পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে
পর্ব-৮
সুদীপ সেন
আমরা পোকামাকড় – আরশোলা – টিকটিকি – মাছি – শুঁয়োপোকা – সাপ – পিঁপড়ে – উঁইপোকা – ইঁদুর ইত্যাদি আমাদের সামনে দেখলেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেরে ফেলি। ঝাঁটা বা লাঠির বাড়ি, কেরসিন তেল, বিষাক্ত ধোঁয়া বা রাশায়নিক স্প্রে কিছুই বাদ দিই না, যাকে যেটা দিয়ে মারা যায় সেটা দিয়েই নির্বিচারে মেরে ফেলার চেষ্টা করি। অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনে অনেককে মেরে ফেলি ( উদাহরণ ঃ জাল দিয়ে মাছ ধরতে হয় আমাদের খাবারের জন্য, তাই কিছু মাছ আমাদের মারতেই হয়। কিন্তু জালের মধ্যে গেঁড়ি – গুগলি – শামুক জাতীয় অনেক প্রানী ধরা পড়ে যাদের আমরা নিতান্ত অবহেলায় মরার জন্য জাল থেকে ছাড়িয়ে ডাঙ্গাতেই ফেলে রাখি, প্রাণীগুলো বিনা দোষে এবং বিনা কারনে মারা যায়। আমরা একটু সচেতন হলে জাল থেকে মাছ ছাড়িয়ে নেবার পরে অন্য শামুক জাতীয় সব প্রাণীগুলোকে যদি আবার জলে ছুঁড়ে ফেলে দিতাম তাহলে ঐ প্রাণীগুলো বেঘোরে প্রান হারাতো না আর আমাদের জলাশয়গুলোতেও স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্র ভালো থাকতো।)। এদের সবার যে এই পৃথিবীতে থাকার স্বাভাবিক অধিকার আছে এটা আমরা ভাবিই না, এদের সবার স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনটাও আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জানি না।
সারা বিশ্বের প্রানী – উদ্ভিদ জগত জুড়ে এক পারস্পরিক নির্ভরশীল খাদ্যশৃঙ্খল রয়েছে, আমরা তারই একটা অংশ মাত্র। এই শৃঙ্খলের যে কোনও একটি অংশ ছিড়ে গেলেই পুরো জগতজোড়া শৃঙ্খলা বিভিন্ন ভাবে ভেঙ্গে পড়বে, আমাদের জীবনযাত্রাও নতুন নতুন বিপদের সামনে পড়বে। আগে এক পর্বে চীন দেশে সাধারন চড়াই পাখি নিধন কিভাবে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই আলোচনা আমরা করেছি। আমরা পোকা মাকড় মাছি মৌমাছি দেখলেই মেরে ফেলি, কিন্ত এরা যে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজটা নীরবে নিঃশব্দে করে থাকে, সেটা হল পরাগমিলন। বিভিন্ন শাক সব্জী ফল ফসল চাষের খেতে ফুলের রেনুর ঠিক মত পরাগ মিলন না হলে আমাদের ফসল উৎপাদন ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর আমরা খাদ্যসঙ্কটের মুখোমুখি হব। আবার এই সব পোকা মাকড় অনেক পাখির স্বাভাবিক খাবার। তাই পোকা মাকড়গুলো না থাকলে পাখিগুলো বাচবে না। আবার এইসব বিভিন্ন পাখী বা তাদের ডিম অনেক ধরনের বনচর সরীসৃপ বা ছোট মাংশাসী প্রানীর খাদ্য। সরীসৃপ বা ছোট মাংশাসী প্রানীগুলো আবার বড় হিংস্র জন্তুদের খাদ্য। আবার এই বড় জন্তুরা যখন মরে যায় তখন তাদের দেহাংশ শকুন – শেয়াল – হায়না - বুনো কুকুর – বিভিন্ন পোকা ও ব্যাকটিরিয়ার স্বাভাবিক খাদ্য হয়ে ওঠে, একই সাথে দেহাংশের যতটুকু অবশেষ মাটিতে মেশার সুযোগ পায় সেটুকু আবার গাছপালার স্বাভাবিক খাদ্যে রুপান্তরিত হয়। এই ভাবেই একে অপরের উপর নির্ভরশীল আমাদের এই বাস্তুতন্ত্র। তবে এই বাস্তুতন্ত্রে সবাই ( একমাত্র মানুষ বাদে) শুধু নিজের খিদে মেটানোর এবং বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু দরকার শুধু সেটুকুই প্রকৃতির কাছ থেকে নেয় আর প্রকৃতির ক্ষতি হয় এমন কোনও কাজ করে না। উল্টো দিকে মানুষ নিজের প্রয়োজনে, শখে, নেশায়, বিলাসিতায়, খেয়ালখুশিতে, লোভে এমনকি কিছু ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনেও নির্বিচারে জলে – স্থলে – অন্তরীক্ষে সবাইকে মারছে, প্রকৃতিকেও ধংস করে চলেছে। মাটির নিচে ত্থেকে জল – কয়লা – খনিজ তেল – আকরিক মিনারেলস টেনে বের করে নিচ্ছে, ডিনামাইট চার্জ করে পাহাড় ফাটিয়ে রাস্তা বানাচ্ছে , নদীর গতিপথে বাঁধ দিয়ে জলাধার বানাচ্ছে আর গতিময় নদীগুলো শুকনো নালার আকার ধারণ করছে ( নদির গতিপথে কয়েকশো কিলোমিটার রাস্তায় যেসব বিভিন্ন প্রজাতির মাছ - জলচর প্রানী – জলজ উদ্ভিদের বাস্তুতন্ত্র ছিল সব এক ধাক্কায় শেষ ), বনজঙ্গল কেটে জনবসতি – শহর – কলকারখানা – রাজপথ বানাচ্ছে ( অক্সসিজেন তৈরি বন্ধ করে দূষণ তৈরির ব্যবস্থা হল ), পুকুরে – জলাশয়ে স্বাভাবিক মাছদের সরিয়ে দ্রুত ওজনে বাড়ে এমন সঙ্কর প্রজাতির মাছেদের চাষ হচ্ছে, দুধ বেশি উৎপাদনের জন্য গরুদের বিভিন্ন ইঞ্জেকশন দেয়া হচ্ছে। কোনও কিছুকেই তার স্বাভাবিক ছন্দে প্রাকৃতিক রুপে মানুষ থাকতে দিচ্ছে না। আরও বেশি উৎপাদন, আরও বেশি মুনাফা, আরও বেশি আরাম – বিলাস, আরও বেশি উন্নত জীবনযাত্রার পিছনে অবিরাম ছুটতে ছুটতে আমাদের দেখার অবকাশ নেই যে আমাদের পায়ের নিচে প্রকৃতির বাকি সব কিছু ( গাছপালা – পশু পাখী – নদী পাহাড় জলাশয় - আকাশ বাতাস সব কিছু) আমরা কিভাবে ধ্বংস করে চলেছি। আর এই ভাবেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে হাজার হাজার প্রানী – উদ্ভিদ ।
পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রতি বছর ধাপে ধাপে বেড়েই চলেছে, বাতাসে বিষাক্ত গ্যাস ক্রমশ বাড়ছে, হিমবাহগুলো গলে সেই বিপুল জলরাশি এসে সমুদ্রগুলোর জলস্তর বাড়িয়ে দিচ্ছে, অনেক বেশি সংখ্যায় বজ্রপাত – ঘূর্ণিঝড় – সুনামি – ভুমিকম্প – দাবানলের খবর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছে, অনেক জায়গায় সমুদ্র তীরবর্তী জায়গাগুলো ডুবে যাচ্ছে। আবার অন্যদিকে অনিয়মিত বা অনাবৃষ্টির কারনে মাটি শুকিয়ে খরার সৃষ্টি হচ্ছে, নদীগুলো তো এমনিতেই শুকিয়ে আছে বাঁধ দিয়ে জলাধার বানিয়ে ফেলার ফলে, পুকুর খাল বিল বুজিয়ে আমরা রাস্তা বাড়িঘর কলকারখানা বানিয়ে ফেলছি। মাটির নিচের জলও টেনে তুলতে তুলতে জলস্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে ( ১০ বছর আগে যেখান থেকে অনেক জল তোলা যেত এখন আর অনেক ক্ষেত্রেই সেখান থেকে জল পাওয়া যায় না। খাবার জলের অভাব মারাত্মক আকার ধারন করছে। গরমের দিনে যেসব এলাকায় মানুষই খাবার জল জোগাড় করতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে সেই সব জায়গার গাছপালা – পশুপাখি – মাছদের তো অসহায় মৃত্যুবরণ ছাড়া গতি নেই। আর এদের মৃত্যু মানেই তো প্রাকৃতিক খাদ্য শৃঙ্খল ছিঁড়ে গেলো আর আমাদের কোনও নতুন সমস্যার বীজবপন হলো।
তাই কবির কথায় এখন আর দেরি নয়, ধর গো তোরা হাতে হাতে ধর গো, আজ আপন পথে ফিরতে হবে সামনে মিলন স্বর্গ। সবাই মিলে এই প্রাকৃতিক খাদ্য শৃঙ্খল রক্ষা করতে হবে। অপ্রয়োজনে একটা ঘাস বা একটা পোকাও মেরে ফেলবো না, যাকে যতটুকু বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব তাকে সেইটুকু বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা সবাই মিলে করলে অবশ্যই অনেকটা সুফল পাওয়া যাবে।
"প্রকৃতি - পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, মানুষ বাঁচলে তবেই বাকি সবকিছু কাজে লাগবে"।
🍁বাড়িতে বসেই রেজি.ডাক মাধ্যমে জ্বলদর্চির বিশেষ সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। যোগাযোগ হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৭৩২৫৩৪৪৮৪
0 Comments