জ্বলদর্চি

পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে /পর্ব-৭/সুদীপ সেন

পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে

পর্ব-৭

সুদীপ সেন  


Use & Throw এই শব্দবন্ধ্ আমাদের দ্রুতগতির আধুনিক জীবনযাত্রার আবহে খুব পছন্দের এবং অবশ্যই অনেকাংশে প্রয়োজনীয়। Use তো করতেই হবে কিন্তু Throw করবো কোথায় ? চকলেট – বিস্কুট – বাদাম – ওষুধ – পাউরুটি – দুধ – আইসক্রিম - চানাচুর খাবো তো সবই কিন্তু খাওয়ার পরে প্লাস্টিকের প্যাকেটটা কোথায় ফেলবো ? ক্যানো, ঘরের জানলা দিয়ে রাস্তায় বা চলন্ত গাড়ির কাঁচ নামিয়ে যেখানে খুশি। পিকনিকে রান্না করে খেতে তো হবে, সুতরাং নিয়ে আসবো সাদা থার্মোকলের থালা – প্লাস্টিকের গ্লাস ইত্যাদি কিন্তু খাওয়ার পরে থালা গ্লাস কোথায় ফেলবো ? ক্যানো, পিকনিকের স্পটেই নদীর পাড়ে বা জঙ্গলের কোনায়। রাস্তাঘাটে পরিস্কার জল পাওয়া যায় না তাই মিনারেল ওয়াটার কিনে খেতে হয় কিন্তু জল খাওয়ার পরে ফাঁকা বোতল কোথায় ফেলি ? কোথায় আবার, রাস্তায় ! পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে ম্যাগি, ক্যানড ফুড ছাড়া অনেক জায়গায় কিছু পাওয়াই যায় না, বাধ্য হয়ে খাবো আর তারপর ফাকা ক্যান / প্যাকেট ওই পাহাড়েই ফেলে আসবো ! দুর্গা – লক্ষী – কালি – কার্ত্তিক ঠাকুরকে কয়েকদিন খুব পুজো করে তারপর জলে ফেলে দেবো একগাদা শোলার ফুল -গহনা, সিনথেটিক শাড়ী আর কেমিকাল রঙ সমেত। ব্যাগ না নিয়ে বাজারে গিয়ে অথবা ক্যারিব্যাগ যখন মাছ / সবজিওয়ালা ফ্রীতেই দিচ্ছে তখন নিয়েই নিই ( ছাড়বো ক্যানো ! ) এইসব ভেবে প্রচুর প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ আমরা নিই কিন্তু বাজার থেকে বাড়ি ফিরে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্যারিব্যাগ গুলো ফেলে দিই। কোথায় ফেলি ! ক্যানো, যেখানে সেখানে !! মালপত্র প্যাক করে দূরে কোথাও পাঠাতে হলে প্যাকিং ম্যাটেরিয়াল হিসাবে কি দেয়া যায় ! ক্যানো, থার্মোকল !! হালকা সস্তা এবং ঘাতসহনশীল। মালপত্র গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাবার পরে প্যাকেট খুলে সেই থার্মোকল দিয়ে কি করবো ! ফেলে দেবো, যেখানে পারি।      

🍂

এই একবার Use করেই Throw করার সময় আমরা কিন্তু ভাবি না যে আমি যে প্লাস্টিক / পলিথিন / থার্মোকল / বিষাক্ত কেমিকাল Throw করলাম সেটা হয়তো আমার জীবন শেষের পরেও মাটিতে থেকে যাবে। আমরা প্রত্যেকে আমাদের সারা জীবনে ( গড় ৭০ বছর আয়ু ধরে, প্রতিদিন গড়ে মোটামুটি ১০ গ্রাম ) যত প্লাস্টিক Throw করবো সেটা ( ৭০ x ৩৬৫ x ১০গ্রাম = ২৫৫.৫০ কিলোগ্রাম ) এই পৃথিবীতে আবর্জনা হিসাবে থেকে যাবে। আর আমাদের দেশের জনসংখ্যার নিরিখে হিসাব করলে মোট প্লাস্টিক Throw কয়েক হাজার কোটি টনে গিয়ে দাঁড়াবে। পৃথিবী যতই বিপুল বিশাল হোক তারও তো ধারনক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে, বিশেষত এই ধরনের অতিদীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থের ক্ষেত্রে। তাই আমাদের সবার, মানে সত্যি সত্যি সবার ( কেউ বাদ না ) অবিলম্বে একবার Use করার পরে পরেই Throw করার প্রবনতা কমিয়ে আনতে হবে। Use & Throw এর পরিবর্তে আমাদের এখন Use & Re-use & Reduce নিয়ে ভাবতে হবে।   

১) চকলেট – বিস্কুট – বাদাম – ওষুধ – পাউরুটি -দুধ - আইসক্রিম তো নিশ্চয়ই খাবো, পিকনিকে গিয়ে মজা করে অবশ্যই খাবো কিন্তু খাওয়ার পরে প্লাস্টিকের প্যাকেটটা যেখানে ব্যাবহৃত প্লাস্টিক ( নিদেন পক্ষে ডাস্টবিন ) ফেলার জায়গা পাবো শুধুমাত্র সেখানেই ফেলবো। এক জায়গায় এইভাবে সব ব্যাবহৃত প্লাস্টিক জমা হতে শুরু হলে তারপর সেটার Re-cycling & Re-use করার ব্যবস্থা করলে ( আজকাল অনেক দেশে নতুন রাস্তা তৈরি  করতেও ফেলে দেয়া প্লাস্টিক / পলিথিন এক জায়গায় জড় করে ব্যাবহার করা হচ্ছে) দূষণকারী আবর্জনা প্রকৃতিতে অনেক কম মিশবে। আর ফেলে দেবার আগে আমি নিজেই একে আরো কয়েকবার Re-use করতে ভাল করে চেষ্টা করবো। আজ যে ক্যারিব্যাগটা সবজিওয়ালার কাছ থেকে নিয়ে এসেছি সেটাই কাল বাজারে যাবার সময় পকেটে নিয়ে যাওয়া খুব কিছু কঠিন না, শুধু একটু সচেতন হয়ে অভ্যাসে পরিবর্তন করতে হবে।  

২) যেখানে সম্ভব সেখানে প্লাস্টিক / থার্মোকলের পরিবর্তে অন্য জৈব সহজে পচনশীল দ্রব্য ব্যাবহার করা যেতে পারে। পিকনিকে গিয়ে শালপাতা, কলাপাতা, আখের ছিবড়ে / ভুট্টাপাতার থালায় বা মাটির গ্লাসে খাওয়া কিন্তু নতুন মজা আনতে পারে, প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের বদলে কাগজের ঠোঙ্গাও অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাবহার করা যায়। ফুল কিনতে, চপ কিনতে, মাছ কিনতে সবেতেই আমাদের প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ চাইবার প্রবনতা কমাতে হবে।  

৩) সিনথেটিক দড়ির পরিবর্তে যতটা সম্ভব নারকেলের দড়ি, পাটের সুতলি দড়ি, পুরনো কাপড় লম্বা ফালি করে কেটে দড়ি বানিয়ে নিয়ে অনেক কাজই ম্যানেজ করা যেতে পারে।  

৪) অনলাইনে কেনা মালপত্র বা টিভি / মাইক্রোওয়েভ / ফ্রিজ ইত্যাদি যেসব বড় প্লাস্টিক প্যাকেটে বা থার্মোকলের বাক্সে আসে, সেগুলো ফেলে না দিয়ে তার ২-৩টে একসাথে নিয়ে তার মধ্যে মাটি দিয়ে গাছ পোতা যেতে পারে। একইরকম ভাবে একটু মাথা খাটিয়ে, বড় কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতল বা ছোট ড্রাম কেটে সুন্দর বাহারি ঝুলন্ত টব বানানো যেতে পারে।   

৫) প্লাস্টিকের বোতল, বোতলের ছিপি, কারিব্যাগ, পাউচ প্যাকেট, পুরনো জুতোর সোল, টেট্রাপ্যাক এর ফাঁকা প্যাকেট ইত্যাদি দিয়ে অনেকরকম গৃহস্থালির জিনিস, গৃহ সজ্জার জিনিস বা সুদৃশ্য উপহার সামগ্রী বানানো যায় ( ইউ টিউবে এরকম অনেক আইডিয়া পাওয়া যায় আর নিজেরাও মাথা খাটাতে হবে ), এমনকি বানিয়ে বিক্রি করে ব্যবসাও করা যায়। আমি কলকাতার একজন মহিলাকে জানি যে পুরনো জিন্সের জামা প্যান্ট সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে রকমারি ব্যাগ - সৌখিন জিনিস বানিয়ে বিক্রি করে, এবং এই কাজে সে আরও অনেক দুঃস্থ মহিলাকে সাথে নিয়ে কয়েকশো পরিবারের রুজি রুটির ব্যবস্থা করেছে।  

৬) পুরনো প্লাস্টিকের টেবিল ক্লথ ফেলে না দিয়ে ওটা দিয়ে একটা বালিশের খোল বানিয়ে তার মধ্যে পুরনো প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ভাল করে ঠেসে ভরে মুখ সেলাই করে দিলেই সুন্দর আউটডোর বালিশ ( জলে ভিজলেও কিছু হবে না) বানানো যেতে পারে।  

৭) আশপাশের সবাইকে, বাচ্চা থেকে বুড়ো পর্যন্ত সবাইকে উপরের বিষয়গুলো নিয়ে বারবার সচেতন করতে হবে। হাসি ঠাট্টা বা অবাঞ্ছিত বিরূপ মন্তব্য গায়ে না মেখে নিজেদের এবং সন্তানদের প্রান বাঁচানোর লড়াই চালিয়ে  যেতে হবে। এক্ষেত্রে বাচ্চারা মনে হয় সব থেকে বেশি অবদান রাখতে পারবে। ওদের যদি আমরা সচেতন করে তুলতে পারি তাহলে ওরাও অন্য সবাইকে প্রভাবিত করতে পারবে আর শিশুদের আবেদন বড়দের মনে দাগ কাটবেই। তাই নিজেরা সচেতন হই, Use & Re-use & Reduce মন্ত্র আত্মস্থ করার চেষ্টা করি আর বাড়ির শিশুদের সচেতন করে তুলি যাতে Re-use & Reduce এর নিত্যনুতন উদ্ভাবন ওদের হাত ধরে বেশি করে আসে আর ওদের কর্মকাণ্ড দেখে, ওদের আবেদনে সমাজের সকল স্তরে ফলপ্রসু প্রভাব পড়ে । 

"প্রকৃতি - পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, মানুষ বাঁচলে তবেই বাকি সবকিছু কাজে লাগবে"।

Post a Comment

0 Comments