জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -১৫৩

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা  ১৫৩
চিত্রগ্রাহক মৃণাল ঘোষ
সম্পাদক -মৌসুমী ঘোষ 
সম্পাদকীয়,
আমরা কথাটার মধ্যে একটা পরিবারের গন্ধ আছে। পরিবার মাত্রই হৈ হৈ রৈ রৈ, খেলাধুলা, মারপিট আর খাওয়া দাওয়া। এমনই এক পরিবারের ছবি এবারের প্রচ্ছদে, মৃণাল আঙ্কেলের ক্যামেরায় উঠে এসেছে। বড়ো পরিবারের সবাই যে সব সময় কাছেই থাকবে তা কিন্তু নয়। সুকুমার জেঠুর ছোটোকাকুর কান্ডকারখানাতে ছোটোকাকু তো বিদেশে থাকে। তাই না? কাকু বাড়ি আসে উৎসবের সময়। কোন উৎসব বলতে হবে না কি? যে উৎসবে কাশফুল ফোটে, বিপ্লব জেঠুর ছড়ার মতো। যে উৎসবে সাদা মেঘের ভেলা চেপে মেঘবালিকা উড়ে বেড়ায়, সবিতা পিসি তার ছড়ায় বলেছে। তবে উৎসব মাত্রই যে শুধু আনন্দ বয়ে আনে তা কিন্তু নয়। অনেকবার পুজোর সময় বৃষ্টি হয়। তখন বৃষ্টি হয়ে যায় ভিলেন। ঠিক রামায়ণের রাবণের মতো। মানসী পিসি সের রাবণের কথা বলেছে। শুধু রাবণ কেন পরিবারে কত কত রকমের মানুষ থাকে। যেমন অনাদি বাবু। তিনি কে? শর্মিষ্ঠা আন্টির গল্প পড়ে জেনে নাও। টিপুদের পরিবারের গল্প বলেছে কৌশিক আঙ্কেল। আর সৌর পরিবারের হেড সূর্যের ছড়া বলেছে দীপঙ্কর আঙ্কেল। আমাদের জ্বলদর্চি পরিবারের ভ্রমণ পিপাসু মলয় জেঠুর কাছে শুনে নাও হলুদ পাথরের দেশের গল্প। আর প্রীতেশ, আনিসা, শুভশ্রী, শুভঙ্করের আঁকায় উৎসবের আনন্দে আর একবার চলি চল। শেষে ছোটোবেলা পরিবারের সকলকে বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা। ......  মৌসুমী ঘোষ।
ধারাবাহিক উপন্যাস
ছোটোকাকুর কান্ডকারখানা
পর্ব ৩
সুকুমার রুজ

 তিন 
ড. শুভদীপ রায় এবার পল হ্যারির পাঠানো ই মেল-টা খুলে পড়তে শুরু করেছেন। পল চিঠিটাতে ইংরাজিতে যা লিখেছেন, তাঁর বাংলা মোটামুটি এরকমঃ  
  ''প্রিয় বিজ্ঞানী শুভদীপ রায়,
প্রথমে আমার নমস্কার নেবেন। আপনাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় জানানোর জন্য এ চিঠি। সম্প্রতি আমি প্রত্নতাত্ত্বিক রবিন চার্লের আহ্বানে ভিন্ডোল্যান্ডার দুর্গ থেকে পাওয়া কিছু চিঠি ও দলিলের লিপি উদ্ধারের কাজ করছি। এ কাজ করতে করতে একটা অদ্ভুত চিঠি পেয়েছি। চিঠিটাতে আপনার গবেষণা করার মতো বা কাজ করার মতো একটা ফরমুলা রয়েছে। প্রায় দুশো বছর আগে এ চিঠিখানা লিখেছেন লুসিয়াস নামের একজন। তিনি ছিলেন একজন সামরিক ডাক্তার। সালপিসিয়া লেপিদিনা নামের কোনও এক মহিলাকে ‘স্যালুটেম’ সম্বোধন করে এই চিঠি। চিঠির লিপি উদ্ধার করে যা পড়তে পারলাম, তার মূল কথা হল — ‘ভেষজ পদ্ধতিতে প্রাণীদেহে এমন এক বৈশিষ্ট্য বা গুণ উৎপন্ন করা সম্ভব; যাতে প্রাণীরা উদ্ভিদের মতো নিজেদের শরীরের মধ্যেই নিজের খাদ্য তৈরি করে নিতে পারে।’     
  যদি সত্যি সত্যিই এমন করা সম্ভব হয়, তাহলে এটা হবে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। এ ফরমুলাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষমতা আপনার আছে বলে আমি মনে করি। তাই আপনাকেই প্রথম এ চিঠির কথা জানালাম। আপনি চাইলে চিঠিটার ফোটোকপি আমি আপনাকে পাঠাতে পারি। কিন্তু সম্ভবত আপনি এর ভাষা উদ্ধার করতে পারবেন না। তাই আমি চাইছি, আপনি সম্মত হলে, আমরা দু'জনে মিলে এ কাজটি করতে পারি। আপনার মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।''  
                           আপনার বিশ্বস্ত 
                              পল হ্যারি    
  ই মেল-টা পড়ে শুভদীপ খুব উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। যদি সত্যি সত্যিই ওই পুরোনো চিঠিটাতে কোনও ভেষজ ফরমুলা দেওয়া থাকে এবং সেটাকে কোনোভাবে বাস্তবে রূপ দেওয়া যায়, তাহলে তো সারা পৃথিবীর উপকার হবে। সেই সঙ্গে চাই কী, নোবেল পুরস্কার ও মিলে যেতে পারে।  
  ড. শুভদীপের মানসিক উত্তেজনা কিছুটা কমলে উনি পল হ্যারিকে উত্তরপত্র লেখা শুরু করেন। জানিয়ে দেন, উনি এখন একমাসের ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছেন। ফ্লোরিডাতে ফিরে গিয়ে অবশ্যই যোগাযোগ করবেন। এর মধ্যে এ ব্যাপারটা যেন অন্য কাউকে না জানানো হয়, এ অনুরোধও করেছেন।      
  চিঠিটা লিখে পাঠানো শেষ হতে না হতেই আর একটা ই মেল ঢোকে। পাঠিয়েছেন বন্ধু পরিবেশ-বিজ্ঞানী স্যামুয়েল জনসন। জানিয়েছেন —    
''আমি আর মহাকাশ-বিজ্ঞানী আইভ্যান ডিক্সন দু’জনেই ভারতে আসছি এক সপ্তাহের মধ্যেই। পরিবেশ-বন্ধু ছোট্ট বিমান নিয়ে আমরা ওয়াশিংটন থেকে রওনা হয়েছি এক সপ্তাহ আগেই। নতুন বিমানটার নাম 'হেলিপ্লেন'। জ্বালানি তেল লাগে না। হাইড্রোজেন সেল ব্যাটারিতে চলে। এর দ্বারা কোনও দূষণ হয় না। কারণ এর ধোঁয়া মানে জলীয় বাষ্প শুধু। বিমানের প্রযুক্তিতে এটা ওড়ে, আবার হেলিকপ্টারের মতো মাঠে ময়দানে নেমে যেতেও পারে, রানওয়ে লাগে না। তাই আপনার বাড়ির কাছে ল্যান্ড করতে আমাদের কোনও অসুবিধা হবে না। আপনি শুধু এয়ারওয়ে লোকেশনটা আমাকে মেল করে দিন। 
  ইন্ডিয়াতে আমাদের যাওয়ার উদ্দেশ্য পরিবেশ দূষণ ও তার সচেতনতা বিষয়ে প্রচার। শুধু ইন্ডিয়া নয়, অনেকগুলো দেশ ঘুরে ঘুরে প্রচার করতে করতে আমরা যাচ্ছি। আশা করি, আপনি আমাদের এই প্রচারে সহযোগিতা করবেন। 
  আমরা তিনদিন থাকবো। আপনার পরিবারের সকলে মিলে হেলিপ্লেন'-এ চড়ে প্রচারে বেরোবো। 
নমস্কার নেবেন।
                                আপনার বন্ধু  
                              স্যামুয়েল জনসন 
  শুভদীপ এ মেল-টা পেয়ে খুব খুশি হয়েছেন। স্যামুয়েলের যে ওর কথা মনে পড়েছে এবং ওর কাছে  আসবেন বলে ঠিক করেছেন, এটা সত্যিই আনন্দের।  স্যামুয়েল জনসন এত বড় একজন পরিবেশ-বিজ্ঞানী। যখন ‘স্পেস্ ট্যুরিজম’ মহাকাশনগরীতে 'ডোম  অরচারড' তৈরির কাজে তিনমাসের জন্য গিয়েছিলেন, তখনই ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ওখানে বিশাল বড় কাচের গ্লোবের মধ্যে শাক-সবজি ফলানোর ব্যবস্থা দেখে উনি তো তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন। খুবই প্রশংসা  করেছিলেন।  
  সঙ্গের মহাকাশ-বিজ্ঞানী আইভ্যান ডিক্সনের সঙ্গে অবশ্য আলাপ নেই। কিন্তু তাতে অসুবিধা কিছু নেই। ওঁর বাড়িতে ওঁরা অতিথি হবেন, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। ওঁরা এলে সবচেয়ে খুশি হবে সুমন আর তিতলি। ওরা এখনও অবধি বিমানে চড়েনি। এবারে চড়বে। ওদেরকে খবরটা জানাবে ঠিকই, তবে একটু সাসপেন্স তৈরি করতে হবে। আগে তো এই ই মেলের উত্তরটা পাঠিয়ে দেওয়া যাক।               
  এরপর শুভ, মানে  বিজ্ঞানী ড. শুভদীপ রায়  বিজ্ঞানী-সুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসেন। সুমন আর তিতলি ওখানে বসে বইমেলায় কেনা নতুন বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিল। শুভদীপ মানে ওদের ছোটকাকু বলেন — সুমন, তুমি কী বই পড়ছ? 
  সুমন একটু থতমত খেয়ে যায়। ওর এখন স্কুলের পড়ার বই পড়ার কথা। আর কয়েক দিন পরেই ওর নতুন ক্লাসের ফার্স্ট ইউনিট টেস্ট। কিন্তু ও পড়ছে সদ্য কেনা মহাকাশ বিজ্ঞানের বইটা।
  বল, কী বই পড়ছ?
  আমি পড়ছি এই বইটা, মানে মহাকাশ বিজ্ঞানের বই। 
  খুব ভালো। তাহলে তো তুমি মহাকাশ বিজ্ঞান সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছ। আমি তাহলে তোমাকে কিছু প্রশ্ন করি! প্রশ্নগুলোর যদি ঠিক ঠিক উত্তর দিতে পারো, তাহলে তোমার জন্য একটা দারুণ প্রাইজ অপেক্ষা করছে।  
  সুমন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বাপীর মতো কাকু 'ক্লাসের বই পড়, ক্লাসের বই পড়' বলেনি। সুমন যে কোনও চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসে। বিশেষত যদি বিজ্ঞানের বিষয় হয়। তাই ও বলে — বল কাকু, চেষ্টা করে তো দেখি। না পারলে তুমি বলে দেবে। উত্তরটা আমার জানা হয়ে যাবে। আর বলতে পারলে কী প্রাইজ দেবে কাকু?
  আগে তো বল, তাঁর পর প্রাইজের কথা শুনবে।
  ঠিক আছে, বল।
  বলছি। আর তিতলি, তুমি কী বই পড়ছ?
  আমি পড়ছি বিভূতিভূষণ রচনাবলী। 
  ওই বইয়ের কোন উপন্যাসটা?
  'আরণ্যক'।
  ঠিক আছে, বন জঙ্গলের ব্যাপার। তোমাকেও প্রশ্ন করব, তৈরি থেকো।
  সুমন বল তো মানুষের তৈরি প্রথম উপগ্রহের নাম কী আর তা কোন দেশ কত সালে তৈরি করেছিল?
  সুমন একটু ভেবে নিয়ে বলে — প্রথম উপগ্রহের নাম তো স্পুটনিক। তৈরি করেছিল রাশিয়া। কিন্তু সালটা ... সালটা...! সালটা কিছুতেই মনে পড়ছে না কাকু। 
  কাকু হেসে বলে ওঠেন — তুমি হাফ নম্বর পেলে।সাল হল ১৯৫৭। তবে দুটো সঠিক উত্তর দিয়েছ বলে আমি খুশি। এবার বল তো আমাদের দেশ প্রথম যে উপগ্রহটা তৈরি করেছিল সেটার নাম কী এবং কত সালে তা মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল?
  তিতলি আচমকা বলে ওঠে — আর্যভট্ট। 
  সুমন ক্ষেপে ওঠে — তুই বললি কেন! আমি তো পারতাম। এমন করলে খেলব না যা!
  ছোটকাকু হেসে বলেন — ঠিক আছে, এটা তোমার উত্তর ধরে নিলাম। এবার সালটা বল!
  এটা আমি জানি। সাল হল ১৯৭৫।
  বাঃ! এটা তো মনে রেখেছ, দেখছি। 
  সুমন বলে — এটা মনে থাকার একটা কায়দা বিজ্ঞান-স্যার শিখিয়ে দিয়েছেন, তাই বলতে পারলাম।
 কীরকম কীরকম, শুনি!
  রাশিয়া যে সালে প্রথম উপগ্রহ বানিয়েছে, সেটা জানা থাকলেই এটা বলা যাবে। শুধু শেষের সংখ্যা দুটো ওলট পালট করে দিলেই হবে। তুমি বলে দিলে, রাশিয়া ১৯৫৭। এই কায়দাটা আমার মনে ছিল। তাই ৫৭ উল্টে ৭৫ বললাম। 
  ছোটকাকু খুশিতে ঝলমলে যেন — বাঃ! দারুণ কায়দা তো! ঠিক আছে আর একটা প্রশ্ন করব। বল তো এবছরে 'প্রজ্ঞান' নামের রোভারকে যে রকেট চাঁদের মাটিতে পৌঁছে দিল তাঁর নাম কী?
  সুমন এক সেকেন্ড দেরি না করে বলে — বিক্রম! 
  গুড! তুমি পাশ করে গেছো। অবশ্যই প্রাইজ পাবে। এবার পেরজাপতি বলবে, সুমন, তুমি বলে দেবে না। 
  তিতলি একটু নড়েচড়ে বসে। ওর চোখেমুখে টেনশন  ফুটে ওঠে। তা দেখে কাকু বলেন — ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। সহজ প্রশ্ন করব। বল তো  'ভেষজ উদ্ভিদ' কোনগুলোকে বলে? 
  তিতলি ক্লাসে পড়া বলার মতো বলে — যে সমস্ত উদ্ভিদের মধ্যে রোগ সারানোর গুণাবলি আছে, তাদেরকে ভেষজ উদ্ভিদ বলা হয়। যেমনঃ তুলসী, বাসক, নিশিন্দা ইত্যাদি। 
  ছোটকাকু হো হো করে হেসে ওঠেন। তা দেখে তিতলি ভড়কে যায়। ভাবে, ও কিছু ভুল বলে ফেলল নাকি!   
  ছোটকাকু বলেন — তুমি যেন জীবন বিজ্ঞান স্যরের কাছে পড়া দিচ্ছ মনে হচ্ছে। ঠিক আছে, উত্তর ঠিক দিয়েছ। তোমাকে আর একটা প্রশ্ন করব। তুমি বল, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পথের পাঁচালি' ছাড়া আর একটা উপন্যাসের নাম, যেটা নিয়েও সিনেমা হয়েছে।
  সুমন বলে ওঠে — আমি জানি!
  না তুমি বলবে না! পেরজাপতি বলবে।  
  তিতলি একটু মাথা চুলকে নিয়ে প্রশ্ন করার ঢঙে বলে — অপুর সংসার? 
  তুমি কনফার্ম হয়ে বল!  ওটা কিন্তু পথের পাঁচালির অপুকে নিয়েই। অন্য একটা উপন্যাসের নাম বল! 
  এবার তিতলি ভেবেচিন্তে বলে — মনে পড়েছে, 'অশনি সংকেত' সেদিন টিভিতে দিয়েছিল। 
  কারেক্ট! একদম ঠিক বলেছ। তাহলে তুমিও প্রাইজ পাওয়ার জন্য মনোনীত হয়ে গেলে। 
  সুমন আর তিতলি খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে। ও কাকু বল না, কী প্রাইজ দেবে? বল না! 
  তোমাদেরকে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এরোপ্লেনে চড়াবো। তোমরা তো কখনও প্লেনে চড়নি! 
  সুমন আর তিতলির এক মুহূর্তের জন্য কোনও কথা বেরোয় না। তারপর সুমন হঠাৎ ওর স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে  বাতাসে ঘুষি ছুঁড়ে বলে ওঠে — ইয়া একাইনো ডারমাটেক্সিয়া আপিস্ থুপিস্। 
  তিতলি আবেগ জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করে — আমরা কোথায় যাবো কাকু? দিল্লি না মুম্বাই?
  কাকু মুচকি হেসে বলেন — দেখা যাক, কোথায় যাওয়া যায়। 'হেলিপ্লেন' তো আমাদের বাড়ির কাছেই আসবে।
  সুমনের হঠাৎ মনে পরে গেছে যেন! এমন ভাবে বলে ওঠে — কাকু, এই সপ্তাহে আমাদের তো 'ব্যাথিস্কোপ সিটি' দেখতে যাওয়া ফাইনাল হয়ে আছে, সেটার কী হবে?
  কাকু বলেন — 'ব্যাথিস্কোপ সিটি' তো পরশু দিন রবিবারে যাবো। তোদের দেখাবো বলেছি যখন, দেখিয়েই আনবো। তবে একটা শর্ত আছে। 
  কী শর্ত কাকু?  
  তিতলি, তুমি তো রোজ ডায়েরি লেখো। 'ব্যাথিস্কোপ সিটি' ঘুরে এসে পুরো ভ্রমণটা ডায়েরিতে লিখবে এবং বাবা-মা সবাইকে পড়ে শোনাবে। আর সুমন, তুমি ছবি তুলতে ভালোবাসো। তোমার দিদির মোবাইলফোনে ভ্রমণের ছবিগুলো তোলা চাই। দাদা-বউদি যেতে পারবেন না বলেছেন। এসে ওঁদেরকে ছবিগুলো দেখাতে হবে। তোমরা রাজি আছো?
  সুমন ও তিতলি সমস্বরে বলে ওঠে — হ্যাঁ, আমরা রাজি।    
( ক্রমশ)
🍂
কাশফুল আসছো তুমি
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


ওই যে    দূরের গাঁয়ে
ভাসছে    নীল সীমানা
সেখানে   যাই চলে যাই
ওই তো   সেই ঠিকানা ।

 
নদীজল    স্বচ্ছ এখন
পরে নেই   কাদার টোপর
উড়ে বক   একটু দূরে
আমাদের    মাথার ওপর।

 
বাতাসে     উড়ছে শালিখ
সে জানে    বনের পাশে
ভাসছে       গন্ধ পুজোর
শিশিরে       দুব্বোঘাসে। 

 
চারদিক      সাদায় সাদা
জাগছে        নতুন ভূমি
আমরা       জেনেই গেছি
কাশফুল      আসছো তুমি।

কুট্টুস 

কৌশিক চট্টোপাধ্যায়

টিপু মাঠে যখন ফুটবল খেলছিল তখনই দেখেছিল পশ্চিমদিকে বেশ কালো মেঘ করে আছে৷ আজ হাওয়াও দিচ্ছে না, চারদিক থমথমে  ৷

 ৷না! 

খেলা মনে হচ্ছে আর হবে না৷ ডোডো, তাতাই ,টিঙ্কু সবাই খেলা থামিয়ে দিয়েছে৷ সময় থাকতে বাড়ী চলে আসাই ভালো৷ বাড়ীর বড়রা চিন্তা করবে৷ 

টিপুদের সব খেলার সাথীদের বাড়ী এ পাড়াতেই ৷

বলতে বলতে শোঁ শোঁ করে ধুলোর ঝড় শুরু হল৷ টিপুরা ফুটবল নিয়ে তো এক দৌড় ৷

বাড়ীতে টিপু যখন ঢুকে পড়েছে তখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি৷

হাত ,পা ভালো করে ধুচ্ছে যখন টিপু তখনই ঝড় শুরু হল ৷ আর তার সাথে বৃষ্টি ৷ 

বাপরে! একে বলে  ঝড় ! টিপুর দুঃখ লাগছিল হিমসাগর আমগাছটার জন্য ৷ কত আম পড়ে যাবে ,ডালও ভাঙতে পারে ৷ গত ঝড়ে বাগানের সুপারী গাছটা পড়ে গেছিল ৷ 

মেঘের ডাক আর বাজ পড়া শুরু  হতেই টিপু প্রমাদ গোণে ৷বাজের আওয়াজকে টিপু ভীষণ ভয় পায় ৷ দাদুর পাশে খাটে টিপু বসে পড়ল৷

দাদু ঠিক বুঝেছেন , বললেন "কী দাদুভাই ভয় করছে?"

টিপু মাথা নাড়ল ৷

আজ মনে হচ্ছে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে৷

বলতে বলতেই কারেন্টটাও গেল চলে ৷

টিপুর এখন ভয়ের সাথে আনন্দও  হচ্ছিল ৷এমনি আজ শনিবার ,কাল স্কুল ছুটি মানে হোমটাস্ক নেই ৷তার উপর লোডশেডিং মানে কারেন্ট নেই ৷পড়ার থেকে আজ টিপুর ছুটি ৷তারপর সে এখন দাদুর পাশে ৷দাদুকে জড়িয়ে ধরে টিপু বলল,

"দাদু সব আম পড়ে গেল ?"

দাদু টিপুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,"হ্যাঁ দাদুভাই, অনেকে পড়ে যাবে যারা থাকবে তারা টিকে যাবে ৷ এটাই প্রকৃতির নিয়ম৷"

ঝড় ,বৃষ্টি থামারও অন্তত একঘন্টা পরে কারেন্ট এসেছে৷ 

"টিপু! কোথায় গেলি?" 

টিপু তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় ৷

এতো ছোটকার গলা৷!

ছোটকা কখন এলো? 

টিপুর প্রিয় মানুষ, দাদুর পরেই এই ছোটকা৷ ছোটকা ডাক্তার ৷ আসলে ছোটকার মনটা ভীষণ ভালো ৷প্রায়ই টিপুকে এটা ওটা খাওয়ায় ৷তার মধ্যে বিরিয়ানি, রুমালি রুটি ,চিলি চিকেন তো টিপুর ভীষণ পছন্দের ৷

"যাই ছোটকা !" টিপু এক দৌড়ে ছোটকার ঘরে ৷

"চল , বৃষ্টি থেমেছে৷ বাগানে যাই ৷টর্চ নিয়ে দেখি আম কতগুলো পড়ল৷" টিপু চটি পরে নেয়৷ 

আম কুড়োতে দারুণ লাগে ৷

টর্চের আলোয় বাগানে নেমে টিপু দেখে ঝড়ে খুব বেশী আম পড়েনি তবে একটা বড় ডাল ভেঙেছে ৷

সেই ডালের ধাক্কায় গোলাপের আর এডেনিয়ামের টবটা ভেঙে গেছে ৷

ছোটকা বলল,"ইশ! কাল রমেনকে দিয়ে সকালে নতুন টবে গাছ দুটোকে আবার বসাতে হবে৷"

টিপু আম কুড়িয়ে ব্যাগে রাখতে থাকে ৷ছোটকা টর্চ ধরে থাকেন ৷

হঠাৎই টিপু শুনতে পায় একটা আওয়াজ ৷কিচ কিচ করে একটা মৃদু আওয়াজ !

এ আওয়াজ কিসের ?

পাখীর ডাক না অন্য কিছুর ? গত বছর ঝড়ের পর বাগানে শালিখ পাখির ছানা কুড়িয়ে পেয়েছিল ছোটকা৷ দুটো ছোট্ট ছানা৷ বৃষ্টিতে ভিজে ছানাদুটির অবস্থা নাজেহাল ৷ছোটকা আর টিপু তাদের যত্ন করে বাড়ীতে নিয়ে এসেছিল৷ছোটকা গজ আর তুলো দিয়ে দারুণ খাট বানিয়েছিল ৷একটা বাচ্ছা অবশ্য মারা যায় পরদিন ৷কিন্তু টিপু আর ছোটকার যত্নে আরেকটি শালিখের ছানা বেঁচে গেছিল ৷টিপু ড্রপারে করে দুধ,ছাতু খাইয়ে দিত৷ বাচ্ছাটার তখনো চোখ ফোটেনি ৷

দিন পনেরো পরে আস্তে আস্তে সেরে উঠলো ৷

ছোটকা বললেন , এবার একে ছেড়ে দিতে হবে ৷

সত্যিই তাই !খাঁচা খুলে টিপু শালিখটাকে ছেড়ে দিয়েছিল , তখন দুঃখের সাথে আনন্দও হচ্ছিল ৷যাক! শালিখটা তার বাড়ী যেতে পারবে,বাবা ,মা'র সাথে দেখা হবে৷

শালিকটারও বোধহয় মায়া পড়ে গেছিল ৷

অনেকক্ষণ হিমসাগর গাছের ডালে বসেছিল ৷হয়তো টিপুদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিল ৷তারপর আস্তে আস্তে উড়ে গেল ৷

"ছোটকা, কিসের আওয়াজ বলো তো?"

ছোটকাও কান পাতেন ,"হ্যাঁ রে৷ মনে হচ্ছে ঐ ভাঙা আমের ডালটার পেছন থেকে আসছে শব্দটা…"

ছোটকা আর টিপু সাবধানে টর্চের আলো ফেলে এগিয়ে যায় বাগানের পূর্বদিকে৷

ছোটকা আস্তে আস্তে ডাল সরাতে থাকেন ৷

টিপুই প্রথম শব্দের উৎসস্থল টের পায় ৷

"এ দেখ ছোটকা! একটা কাঠবিড়ালীর বাচ্ছা! আহারে গাছ থেকে পড়ে গেছে ৷খুব লেগেছে মনে হচ্ছে …"

ছোটকা টিপুর হাতে টর্চটা দিয়ে বলেন "তুই টর্চটা ধর ৷আমি দেখছি ৷"

ছোটকা পকেট থেকে সাদা রুমালটা বের করে আস্তে আস্তে কাঠবিড়ালীটাকে তুলে নেন ৷একেবারে বাচ্ছা ৷পুরো জলে ভিজে গেছে ৷কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে ৷

টিপু আমের ব্যাগ আর টর্চ নিয়ে ছোটকার সাথে বাড়ীর দিকে হাঁটা দেয়৷

ছোটকা ভালো করে তুলো আর নরম কাপড়ে কাঠবিড়ালীর বাচ্ছাটাকে মুছিয়ে দিয়েছেন ৷ছাতু গুলে ড্রপারে করে টিপু খাওয়াতে চাইল ৷বাচ্ছাটা খেতে পারছে না ৷আসলে আঘাত পেয়ে আর জলে ভিজে শরীরের অবস্থাটা বেশ খারাপ ৷

টিপুর মন ভীষণ খারাপ ৷ বাচ্ছাটার নাম দিয়েছে "কুট্টুস "৷ 

ছোটকারও নামটা ভীষণ পছন্দ ৷সবচেয়ে বড় কথা দাদু, ঠাম্মা,বাবা ,মা'ও এসে দেখে যাচ্ছেন ৷

ছোটকা কীসব ওষুধ জলে গুলে খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন ৷

কুট্টুস একটু করে খাচ্ছে৷

এ বাড়ীতে একটা হলুদ হুলো আছে ৷টিপু নাম দিয়েছে "মোহনকুমার "৷

মোহনকুমারের মনে হচ্ছে হিংসে হয়েছে৷ সবাইতো কুট্টুসকে নিয়ে ব্যাস্ত ৷

এ ব্যাপারটা মোহনকুমারের পছন্দ নয় ৷

ছোটকা বলে দিয়েছে কুট্টুসকে, মোহনকুমারের নাগালের বাইরে রাখতে হবে ৷ না হলে মোহনকুমার কুট্টুসকে মেরে ফেলবে৷

ছোটকার চেম্বারে শালিক পাখির খাঁচা পরিস্কার করে তুলোর বিছানায় কুট্টুসকে  শোয়ানো হয়েছে৷ টিপু পাহারা দিচ্ছে কোনও ভাবে মোহনকুমার যেন এদিকে না আসে ৷

"ছোটকা, কুট্টুস ভালো হবে তো?"

ছলছল চোখে টিপু জিজ্ঞেস করেছে ছোটকাকে৷

ছোটকা উত্তর দিয়েছে," ঠিক হয়ে যাবে৷দাঁড়া,ওষুধ দিয়েছি৷এখন একটু বিশ্রাম নিতে দে ৷কালকেই দেখবি কুট্টুস ঠিক হয়ে যাবে৷একঘন্টা ধরে জলে ভিজেছে না …"

টিপু রাতে দুবার উঠে দেখে এসেছে ৷না!কুট্টুস ঘুমিয়ে আছে ৷মাঝে মাঝে কিচ কিচ করে আওয়াজ করছে৷

সকালে কুট্টুসকে ভালো করে দেখল টিপু৷ চোখদুটো কালো,বড় বড় ,পিঠের লোম কিছুটা উঠে গেছে ৷বোধহয় ডালের আঘাতে ৷ছোটকা তাতে মলম লাগিয়েছেন ৷ তবে সকালেও কুট্টুস ভালো করে খেতে পারছিল না ৷

বিকেল থেকে কুট্টুসের অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে৷ 

সন্ধ্যেতে একটু বাদাম,আপেলের কুচি খেয়েছে কুট্টুস ৷আর গলায় আওয়াজও ফুটেছে৷

এক সপ্তাহ হতে চলল, কুট্টুস এখন সবার নয়নের মণি  ৷ছোটকা বসে চা খান ৷ টেবিলে কুট্টুসকে রেখে দেন ৷সারা টেবিল কুট্টুস ঘোরে ৷তবে পালায় না৷ কিচকিচ আওয়াজ করে৷সবচেয়ে বড় কথা টিপুর গলার আওয়াজ চেনে৷টিপু  হাত বাড়িয়ে দিলে কুট্টুস হাতের তালুতে নিজেই উঠে আসে৷ হাত বেয়ে উঠতে থাকে৷টিপুর ভীষণ সুড়সুড়ি লাগে৷বাদাম বিশেষত কাজু খেতে কুট্টুস ভীষণ ভালোবাসে৷

মোহনকুমারের তাতে আরো রাগ বেড়েছে৷দুদিন মোহনকুমার বাড়ীতে বেশীক্ষণ থাকছে না৷ 

পনেরোদিন পর ছোটকা টিপুকে ডেকে বললেন "টিপু ,কুট্টুসকে এবার ছেড়ে দিতে হবে রে৷ও এখন সুস্থ হয়ে গেছে ৷ ওরও তো বাড়ীতে বাবা -মা আছে ৷চল দেখি আমগাছের কাছে ছেড়ে দিই৷"

ও বাবা! টিপুর ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল যদিও কিন্তু দাদু বলেন ,ওদের নিজের পরিবেশে রাখতে হয় ৷ওতেই ওদের আনন্দ ৷বনের পাখীকে শিকল পরাতে নেই ৷সবারই স্বাধীনতা দরকার ৷

আমগাছের ছোট ডালটাতে কুট্টুসকে ছেড়ে দিয়েছেন ছোটকা ৷

কুট্টুস আমডালের উপর চুপ করে বসে আছে ৷টিপু আর ছোটকা একটু পিছিয়ে গেছেন ৷

দশমিনিট হতে চলল ৷কুট্টুস কিচকিচ করে ডাকছে৷বোধহয় এ পরিবেশ তার ভীষণ চেনা,মনে পড়ছে  ৷

এ বাবা! দুটো বড় কাঠবেড়ালী ডাল বেয়ে নেমে আসছে কুট্টুসের দিকে৷আচ্ছা!ওরা কুট্টুসকে নেবে তো? এতদিন মানুষের কাছে রয়েছে যে কুট্টুস !

কাঠবেড়ালী দুটো কুট্টুসের সারা গা চাটছে৷

ছোটকা হেসে ফেলে ৷

"যাক!কুট্টুসের বাবা -মা তাহলে পেল তাদের ছানাকে৷"

টিপুও হাসতে থাকে৷

তিনজনে তরতর করে আমগাছের ডাল দিয়ে ওপরে উঠতে থাকে৷

টিপু এখন সেভেনে পড়ে ৷জানলার পাশে বসে যখন দোতলার ঘরে অঙ্ক করে তখন মাঝে মাঝেই কুট্টুসকে দেখতে পায় ৷কুট্টুসও বড় হয়ে গেছে৷ জানলায় পেয়ারার টুকরো রেখে দিলে কুট্টুস এসে নিয়ে যায় ৷টিপুর পাশে জানলায় বসে পেয়ারার টুকরো দুহাতে ধরে কুটুস কুটুস করে খেতে থাকে ৷

মোহনকুমার দেখেও না দেখার ভান করে ৷


মেঘবালিকা 
সবিতা বিশ্বাস 

মেঘবালিকা মেঘবালিকা খুব যে খুশি আজ 
আকাশী নীল শাড়ি পরেছ সাদা মেঘের সাজ 
শরৎ বুঝি খবর দিল বর্ষা গেছে দূরে 
সোনা রোদের পরশে তাই ঘুরছ আকাশপুরে     

ধানের ক্ষেতে শরৎ রানী শুনিয়ে গেছে চিঠি 
সকালবেলা খবর দিল সাবিনা টম মিঠি
পুজোর ঢাক উঠলো বেজে তাকুড়নাকুড় তাক 
রইলো তোলা বই পত্তর পড়া ক’দিন থাক  

আমরা যাবো সবাই মিলে কাশ ফুলের মাঠে 
দেরী হলেই বিলের জলে সুয্যি যাবে পাটে
আঁধার হবে মাদারতলা ভয় লাগবে খুব 
বুকের মাঝে শুনতে পাবো লাবডুবাডুব ডুব

শরৎ মানে শিউলি ফুল কমলা পাড় শাড়ি
ঠিকই জানি ফুল কুড়োতে হবেই কাড়াকাড়ি 
সাজুর সাথে ভাব জমিয়ে যাবো জুড়োনবিলে 
মাছ ধরবো বঁড়শি গেঁথে ছোঁ মারবে চিলে 

ভিজে কাপড়ে ফিরলে বাড়ি মায়ের বকা খাবো
বিকেলবেলা বাবার সাথে দখিন পাড়া যাবো
ব্যাগ ভর্তি নতুন জামা সবার হাতে দেবো
পুজোর খুশি ওদের সাথে ভাগ করেই নেবো

নতুন জামা পরে তুতান নাচবে ধা-তিন ধিনা 
রঙিন ফিতে কাঁচের চুড়ি পরবে টিনা মিনা 
পুজোর খুশি জমেই যাবে বাজবে ঢাক কাঁসি 
দেখা হলেই মিষ্টি মুখে বলবো ভালোবাসি

শরৎ ঋতু এলো বলেই ডাকলো খুশির বান 
স্কুলের মাঠে জলসা হল রাম রাবণের গান 
সিঁদুর খেলা শেষ হতেই হারিয়ে গেল পুজো 
মা বললেন, পড়তে বোসো আসছে বছর খুঁজো |

নিবন্ধ 
মানসী গাঙ্গুলী

রাবণ, রামায়ণের এক খলচরিত্র 

ছোট্ট বন্ধুরা তোমরা নিশ্চয়ই জানো ভারতের দুই হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত। আর এই দুই মহাকাব্যেই খলচরিত্রের অভাব নেই। কেউ চারিত্রিকভাবে খল কেউ বা জীবনের প্রয়োজনে। রামায়ণের শ্রেষ্ঠ দুই খলচরিত্র আমার তো মনে হয় রাবণ এবং কুঁজীবুড়ি মন্থরা। আজ তোমাদের রাবণের কথাই বলি। স্বভাবে তো ছিলেনই দুষ্ট চরিত্র, খলও বটে। তবে খল হলেও রাবণ রামায়ণের অন্যতম প্রধান চরিত্র। তিনি মহাকাব্য ও পুরাণে বর্ণিত লঙ্কা দ্বীপের রাজা। রামচন্দ্রের পত্নী সীতাকে স্বর্ণমৃগে প্রলুব্ধ করে, ব্রাহ্মণের বেশ ধরে তিনি সীতাকে ছলনা করেন এবং হরণ করে লঙ্কায় নিয়ে যান। সীতা উদ্ধারের জন্য কিষ্কিন্ধ্যার বানরসেনার সাহায্যে রামচন্দ্র লঙ্কা আক্রমণ করলে রাবণের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয়। মহাকাব্যে অত্যাচারী, দুষ্ট বলে নিন্দিত হলেও রাবণকে মহাজ্ঞানী ও তাপসও বলা হয়েছে।  তবে রাবণের রাবণ হয়ে ওঠার পিছনেও আছে গল্প। আবার রাবণ যদি না থাকতেন সীতাহরণও হতো না, আর রাম রাবণের যুদ্ধও হতো না। তাহলে রামায়ণের মত মহাকাব্যও রচনা হতো না। বস্তুতঃ, রাম-রাবণের যুদ্ধই রামায়ণের মূল বিষয়।
          রাবণের পিতা বিশ্রবা ও মাতা কৈকসী। বিশ্রবা মহর্ষি পুলস্ত্যর পুত্র আর কৈকসী হলেন অসুররাজ সুমালীর কন্যা।কৈকসী বাল্যে পিতা সুমালীর সঙ্গে লঙ্কায় বসবাস করতেন।  তখন বিশ্রবা মুনির পুত্র কুবের তার পিতার কথা মত লঙ্কায় থাকতে শুরু করেন। কুবের স্বভাবে অতিশয় মিষ্ট। তাঁর একটি পুষ্পক রথ ছিল যেটা চড়ে তিনি বাবা-মাকে প্রণাম করতে যেতেন। রাক্ষসেরা তাঁর কাছে এসে ফাঁকা লঙ্কায় থাকতে চাইলে তিনি থাকতে দেন। লঙ্কায় থাকার সময় কুবেরকে পুষ্পক রথে চড়তে দেখে কৈকসীর ভেতরে হিংসার জ্বালা ধরে। তিনি কুবেরের পিতা বিশ্রবামুনির কাছে পুত্র ভিক্ষা করেন। সেসময় মুনি-ঋষিদের কাছে পুত্র ভিক্ষা করার একটা প্রথা ছিল আর তাঁরাও ফেরাতেন না। কিন্তু বিশ্রবামুনি কৈকসীকে নিরস্ত করতে চেষ্টা করেন এই বলে যে সেই সময়টা ছিল মন্দ, সেই সময় পুত্র চাইলে দুরাচারী পুত্রলাভ হবে। কিন্তু কৈকসী তা শুনতে রাজী নন। ফলতঃ তাই হল। রাবণের  জন্মক্ষণে উল্কাপাত, বজ্রপাত, মেঘগর্জন এমন নানারকম আওয়াজ অর্থাৎ রবের উপস্থিতি, তাই তিনি রাবণ। আবার কথিত আছে, তাঁর আসল নাম দশগ্রীব, রাবণ নামটি শিবের দেওয়া। তাঁর দশ মাথা ছয় শাস্ত্র ও চার বেদের জ্ঞানকে বোঝায়। রাবণের আরও অনেক নাম আছে যেমন দশানন, লঙ্কেশ্বর, রাবণাসুর, রাবণেশ্বরণ ইত্যাদি। তিনি ছিলেন শিবের পরম ভক্ত, পন্ডিত ও দক্ষশাসক এবং বীণা বাজানোয় পারদর্শী। হিন্দু জ্যোতির্বিদ্যার ওপর রচিত তাঁর বইয়ের নাম রাবণ সংহিতা। তিনি প্রথম জীবনে কৈলাশ অভিযান করে মহাদেবের কাছে পরাজিত হয়ে শিবভক্ত হন।
          ছোট থেকেই কৈকসী রাবণকে দেখাতেন যখন পুষ্পক রথে চেপে কুবের যাতায়াত করতেন। তাঁর মনে হিংসা সৃষ্টি করতে চাইতেন। এইভাবে মনের মাঝে হিংসার বীজ বপন করতে করতে রাবণের বেড়ে ওঠা। তিনি যে কুস্বভাবী, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও অপরিণামদর্শী ছিলেন তার কারণ অনুসন্ধান করলে জানা যায় শৈশব থেকেই অনাদর, অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার ছিলেন তিনি। পিতা বিশ্রবা আর্য আর মাতা কৈকসী রাক্ষসকন্যা হওয়ায় বিশ্রবা কৈকসী ও তার সন্তানদের অত্যন্ত অবজ্ঞার চোখে দেখতেন ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন। পিতার হাতে মায়ের লাঞ্ছনা ও নিজেদের প্রতি অবজ্ঞা রাবণকে ক্রুর স্বভাবের ও প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলেছিল। এরপর বড় হয়ে রাবণ ব্রহ্মার কাছে কঠোর তপস্যা করেন এবং ব্রহ্মার বর লাভ করেন এই মর্মে যে দেবতা-দানব, রাক্ষস -মানুষ কারো কাছ থেকেই তাঁর ভয় নেই। এছাড়া তিনি ইচ্ছামত রূপ ধারণ করতে পারবেন। এই বর পাবার পর রাবণ অতিমাত্রায় অহংকারী হয়ে পড়েন। এরপর কুবেরকে লঙ্কাছাড়া করেন। কুবের রথে চেপে চলে যান কিন্তু রাবণের তাঁর রথের প্রতি লুব্ধ নজর থাকে। পরবর্তীকালে কুবেরকে মেরে তাড়িয়ে দিয়ে তার পুষ্পক রথ হস্তগত করেন। এই পুষ্পক রথ ছিনিয়ে নিয়ে তিনি অতি অল্প সময়ে লঙ্কা থেকে যে কোনো জায়গায় চলে যেতে পারতেন। রাবণই আদিযুগে সর্বপ্রথম যিনি মর্তে উড়ন্ত যান ব্যবহার করেন। 
      মহাকাব্যে অত্যাচারী বলে নিন্দিত হলেও রাবণকে মহাজ্ঞানী ও তাপসও বলা হয়েছে। রাবণের শিক্ষা তার পিতার কাছে সম্পন্ন হয়। তিনি বেদ শাস্ত্রের অন্যতম একজন পন্ডিত ছিলেন। তিনি সঙ্গীত রচনায় অতি নিপুণ ছিলেন। তিনি 'শিব তান্ডব স্তোত্র' নামে শিবকে শান্ত করার জন্য সঙ্গীত রচনা করেন। মহাদেব তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে নিজের 'চন্দ্রহাস' নামক খড়গ উপহার দেন। এছাড়া বাস্তুশাস্ত্রে এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে তাঁর অতীব জ্ঞান ছিল। তথাপি তাঁর কুকীর্তির জন্য তিনি নিন্দনীয় হওয়ায় উত্তর ভারতে দশেরা উৎসবে রাবণের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। দশেরা আজও জনপ্রিয় এক প্রথা। এর থেকে বোঝা যায় রাবণ মানে অশুভ শক্তি যার বিনাশ কামনায় এই কুশপুত্তলিকা দাহ। দাম্ভিক দুরাচারী হলেও রাবণ কিন্তু কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন। তিনি শূর্পণখার বিয়ে দেন, কুম্ভকর্ণের জন্য ছ'মাস ঘুমানোর উপযুক্ত ঘর তৈরি করে দেন, কিন্তু নিজের ক্ষমতার উপর অগাধ আস্থাই শেষ পর্যন্ত তাঁকে ধ্বংস করে। নিজের ক্ষমতার অহংএ রাবণ তখন মত্ত। ভাবেন মনে, তাঁর চেয়ে শক্তিশালী বুঝি আর কেউ নেই। এরপর ময়দানবের কন্যা মন্দোদরীকে তিনি বিবাহ করেন। ধর্মপ্রাণ মন্দোদরী রাবণকে সঠিক পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করতেন। তিনি রাবণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কুবেরের পুত্র নলকুবেরের বাগদত্তা অপ্সরা বেদবতীর সম্মান নষ্ট করতে নিষেধ করেন। এছাড়া তিনি সীতাকে রামের কাছে ফিরিয়ে দেবার জন্য রাবণকে পরামর্শ দেন, তাতে রাবণ কর্ণপাতও করেননি। রাবণ দোষেগুণে সমৃদ্ধ একজন যিনি নিজের ভুলের কারণে ভয়াবহ এক যুদ্ধের মুখোমুখি হন এবং আপন সহোদর বিভীষণের ষড়যন্ত্রে পরাজিত হন এবং প্রাণ হারান।
           রাবণ সার্বিক অর্থেই খলনায়ক। কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই যিনি যে কোনো খারাপ কাজ করতে পারেন। তিনি ছিলেন দুর্বিনীত ও দুরাচারী। অত্যন্ত অহংকারী, অপরিণামদর্শী ও অবিবেচক প্রকৃতির রাক্ষসরাজা তিনি। সেখানে রাবণের নারী লোলুপতা তীব্র। এইসব বদগুণ থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন বিদ্বান, দুঃসাহসী এক বীর, স্বদেশপ্রেমী, প্রজাবৎসল, পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল এবং ভীষণভাবে রামভক্ত। রাবণ তাঁর ভগিনী শূর্পণখার অপমানের প্রতিশোধ নিতেই সীতাহরণের পরিকল্পনা করেন এবং তাঁকে নিয়ে গিয়ে লঙ্কায় বন্দি করে রাখেন। আপাতদৃষ্টিতে এটিই কারণ মনে হলেও এর পিছনে আরেকটি বড় কারণ রয়েছে। তিনি রামের হাতে মরে রাক্ষস জীবন থেকে মুক্তিলাভের জন্যই সীতাকে চুরি করেন। এইভাবে তিনি রামের শত্রু হতে চান কারণ শত্রু না হলে রাম তাঁকে বধ করবেন না। আর এই সীতাহরণকে কেন্দ্র করেই লঙ্কায় রাম-রাবণের মধ্যে এক দীর্ঘ যুদ্ধ হয় যাতে রাবণের মৃত্যুতে অশুভের বিনাশ হয়


খুকির খুশি
দীপঙ্কর বেরা

গাছের আড়ে বিকেল সূর্য 
যেই না দিচ্ছে ডুব
দিগন্তে লাল আলোর আভা 
দেখে খুকু চুপ।
নিচ্ছে বিদায় দিনের আলো 
আসছে আঁধার দূর
পাখিরা সব তুলছে নীড়ে 
কিচিরমিচির সুর।

পথের বাঁকে ফিরছে ঘরে 
কর্মে মানুষ দল
আকাশ রাঙা মিষ্টি হাওয়া 
বলছে ধীরে চল।
দিন ও রাতের এমন ক্ষণে 
খুকুর খুশি মন
পড়তে বসে নিয়েছে আজ 
বড় হওয়ার পণ।

অনাদিবাবুর খেয়াল - শর্মিষ্ঠা বসু 


শেষ পর্যন্ত দেউলহাটির রাজবাড়িটা কিনে ফেললেন অনাদিবাবু ।বাড়িখানা পেয়েও গেলেন জলের দরে । অবশ্য ও বাড়ি এখন নামেই রাজবাড়ি । বাড়ির হাল দেখলে এখন সেই বাড়িকে আর পোড়ো বাড়ি ছাড়া কিছু বলা যায়না ।

প্রাসাদোপম বাড়ির বর্তমানে জরাজীর্ণ দশা । চতুর্দিকে পলেস্তারা খসা দেওয়াল , এদিক ওদিক থেকে বড় বড় চাঙর ভেঙে পড়ছে । ফাটল ধরা মেঝেতে বট অশ্বথের চারা গজিয়েছে ।রাতে তো বটেই , দিনের বেলাতেও কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে ।

বাড়িখানা অবশ্য বিরাট । প্রায় পাঁচ বিঘে জমির ওপরে বিশাল অট্টালিকা।
। একসময় সামনের দিকে ফুলের বাগান ছিল ।এখন সেই সাজানো গোছানো বাগান আর নেই । রাজা অম্বিকানাথ চৌধুরীর শখের বাগানে এখন শুধু আগাছার জঙ্গল ।

রাজবাড়ীর পেছনে আরো একখানা বাগান আছে । সেই বাগানে ফলের গাছ রয়েছে অনেক আর সেগুলো কোনো যত্ন ছাড়াই দিব্যি বেঁচে আছে । আম , জাম , কাঁঠাল , কুল ,তেঁতুল , পেয়ারা সব গাছগুলোতেই ফল হয় প্রচুর । ফলের লোভে গ্রামের ছেলের দল সারাদিন ওই বাগানে হুটোপুটি করে বেড়ায় ।

সস্তায় কিনলেও বাড়িখানা বাসযোগ্য করতে বেশ কিছু খরচা হয়ে গেল অনাদিবাবুর । তাতে অবশ্য অসুবিধা কিছু ছিলনা । অনাদিবাবু এমনিতে বেশ শৌখিন প্রকৃতির মানুষ । তাছাড়া টাকার অভাব তাঁর নেই ।

বাপ ঠাকুরদা কাঠের ব্যবসা করে যা রেখে গেছেন তাতে তিন পুরুষ শুয়ে বসে দিব্যি খেতে পারবে । তাই ভাঙাচোরা রাজবাড়ির চেহারা বদলাতে কোথাও তিনি কোনো কার্পণ্য করলেন না ।


অনাদিবাবুর খেয়াল 
 শর্মিষ্ঠা বসু 


শেষ পর্যন্ত দেউলহাটির রাজবাড়িটা কিনে ফেললেন অনাদিবাবু। বাড়িখানা পেয়েও গেলেন জলের দরে। অবশ্য ও বাড়ি এখন নামেই রাজবাড়ি। বাড়ির হাল দেখলে এখন সেই বাড়িকে আর পোড়ো বাড়ি ছাড়া কিছু বলা যায়না।

প্রাসাদোপম বাড়ির বর্তমানে জরাজীর্ণ দশা। চতুর্দিকে পলেস্তারা খসা দেওয়াল, এদিক ওদিক থেকে বড় বড় চাঙর ভেঙে পড়ছে। ফাটল ধরা মেঝেতে বট অশ্বথের চারা গজিয়েছে। রাতে তো বটেই, দিনের বেলাতেও কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে।

বাড়িখানা অবশ্য বিরাট। প্রায় পাঁচ বিঘে জমির ওপরে বিশাল অট্টালিকা।
 একসময় সামনের দিকে ফুলের বাগান ছিল। এখন সেই সাজানো গোছানো বাগান আর নেই। রাজা অম্বিকানাথ চৌধুরীর শখের বাগানে এখন শুধু আগাছার জঙ্গল।

রাজবাড়ীর পেছনে আরো একখানা বাগান আছে। সেই বাগানে ফলের গাছ রয়েছে অনেক আর সেগুলো কোনো যত্ন ছাড়াই দিব্যি বেঁচে আছে। আম, জাম , কাঁঠাল, কুল, তেঁতুল, পেয়ারা সব গাছগুলোতেই ফল হয় প্রচুর। ফলের লোভে গ্রামের ছেলের দল সারাদিন ওই বাগানে হুটোপুটি করে বেড়ায়।

সস্তায় কিনলেও বাড়িখানা বাসযোগ্য করতে বেশ কিছু খরচা হয়ে গেল অনাদিবাবুর। তাতে অবশ্য অসুবিধা কিছু ছিলনা। অনাদিবাবু এমনিতে বেশ শৌখিন প্রকৃতির মানুষ। তাছাড়া টাকার অভাব তাঁর নেই।

বাপ ঠাকুরদা কাঠের ব্যবসা করে যা রেখে গেছেন তাতে তিন পুরুষ শুয়ে বসে দিব্যি খেতে পারবে। তাই ভাঙাচোরা রাজবাড়ির চেহারা বদলাতে কোথাও তিনি কোনো কার্পণ্য করলেন না ।

কলকাতা ছেড়ে দেউলহাটিতে আসার এই হঠাৎ সিদ্ধান্তে, অনাদিবাবুর ওপর সবাই বিরক্ত হয়েছিলেন। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সকলেই অনাদিবাবুর সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, ”বড় ভুল করছ অনাদি,
এই বয়সে কলকাতা শহর ছেড়ে অমন অজ পাড়াগাঁয়ে গিয়ে থাকা কি আর মুখের কথা! নির্জনতা ভাল লাগে বলে হুট করে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঐ ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে গিয়ে থাকতে হবে! তাছাড়া এসব বাড়িতে ভূত - টূত আছে কিনা কে জানে। “

অনাদিবাবু অবশ্য সেদিন তাঁদের কথার কোনো উত্তর দেননি। এই বাড়ির ইতিহাস তিনি জানতেন। দেউলহাটির রাজা অম্বিকানাথ চৌধুরীর স্ত্রী মণিকুন্তলার আত্মা যে এখনও এই বাড়িতে ঘুরে বেড়ায় সেই খবরও তাঁর কানে গিয়েছিল। কিন্তু ভূত প্রেতে তাঁর কোনদিন তেমন বিশ্বাস নেই। তাই তিনি এসব কথার কোন গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন নি।

আসলে কলকাতার পাট চুকিয়ে আচমকা দেউলহাটিতে চলে আসার প্রকৃত কারণটা অনাদিবাবু কাউকে জানাতে চান নি। বছরখানেক আগে একমাত্র ভাইয়ের মৃত্যুর পরে তাঁর আর কলকাতায় কিছুতেই মন বসছিল না। তিনকূলে তাঁর কেউ নেই। থাকার মধ্যে ছিল একমাত্র তাঁর ছোট ভাই অতনু , তাঁর চোখের মণি। জীবনের সমস্ত আনন্দ, সব আকাঙক্ষা তাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল।

অমন সুস্হ সবল পনেরো বছরের ছেলে যখন হঠাৎ মারা গেলো তখনই ভাই অন্তপ্রাণ অনাদি সান্যাল মনে মনে ঠিক করেছিলেন কলকাতা থেকে দূরে কোথাও চলে গিয়ে সেখানেই পাকাপাকি থাকার ব্যবস্হা করবেন।

তারপর যেমন ভাবনা তেমন কাজ। দেউলহাটির রাজবাড়ির খোঁজ পাওয়ামাত্র কারো কথায় তিনি আর কর্ণপাত করলেন না। বাড়ি কিনে তাকে বাসযোগ্য করে দেউলহাটিতে এসে থাকতে শুরু করলেন।

অনাদিবাবুর বাড়ি কেনার সিদ্ধান্তে গাঁয়ের ছেলেপুলেদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আর হবে নাই বা কেন! দেউলহাটি রাজবাড়ির বাগানেই তো তারা এতদিন ধরে রাজত্ব করেছে।গাছের ফলফলাদি পেড়েছে, পিঁপড়ের বাসা ভেঙে ডিম যোগাড় করেছে।

সারা দুপুর ওই বাগানেই তাদের যত খেলাধুলো। কিন্তু অবনীবাবু আসা ইস্তক সে সুযোগ আর তেমনভাবে মেলে কই! এখন বাড়ির মালিকের হুকুমে বাগানের ত্রিসীমানায় আর কারো যাওয়ার উপায় নেই। রাজবাড়ির গেটে আজকাল মস্ত বড় তালা ঝোলে।

লোকলষ্কর রয়েছে কিছু। তারা সারাক্ষণ ঐ ঝাঁ চকচকে বাগান পাহারা দেয়।

বিশাল বাড়িতে একাই থাকেন অনাদিবাবু। কলকাতা থেকে মাঝেমধ্যে ছুটির দিনে তাঁর বন্ধুবান্ধব আসে। সারাদিন হৈ হৈ, খাওয়াদাওয়া, গানবাজনা চলে। তারপর বিকেল না হতেই আবার তাঁরা ফিরে যান।

এত সাবধানতা স্বত্তেও ফাঁকফোকর দিয়ে কী করে যেন বাগানে ঢুকে পড়ে ছেলের দল। তাই মাঝেমাঝেই দিবানিদ্রার বিলাসিতা ভুলে বোতাম লাগানো সাদা ধবধবে ফতুয়া পরে অনাদিবাবু সারা বাগানে
হেঁটে বেড়ান।

কিন্তু ছোট ছেলেপুলেদের সামলানো কি আর সহজ কথা! তাই কড়া পাহারা স্বত্তেও প্রায়ই ফলফলাদি কেমন করে যেন চুরি হয়ে যায়। ভয়ানক বিচ্ছু এই ছেলেগুলো।
আর সবথেকে বেশি দুষ্টু হলো এদের দলের সর্দার বিলু। অনাদিবাবুর দু চক্ষের বিষ।

ভারী বাঁদর ছেলেটা, বিন্দুমাত্র ভয়ডর নেই। বছর পনেরো বয়স হবে কিন্তু মাথায় যেন দুর্বুদ্ধি ঠাসা। সর্বক্ষণ দলবল নিয়ে কোন না কোন দুষ্কর্ম করে বেড়াচ্ছে।

বহুবার ছেলেটাকে ধমকধামক দিয়েছেন অনাদিবাবু, বারকয়েক কড়া শাস্তি দেওয়ার ভয় দেখিয়েছেন কিন্তু কোন ফল হয়নি।

দিনকয়েক আগে কলেজ স্ট্রীট থেকে কিছু বইপত্র কিনে বেশ খোশমেজাজেই তিনি বাড়ির দিকে আসছিলেন। গেটের সামনে আসতেই হঠাৎ থমকে গেলেন।

কালো রঙের গেটের গায়ে সেঁটে রাখা কাগজটার দিকে সেদিন নিষ্ফল আক্রোশে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তাঁর অবশ্য আর কিছু করার ছিল না। সাদা কাগজের ওপর গোটা গোটা অক্ষরে “স্বার্থপর দৈত্যের বাড়ি “লেখাটা দেখে তাঁর বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি যে এই কাজ বিলু ছাড়া আর কারো নয়।

রাগে তাঁর শরীরের রক্ত ফুটছিল।

গজগজ করতে করতে যেই না কাগজখানা ছিঁড়তে যাবেন, অমনি খানিক দূর থেকে খিলখিল হাসির শব্দ কানে ভেসে এলো। এদিক ওদিক তাকাতেই অনাদিবাবু সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পেলেন।
একটু দূরে নারকেল গাছের ওপরে বসে থাকা বিচ্ছু ছেলেগুলোর মুখে গা জ্বালানো হাসি দেখে
রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে যাচ্ছিল তাঁর।

এদের অত্যাচারে যে বাকি দিনগুলো আর সুখেশান্তিতে কাটানো যাবে না সে কথা তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন অথচ কী করে এই সমস্যার সমাধান করা যায় সেটা কিছুতেই তাঁর মাথায় আসছিল না।

অনেক ভেবেচিন্তে তিনি ভবানীবাবুর সঙ্গেই এই বিষয়ে কথাবার্তা বলবেন বলে মনস্হির করলেন।

অনাদিবাবু তেমন মিশুকে মানুষ নয়। নতুন জায়গায় দুচারজনের সঙ্গে অল্পস্বল্প আলাপ হলেও কারো সঙ্গেই তাঁর তেমন অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠেনি।
তবে দেউলহাটি স্কুলের হেডমাস্টার ভবানীবাবুর সঙ্গে এই অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।

প্রায়ই সন্ধ্যাবেলায় তিনি ভবানীবাবুর বাড়িতে গিয়ে গল্পগুজব করেন, দেশ বিদেশের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।

পরের দিন সান্ধ্যভ্রমণ সেরে ভবানীবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন অনাদিবাবু। ভবানীবাবু তখন তাঁর বৈঠকখানায় বসে বই পড়ছিলেন। অনাদিবাবুকে দেখে তিনি উৎসুক গলায় বললেন, “ আপনার কথাই ভাবছিলাম , অনাদিবাবু। দেউলহাটির কাছেই একটি গ্রাম আছে। তার নাম রতনহাটি। সেখানকার মন্দিরের ইতিহাস বিষয়ে কিছু বই সংগ্রহ করেছি। আপনি দেখলে নিশ্চয়ই খুশি হবেন।

অনাদিবাবুর কাছে ইতিহাস একটা নেশা। সময় পেলেই তিনি ইতিহাসের বই পড়েন।
অন্য সময় হয়ত তিনি ভবানীবাবুর কথা শুনে যথেষ্ট উৎসাহিত বোধ করতেন।
কিন্তু সেদিন তিনি আর কিছুতেই কোনো আলোচনায় মনসংযোগ করতে পারছিলেন না। বইটা হাতে নিয়ে দুচারটে পাতা উল্টেপাল্টে দেখে তারপর আবার সেটি যথাস্হানে রেখে দিলেন।

অনাদিবাবুর অস্হিরতা ভবানীবাবুর নজর এড়াল না। খানিকটা অবাক হয়ে তিনি কথার মোড় ঘোরালেন। বললেন, “আজ অনাদিবাবুর বাড়ি ফেরার বিশেষ তাড়া দেখছি যে? বিশেষ কোন কাজ আছে নাকি?

অনাদিবাবু খানিকক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবলেন। তারপর কোন ভূমিকা না করে গম্ভীরমুখে বললেন,
“কাজ তেমন কিছু নেই তবে মন বড় চঞ্চল হয়ে আছে। “
“ঐ বিলুকে নিয়ে বড় বিপদে পড়েছি ।দিন নেই , রাত নেই ,দলবল নিয়ে বড় উপদ্রব করে বেড়াচ্ছে ছেলেটা। এতদিন অনেক সহ্য করেছি,অনেক প্রশ্রয় দিয়েছি কিন্তু ভাবছি এবার ওকে কঠিন কোন শাস্তি দেব।

ভবানীবাবুর মুখে হঠাৎ যেন ছায়া ঘনাল। উদাস চোখে বাইরে তাকিয়ে বললেন ,
“বড় অভাগা ছেলে বিলু। জন্মের কিছুদিন পরেই মা মারা গেল ,বছর তিনেক আগে বাবাকেও হারালো। আমাদের গ্রামে যে বিশালাক্ষ্মী
মায়ের মন্দির আছে তার ঠিক পাশেই বিলুদের বাড়ি। বিলুর বাবা সুবিমল ছিল দেউলহাটি স্কুলের ছাত্র। ভারী ভাল ছেলে ছিল সুবিমল। বিনয়ী , নম্র, ভদ্র।

কিন্তু অমন সুন্দর, প্রাণবন্ত ছেলে সেনাবাহিনীতে চাকরী করতে গিয়ে জঙ্গিদের গুলিতে মারা গেল।“ টেবিলে রাখা কাঠের বাক্স থেকে একটা পুরোনো ছবি বের করে অনাদিবাবুর দিকে এগিয়ে দিলেন ভবানীবাবু। বললেন, “এই দেখুন সুবিমলের ছবি।

তিনবছর আগে কাশ্মীরে গিয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিল সুবিমল। সেই থেকে এখন বুড়ো ঠাকুমার কাছেই বড় হচ্ছে বাপ মা মরা বিলু। তবে তাঁরও বয়স হয়েছে।

আর দস্যি ছেলেটাকে ও শাসন করার কেউ নেই তাই দিনরাত শুধু হুল্লোড় করে বেড়ায়। “ভবানীবাবুর স্বর আরো নরম হয়ে গেল।

ছবিটার দিকে তাকিয়ে অনাদিবাবু কিছুক্ষনের জন্য নির্বাক হয়ে থাকলেন। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ। ছোটভাইটার কথা মনে পড়ছে আবার। এমন করেই তো দেশের জন্য লড়াই করার স্বপ্ন দেখত অতনু। কিন্তু হঠাৎই সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলো। পনেরো বছর বয়সের সুস্হ সবল ছেলে, হঠাৎ দুদিনের জ্বরে সব শেষ।

দু চারটে কথা বলে অনাদিবাবু সেদিন উঠে পড়লেন। মনটা বড় অস্হির লাগছিল।

দিনকয়েক এভাবেই কেটে গেলো। কোথাও আর তেমন গন্ডগোল হলোনা। তারপর হঠাৎ একদিন আবার এক বিভ্রাট ঘটল।
সেদিন ছিল পনেরোই আগস্ট।
রোজ সকালের মতোই দক্ষিণের বারান্দায় বসে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন অনাদিবাবু।

হঠাৎ সনাতন মালীকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে তাঁর ভুরুতে ভাঁজ পড়ল।
একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, “কী হলো , সাতসকালে এমন ছটফট করছিস কেন? “

“সর্বনাশ হয়ে গেছে বাবু, বড় পেয়ারা গাছটাতে আজ আর একটা পেয়ারাও নেই।” সনাতন মুখ কাঁচুমাচু করল। একটু দম নিয়ে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল
“এ নিশ্চয়ই বিলুর কাজ। এমন বাঁদর ছেলে …..। “

অনাদিবাবুর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। সনাতনের বাকি কথা তাঁর কানে আর যাচ্ছিল না। মাথায় তখন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।

কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তিনি আলনায় ভাঁজ করে রাখা সাদা ধবধবে ফতুয়াটা তাড়াতাড়ি পরে নিলেন।
একটা ফয়সালা না করলে যে শান্তিতে থাকা যাবেনা সেকথা তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলেন।

আগামী রবিবার কলকাতা থেকে তাঁর বন্ধুবান্ধবদের আসার কথা। এই পেয়ারাগুলো তাঁদের দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু এখন আর সে উপায় নেই।

চটিটা পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে পড়লেন অনাদিবাবু। থমথমে মুখ যেন রাগে ফেটে পড়ছে।

গ্রামের সকাল এমনিতেই বড় মনোরম। সকালের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হওয়ার পরে হাওয়াতে অল্প ঠান্ডা ভাব রয়েছে। ক্ষেত খামারের ওপর হাল্কা বাতাস খেলে যাচ্ছে। নরম হাওয়ায় তালবনের সারি সারি গাছগুলো মাথা দোলাচ্ছে।

পনেরোই আগষ্টের সকাল। দেউলহাটির স্কুলে তখন পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে। ছাত্র ছাত্রীরা একত্রিত হয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইছে।
অনাদিবাবুর অবশ্য কোনদিকে তাকিয়ে দেখার মতো মনের অবস্হা ছিলনা। ভেতরে রাগ আর বিরক্তি চেপে রেখে তিনি হনহন করে হাঁটতে লাগলেন। মুখ গম্ভীর,

রাগে, উত্তেজনায়, বিরক্তিতে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে।

বিশালাক্ষী মন্দির পেরিয়ে ঝাঁকড়া এক বটগাছ। তার ঠিক পাশেই বিলুদের বাডি।
বাড়ি না বলে কুঁড়েঘর বলাই ভাল। মাটির বাড়ি , খড়ের চাল , ঘরের সামনে বিশাল নিকোনো উঠোনে মাদুর বিছানো। উঠোন দিয়ে সামনের দিকে খানিকটা এগিয়ে গেলেন অনাদিবাবু।

কিছুদূর যেতেই হঠাৎ একটা শব্দ শোনা গেল। একটা অস্পষ্ট অবয়বের মতো নড়চড়া চোখে পড়তেই অনাদিবাবু পা টিপে টিপে আরো কয়েক পা এগিয়ে গেলেন।

একটু দূরে দাঁড়ানো আধময়লা জামা আর ঢলঢলে প্যান্ট পরা ছেলেটি যে বিলু সেকথা বুঝতে তার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না।

কৌতূহলী অনাদিবাবু খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে গোপনে লক্ষ্য করতে থাকলেন।

চশমাটা ভাল করে মুছে নিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই একটা উঁচু বেদীর দিকে চোখ আটকে গেলো তাঁর। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন অনাদি সান্যাল।

অবাক হয়ে দেখলেন একটা উঁচু বেদীর ওপর জাতীয় পতাকা রেখেছে বিলু আর তার ঠিক পাশেই একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি রয়েছে।

দূর থেকে ঠিকমতন ঠাহর না করতে পারলেও, অনাদিবাবু কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিলেন। গতকাল এই ছেলেটির ছবিই তিনি দেখেছিলেন ভবানীবাবুর বাড়িতে। জলপাই রঙের পোশাক পরা ছবিটা বিলুর বাবা সুবিমলের।


বেশ কিছুক্ষণ বেদীর সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে রইল বিলু। তারপর টানটান শরীরটাকে আরো সোজা করে বলল,
“আমাকে আশীর্বাদ করো বাবা। বড় হয়ে আমি দেশের জন্য লড়াই করব। ভারতমাতাকে রক্ষা করব আমি , ঠিক তোমার মতো।

বাঁ হাতটা কপালে ঠেকাল বিলু তারপর সজোরে বলে উঠল “জয় হিন্দ। “ পাথরের মতো স্হির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন অনাদিবাবু। অপলক দৃষ্টিতে বিলুর দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ।

বড় একটা শ্বাস পড়ল তাঁর। ছোট ভাইটার কথা মনে পড়ছিল। অনেকগুলো ছবি ভিড় করে আসছিল মনের মধ্যে। বড় আনন্দ করে স্বাধীনতা দিবস পালন করত অতনু। দেশের জন্য এভাবেই লড়াই করার কথা ভাবত সে।

চশমা খুলে কোঁচার খুঁটে চোখ মুছলেন অনাদিবাবু। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।

হলুদ পাথরের দেশে বিশ্বস্ত প্রস্রবণে

মলয় সরকার

নাম শুনেই তোমরা নিশ্চয় ভাবছ, এ আর নতুন কি, হলুদ পাথরের গল্প তো, যারা বিখ্যাত সিনেমা পরিচালক সত্যজিত রায়ের 'সোনার কেল্লা' সিনেমা দেখেছ বা বইটা পড়েছ, সে তো সেখানেই জানা হয়ে গেছে।

কিন্তু না, দেখছ না, আর একটি কথাও আছে, বিশ্বস্ত প্রস্রবণ! কথাটা একটু ধাক্কা দেবে বৈকি।প্রস্রবণ আবার বিশ্বস্ত হয় কি করে, তাও যদি বলি এটা উষ্ণ প্রস্রবণ! তাহলে? ব্যাপারটা একটু গুলিয়ে যায় নিশ্চয়ই।
যারা দেখেছ বা পড়েছ তাদের কথা আলাদা।যারা দেখনি, তাদের জন্যই আমার এই গল্প।

তাহলে বলেই ফেলি, সেই গল্প।
সেবারে গিয়েছি আমেরিকায়। এই হলুদ পাথরের দেশের গল্প অনেক শুনেছি। কাজেই ঘুরে আসার ইচ্ছা তো ছিলই।
হঠাৎই ছেলে প্রস্তাব দিল, এখানে যাওয়ার।মনটা ধড়াক করে নেচে উঠল।
যখন নামলাম বিলিংস এয়ারপোর্টে, এক অন্য অনুভূতি এসে কাজ করতে লাগল। সত্যি এলাম তাহলে এখানে, যা আমার অনেক দিনের স্বপ্ন!

একটুখানি তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই এই জায়গাটার ব্যাপারে। আমেরিকা তো আগে আদিবাসী রেড ইণ্ডিয়ানদেরই জায়গা ছিল।
এখানে যে আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানরা ছিল ( Minnetaree Indians) তারা এখানকার বিভিন্ন রকম হলুদ পাথর দেখে এর নাম করেছিল Yellow rock এবং এখানকার প্রধান নদীর নাম Yellow rock river। তার থেকেই পরে জায়গাটার নাম হয় Yellow stone। এই কঠিন আগ্নেয় পাথর (Obsidian) তারা ছুরি বা অন্য অস্ত্র তৈরীর কাজে লাগাত।বর্তমানে জায়গাটির নাম Yellow stone National Park। 


জায়গাটি বেশিরভাগ ( প্রায় ৯৬%) উওমিং (Wyoming)  প্রদেশের মধ্যে, অল্প আছে মন্টানা (Montana)আর ইডাহোর (Idaho) মধ্যে।এটিই পৃথিবীর মধ্যে প্রথম ন্যাশনাল পার্ক (১৮৭২সাল)। এখানে আদিম মানুষরা বাস করে আসছে প্রায় ১১০০০ (এগারো হাজার) বছর ধরে।
এটি আসলে একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি,  যেটির ভবিষ্যতে অগ্ন্যুৎপাত হতে পারে যে কোন সময়েই।তবে এখানে শেষ অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল প্রায় ৭০০০০ বছর আগে।

আমি যত এগোচ্ছি গাড়ি করে, সেই এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে, তত আশ্চর্য হচ্ছি রাস্তার অদ্ভুত সৌন্দর্য দেখে। ঝকঝকে ঘন নীল আকাশের নীচে হাড় কাঁপিয়ে দেওয়া ঠাণ্ডা হাওয়া আর তার সঙ্গে পাহাড়ের পাথরের রঙের বৈচিত্র্য যে কোন মানুষকে মুগ্ধ করবেই। কখনও কখনও অনেক নীচে দেখতে পাচ্ছি ঘন নীল জলের নীরব একাকী লেকের শুয়ে থাকা, আর পাশে প্রহরীর মত স্থির দাঁড়িয়ে আছে সবুজ পাহাড়ের কোলে  সবুজ চিরহরিৎ পাইনের সারি। কখনও চলেছি পাহাড়ের মাথার উপর দিয়ে, কখনও আবার শান্ত সমাহিত কাকচক্ষু জলের লেকের পাশ দিয়ে। প্রায় দেড়শ মাইল রাস্তা সারাদিন ধরে চলাটাই একটা সুন্দর অভিজ্ঞতা।

চলেছিলাম বিখ্যাত সুন্দর Beartooth Haighway দিয়ে।যেতে যেতে যেখানে, মন বলছে একটু দাঁড়াও, প্রকৃতি বলছে আমায় দেখ, দাঁড়ালাম। মন ভরে যায় কখনও সামনে উত্তুঙ্গ খাড়াই পাহাড়, কখনও রঙবেরঙের পাথরের রঙীন পাহাড়, এই সব দেখতে দেখতে।
হঠাৎ দেখি কিছু দূরেই চরছে একদল বাইসন। বাইসনকে যদিও বুনো মোষ বলা যায়, তবু দেখতে বেশ ভয়ঙ্করই লাগে।
এই ইয়োলো স্টোন পার্কটি প্রায় ৯০০০( নয় হাজার) বর্গ কিমি আয়তন জুড়ে ছড়িয়ে আছে এর পাহাড় পর্বত নদী আর আশ্চর্যময় সব ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্য  নিয়ে।

এখানে আসতে আসতেই দেখলাম রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি স্তুপাকৃতি বড় পাথরের জায়গা। তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে ভসভস করে ধোঁয়া। বাতাসে ভাসছে গন্ধকের গন্ধ। দূরে চরছে একপাল হরিণ যাদের বলা হয় Pronghorn deer। এই স্তুপটির নাম Soda Butte। 

এগোলাম। চারদিকে এখানে ওখানে  বেরোছে সাদা ধোঁয়া।যেন মনে হচ্ছে আশেপাশে কোথাও আগুন লেগেছে। সে ধোঁয়া কখনও মাটির থেকে, কখনও কোন স্তুপের মাথা থেকে, কখনও বা নিছক নদীর জলের উপর থেকে।
দেখে তো আমার মুখে আর বাক্য সরে না।ভাবছি এ কোন অদ্ভুত দেশে এলাম রে বাবা!
এখানে নানা রকমের জন্তুজানোয়ার রয়েছে। রয়েছে মানে গিজগিজ করছে আমাদের আশে পাশেই। মানুষকে খুব ভয় পায় এমন নয়। একেবারে সামনেই দেখা যায় অনেক জন্তু।
এখানে ২০০৫ সালে ছিল প্রায় ৫০০০ বাইসন, যদিও নানা কারণে পরে কিছু কমে গেছে।
এখানে অল্প হলেও আছে নেকড়ে ধরণের প্রাণী। তবে যেটি বেশি আছে তা হল কোয়োটে, যা ছোট শেয়ালের মত দেখতে। এরা বড় প্রাণী মারতে পারে না। এছাড়া এখানে প্রচুর ভালুক( গ্রিজলি), ৩০০০০ এর উপর এল্ক (এক ধরণের হরিণ) ,অল্প পরিমাণে মুজ,পাহাড়ী ছাগল, পার্বত্য সিংহ( এগুলি নামে সিংহ হলেও বড় বিড়ালের মত),অন্যান্য বেশ কিছু ধরণের হরিণ, ব্ল্যাক বিয়ার, ইত্যাদি পাওয়া যায়।
এখানে বল্ড ঈগল,  ফ্যালকন ছাড়াও নানা ধরণের ( প্রায় ৩১১ ধরণের) পাখী পাওয়া যায়।

তবে সবচেয়ে যা বেশি পাওয়া যায় তা হল, এই সব প্রাণীর চেয়েও আশ্চর্য,  উষ্ণ প্রস্রবণ বা ফোয়ারা।সারা পৃথিবীতে যত ঊষ্ণ প্রস্রবণ আছে, তার অর্ধেকই আছে এখানে।
এছাড়া আছে mudpots। এই গুলি থেকে অনবরত বা মাঝে মাঝেই বেরিয়ে চলেছে গরম কাদা, ফুটন্ত অবস্থায়।রয়েছে fumaroles। এগুলি থেকে ভুস ভুস করে, কখনও শুধু ধোঁয়া, কখনও গরম জলের সাথে ধোঁয়া বেরিয়েই চলেছে। প্রায় ১০০০০ এরকম ফোয়ারা, mudpot বা fumarole ইত্যাদি রয়েছে।
এই অঞ্চলের তাপমাত্রা -৪° থেকে ৩৭° সে পর্যন্ত হতে পারে।

এবার বলি, এসব দেখতে দেখতে দুপাশে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছি। হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশে একটি হরিণ বাচ্চা, গায়ের রঙ ঘন কালচে বাদামী, লোমে ঢাকা দুটি শিং নিয়ে বড় বড় চোখ মেলে পাতা খাচ্ছে।এটি একটি এল্ক বাচ্চা। আমরা গাড়ি দাঁড় করালাম। আমাদের দেখাদেখি অনেক গাড়িই দাঁড়াল, বেরিয়ে এল নানা ধরণের ক্যামেরা।কিন্তু তার কোন ভয়ডরই নেই।দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পোজ দিতে লাগল। খুব মজা লাগল।

আমরা পৌঁছালাম ভিজিটর সেন্টারে। দেখার মত ভিজিটর সেন্টার।মোটা মোটা কাঠ দিয়ে তৈরী ত্রিতল বিশাল এক ঘর।তার কাঠে কোথাও স্বাভাবিকত্ব নষ্ট না করে সুন্দর ডিজাইনের আধো অন্ধকার ধরণের পরিবেশ করা রয়েছে।প্রচুর পর্যটক ভিতরে।এর ভিতরে খাওয়ার হোটেল, বসার জায়গা ইত্যাদি সমস্তই আছে। সবাই জানতে চাইছে এখানকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ বিশ্বস্ত ফোয়ারা বা Faithiful geyser সম্বন্ধে।

এখানে যতগুলি geyser আছে, তার মধ্যে Castle geyser, Lion geyser, Beehive geyser, Grand geyser (এটি পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা গীজার),Giant geyser (পৃথিবীর সবচেয়ে আয়তনে বড় geyser) ইত্যাদি। এই পার্কে রয়েছে সবচেয়ে উচ্চ দুটি সক্রিয় geyser,Steamboat geyser ও Norris geyser। 
সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, এখানে প্রতি বছর হাজার হাজার ছোটখাট ভূমিকম্প হয়।
খোঁজ নিয়ে জানলাম, এই ওল্ড ফেথফুল গীজার বা বিশ্বস্ত প্রস্রবণটি দিনে প্রায় ২০ বার জল উদগীরণ করে। সেই সময়টি প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় ( ৫-১০মি তফাত হতে পারে)। এটি নির্ধারণ করা হয় পূর্ববর্তী উদগীরণের স্থায়িত্ব ও উচ্চতা মেপে। এই প্রতিটি উদগীরণের তথ্য এখানে লিখে রাখা হয়। একটি উদগীরণের থেকে আর একটি উদগীরণের সময় অন্তর প্রায় ৬০-১১০ মি হতে পারে। এই, প্রায় নিশ্চিত ভাবে উদগীরণের সময় বলতে পারা যায় বলেই এর নাম 'বিশ্বস্ত প্রস্রবণ'। এই সময়টা জেনে নিয়ে মানুষ ওই প্রস্রবণের চারপাশে ভিড় করেন, যাতে ভালভাবে এর জল ছোঁড়ার খেলা দেখতে পারেন।এর চারদিকে গোল করে রাস্তা করা আছে, বসার জায়গা আছে দেখার জন্য। সাধারণতঃ এই সীমারেখার ভিতরে যাওয়া নিষেধ।
তথ্য বলছে, প্রতিটি উৎক্ষেপনে প্রায় ২-৪ মি সময় নেয়।আর প্রতি উৎক্ষেপনে ৩৭০০-৮৪০০ গ্যালন জল নিঃসরণ হয়।এর জলের ঊষ্ণতা প্রায় ৯৬° সে।

আমরা দেখলাম, প্রায় এক ঘন্টা দেরী আছে, পরের উদগীরণ হতে।
ততক্ষণ আমরা সময় নষ্ট না করে এগোলাম চারপাশ দেখতে।
এখানে যে Grand Prismatic Spring রয়েছে সেটি আমেরিকার সবচেয়ে বড় ঊষ্ণ প্রস্রবণ। এটি বড় অদ্ভুত দেখতে।এর যা জমা জল রয়েছে তার রঙ যত ভিতর দিকে যায় তত ঘন নীল এবং ধারের দিকে সবুজ হয়ে হলুদ এবং লাল ঘেঁষা হয়ে যায়। অনেকটা রামধনুর রঙের মত।এই রঙ অনেকটাই ঋতু পরিবর্তনের উপর নির্ভর করে।তবে এই রঙের কারণ হিসাবে বলা হয়, এই সমস্ত জলে প্রচুর 
এলগী জাতীয় ক্ষুদ্র অর্গানিজম আছে যারা বিভিন্ন তাপমাত্রায় বিভিন্ন রঙ বিকিরণ করে।এবং এক এক অর্গানিজম এক এক তাপমাত্রায় বাঁচে। তাই তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে এদের নানা রকম রঙ হয়।তাই এই ইয়েলো স্টোন পার্ক এত রংবাহারী। পর্যটকদের জন্য কড়া নির্দেশ আছে, নির্দিষ্ট জায়গা দিয়েই চলাফেরা করতে হবে।এই সমস্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কোন মতেই নষ্ট করা যাবে না। বিভিন্ন জায়গায় হাঁটার জন্য সুন্দর কাঠের রাস্তা করা আছে।
বহু বছর ধরে এখানে যত প্রস্রবণের জল বেরিয়ে চলেছে তার ফলে চতুর্দিকে তৈরী হয়েছে অনেক জলাভূমি। সেগুলি কিন্তু সাধারণ নয়। যেহেতু জলে নানা ধরণের যৌগ রয়েছে, অনেক ধরণের এককোষী প্রাণী রয়েছে, ফলে মাটির উপর তৈরী হয়েছে নানা ধরণের আস্তরণ। বড় সুন্দর লাগে সেগুলো দেখতে তাদের রংবাহারের জন্য।তার উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেক গাছ বা গাছের মরা কঙ্কাল। 
এ ছাড়া বয়ে চলেছে অনেক জলধারা।তার জল, তলদেশ এবং ধারে ধারেও এরকম রঙের ছড়াছড়ি।
অনেক ছোট ডোবার মত poolও রয়েছে, যার তলদেশ থেকে হয়ত নির্গত হয়ে চলেছে এরকম জলধারা। উপরে বাড়তি জল বেরিয়ে বয়ে চলেছে ধীরে ধীরে,মিশছে নদীতে। সেগুলোর ঘন সবুজ, ঘন নীল রঙ মন কেড়ে নেবেই।অনেক জায়গাতেই মনে হচ্ছে কোন আর্টিস্ট রঙ ছড়িয়ে এত সুন্দর ছবির সৃষ্টি করেছেন।কোথাও বেরোচ্ছে কাদা। তাই জমে জমে মুখটা উঁচু স্তুপ হয়ে গেছে।

এই প্রস্রবণগুলো যখন জল ছোঁড়ে সে কিন্তু দেখার মত। তার ভিতর ফুটে ওঠে বিশাল রামধনু।এই pool,  spring,বা  geyser গুলোর বিভিন্ন নাম আছে এবং এক একটা এক এক রকম সুন্দর। যেমন Ephedra Spring,
Sulphur spring, Surprise pool, Sapphire pool কি Spray geyser, Riverside geyser এইসব।যার যা বিশেষত্ব সেই বুঝে  তার নাম।
বেরিয়ে চলেছে ধোঁয়া আর বাষ্প

চলে এলাম ঠিক সময়ে Old faithful geyser এর কাছে।ইতিমধ্যেই বহু মানুষ জড়ো হয়েছেন, এই দৃশ্য দেখতে। জায়গা পাওয়াই মুস্কিল।তবু সুবিধামত জায়গা করে নিলাম।সবার চোখ ফোয়ারার মুখে। প্রায় নির্দিষ্ট সময়েই ফোয়ারার  মুখে অল্প বাষ্প বেরোতে আরম্ভ করল। জনতা উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল।সব ক্যামেরা তৈরী।ধীরে ধীরে ঠিক তুবড়ীর মত ফোয়ারার জল উঠতে লাগল।ক্রমশঃ উচ্চতা বাড়তে লাগল। বাড়তে বাড়তে প্রায় ১৫০ ফুট পর্যন্ত অর্থাৎ  প্রায় ১৫-২০ তলা বাড়ির সমান উঠে গেল। সেরকম বেগে ছুটতে লাগল জল, বাষ্প।প্রায় ২-৩ মিনিট ধরে এরকম চলার পর নামতে নামতে ধীরে ধীরে আবার তলিয়ে গেল গর্তের ভিতর।চক্ষু সার্থক হল।মনে ধরা রইল সেই মূল্যবান ছবি।
এবার আসি সংক্ষেপে এর ভিতরের তথ্যে।
আমরা জানি আজও পৃথিবীর অভ্যন্তরে চলেছে প্রচণ্ড গরম উত্তাপে ভাঙ্গাচোরার খেলা। সেখানে টগবগ করে ফুটছে লাভা। তাই বেরিয়ে আসে মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির মুখ দিয়ে, ঘটায় অগ্ন্যুৎপাত। 
এবার ধর, কোন জায়গা দিয়ে যদি মাটির উপরের জল গিয়ে পৌঁছায় সেই গরম লাভার কাছে।তাহলে কি হবে! সঙ্গে সঙ্গে সেই জল বাষ্প হয়ে প্রচণ্ড চাপ দেবে ভিতরের দেওয়ালে। ফলে মাঝেমাঝেই হয় ভূমিকম্প। 

এবার সেই বাষ্প বাইরে আসার রাস্তা খোঁজে। তার ফলে যখন যেখানে তারা রাস্তা পায়, সেখান দিয়েই বাইরে আসে। এইভাবে, কোন জায়গায় একটা রাস্তা তৈরী হয়ে গেলে সেখান দিয়েই বার বার গরম জল, বাষ্প বেরোতে চেষ্টা করে, যদি তা কোন কারণে বন্ধ না হয়ে যায়।
এইভাবেই এখানে হয়ে চলেছে এত প্রস্রবণের নিত্য উদগীরণ। সেই অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ।

এখানে কাটিয়েছিলাম দু দিন। প্রথম দিন ফেরার সময় এক কাণ্ড।ফিরছি, সন্ধ্যা হয়ে গেছে।হঠাৎ এসে পড়লাম একটা বিশাল বাইসন দলের কাছাকাছি। রাস্তার উপরে, আশে পাশে বেশ কিছু বাইসন চরছে। আমাদের গাড়ি চলল সাবধানে। তার মাঝে হঠাৎ শুনি প্রচণ্ড চিৎকার আর যুযুধান দুই বাইসনের লড়াইয়ের আওয়াজ। ধুন্ধুমার লড়াই। রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল।দাঁড়িয়ে গেল শত খানেক গাড়ি।সে কি ভীম দুর্যোধনের লড়াই! শিং দিয়ে প্রচণ্ড গুঁতোগুঁতি চলছে রাস্তার উপরেই। এরকম একটা দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে থাকব, ভাবি নি কখনও। একবার একজন এগোয় অন্যজন পিছোয় তো পরক্ষণেই বিপরীত। কেউ হার মানে না।লড়াইয়ে নেশায় কোন গাড়ির উপর পড়বে বা কি করবে স্থির নেই।

হর্ণ দিয়ে এসে গেল বনদপ্তরের গাড়ি। তারা পটাপট নেমে বাইসন তাড়াবার নানা ব্যবস্থা নিল। বাঁশি বাজিয়ে, আলো দেখিয়ে, নানা ভাবে নানা কায়দা করতে লাগল।আমরা ভয়ে কাঠ। অন্য সমস্ত বাইসনরা সেইসব দেখে শুনে নানা দিকে দৌড়াতে লাগল। কিন্তু লড়াকুদের ভ্রুক্ষেপ নেই। শেষে অনেক পরে রক্ষীদের চেষ্টায়, না, ক্লান্তিতে জানিনা, তারা রণে ভঙ্গ দিতে বেশ কিছু পরে বনদপ্তরের অনুমতি পাওয়া গেল এগিয়ে যাওয়ার।

ও মা!  জঙ্গলের ভিতরে হোটেলের কাঠের বাড়ির সামনে, প্রায় দরজায় দেখি দুটি বাইসন। ঘাস খাচ্ছে।দেখে ভয়ে মরি। তবে, সাধারণতঃ এরা ঠাণ্ডা।  কিছু করে না।
যাই হোক, ভয়ে ভয়েই ঘরে ঢোকা হল।
রাত কাটিয়ে ভোরে দরজা খুলতেই দেখি, জঙ্গলের সেই গাছপালায় ঘেরা বন্য পরিবেশে ঘাস খাছে দুটি ছোট্ট হরিণশিশু।দূরে রয়েছে তাদের মা।খুব ভাল লাগল। তবে আদর করার ইচ্ছা থাকলেও এগোই নি।সন্তানের উপর কোন কিছু হলে সতর্ক মা যে কি করবে তার ঠিক নেই। তাই জঙ্গলের সতর্কতাও রয়েছে চারিদিকে, বন্যজন্তুকে কোনভাবে উত্যক্ত না করতে বা তাদের কাছে না যেতে।তাই দূর থেকেই দেখে চক্ষু সার্থক করলাম, ভোরের সবুজ ভিজে আবহাওয়ায় হাল্কা নরম আলোর সঙ্গে সেই মৃগপরিবারকে দেখে।

ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না। তবু চলে আসতেই হল। ফেরার পথে এলাম অন্য পথে।সেখানে দেখা হল আরও অনেক নতুন নতুন প্রস্রবণ। তাদের বিচিত্র রূপ, বিচিত্র গঠন, বিচিত্র ধরণ।কেউ ফুটন্ত কাদার গামলা হয়ে রয়েছে, তাতে হয়ে চলেছে নানা আঁকিবুঁকি। কেউ বা আবার ঘোঁতঘোঁত শব্দ করে গ্যাস বের করে যাচ্ছে।কেউ বা অনবরত জল বেরিয়ে বেরিয়ে তার চারপাশে তৈরী করেছে বিস্তৃত সাদা ধবধবে চুণের চাদরের মত আস্তরণ, যা পাহাড়ের গায়ে বিছিয়ে রয়েছে। আকাশ বাতাস সাদা বাষ্প, গন্ধক জাতীয় পদার্থের গন্ধ সব মিশিয়ে এক অন্য আবহাওয়া তৈরী করেছে।দেখা হল বহু ধরণের হরিণের পাল, কয়েকটা ভালুক, বাইসন, কোয়োটে ইত্যাদি জন্তুজানোয়ারের সাথে।

ছেড়ে এলাম বটে, তবে মনের মণিকোঠায় চিরদিন তা জ্বলজ্বল করবে ঊজ্বল মণির মত।আশা রাখি বড় হয়ে তোমরাও দেখে আসবে নিজের চোখে এই সব প্রাকৃতিক আশ্চর্য।

Post a Comment

0 Comments