জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ২৫/বিজন সাহা

আলেক্সান্দর নেভস্কি নভইয়ামারচনি সাবর বা নেভস্কি গির্জা


ভোলগা নদীর খোঁজে – ২৫

বিজন সাহা 

নেভস্কি গির্জা ও চকালভ সিঁড়ি 


বেরিওজোভাইয়া পইমা থেকে দুপুরের পর পর আমরা এলাম নেভস্কি গির্জায়। ওকা যেখানে ভোলগায় পড়ছে সেখানে অবস্থিত হলুদ রঙের এই গির্জাটি। এর পুরো নাম আলেক্সান্দর নেভস্কি নভইয়ামারচনি সাবর। নভইয়ারমারচনি মানে নতুন মেলা বা বাজার। এক সময় ওকা নদীর ওপার থেকে নভগোরাদের বিখ্যাত বাজার বা মেলা রুশে যাকে বলে ইয়ারমারকা এখানে স্থানান্তরিত করা হয়, তাই এটা নতুন মেলা বা নভইয়ারমারকা নামে পরিচিত। আর গির্জা তৈরি করা হয় বিখ্যাত রুশ বীর আলেক্সান্দর নেভস্কির সম্মানে। আলেক্সান্দর নেভস্কি ছিলেন পেরেস্লাভল- জালেস্কির রাজা (পরবর্তীতে কিয়েভ ও ভ্লাদিমিরের গ্র্যান্ড ডিউক) ইয়ারোস্লাভল ভসেভোলোদোভিচের দ্বিতীয় পুত্র, নভগোরাদের রাজা ও কিয়েভ এবং ভ্লাদিমিরের গ্র্যান্ড ডিউক। তিনি ছিলেন সেই সময়ের রুশ দেশের অন্যতম প্রধান সেনাপতি যিনি বিভিন্ন যুদ্ধে ফিন, লিথুনিয়ান ও জার্মানদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। তাঁকে পরবর্তীতে রুশ চার্চ সেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে।  

সম্রাট দ্বিতীয় আলেক্সান্দরের এই মেলায় আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে নিঝনি নভগোরাদের বনিকরা ১৮৫৬ সালে একটি গির্জা তৈরি করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং দীর্ঘ ১০ বছর অর্থ সংগ্রহের পরে ১৮৬৬ সালে গির্জা তৈরি কাজ শুরু হয়। ১৮৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিক ভাবে এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। কিন্তু অর্থাভাবে অনেকদিন কাজ বন্ধ থাকে। শেষ পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ হলে ১৮৬৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নতুন করে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় এবং বিখ্যাত স্থপতি লেভ দালের নকশা অনুযায়ী ১৮৬৮ থেকে ১৮৮১ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে ৮৭ মিটার উঁচু এই গির্জা তৈরি করা হয়। যদিও ১৮৮০ সালেই গির্জার নির্মাণকাজ শেষ হয় তবে ১৮৮১ সালের ২০ জুলাই সম্রাট তৃতীয় আলেক্সান্দরের উপস্থিতিতে একে পবিত্র করা হয়। জার আমলে এই গির্জা ছিল শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মিলনস্থল। 

১৯২০ এর দশকের শেষের দিকে গির্জা ভেঙ্গে সেখানে লেনিনের মূর্তির আকারে একটা বাতিঘর স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। তবে বিভিন্ন কারণে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯২৯ সালে গির্জা বন্ধ করে দেয়া হয় আর এর সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৯৩০ সালের শীতকালে ভোলগার নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গির্জার আইকন ও অন্যান্য কাঠের জিনিস স্থানীয় লোকদের ঘর গরম করার জন্য লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে গির্জার ভক্তরা কিছু কিছু আইকন রক্ষা করতে সক্ষম হয়। পরে গির্জাকে গুদাম ঘরে   পরিণত করা হয়। আর দ্বিতীয়  বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বিমান আক্রমণ থেকে শহর রক্ষা করার জন্য গির্জার শীর্ষদেশে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট মিসাইল বসানো হয়। এসব ঘটনা সোভিয়েত শাসনের প্রথমার্ধে ধর্মের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্কের ধারণা দেয়। ১৯৮৩ সালে সাবরের পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৯২ সালে নেভস্কি সাবর রুশ চার্চের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২০০৬ সালে সাবর পূর্ব রূপ ফিরে পায়।  আরও কয়েক বছর লাগে আভ্যন্তরীণ চিত্রাঙ্কন কর্ম শেষ করতে।  ১৬১২ সালে কুজমা মিনিন ও যুবরাজ দ্মিত্রি পঝারস্কির বীরত্বের ৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে গির্জার সামনে চার মিটার উঁচু ও চার মিটার ব্যাসের ৬০ টন ওজনের একটি ঘন্টা বা বেল স্থাপন করা হয়। 

চকালভ সিঁড়ি

সেখান থেকে বেলা তিনটের দিকে আমরা আসি ক্রেমলিনের পাশে ভোলগার তীরে। সেখানে গাড়ি রেখে এদিক সেদিক হাঁটতে শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় আসি মিনিন ও পঝারস্কি স্কয়ারে। ঠিক ক্রেমলিনের নীচেই এই স্কয়ার। সেখানেই দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিই। উদ্দেশ্য ছিল ক্রেমলিন ঘুরে দেখা, কিন্তু খেতে খেতেই দেমিদ  একটা বাসা পেয়ে যায়। তাই আমরা যাত্রা করি নতুন আস্তানায়। সেখানে জিনিসপত্র রেখে একটু রেস্ট নিয়ে আবার পথে। আমাদের নতুন বাসাটা ছিল নদীর যে পাড়ে নেভস্কি গির্জা সেখানে। তাই যাই সেদিকেই। পথে আমরা গেলাম ডেকাথেলন নামে এক সুপার মার্কেটে। দিলীপ আর দেমিদ প্যান্ট কিনল। এছাড়াও দেমিদ কিনল এক জোড়া জুতা। আমাদের দাড় করিয়ে ও গেল বাথরুমে। যখন বেরুলো দেখি ওর পায়ে নতুন জুতা। পুরানো জোড়া ফেলে এসেছে। জিজ্ঞেস করায় বলল, এক জোড়াই তো যথেষ্ট, অযথা আরেক জোড়া টেনে কী হবে? আমি গেছি ২০ দিনের ট্রিপে। আমার সাথে দু সেট এক্সট্রা জামাকাপড় ছিল, ও বলতে গেলে সাথে কিছু নেয়নি, রাতে জামাকাপড় ধুয়ে শুকাতে দিত। বললে বলত কি দরকার অযথা জামাকাপড় টেনে। দরকার হলে দোকান থেকে কিনে নেব। বর্তমান ভোগবাদী সমাজে এ এক ব্যতিক্রম। 

🍂

অদূরেই দেখা যাচ্ছিল স্টেডিয়াম। ২০১৮ সালে এখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বকাপের খেলা। সেটার পাশ দিয়ে আমরা আবার গেলাম নেভস্কি গির্জার দিকে। সকালে ছিলাম খুব অল্প সময়। তেমন কিছু একটা দেখা হয়নি। যাহোক, অনেক দূরে গাড়ি রেখে আমরা আবার গেলাম এই বিশাল কমপ্লেক্সে। যে যার যার মত। আমি নদীর তীরে, দিলীপ গির্জার দিকে। নদীতে বিভিন্ন ধরণের বোট, জাহাজ। এখানে ভোলগা অনেক প্রশস্ত, লোকজন বোটে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নদীর ওপারে দেখা যাচ্ছে নভগোরাদ ক্রেমলিন। তবে নিচু পাড় বললেও আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটা নদীর তীর থেকে অনেক উপরে। রেলিং দেয়া। বেশ কিছু ছবি তুলে আমিও গেলাম গির্জার দিকে। প্রচুর লোকজন ঘোরাফেরা করছে। মনে হল এটাও স্থানীয় মানুষের প্রিয় জায়গাগুলোর একটা। 

ভোলগার উঁচু পাড়

ইতিমধ্যে বেলা গড়িয়ে গেছে। আমার খুবই ইচ্ছা ছিল এখান থেকে ক্রেমলিনে যাওয়ার। আবার কচালভ সিঁড়িও হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। বলা হয় এখান থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য অপূর্ব। এরকম সিঁড়ি দেখেছি ওদেসায়, সাগর তীরে। সেটার নাম পাতিওমকিন সিঁড়ি। আমরা যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছুলাম ধীরে ধীরে লোকজন জমতে শুরু করেছে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তৈরি  কচালভ সিঁড়ি নিঝনি নভগোরাদের ভোলগার উঁচু পাড়ে অবস্থিত। আগে এই জায়গার নাম ছিল ভোলগার ঢাল বা স্লোপ। প্রাচীন কাল থেকে এখানে একটা উঁচু ঢিবি ছিল যেখান থেকে ভোলগা নদী ও অন্য তীরের অসাধারণ দৃশ্য চোখে পড়ত। ফলে জায়গা শহরবাসীর কাছে বরাবরই প্রিয় ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে এখানে ছিল মেয়েদের মনাস্তির। অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ হলে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে সেটা সরিয়ে নেয়া হয় আর এই এলাকা ব্লাগোভেশেনস্কি স্কয়ারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।  উনবিংশ শতকের ৩০ - ৪০ সালে সম্রাট প্রথম নিকোলাই এখানে বেড়াতে এলে ভোলগার ঢালের উন্নয়ন করা হয়, আর তখনই এখানে গিওরগিয়েভস্কসি বাঁধ তৈরি করা হয় যা বর্তমানে ভেরখনোভোলঝস্কি বা আপার ভোলগা বাঁধ নামে পরিচিত। এই বাঁধের শুরুতে যা বর্তমানে মিনিন ও পঝারস্কি স্কয়ার নামে পরিচিত সে সময় ব্লাগোভেশেনায়া গির্জা অবস্থিত ছিল, যার ফলে তখন এই জায়গার নাম ছিল ব্লাগোভেশেনস্কি স্কয়ার। ভোলগায় নামার সুবিধার জন্য গিওরগিয়েভস্কসি বাঁধের উভয় দিকে  গিওরগিয়েভস্কসি ও কাজানস্কি সিঁড়ি তৈরি করা হয়। গিওরগিয়েভস্কসি সিঁড়ি শুরু হয় ব্লাগোভেশেনস্কি স্কয়ার থেকে। নীচে নিঝনে ভোলঝস্কায়া নামে আরও একটা বাঁধ তৈরি করা হয়। কিন্তু এর পরেও শহরের কেন্দ্রও থেকে ভোলগায় নামা শহরবাসীর জন্য সহজ হয় না। এই সমস্যা বিপ্লবের পূর্বে এভাবে অমীমাংসিতই থেকে যায়। ১৯৩০ এর দশকে নিঝনি নভগোরাদে জন্মগ্রহণকারী ভালেরি কচালভ বিমান চালনায় বিভিন্ন রেকর্ড স্থাপন করে সারা বিশ্বে সুনাম কুড়ান। কথিত আছে তিনি নাকি লেনিনগ্রাদের ব্রীজের নীচ দিয়ে ছোট বিমান চালিয়েছিলেন। দেশে বেড়াতে এলে তিনি এখানে ঘুরতে পছন্দ করতেন। একবার বন্ধু স্থপতি ইসাক মেন্দেলেভিচের সাথে ঘুরে বেরানোর সময় তিনি মাক্সিম গোর্কির স্ট্যাচুর জন্য স্থান নির্ধারণ করেন। ঘটনাক্রমে এটা ছিল সেই উঁচু স্থান যেখান থেকে ভোলগার অপূর্ব দৃশ্য দেখা যেত। কিন্তু গোর্কির স্ট্যাচু অন্যত্র স্থাপিত হয়। ১৯৩৮ সালে কচালভ মারা গেলে গোর্কির পরিবর্তে এখানে স্থান পায় ভালেরি কচালভের স্ট্যাচু। এই সময় নিঝনি নভগোরাদ শহর সোভিয়েতের সহসভাপতি আলেক্সান্দর শুলিপিন উপর ও নীচের দুই বাঁধ সিঁড়ি দ্বারা সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। এভাবেই এখানে তৈরি হয় বিখ্যাত সিঁড়ি। প্রথমে এই সিঁড়ির নাম রাখা হয় স্তালিনগ্রাদ, পরে ভোলঝস্কি। কে জানে স্তালিনগ্রাদের নাম ভোলগাগ্রাদ হবার সাথে এর সংযোগ আছে কি না। তবে মানুষের কাছে এই সিঁড়ি কচালভ সিঁড়ি নামেই পরিচিত হয়। 

আমরা এখানে বেশ কিছুক্ষণ কাটাই। লাল সূর্য ভোলগার ওপারে অস্ত যাচ্ছিল। বিভিন্ন বয়সের লোকজনে ভরে গেছে তখন সিঁড়ি। সবাই ব্যস্ত ছবি তুলতে। সূর্যকে বিদায় জানিয়ে আমরা রওনা হই বাসার দিকে। পরে জানতে পারি সেদিন ছিল নিঝনি নভগোরাদের প্রতিষ্ঠা দিবস। হয়তো এ কারণেই শহরের সর্বত্র ছিল অসংখ্য মানুষের ভিড়। 

ছবিতে নিঝনি নভগোরাদ 

http://bijansaha.ru/album.php?tag=248

নিঝনি নভগোরাদ ভিডিও
https://www.youtube.com/watch?v=mUP1yA5m0JE&t=1267s

 


Post a Comment

0 Comments