পরিষ্কার করে অর্দ্ধেক খাবার দাবার সেইখানে রেখে ক্ষেত্রদেবীকে উৎসর্গ ক'রে, মায়ে পোয়ে খেয়ে সেই কুঁড়েতে দুইজনে শুয়ে রইলো। সকাল হতেই বিষ্ণু ও তাঁর মা উঠে স্নান করে এসে, সেই বীজগুলি কথামত চারিদিকে ছড়িয়ে দিলে। তারপর বাকি খাবারের অর্দ্ধেকগুলি রেখে, অর্ধেক ক্ষেত্রদেবীকে উৎসর্গ ক'রে, সেই প্রসাদ মায়ে পোয়ে খুব তৃপ্তির সহিত খেলে।
তার পরদিন সকালে উঠে দেখে যে, চারিদিকে ধানের বড় বড় গাছে ক্ষেত ভরে গেছে। আর সেই সব গাছে সোনার ধান ফলেছে। এই আশ্চর্য্য ব্যাপার দেখে, সেখানকার কতকগুলো চাষা, সেই দেশের জমিদারকে গিয়ে সোনার ধানের কথা বললে। জমিদার তাই শুনে লোকজন নিয়ে ছুটে এসে দেখলেন যে, সত্যই, সোনার ধানই বটে! তারপর কুঁড়েঘরে বিষ্ণুকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। বিষ্ণু তাঁদের সমস্ত দুঃখ কষ্ট, বাপ মরবার পর থেকে কাল পর্যন্ত যা যা হয়েছে— সব জানালে।
জমিদার খুব আশ্চর্য্য হলেন। তখন বিষ্ণু ও তাঁর মাকে খুব যত্ন করে নিজের বাড়ীতে এনে, বিষ্ণুর পৈতে দিয়ে, নিজের সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে খুব ঘটা করে বিয়ে দিলেন। আর সোনার ধানের ক্ষেত যৌতুকস্বরূপ দিলেন। বিষ্ণুর মা ছেলেকে নিয়ে সেই কুঁড়েতে ফিরে এল। বিষ্ণু তখন শ্বশুরের কিষাণদের নিয়ে সেই সব সোনার ধান কেটে কুঁড়েতে রাখলে। কতক বাজারে বেচে এল, অনেক টাকা পেলে। দেখতে দেখতে বিষ্ণুর রাজার মত সাতমহল বাড়ী আরম্ভ হল। দেশ বিদেশ থেকে রাজমিস্ত্রীরা সব দলে দলে এসে কাজ করতে লাগলো।
এদিকে বিষ্ণুর মামার অবস্থা দিন দিন খুব খারাপ হতে লাগলো। বিষ্ণুর যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীও বিমুখ হয়েছিলেন। গরু-বাছুর সব মরে গেল, শেষে খেতে না পেয়ে, পেটের দায়ে বউকে নিয়ে দেশে দেশে কাজের জন্য ঘুরতে লাগলো। কথায় কথায় শুনলে, বিষ্ণুপুরের মস্ত এক জমিদার প্রকাণ্ড রাজবাড়ী করছেন, সেখানে হাজার হাজার লোক সব কাজ করছে। তাই শুনে বিষ্ণুর মামা ও মামী সেখানে এসে মজুরের কাজ করতে লাগলো। ইঁট বওয়া, সুরকী দেওয়া, খোয়া ভাঙ্গা— এই সব কাজ তাঁরা ক'রতে লাগলো ।
বিষ্ণু একদিন তাঁদের দেখতে পেয়ে, চুপি চুপি মাকে সব বলে। বিষ্ণুর মা তখন দু'জন দাসীকে ডেকে বলে, “ঐখানে দু'জন লোক রয়েছে, একটি মেয়েমানুষ ইঁট বইছে, আর ঐ পুরুষ যে খোয়া ভাঙ্গছে, ওঁদের এখানে ডেকে আন”। বিষ্ণুর মামা মামী বাড়ীর ভিতরে এসে দু'জনকে দেখেই ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলো। বিষ্ণু মামা ও মামীকে নমস্কার করলে। বিষ্ণুর মা দাস দাসীদের দিয়ে ভাল তেল মাখিয়ে দাদা ও ভাঙ্গকে স্নান করালে, ভাল গরদের জোড় ভাইকে আর বউকে বেনারসী শাড়ী পরিয়ে, পঞ্চাশ রকম তরকারী দিয়ে ভাত খাওয়ালে। এমন আদর-যত্ন পেয়ে, তাঁরা দু'জনে আর সেখান থেকে যেতে চায় না। যাহোক, বিষ্ণুর মা তাঁদের কিছুদিনের জন্য সেখানে থাকতে বললে।
আবার অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষে বৃহস্পতিবার এল। তখন বিষ্ণু মামা ও মামীকে ক্ষেত্রব্রত করিয়ে বলে, “মামা, বছর বছর এই ব্রত করবে, কোন কষ্ট থাকবে না”। এই বলে অনেক টাকাকড়ি দিয়ে মামা মামীকে বাড়ী পাঠিয়ে দিলে। মামা মামী, বছর বছর সেই ব্রত করে, ক্রমে তাঁদের ক্ষেতভর৷ ধান হল, বাড়ী ঘর, লোক জন, গরু ছাগল সব হল। গোলাভরা ধান হল, দাস দাসী, হাতী ঘোড়া সব হল।
এমনি করে কিছুদিন যায়, একদিন বিষ্ণুর মামী বিষ্ণু ও তাঁর মাকে নিমন্ত্রণ করে বাড়ীতে এনে খুব আদর যত্ন করে খাওয়ালে। তারপর সোনার বাটিতে ক'রে একবাটি ঘন দুধ, খুব পুরু সরশুদ্ধ এনে বিষ্ণুর মামী বিষ্ণুর মুখের কাছে করে বলে, “এইটুকু খাও বাবা ! এরই জন্যে আজ আমাদের এত ঐশ্বৰ্য্য”। বিষ্ণু মামীকে বেশ দু’কথা বলে, তাঁর আঁতে একটু ব্যথা দিয়ে দুধ খেলে। বিষ্ণুর ঐশ্বর্য্য, ধন দৌলত, বিষয় সম্পত্তি এত হল যে, তখন বিষ্ণুপ্ৰসাদ মস্ত একজন রাজা হল। কিন্তু এত ঐশ্বর্য্যতেও বিষ্ণু তার মামা মামীদের নিয়ে প্রতি বছর খুব ঘটা করে ক্ষেত্র ব্রত করতে ভোলেনি। তাঁদের পূজা দেখে, তখন দেশ বিদেশে— শেষে পৃথিবীর চারদিকে ক্ষেত্র ব্রতের হ'য়ে গেল। কথা প্রচার হয়ে গেল। এই ব্রত কাহিনী শোনার পর ব্রতী উপোস ভঙ্গ করবে।
আরেকটি লোককাহিনীর সন্ধান মেলে এই ব্রতকে কেন্দ্র করে। একসময় এক রাজার এক সুন্দরী কন্যা ছিল। সেই কন্যার বয়স যখন মাত্র ছয় মাস, তখন তিনি তাঁকে রেখে বাণিজ্যে চলে যান। দীর্ঘ ১৬ বছর পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। বাড়িতে ফিরে নিজের মেয়েকে দেখে দারুণ অবাক হয়ে যান। মেয়ে তখন ষোড়শী। রূপে গুনে অতুলনীয়। অথচ মাত্র ছ'মাস বয়সে তিনি শেষ বার দেখেছিলেন। তিনি ভাবলেন, এত বড় হয়ে গিয়েছে তাঁর মেয়ে, অথচ তাঁর এখনও বিয়ে হয়নি? সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর স্ত্রীকে ডেকে বললেন যে অবিলম্বে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। আগামীকাল সকালে আমি যাঁকেই সে প্রথম দেখতে পাবে, তা্ঁর সঙ্গেই তাঁদের মেয়ের বিয়ে দেওয়া হবে। একথা শুনতে পেয়েছিল এক দিনমজুর। তাই রাজার কথামতো পরদিন সূর্যোদয়ের আগেই রাজবাড়ির প্রধান দরজার সামনে এসে সে ঘুমিয়ে পড়ল। রাজা ঘুম থেকে উঠেই সেই দিনমজুরকে দেখতে পেল। এবং নিজের প্রতিশ্রুতি মতো সেই দিনমজুরের হাতেই কন্যাদান করলেন। আনন্দের সাথে কন্যাও শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। সেই দিনমজুরের বাড়িতে ছিল মাত্র এক ছটাক জমি। পেটের ভাত জোগাড়ের জন্য রাজার মেয়ে সেই জমিতেই দিনরাত একটা কোদাল নিয়ে জমি খুঁড়ে ধান চাষ করতে শুরু করে।
একদিন সেই ধান পেকে গেল। পাকা ধান ঘরে তুলতে হবে। মেয়েটি তাঁর স্বামীকে ধান কেটে ঘরে আনতে বলল। দিনমজুর স্বামী স্ত্রীর কথামতো ধান কাটতে যায়। কিন্তু দিনমজুর একদিকে ধান কেটে জমা করে, আর অন্যদিকে সেই খালি জমিতে ফের পাকা ধান ভরাট হয়ে যায়। এইভাবে সে সারা দিনরাত ধান কেটেও শেষ করতে পারছিলনা। প্রচুর ধান হয়ে যাচ্ছে তাঁদের। রাতে ধান পাহারা দেওয়া দরকার। তখন মাঠেই ছোট্ট একটা ঘর বেঁধে ঐ দিনমজুর রাত কাটাতে লাগলো। রাতে তাঁর স্ত্রী তাঁর খাওয়ার জন্য ভাত আর সুঁটকি মাছ দেয়। কিন্তু সে তা না খেয়েই মাথার কাছে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে দেখলো যে সাতজন ষণ্ডামার্কা লোক এসে ভাতগুলো খেতে লেগেছে। তখন দিনমজুরটি তাঁরা কারা, জিজ্ঞেস করল। উত্তরে তাঁরা জানায় যে তাঁরা ক্ষেত্রমোহন। তাঁরা সাত ভাই। তাঁরা দিনমজুর ও তাঁর স্ত্রীর চেষ্টায় খুব সন্তুষ্ট। তাই তাঁকে এই বরদান করেছে যে একদিকে ধান কেটে নিলেও ফাঁকা জায়গায় ফের নতুন ধানগাছ হয়ে যাবে। জমিদার হবে দিনমজুর। তবে এজন্য তাঁদের প্রতি বছর হেমন্তকালে নতুন ধান ওঠার সময় এই ক্ষেত্রমোহনের ব্রত বা লৌকিক আচার করতে হবে।
উপরোক্ত এই কাহিনী অবশ্য বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলায় লক্ষ্য করা যায়। এই ক্ষেত্রমোহনের ব্রতে লাগে সাতখানা চিতুই পিঠা, সুঁটকি মাছ, চালের গুঁড়ো, আটিয়া কলা এবং গুড়। এগুলি সব কাঁঠালের পাতার মধ্যে রেখে নৈবেদ্য দিতে হয়। এই ব্রত পালনের জন্য বাড়ির উঠোনে একটি শেওড়াগাছের ডাল পুঁতে দিয়ে তার গোড়ায় একটি কচুরিপানার গাছ রাখতে হবে। এবার সামনে ঘট বসিয়ে ৭ টি কাঁঠালপাতায় উপরের সামগ্রী গুলি সবকটিই দিতে হবে একটু একটু করে। বাকি জিনিসগুলো অন্য একটি পাত্রে দিতে হবে বেশি করে। এরপর ধূপ প্রদীপ জ্বেলে ফুল তুলসী দিয়ে ব্রতকথা শুনতে হয়। সবশেষে প্রসাদ খেয়ে পূজার যাবতীয় সামগ্রী জলে ফেলে দেওয়াই রেওয়াজ। অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধান লাগালে প্রথমেই করতে হয়। এই লৌকিক উৎসব না করে নতুন ধানের চালের ভাত খাওয়া চলেনা।
ড. শীলা বসাক ত্রিপুরা রাজ্যের ক্ষেত্র ব্রতের লৌকিক আচার সম্পর্কে বলেছেন, "অগ্রহায়ণ বা মাঘ মাসের যে-কোনও শনিবার বা মঙ্গলবার দিন পূর্বাহ্নে এই ব্রত পালন করা হয়। ব্রতের পূর্বদিন ব্রতীকে সংযম পালন করতে হয় অর্থাৎ নিরামিষ আহার গ্রহণ করতে হয়। এই ব্রতের কোন মূর্তি নেই। ক্ষেত্রদেবীকে লক্ষ্মীদেবীরই একটা রূপ বলে বিশ্বাস করা হয়। বাড়ির উঠোনের খানিকটা জায়গা লেপে পরিষ্কার করে শিটকী (স্থানীয় গাছ), শেওড়া ও চেঙ্গা গাছের তিনটি ছোট ডাল পুঁতে তার সামনে কলাপাতায় নৈবেদ্য সাজানো হয়। নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয় বিবিধ ফল, ফুল, দূর্বা, তুলসী, আট পদ ভাজা (যেমন খইভাজা, চিঁড়েভাজা, আতপ চাল ভাজা, বুটভাজা, মটরশুঁটি ভাজা, সিমের বিচি ভাজা, মুগডাল ভাজা, অড়হর ডাল ভাজা)। এই ব্রতের যা কিছু উপকরণ সংগ্রহ করা হয় তার মধ্যে কিছু উপকরণ ভিক্ষে করে আনতে হয় অযুগ্ম সংখ্যক (৩, ৫, ৭ ইত্যাদি) বাড়ি থেকে এবং বাদ বাকি সব নিজের ঘর থেকে দিতে হয়। বিভিন্ন ধরনের ফসলবৃদ্ধির কামনায় এই ব্রত পালন করা হয়"।
0 Comments