পর্ব- ১৪
গৌতম বাড়ই
আজ সুশোভনবাবু অনেকটাই যেন গল্পের মেজাজে ছিলেন, অনেকটা বাড়তি স্ফূর্তি আর খোশ-মেজাজ। ডুয়ার্সের ফালাকাটা থেকে আজ সকালের ট্রেনে কলকাতায় এসেছেন তার ছোটবেলার বন্ধু অভিজিৎ। না কোনও কাজে নয়, একমাত্র সুশোভনের সাথে কয়েকটা দিন কাটাবেন বলে। বসন্তসেনা তার মা বেঁচে থাকতেও তার ছোটবেলা বা কিশোরীবেলায় দেখেছে এই অভিকাকুকে আসতে। তারপরেও দেখেছে। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়েও বার- চারেক বাবার সাথে কাটিয়ে গিয়েছেন, ছোটাছুটি করেছেন বাড়ি আর হাসপাতালে। যে অল্প কয়েকদিন ছিলেন তার কাজের বাইরে পুরো সময়টাই বাবার সাথে পাশাপাশি ছিলেন। তবে সেইসময়টা বাবার দুঃখে সমব্যাথী হয়েই ছিলেন। গম্ভীর আর চাপাস্বরে দুইবন্ধু ভিন্নঘরে আলোচনা করতেন। মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আসতে পারেননি, কারণ অভিকাকুর পরিবারেও সেইসময় ভয়ানক এক বিপর্যয় নেমে এসেছিল। তার বড়দার ছেলে চেন্নাইয়ে নামজাদা এক কর্পোরেট সংস্থায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করতেন এবং বেশ উচ্চ- বেতনে। চেন্নাই হাইওয়েতে মারাত্মক এক গাড়ি দূর্ঘটনায় মারা যান। তখন তার চেন্নাইয়ের বাড়িতে সদ্যজাত ছেলে ও স্ত্রী, ছুটে যেতে হয়েছিল তাকেই। বলতে গেলে দু- চারদিন আগে পরে যুগপৎ একই সাথে এই ঘটনাটি ঘটেছিল তাদের দুই পরিবারের মধ্যে। তারপর কেটে গিয়েছে সময়, আর সময় কী সুন্দর ভাবে বিষাদের গায়ে মাটির নরম পেলব লাগিয়ে দেয়। আমরা আমাদের এই ছোট্ট জীবনে সব আত্মসাৎ করে নেই আবার এগিয়ে চলি। অথচ ভুলি না কিছুই। সবই থাকে এই মনের অন্দরে। বলতে ইচ্ছে করে, ও মন তোর কয়টি প্রকোষ্ঠ রে?
অভিকাকুর আগের কথাও বলছি, আর যখন এই অভিকাকু আসেন, বাবা কেমন ছেলেমানুষ হয়ে ওঠেন, বসন্তসেনা ভাবতে থাকেন। যে বাবা কঠিন কোনও অসুবিধায় না পরলে, পারতপক্ষে স্কুলও কামাই করেন না, সেই বাবা অভিকাকুর সাথে সঙ্গ দেবেন বলে দু- তিনদিন স্কুল কামাই করে কলকাতার এখানে- ওখানে ঘুরে বেড়াতেন। অভিকাকু একাই থাকেন, এ জীবনে আর তার দার গ্রহণ করা হয়নি। ছোটবেলায় সে বোকার মতন কাকুকে প্রশ্ন করেছিল অবশ্য বাবা তাকে পরে বলেছিল, " না, তুই একদমই বোকার মতন প্রশ্ন করিসনি, খুব স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন, যা একটি চেতনা সম্পন্ন বাচ্চা করে থাকে, এটাও তাই।
বসন্তসেনা বলেছিল- " কাকু তুমি যখন এখানে বেড়াতে আসো, একা- একা আসো কেন? কাকীমা বা সাথে ভাই- বোনেদের আনোনা কেন? "
অভিকাকু কী সুন্দর ভাবে তাকে হেসে- হেসে বলেছিল , "বুঝলে হাসনু- মা, তারা কেউ-ই আমার সাথে আসতে চায় না। ঐ ভাই- বোনেদের কথা বলছি, কারণ তোমার কাকিমা যে নেই। আজ পর্যন্ত একটা মেয়েকেও খুঁজে পেলাম না, যে আমায় বিয়ে করে তোমার কাকিমা হবে!" এই বলে হা হা করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিল। বড় হয়ে সে অভিকাকুকে যেটুকু মূল্যায়ন করেছে, তাতে বুঝেছে, ওরকম সরল মানুষ , প্লেজান্ট চরিত্রের লোক খুব কম আছে। এখনও ফালাকাটায় তাদের যৌথ সংসার। দাদা-বৌদি, ভাই- ভাই-বৌদের সাথে একই পরিবারে থাকে। মায়ের অসুস্থতার সময় কাকু আসতে না পারলেও , বারেবারে খবর নিয়েছে, বসন্তসেনাকে আর তার বাবাকে সান্তনা দিয়েছে। এটুকুও বা কেইবা করে! সেই অভিকাকুর অনেক অনেকদিন পর আগমন ঘটল আজ, বাবা স্বভাবতই আজ খুশি এবং ভীষণ খুশির আনন্দ আজ তার মনে। বসন্তসেনা আজ বাড়িতে ঢুকেই টের পেয়েছে।
🍂
অভিকাকু বসন্তসেনা অফিস থেকে বাড়িতে ঢুকে, ফ্রেশ হয়ে যখন বাবা আর কাকুর কাছে গিয়ে বসলেন, অভিজিৎ ওকে জিজ্ঞেস করলেন - " হাসনু- মা, বলতো দীপাবৌদি এই যে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, একেবারেই কী গেলেন চিরদিনের জন্য আমাদের ছেড়ে? তাই কী মনে হয়? না, কখনই তা নয়। তোমার মায়ের এই যে হঠাৎ করে প্রসঙ্গ টেনে আনলাম, তাতে তুমি আমার ওপর খানিকটা অপ্রসন্ন হতে পারো, এবং এটাই স্বাভাবিক। ঠিক কিনা?"
"হ্যাঁ কাকু, তুমি তা ঠিক বলেছ। তবে তুমি বলো, আমি শুনছি সব ভীষণ আগ্রহে। কারণ তুমি আমার মনের বার্তাটি ঠিক ধরে ফেলেছ। তবে এখন আর একটুও অপ্রসন্ন নই। " এই বলে বসন্তসেনা অভিকাকুকে কথা বলতেই বলল।
তিনি বললেন- " আমরা যে তাকে টেনে আনলাম প্রসঙ্গে, এই আমি, কারণ মনে- মনে দীপাবৌদি কিন্তু ঐ যে তোমরা এখনকার ছেলে- মেয়েরা বলোনা, মিস করছি , তার থেকেই, তিনি তার শারীরিক উপস্থিতি দিয়ে হয়ত নেই, কিন্তু তিনি খুব বেশি করেই আছেন এই ঘরের সব জায়গায় তার উপস্থিতি দিয়ে। এই সকাল থেকেই , আমি আর তোমার বাবা , কত- কতবার শুধু তার কথাই বলেছি, তুমি অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর। তুমি তা জানলে ভীষণ অবাক হবে। "
বসন্তসেনা শেলীর দু- চার লাইন কবিতা আবৃত্তি করে ওঠেন, হঠাৎ আবেগে জড়িয়ে-
" What softer voice is hushed over the dead?
Athwart what brow is that dark mantle thrown?
What form leans sadly o'er the white death-bed,
In mockery of monumental stone,
The heavy heart heaving without a moan?"
বাংলা তর্জমা করলে হয়ত দাঁড়ায় -
"ও কার মৃদু স্বর মৃতের উপর নিশ্চুপ করে রয়?
ও কার ললাট ভ্রুতে সেই অন্ধকার আবরণ নিক্ষেপ করা হয়?
সাদা মৃত্যু-শয্যায় দুঃখের সাথে কেমন ঝুঁকে আছে,
স্মারক পাথরে উপহাস করে,
হাহাকার ছাড়াই কি ভারী হৃদয় কাঁপছে?"
"তবে যাই বলো কাকু, একটা হাহাকারও যেন আমাদের মনের মাঝে সবসময় জড়িয়ে থাকে। আমি শেলীর এ্যাডনিস্ থেকে পঁয়ত্রিশ-তম স্তবক থেকে বললাম। " - এই বলে কথা থামলো বসন্তসেনা।
সারাঘরে অদ্ভুত এক বিষাদের সুগন্ধে মন ভরে গেল। বসন্তসেনা অবাক হয়ে দেখল, বাবা আর অভিকাকুর গাল বেয়ে জলধারা নেমে আসছে।
বাবা সুশোভন তা লুকোতেই যেন বলে উঠলেন, " জানিস অভি, হাসনু- মায়ের ভেতরের সত্তায় এক ইতিহাসের নারী সবসময় ঘোরা ফেরে করে । অভিজিৎ বলে - " জানি তো, তুই তো ওকে ওই নারী চরিত্রের ভিতরে প্রতিস্থাপন করেছিস। তার নাম সুসীমা। সেই পৌরাণিক ইতিহাসের অন্তিম সময়ে যে নারী আমাদের বাংলাদেশে এক সাড়া জাগানো নাম। তুই আমাকে আগেও বলেছিলি তার কথা। "
আরও কয়েকদিন তাদের সাথে কাটিয়ে অভিজিৎ তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তার বাড়িতে, ফালাকাটায়, উত্তরবঙ্গে ফিরে যায়। সেই সবুজ গাছ- গাছালি , পাহাড়ি ঝোরা, নদী, বন- বাদাড়, বালিমাটির দেশে। যেখানে চা- বাগান বর্ষার গন্ধ গায়ে মেখে শুয়ে থাকে। অপরূপ সেই দেশ। এই দেশেরই ভেতরে।
সুশোভনবাবু এরপর একদিন রাতে খেতে বসে বলেছিল , "জানিস হাসনু, ঐ তোর অভিজিৎ কাকুর মতন, আমরা উত্তরবঙ্গের মানুষেরা খুব সরল সিধেসাদা মনের। অভি হয়ত ওর যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি চাকরি পায়নি, সামান্য এক বিডিও অফিসের করণিক হয়েই জীবন কাটিয়ে দিল। তবে ওর জীবনের কাছে খুব বেশি চাহিদাও নেই। ওর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে তো দেখেছিলি কী বিপুল পরিমাণ বইয়ের সংগ্রহ, ওই নিয়েই ও সুখে আছে। তবে ওর বড় ভাস্তা মানে বড় ভাইপোর অকস্মাৎ মৃত্যুতে ওর বইয়ের প্রতি আগ্রহে সামান্য হলেও ভাঁটা পড়েছে। এটুকু ওর সাথে থেকে এবারে বুঝেছি। "
বসন্তসেনা বলে ওঠে - "বাবা, তুমি আবার উত্তরবঙ্গীয় হলে কবে থেকে? "
সুশোভন বাবু বলেন- " কেন! আমার পড়াশোনা , ছোটবেলা পুরোটাই তো উত্তরবঙ্গে। তুই তো জানিস মা সবই। "
বসন্তসেনা বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে- " ও তাই বুঝি! তাহলে একদিন তোমার সেই নাকচেপ্টি বুঁচির কথা আবার শুনতে হবে। কী শোনাবে তো? এখন তো আর মা নেই, যে তোমার ওসব কথা শুনে রাগ করবে। আর তুমি জোরে- জোরে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠবে।"
সুশোভন বাবু বলে ওঠেন - " আর তুমিও আমায় একদিন সেই বোকা ছেলেটির গল্প শোনাবে। যে আদৌ সুসীমার নায়ক অনুরের মতন নয়। না চেহারায়, না তার বীরত্বে। একদম তার আশেপাশেও নয়। "
এরপরে বাবা আর মেয়ে দুজনেরই মুখে হাসি ফুটে উঠে। অভিজিৎ চলে যাওয়ার পর , তারা দুজনেই আজ ক'দিন মনমরা হয়ে পড়েছিল। সারাঘরে আজ যেন কেমন করে খুশির ঝিলিকে ভরে গেল।
**শব্দ : ভাস্তা- ভাস্তি= ভাইপো- ভাইঝি ( উত্তরবঙ্গীয় শব্দ)
ক্রমশ
0 Comments