জ্বলদর্চি

কালের অতল তলে কলোরাডো/ পর্ব ২৪ /চিত্রা ভট্টাচার্য্য

কালের অতল তলে কলোরাডো 
পর্ব ২৪ 
চিত্রা ভট্টাচার্য্য 
                                                                                                                                                                  এক রাশ সবুজ অন্ধকারের কারাগারে বদ্ধ আমার প্রতিদিনের বৈচিত্র্যহীন জগৎ। এখানের বেশীর ভাগ সময়  সকাল থেকে বিকেল কাটে  সাবেকী আমলের তৈরী মেহগিনি কাঠের ডেক চেয়ারে বসে গা এলিয়ে দিয়ে। আকাশ ছোঁয়া রেডউড বুড়ো এঞ্জেল ওকের ঝাঁকড়া মাথার ওপর আজ খেয়ালী বালক সূর্য্য এক গাল হেসে পা ঝুলিয়ে বসে আপন খেলায় মেতেছে। চারদিক তাই আলোয় আলোময় ।গত রাতের বৃষ্টিতে ভেজা মাটিতে মিশে আছে গাছেদের একান্ত নিজস্ব গায়ের গন্ধ। ঠিক যেন মন্দিরে দিন শুরুর আগে সুগন্ধি ধূপ দীপের সমারোহে আরতী তে অলক্ষ্যে থেকে নিত্যপূজার আয়োজন সাজিয়ে ধ্যানে মগ্ন পূজারী। এতো নিস্তব্ধতায় ঢাকা এ পাহাড়ি অরণ্যে একান্তে  প্রহরের পর প্রহর পার হয়ে চলছে। দিনগুলো কাটছে যথা পূর্ব্বং তথা পরং -- বৈচিত্র হীন বন্দিদশায়। মাথার ওপর দিগন্ত জোড়া নীলাকাশে সোনালী ডানার বিশাল বল্ড ঈগল আর ফ্যালকন দের চক্রাকারে চৌকিদারী চলছে। চড়কির মত ঘুরছে ওরা।অত উঁচুর থেকে পাহাড়ের খাঁদে ঝোপে ঝাড়ে শিকারের আশায় তীক্ষ্ণ নজর, মেটে খরগোশ বা বাচ্চাশেয়াল টি যে অতি লোভনীয়। শুকনো পাতার ওপর মর্মরিয়ে শব্দ করে খেলে বেড়ানো হৃষ্ট পুষ্ট কাঠবেড়ালী টি কে চোখের সামনে দেখলাম তড়িৎগতিতে কত দূর থেকে উড়ে এসে বল্ড ঈগল টি ঝাঁপিয়ে পরে সাঁড়াশির মত ঠোঁট বাঁকিয়ে সুনিপুণতায় গলা চেপে ধরে পাহাড়ের ওপরে নিয়ে যাচ্ছে। কী সুতীক্ষ্ণ শিকারীর নজর।     
     আর নীচের দিকে পাহাড়ের খাঁদের জঙ্গলে , নিরীহ বাচ্চা হরিণ শিশুরা লাফিয়ে ছুটে বেড়িয়ে পাথরের গায়ে ফাঁকফোঁকরে সদ্য জন্মানো কচি ঘাসের গন্ধে বিভোর। মুখ ডুবিয়েছে আহারের সংগ্রহে। মা হরিণ টি ভীত ত্রস্তচোখে পাহারাতে থাকছে তার পিছু পিছু। খাঁদের ঝোঁপের আড়ালে হয়তো ধূর্ত শেয়াল বা নেকড়ে কড়া চোখে নজর রাখছে। সুযোগ পেলেই দুদিনের শাবক কে আয়ত্বে এনে সাবড়ে মারতে কতক্ষণ লাগবে ? কত খাদ্য খাদকের মেলার লুকোচুরির দৃশ্য চোখের ওপর ঘটে যায়। দূর থেকে দেখা ছাড়া উপায় থাকে না। সময় বে হিসেবে গড়িয়ে চলেছে অবসন্ন মন নিয়ে সব কাজ ভুলে বসে আছি। ভেজা হাওয়ায় ভেসে আসছে ভাত সেদ্ধর গন্ধ। যদি ও জানি এমন বসে থেকে সময় কাটালে চলবে না ,রান্না ঘরে অসংখ্য কাজ জমে আছে ,তবু কী এক চুম্বকীয় আকর্ষণে নিশ্চল মন গাছেদের মতই নিরুপায় হয়ে এক ঠায় ডেকের ওপরে স্থির স্থবিরের মত দাঁড়িয়ে থাকত।
 চোখে গভীর সুখে অপলকে উদাসীন তন্দ্রা নেমে আসে। বাস্তবের ডাকে সাড়া দিয়ে কল্পনার জগৎ কে দূরে সরিয়ে রাখি। দুপুরের আহারের প্রয়োজনে আমি তখন ভারী ব্যাস্ত। ওদিকে যক্ষপুড়ি থেকে কোনো আগাম সংকেত না দিয়ে আকাশ কালো করে উড়ো মেঘ উড়ে এসে জাঁকিয়ে বসেছে পাহাড়ের কোলে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। পাহাড়ি বৃষ্টি যেন হঠাৎ বড়ো হওয়ার আনন্দে যৌবনের সন্ধিক্ষণে পৌঁছনো সদ্য কিশোর কিশোরীর মত সাবলীল। কোনো বাঁধা মানেনা ,উদ্দাম খুশিতে ভাসা এক দুরন্ত যৌবন। টপাটপ শব্দ করে মেঘের বুক চিরে শিল পড়ে।  কালচে ডিপ ব্রাউন রঙের বার্নিশ করা কাঠের ডেকের ওপর মুক্তর দানা ঝরে পড়ার মত লাগে। ইচ্ছে করে ছোটবেলার মত আটপৌরে গাছকোমর করে শাড়ি পরে বাটি হাতে নিয়ে ছুটে  শিল কুড়োতে যাই। একেতেই বেশ ঠান্ডা তারপর পা পিছলে পড়ার সম্ভাবনা ও আছে। বয়সের চোখ রাঙানি তে ইচ্ছে টাকে দমন করি। এবারে ঠান্ডা লাগলে ''কোভিড১৯ '' কিছুতেই আমাকে রেহাই দেবেনা।
🍂
বেশ কিছুক্ষণ প্রবল বেগে ভিজিয়ে দিয়ে আপন মর্জিতে অসময়ের বৃষ্টি উধাও হয়ে পালায়। কাঁচের বাইরে তাকিয়ে দেখি কাঠের পাটাতন নিমেষে সব জল শুষে নিয়েছে আকাশ এখন নির্মেঘ পরিষ্কার। গাছের পাতা গুলো ক্ষণিক বৃষ্টির জলে ধুয়ে গিয়ে আরো সুন্দর ঘন সবুজ ধরিত্রী স্বচ্ছ নির্মল আলোর আনন্দ ধারায় ভেসে চলেছে। নীচের দিকে পাহাড়ের ঢাল বেঁয়ে সদ্য জন্মানো রেডউডের চারা গাছ গুলো বৃষ্টির জল পেয়ে মাথাঝাড়া দিয়ে উঠে তড়তড়িয়ে  বাড়তে থাকে, গাছের পাতা গুলোয় খুব ধার গায়ে লাগলে ছুঁচের মত ফোঁটে। প্রকৃতির খেয়ালী মর্জির সাথে পাল্লা দিয়ে চলা খুব মুস্কিল।এমনি করে দিনের অবসানে সপ্তাহ শেষে মাস ও ফুরোয়।আগস্ট ও শেষ হতে চলেছে। ভারাক্রান্ত মনে প্রচন্ড দিশেহারা লাগে কোনো উপায় খুঁজে পাইনা। মহাসমারোহে ঘরে বাইরে বিষণ্ণ আঁধারের জোয়ারে ভেসে চলেছি। 

      এমন  নির্জন উপত্যকায় বনের ধারে তমসাবৃত গহীন রাত গুলোর খবর আরো চমকদার।ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ঘ্যানঘ্যানানি ছাড়া কোথাও প্রাণের সাড়া তো দূরের কথা এক বিন্দু আলোর চিহ্ন ও নেই। আজকাল প্রায় প্রতিদিন দুপুর থেকে মেঘের ছায়া ঘনিয়ে আসে। আকাশ জুড়ে ঝড় বৃষ্টি প্রলয় কান্ড শুরু হয়ে যায়। এমনিতেই এ পাহাড়ে জন বসতি খুব কম। অনেকটা দূরে দূরে বাড়ি গুলোর থেকে মৃদু হলুদ আলো বন্ধ কাঁচের জানলায় দেখা যায়। ঘরবন্দি জীবনে জনমানবের সাড়া শব্দ বা মুখ দেখা যায় না। বিস্মিত হয়ে ভাবি এদের আবার সন্ধ্যে সাড়ে ছটার মধ্যে ডিনার হয়ে যায়। সারা রাতে ক্ষিধে পায় না ? কাটে কেমন করে? আমাদের সিস্টেমে সাড়ে ছটায় ডিনার নৈব নৈব চ। তখন তো এখানে সূর্যই অস্ত যায়না বরং সান্ধ্য কালীন কফি স্নাক্সের তুমুল আড্ডা চলে। আবহাওয়ার পরিবর্তনে জমিয়ে জোরদার ঠান্ডা পড়েছে। রুম হিটারের লাল আলোটা বুনো শ্বাপদের রক্ত চক্ষুর মত জ্বলজ্বলে চোখ মেলে লোভাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আমি এক দৃষ্টে পুরোনো বাড়িটার ছাতের বিম গুলোর দিকে তাকিয়ে আকাশপাতাল ভাবনায় তলিয়ে গিয়ে রাতের প্রহর গুনে চলেছি। অবস্থার আশাপ্রদ কোনো উন্নতির খবর নেই।   

 রাতভর  ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ঘ্যানঘ্যানানি, বিশাল অগুনিত গাছ গুলোর পাতায় শিশির ঝরে পড়ার টুপ টাপ শব্দ ঘুম না আসা রাত গুলোতে বালিশে মুখগুঁজে ও বেশ স্পষ্ট শোনা যায়। একের পর এক কেটে যাচ্ছে তন্দ্রা হারা বিনিদ্র রাত। মাথার ওপরে কাঁচের জানালায় বিশাল লম্বা গাছ গুলোর ডাল পালার ফাঁক দিয়ে এক টুকরো আকাশ নিজের মত করে উঁকি দেয়। এই বাড়ির সামনে নুড়ি বিছানো উঠোন থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পাহাড়ের নীচের স্তরে আপেলের বাগান রয়েছে যেখানে দিনের বেলায় দেখেছি তৃণভোজী হরিণ পরিবারের  অবাধ বিচরণ। সুযোগ পেলেই সুস্বাদু কচি আপেল গুলো গাছের ডালে সমেত মুখে পুরে চিবোয়  আর  বিন্দাস ঘুরে বেড়ায়। বাঁধা দিলে এমন ভাবে মুখ তুলে তাকাবে যেন           '' আমাদের রাজত্বে তোমরা কোথাথেকে এলে হে ? যত সব যাচ্ছেতাই রবাহুতের দল?'                                                                                                                                                                 রাতের নীরবতা ভেঙে খানখান হয়ে সেখান থেকেই ভেসে আসছে অসহায় হরিণ শাবক ও তার মার কাতর ডাক। সে আওয়াজ দূর দূরান্তে প্রতিধ্বনিত হয়ে মিলিয়ে যায়। বোধহয় ওরা ঐ গ্যাটস বা মাউন্টেন লায়নের খপ্পরে পড়েছে। রাত জাগা পাখিদের ঝরঝর আওয়াজ তুলে ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ এ রাত কে  আরো রহস্যময় করে তুলেছে। 

      কখনো জোরালো বাতাস বইতে থাকলে গাছেদের মাথায় মাথায় শুধুই অনাড়ম্বর ঠোকাঠুকি। ছাতের গায়ে লাগানো ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে শীতল তম জলের ছাট, গালের ওপর কয়েক ফোঁটা বরফের বিন্দুর মত স্পর্শ,সামান্য ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির এমন করে ঘরে ঢুকে পড়ার বেশ সক্রিয় চেষ্টা দেখে রাত দুপুরে মজার যেন শেষ নেই। ইয়াম আমার পাশে শুয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে ,ওকে সেদিন যে লসগ্যাটসের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম তারপরে আর ওর রুম পার্টনার পারভীন না ফেরা পর্যন্ত সানহোসের এপার্টমেন্টে যেতে দেইনি।রীয়ামের জীবন দীপ এমন অসময়ে নিভে যাওয়ার জন্য ও নিজেকেই দায়ী করে চলেছে। ক্রমশঃ দেখছি  ও কেমন ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। কতবার ওকে মাউথর্গান হাতে তুলে দিয়ে বলি বাজাতে, বাজায় না ,হাতে নিলেও চুপ করে বসে থাকে। ফুঁ দিয়ে সুর তোলে না। ভাবছি এই অবস্থার থেকে ওর পরিবর্তন আসবে কেমন করে?   

 রাতের নীরবতার মাঝেও নিজস্ব এক ভাষা আছে। কান পেতে শুনছি গাছেদের সাথে তার গভীর আলাপ। অনুভব করি ডালে ডালে পাতায় পাতায় রহস্য ঘন ফিস ফিসানি --কানাকানির জোরালো শব্দ।    পাহাড়ি বনভূমি তে এই চল্লিশ বছর আগের পুরোনো বাংলো বাড়িটির সাজানো ঘরটির আসবাব পত্রের মাঝে শৌখীন বিছানাতে শুয়ে প্রতি পলে আমার অনুভূতিরা সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কাঁচের জানলা দরজার ওপারে ঝুপঝুপ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা নির্বিকার সিডার পাইন রেডউডের ঘন বনের গাছ গুলোকে দেখে মনে হয় হাজার হাজার অশরীরীর আত্মার দল কবর থেকে উঠে এসে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের অতৃপ্ত আত্মারা জেহাদ জানাতে চায় ,  বিপুল আক্রোশে কৈফিয়ৎ চাইছে এমন অসময়ে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়ার জন্য আসল দায়ী কে? প্রশ্ন অনেক কে দেবে উত্তর ? ভাবি এ রাত শেষে তমসা কেটে যাবে আগামী কালের নতুন সূর্যোদয় ঠিক নতুন আশার আলো দেখাবে। 

আবোল তাবোল অপ্রয়োজনীয় কত চিন্তায় চোখে তন্দ্রা জড়িয়ে আসে ঘুমিয়ে পড়ি।তারপর কখন দেখি  , আঁধার পেরিয়ে প্রভাতের প্রথম আলোর রেখা দূরের পাহাড়ের শিখর চূড়ায় অপরূপ ভাবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। এই কঠিন রুক্ষ পৃথিবীকে মোহজালে মুগ্ধ করে দিনের আলোর কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙে। রাতের শয্যা ত্যাগ করে প্রাত্যহিক নিয়মের বেড়াজালে প্রস্তুত হতে থাকি। সকাল বেলায় সবুজ সমারোহে নিশ্চিন্তে কুয়াশায় ঢাকা আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে নির্বিকারে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু নীচু পর্বত শৃঙ্গ গুলো। ইয়াম আমি নিয়ম করে প্রাতঃভ্রমণ সেরে ঘরে ফিরে দেখি সকালের চায়ের টেবিলে টিপটে চা পাতা ভিজিয়ে অতনু ও ব্রতীন রেডি। দুজনের মুখই একরাশ খুশীতে ভরা। চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে ভাবছি বেশ কিছুদিন পরে এদের মুখে এত উজ্জ্বল হাসির  ঝিলিক দেখছি। আসল কারণ টা কি ? আমাকে কোনো প্রশ্নের সুযোগ না দিয়েই অতনু বলে ''হ্যারি গ্র্যান্ডপা নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছে আমাদের  সবাই কে  Monterey  Bay র রিসর্টে। দুপুরের  লাঞ্চ পর্ব সেখানেই সারা হবে। তোমার রান্না ঘরে আজ লক ডাউন চলবে। এক  বড়ো সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আমি তো ছেলেদের মতই মহা খুশী। 

     বেশ কয়েক মাস পর আবার পথে বেরোলাম। মুখে মাস্ক হাতে স্যানিটাইজার এবং যথেষ্ট সাবধানতা সবাই নিয়েছি। আজকের বিবিসি নিউজে শুনেছি বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে ফাইজার বায়ো এনটেকের করোনা ভাইরাস টিকার অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাজ্য ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এইম এইচ আর এ.।ওরা প্রমাণ করেছে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ৯৫শতাংশ এই টিকা টি এখন ব্যাবহারে নিরাপদ। মানুষ তাদের বয়স এবং স্বাস্থ্যের অবস্থার ওপর নির্ভর করে এই ভ্যাকসিন নিতে পারবে। খুব তাড়াতাড়ি এক কোটি টিকার ডোজ বাজারে পাওয়া যাবে। অবশ্যই এ খবরে ভালো লাগছে মনোবল বেশ একটু বাড়ছে। খুব ক্ষীণ এক আশার আলো যেন দেখতে পেলাম এবারে হয়তো দেশ ঘরে  ফেরার সুযোগ আসবে ।  

   রাস্তায় বেরিয়ে দেখছি অবাক কান্ড যত ভয় আমাদের গ্রাস করেছে। এরা যে দেখছি একদম কেয়ার ফ্রী। পৃথিবী ব্যাপী মহা সংক্রমন কোভিড 19 চক্রে সব চেয়ে বেশী ক্ষতি গ্রন্থ দেশ আমেরিকার ছোট শহর তলী থেকে বড় শহর রাজ্পথ জনপথের মানুষ গুলো সর্বত্র।এতো বড়ো বড়ো হস্পিটাল গুলো পর্যন্ত হাজার হাজার পেশেন্ট নিয়ে উদয়াস্ত হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু মানুষ গুলোর কিছু মাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। ওরা নির্ভিক , আনন্দে প্রশান্তি তে বিন্দাস চিন্তা মুক্ত হয়ে হাসছে খেলছে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হয়তো টিকা আবিষ্কারের খবরে ভয় ভীতি সব উধাও হয়েছে। পার্কে ফটো সেশন চলছে ,শরীর ও মুখের নানা ভঙ্গিমায় সেল্ফি তুলছে।মৃত্যু ভয়ে একটু ও শঙ্কিত নয়। সব স্বাধীন সুখী মুক্তপাখির মত। ব্রতীন বলে বড়ো বড়ো শহর গুলোতে শিকাগো ,নিউয়র্ক , লসএঞ্জেলে ওয়াসিংটন এমনকি ক্যালিফোর্নিয়ার অন্যান্য সিটি গুলোতেও এতোদিন এমন টা দেখিনি। সবাই এতো Dont care বা বেপরোয়া নয়। এখানে দেখছি তেমন কোনো আইনি বাধ্য বাধকতাও নেই.।

সামনে এক স্বচ্ছ নীল জলের লেক বা লেগুন দেখতে পেয়ে সেখানে দাঁড়ালাম। কাছে গিয়ে দেখি সমুদ্রের খাঁড়ি মত। কোন ফাঁকে সাগরের জল নিজের মর্জিতে প্লাবন তুলে এখানে ঢুকে মাইলের পর মাইল কব্জা করে বয়ে গিয়েছে । সাদা বালুকা ভূমি ঘিরে একসাথে জোট বেঁধে ছেলে মেয়েরা গানবাজনা করছে। লেকের ধার ঘেঁষে এরই মধ্যে যেন মেলা বসেছে। ইয়ং ছেলে মেয়েদের গ্ৰুপ ওরা কেউ সেলর বোট ভাড়া করছে কেউ বা সঙ্গে করে বোট নিয়ে এসে অগাধ জলে ভাসছে। এখনই এখানে ক্যানোয়িং করা যেন জীবনের চরম লক্ষ্য। ঘরের বাঁধন ছেড়ে ওদের কানে কানে জানিনা কে দিয়ে গেলো এমন চরম স্বাধীনতার মন্ত্র। ব্রতীনের অফিসের কলিগ পল আমাদের দেখতে পেয়ে হৈ হৈ করে এগিয়ে এলো এবং ওদের সামাজিক প্রথা অনুযায়ী ওরা হ্যান্ডশেক করবে জড়িয়ে ধরবেই। ব্রতীন ও আমি দুজনেই ভারী অবাক হয়ে যাই। আমার মনে হয় ওদের এই ভদ্রতা জানানোর আজন্ম সংস্কৃতি ই করোনা ভাইরাস অসুখটি এমন ব্যাপক ভাবে গ্রাম নগর ছড়ানোর প্রধান হাতিয়ার হয়েছে। অতনু কৌতূহলে পল কে জিজ্ঞেস করেছিল এই পান্ডামিকের সময়ে দলবদ্ধ হয়ে বোটিং করতে যাচ্ছিস কেন ? পল নির্দ্বিধায় একরাশ হেসে উত্তর দেয় ,'' অনেক দিন বন্দি থেকে ঘরেই পচে মরছি। একদিন তো মরতে হবেই তার আগে যত টুকু সময় পাও জীবন কে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে উপভোগ কর। আজ রবিবার এডভেঞ্চার প্রিয় পল তাই চুপচাপ ঘরে বসে না থেকে হ্রদের বুকে বোট নিয়ে ঝাঁপাঝাঁপি করবেই। যা কিছু ভালোলাগে দুহাত ভরে লুটে নাও আগামীর জন্য জমিয়ে রেখে লাভ নেই ''। পল বোট টি সাদা বালির ওপর মহা সমারোহে টেনে নিয়ে চললো বন্ধুদের সঙ্গে জলে ভাসাতে ।

আমার মনে হলো এমন সংকট কালে জীবন সম্বন্ধে এত তীব্র উদাসীনতা কোথা থেকে এলো ? অতনু বলে'' হায় রে ! কি অদ্ভুত দর্শন এদের। '' দেখো,এরা কেমন বে আক্কেলে অবিবেচকের দল। ক্ষণিকের আনন্দ সুখে লাভের আশায় নিজেদের জীবনের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনছে। প্রতিটা পল বিন্দাস মস্তিতে উপভোগ করে নিতে এদের জুড়ি নেই। তারপর নিজে মর অন্য যারা সব তোমার সাথে জড়িয়ে আছে তাদের ও মারো। সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া ফলো করে দেখেছি , কি স্বদেশে ,কি বিদেশে ডক্টর ,নার্স স্বাস্থ্যকর্মী পুলিশ এমন কি সোশ্যাল ওয়ার্কার রা বারবার কাতর আবেদনে অনুরোধ জানাচ্ছে যে এমনি করে বেহিসেবী পথে বেড়াতে বেরিয়ে রোগ টাকে এমন করে বাড়তে দিয়ে ছড়াবেন না। সোশ্যাল ডিসট্যান্স বজায় রাখুন। কারণ এই ডক্টর ,নার্স ,স্বাস্থ্যকর্মী ,সমাজ সেবী ,পুলিশ, এ রাও মানুষ তাদের ও বিশ্রামের দরকার আছে তাদের ঘর সংসার রয়েছে তারা অসুস্থ রোগ গ্রস্থ হয়ে পড়লে হস্পিটাল চলবে কেমন করে। তবু দেখছি কি অদ্ভুত ব্যাপার। এই আত্মসুখী মানুষ গুলো ভারী বেপরোয়া। তিন চার মাসের বাচ্চা কে ও প্যারাম্বুলেটরে বা বুকের ব্যাগে বা কাঁধে চড়িয়ে বেরিয়ে পড়েছে। এমন কি আশি নব্বই বয়সের মানুষ গুলোর যেন কোনো চিন্তা ,ভাবনা নেই।এই ভয়ঙ্কর রোগ টা তে শুনেছিলাম খুব বয়স্ক এবং অসুস্থ জনেরাই ক্ষতি গ্রস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে। কিন্তু এই বিদেশে প্রায়ই খবর পেয়েছি কভিড ১৯ এর কোনো বাচ বিচার নেই। সে ছোট বড়ো অসুস্থ পীড়িত কাউকে রেহাই দিচ্ছে না। 

এত দিন পর যাচ্ছি মিষ্টার হ্যারির কাছে। ওর জন্য কিছু উপহার নেওয়া আমার বিশেষ প্রয়োজন। ওনার প্রিয় চুরুট ,আর ভালোবাসার কিছু dry fruits এবং পছন্দের ব্র্যান্ডের ওয়াইন নিতে শপিংমলে ব্রতীন ঢুকেছে। হ্যাঁ তবে হোটেল দোকান বাজারে বাধ্যতা মূলক নিয়ম শৃংখলা অবশ্যই মেনে চলতে হচ্ছে। শপিং মলে একজন ই শুধু ঢুকতে পারবে। লাইনে ও এ কে অপরের থেকে ছয় ফুটের মত ডিসট্যান্স রেখে দাঁড়িয়ে আছে। কেনাকাটা সাড়া হলে পথে আর বেশী সময় নষ্ট না করে চলেছি Monterey  Bay র সমুদ্র উপকূলে। এর মধ্যে গ্র্যান্ডপার গ্র্যান্ড সন সিড তিনবার ফোন করেছে। ,আমাদের বেএরিয়ায় পৌঁছতে দেরী হওয়ায় ওদের চিন্তা করাই স্বাভাবিক। প্রায় ৪৫মিনিট মত লাগবে এখোনো হ্যারি সাহেবের ডেরায় পৌঁছতে। দূর থেকে দেখছি প্রশান্ত মহাসাগরের নীলজল রাশি সাদা ফেনার ঢেউয়ের তালে গড়িয়ে বিশাল গর্জন সমেত ছুটে এসে বালির পাড়ে আছড়ে পড়ছে। দ্বিপ্রহরের রৌদ্র সাদা বালিতে মিশে থাকা অভ্র কুচিতে আলো পরে চিক চিক করছে। সামুদ্রিক পাখিদের অপার স্বাধীনতা, ঢেউয়ের সাথে ভেসে আসা চকচকে রূপালী মাছ শিকারের মহাভোজ চলছে মহা আনন্দে ।

আমরা রিসর্টের পার্কিং জোনের ড্রাইভ ওয়েতে ঢুকতেই যেন ভূত দেখলাম ইয়াম চেঁচিয়ে বলে সিডের সঙ্গে যেন পারভীন কে আসতে দেখছি। অতনু বলে ,তোর মাথা খারাপ ! এখন এখানে পারভীন আসবে কি করে ? দুদিন আগেও কথা বললাম ,ও তো কিছুই জানালো না। মনের কোণে জমে থাকা একরাশ চিন্তা উদ্বেগের মত আমার মাথায় ঘুরছে । গাড়ি থেকে নেমে সত্যি ভূত দেখলাম। শুধু পারভীন নয় মুনিয়া এবং মিষ্টার গ্যারি সাহেব ও সামনে এগিয়ে আসছে। সব দল বেঁধে রাস্তায় নেমে গিয়েছে আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানাতে। আমি একেবারে হতবাক। মিষ্টার হ্যারি বলেন , কন্যে এই হলো তোমার জন্য আমার গ্রেট সারপ্রাইজ। সবাই কে এক জায়গায় করেছি। এখানে রাবেয়া ম্যাডাম কেও পাবে। সে যে আজ নিজে হাতে রান্না করে কিচেন সামলে তোমাদের জন্য ডাইনিং হলে টেবিল গুছিয়ে অপেক্ষা করছে।                     ক্রমশঃ

Post a Comment

0 Comments