জ্বলদর্চি

বার্লিনের ডায়েরি -পর্ব ৪/ চিত্রা ভাটাচার্য্য

বার্লিনের ডায়েরি -পর্ব ৪
 চিত্রা ভাটাচার্য্য 

ধূলি ধূসরিত পুরোনো দিনের আঁকি বুকি কাঁটা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখা ডায়েরির ঝুরঝুরে পাতা গুলো শ্রীময়ীর সঞ্চিত ভান্ডারের বহু স্মৃতির স্বাক্ষর। ওর নতুন পথের সঞ্চয় বার্লিনে ভ্রমণের গল্প  আজ এতদিন পরে সাজিয়ে লিখতে বসে রাত গভীরে কত কথার মালা  নীরবে গাঁথা হয়ে যাচ্ছিল । সেদিন নভেম্বরের প্রথম দিকে জার্মানীর শীতের আকাশের  চাঁদ ডোবা অন্ধকারে একটু ফ্যাকাসে আলোর রেখা  --প্লেনের জানলা দিয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকেও পূবের আকাশের কোলজুড়ে ভোরের বেলা কমলা রঙা আলোর ছটায় সদ্য জাগ্রত সূর্য্যের প্রথম প্রকাশের অপরূপ রূপটি দেখতে না পেয়ে ভাবছে বুঝি এখনো ভোর হ'তে অনেক দেরী।তাহলে এতো অন্ধকারে তিতির এয়ারপোর্টে আসবে কেমন করে?  এদিকে ঘড়িতে ভোর পাঁচ টা। আলো আঁধারি কুয়াশায় ঢাকা  আকাশে কয়েক বার চক্কর কেটে অবশেষে টেগেল এয়ারপোর্টের রানওয়ের  ওপর ঝুপ করে নেমে  মাটি দাঁপিয়ে থামলো এমিরেটসএয়ার ওয়েসের প্লেন' টি। যদিও  বিদায়ী বাঁশি বাজিয়ে রাত অনেক আগেই  অন্তর্ধান হয়েছিল  কিন্তু শীতের কুয়াশায় ঢাকা আকাশে প্রতুষ্যার আলোর দেখা নেই।  

  অফিসিয়াল ফর্মালিটি সেরে লাগেজ সংগ্রহের জন্য মহাব্যাস্ত হয়ে পড়েছিল ঋষভ । বিদেশের মাটিতে পা রেখে সঙ্কোচে ভয়ে -- দ্বিধা দ্বন্দ দুশ্চিন্তায় উৎকণ্ঠায় রীতিমত আচ্ছন্ন হয়ে আছে মন , সেই সময় দূর থেকে শ্রীময়ীর সতৃষ্ণ নয়ন দেখতে পেয়েছিলো --এয়ারপোর্টের বিশাল কাঁচের বাইরে ,দরজার অপর প্রান্তে  লাল ওভারকোট টুপির  আড়ালে আপাদমস্তক আবৃতা অদ্রিজা মা -মা বলে চেঁচিয়ে উঠে ,দুই হাত  শূন্যে তুলে কিশোরী মেয়ের মত লাফাতে শুরু করেছে। বিদেশের মাটিতে এমন মা ডাকের স্পষ্ট উচ্চারণ অদৃজার গলার আওয়াজ এক নিমেষে উতলা মায়ের মনে স্নিগ্ধ শান্তির বারি ধারা ছুঁইয়ে দিল। ঋষভ ও ভাবে তার কন্যা তিতির  ছাড়া এই বিদেশে এমন মা বলে আর কে চিৎকার করবে ? ওর  মোটেই তর সইছে না ,পারলে এক  ছুটে ভিতরে ঢুকে আসে।  কি যে করবে তাও বুঝতে পারছে  না। এমন বাঁধভাঙা  আনন্দের অভিব্যক্তির কোনো ভাষা নেই। ওর টানা আয়ত চোখের পাতায় অনাবিল বয়ে চলেছে আষাঢ়ের আনন্দ ধারা। একটানা কাঠফাঁটা গ্রীষ্মের রৌদ্রের পর হঠাৎ বর্ষার মেঘের বৃষ্টির ধারায় মন যেমন আনন্দে মেতে ওঠে , সেই ক্ষণে মা ও প্রবাসী কন্যার হৃদয় জুড়ে চলছে তারই বহিপ্রকাশ। যেন সহস্র ময়ূরময়ূরী এক সাথে পেখম মেলে দিয়েছে মনের অদৃশ্য আঙিনাতে।  

 এখানে সূর্যোদয় হয় খুব দেরীতে ,ঠান্ডা হাওয়া বইছে। বার্লিনের আকাশ মাটি প্রাত্যহিক জীবন সস্নেহে  মায়ার বাঁধনে ঘুমিয়ে আছে।সময় গড়িয়ে চলেছে ; ঋষভ বলে ভারত বর্ষ থেকে বার্লিনের টাইম ডিফারেন্স পাঁচ ঘন্টার মত অর্থাৎ ভারতীয় ঘড়িতে দুপুর বারোটা হবে। টেগেল এয়ারপোর্ট থেকে অদ্রিজার সাথে কিছুটা রাস্তা হেঁটে বাইরে বেরিয়ে অবাক শ্রীময়ী ভাবে পরিচিত দুনিয়ার ঘরের চার দেওয়ালের গন্ডি ছেড়ে বাইরে বেরোলে বোঝা যায় এই বিশ্বলোক ,এই বিশাল পৃথিবী কত তার ব্যাপ্তি ;কত তার ঐশ্বর্য্য। একই পৃথিবীর কত রূপ কত সীমাহীন সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ। কত বৈচিত্র্য ময়তায় পরিপূর্ণ তার প্রতিটি অঙ্গ।এতো সুন্দর ছবির মত সাজানো শহর ,শীতের কুয়াশার চাদরে ঢাকা,স্বল্প আলো আঁধারিতে যেন মাত্র ঘুম ভাঙা চোখে বুঝে নিতে চাইছে জীবনের চাওয়া পাওয়া কে। অবাক বিস্ময়ে হাঁ করা মন শুধু তাকিয়ে থাকে চোখের পলক পড়ে না।
🍂
এয়ারপোর্টে থেকে বাসে উঠে আবার উইন্ডো সীটে বসে পথ দেখা শুরু,বহি প্রকৃতির সাথে ক্ষণিকের মিলন। দূরে নদীর মত দেখা যায় ,পথের কিনারা দিয়ে নিরন্তর বয়ে চলেছে কত বাঁক ঘুরে কাঁচের মত স্বচ্ছ নীল জলের ধারা। তিতির বলে নদী নয় লেক ,শহর ময় এমন প্রচুর আছে।   অপর প্রান্তে সবুজ গাছেদের সমারোহ ঘনবন বিথীকায় শৃঙ্খলিত ভাবে সাজানো বাগান।পাতারা সব হলুদ রঙে স্নান করেছে ,কোথাও আবার লালচে পাতার বাহার তারই মাঝে অল্প সবুজের ছোঁয়া লেগেছে। শীত হামাগুড়ি দিয়ে এসে যাওয়ায় পর্ণমোচি বাগানের গাছ গুলো নিস্পত্র ডালপালা মেলে নিঃস্বের মত দাঁড়িয়ে আছে। হাওয়ার দোলায় পাতা ঝরছে অনবরত আর গল্প লেখা হয়ে চলেছে নতুন কিশলয়ের। অন্য দিকে  চিরহরিৎ গাছের বন।  পাতার ফাঁকে সবুজ আলো উঁকি দিয়ে যায়। শ্রীময়ী বলে কী অপরূপ !প্রকৃতির অনুপম রূপের মাঝে এ শহর গড়ে উঠেছে। অদ্রিজা ভুল ভেঙে দিয়ে বলে, ঠিক তা নয়। এই নদী হ্রদ বন,উপবন ,ঐ সুদৃশ্য ফাউন্টেন সব এখানকার সৌন্দর্য প্রিয় মানুষের নিজের হাতে তৈরী একটি কৃত্রিম সিটি পার্ক। পীচ ঢালা হাইওয়ের চকচকে কালো মসৃণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে ঋষভ স্বগতোক্তি করে  স্লেট রঙা নীলচে আকাশের তলে মিলে মিশে একাকার এ শহর যেন লাল নীল হলদে সবুজ রঙের ছোঁয়ায় চিরযৌবনের দূত।  

এয়ার পোর্ট থেকে বাসে ঠিক আধ ঘন্টায় তিতিরের আস্তানায় পৌঁছে গিয়ে শ্রীময়ীর আরো অবাক হবার পালা। সুসজ্জিত পুরোনো আমলের রাজ প্রাসাদের মত বিশাল বাড়ি। তারই চার তলায়  এপার্টমেন্ট। ,একদম মেইন রোডের ওপর ,বাস স্টপেজের কাছেই। বিশাল বাড়িটা গথিক আর্টের জীবন্ত নিদর্শন। গোল গোল পিলার বসানো, খিলান, রাস্তা থেকেই কত গুলো কত গুলো সিঁড়ি পেরিয়ে      প্রাসাদের মেইন দরজায় পৌঁছতে হবে। লম্বা চওড়া সেগুন কাঠের পালিশ করা সিঁড়ি ও রেলিঙ লাগানো। কার্পেট পাতা মজবুত তেমন ই কারুকার্য্য ময় ,ইউরোপিয়ান স্টাইলে সাজানো। কালো বার্নিশ করা বিশাল ভারী এক মজবুত দরজায়  রাজকীয় চকচকে পেতলের হাতল লাগানো বেশ আভিজাত্যের পরিচয় বহন করছে। পুরোনো আমলের বাড়ি লিফ্ট নেই , ঠিক ইংলিশ সিনেমাতে যেমন বাড়ি গুলো দেখায়। সিঁড়ি বেয়ে চার তলায় উঠতেই শ্রীময়ী বেশ হাঁপিয়ে সারা।

 ঘরদোর কিচেন ঘুরে বেডরুমের সংলগ্ন স্কয়ার  সুন্দর   ব্যালকনিটি  তে এসে দাঁড়ালো ,দরজা খুলতেই তীব্র শীতল হাওয়া গালে চড় মেরে যায় । রাস্তার ধারে দুইপাশে একই রঙের একই উচ্চতার একই মাপের ভারী সুন্দর বিল্ডিং গুলো শহর টাকে অপরূপ  করে তুলেছে। মাথার ওপরে এক টুকরো মেঘলা বরণ আকাশী আকাশ-- তার প্রাণ ময় অসীম উদারতা। নীচের দিকে ওক বার্চ আর ম্যাপেল গাছ গুলো পথের ধারে সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে। আঁকা বাঁকা কালো রাস্তাটি বিশাল সরীসৃপের মত চকচকে দেহে  দূর দূরান্তে মিশে গিয়েছে। ওর ওপর দিয়ে অনবরত বিভিন্ন ধরণের হাজার হাজার গাড়ি--- বাস ট্রাম ট্যাক্সি প্রাইভেট গাড়ির প্রতি মুহূর্তে কর্ম ব্যস্ত চলাচল। সদা ব্যস্ত রাস্তা ওপর থেকে বড়ো সরো গাড়ি গুলোকে দম দেওয়া খেলনার গাড়ির মত ছোট্ট  লাগছে। নীচে চারদিকে দোকান পসার গ্রসারি শপ মেডিকেল স্টোর সিনেমা হল একে বারে জমজমাটি পরিবেশ। ব্যস্ততায় ভরা শহরের হৃদয়ের কেন্দ্র বিন্দুতে এসে পৌঁছেছি। এই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বা কাঁচের জানলার পাশে বসে নীচের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলে দিন রাত অনায়াসে কেটে যাবে।    

  সম্পূর্ণ একলা এই এত বড়ো ফ্ল্যাটে  এই মেয়ের রাত দিন কাটে কেমন করে ? দেখেই তো গা ছমছম করা এক অজানা ভয় শ্রীময়ী কে আতঙ্কগ্রস্থ করলো। নির্বাক মুখে বিস্ফারিত চোখে শুধু তাকিয়ে থাকে। অদ্রিজা বলে কি ভাবছো অতো ?এত বড়ো ফ্ল্যাটে একা !, ভয় লাগে কিনা ? দেখো এই বাড়িটা যখন ভাড়া  নিয়েছিলাম তখন দুজন পার্টনার ছিল ,পরে  ওরা অন্য ইউনিভার্সিটিতে চলে যাওয়ায় আমি এখানেই থেকে গেলাম। এখানে বেশ সুবিধা ,আমার ম্যাক্সপ্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট এবং ল্যাব খুব কাছে। নীচে নামলেই বাস স্টপ ,হাঁটা পথে ট্রেন স্টেশন মাত্র চারটে স্টপেজ।পাঁচ মিনিটে পৌঁছোনো যায়। এয়ারপোর্ট ও মাত্র আধঘন্টা। তোমরা যখন এসে থাকবে  তখন ছোট নিলে চলবে কেন ? তবু যত রাজ্যের অসম্ভব কল্পনা শ্রীময়ীর মনে দানা বাঁধে ,প্রশ্ন উত্তরে ব্যতিব্যস্ত করে তুললে তিতির আস্বস্ত করে  বলে "  বেকার চিন্তার  কোনো  কারণ নেই  এখানে পথে ঘাটে চলা ফেরায় লাইফ খুব সুরক্ষিত অন্তত আমার দেশের থেকে। কোনো উটকো বিপদ আপদের অভিজ্ঞতা এই আড়াই বছরে হয়নি। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সমান অধিকার পায়।  সবার সমান স্বাধীনতা। আইন  সবার জন্য এক ,অমান্য করলে শাস্তি আছে। ওরা ফোন নাম্বার দিয়েছে ,যে কোনো বিপদে একটা কল করলেই সিকিউরিটি গার্ড আসবে। '' 
               চলার পথে-- বার্লিন শহর।

শ্রীময়ী গালে হাত দিয়ে শোনে আর ভাবে , জীবনের অন্তহীন পথ পরিক্রমায় কখন কোন বাঁকে এসে মানুষ নিজেকে কোথায় কেমন করে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে ? আগের থেকে কেউ কখনো জানেনা। পথ চলতে গিয়ে নির্দিষ্ট রাস্তাটি পথিক নিজেই খুঁজে নিয়ে হয়তো একদিন চরম লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। এতো দিন চোখে দেখা হয়নি তাই এতো আশঙ্কা ও হয় নি। আসলে সারা সপ্তাহ এমন কি উইকেন্ডে অদ্রিজার ল্যাবেই কাটে। রাতে ফিরে রান্না ও ডিনার সারার পরে বই হাতে ঘুমোনো।

 কি জানি কেন ওদের মনে হয় এই মেয়ে অনায়াসে জীবনের কণ্টকময় বন্ধুর চলার পথের সব কাঁটা হেলায় জয় করে আরো বিস্তর পথ এগিয়ে যাবে  কোনো জগদ্দল পাথরের স্তূপ ওর যাত্রা পথের গতি রুখতে পারবে না।  এতো সৎপ্রচেষ্টা আর নিরলস কর্মোদ্যম এবং আত্মবিশ্বাস তার পুরস্কার কি এই দুনিয়ায় সত্যি পাওয়া যাবে ? সেইক্ষণে শ্রীময়ী তার অদেখা ভাগ্য বিধাতা -- ঈশ্বরের পায়ে শত কোটি প্রণাম জানালো। ওরা আজ ধন্য । এমন ভাবে ঘর ছেড়ে যা কিছু প্রিয় সব ত্যাগ করে এক নির্বাসিত জীবন যাপন ,  একাকিত্ব জয় করে লক্ষ্যের পথে এগিয়ে গিয়ে অভীষ্ট সিদ্ধি লাভ করা এ শুধুই  "তোমার আশীর্বাদ হে প্রভু তোমার আশীর্বাদ। " শ্রীময়ীর আনন্দ উপচে পরে , ঋষভ কে বলে দেখ ,আজকের দিনের মেয়েরা জীবন যুদ্ধে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে একটুও পিছিয়ে নেই !আমাদের তিতির  কেমন  লড়াই করে দিনে দিনে বলিষ্ঠ সংগ্রামী সৈনিক হয়ে উঠেছে।
                                                                ক্রমশঃ

সংগ্রহ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ -৯৭৩২৫৩৪৪৮৪

Post a Comment

0 Comments