জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৫৪

 ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৫৪
সম্পাদকীয়,
চং-কে মনে আছে? সেই যে আগের পুজোয় শ্যামলী আন্টি চং-এর গল্প বলেছিল। সেই বিড়ালটার নামই তো চং। মনে পড়েছে এবার? এবারো চং-কে নিয়ে হাজির শ্যামলী আন্টি। আর সুমনা আন্টি সিংহ আর নেংটি ইঁদুরের ছড়া শুনিয়েছে। আজ তোমরা সুকুমার জেঠুর কাছে আজব নগরীর গল্প শুনে নাও। আর দীপক জেঠুর রূপকথার গল্প পড়ে জেনে নাও বেল্লামী কে৷  বানিয়া দিদি কিন্তু হেমন্তেও শরতের কথা বলেছে। রাজর্ষি আঙ্কেল ভয়ের ছড়া বলেছে। কিসের ভয়? পড়ে জেনে নাও। কৃষ্ণা আন্টি ছাতা হারানোর মজার গল্প বলেছে। আর ঋপণ আঙ্কেলের পাঠানো ছবিতে একটা ছোট্ট ছাগল ছানাকে কোলে তুলে ওরা খেলা করছে। কি মজা না! এসো মজার গল্প করতে করতে পড়ায় মন দিই। পরীক্ষা তো আর এসে গেল। তাই না? তবে ছোটোবেলার সঙ্গে থেকো। বলা যায়না তোমরাই হয়তো বড়ো হয়ে তিতলির মতো লেখিকা হয়ে উঠবে। তিতিলি কে? আজকের ছোটোবেলা পড়ে তোমরাই জানাও তিতলি কে। -- মৌসুমী ঘোষ।
ধারাবাহিক উপন্যাস
ছোটোকাকুর কান্ডকারখানা
সুকুমার রুজ

পর্ব ৪

চার
  বিকেলবেলা। সুমন, তিতলি, ওদের বাবা-মা এবং বিজ্ঞানীকাকু ড্রয়িংরুমে বসে রয়েছেন। সুমন ও তিতলি ফলের রস পান করছে। আর ওদের বাবা-মা ও কাকু চা পান করছেন।
  তিতলি তার ডায়েরি খুলে বসেছে। আর সুমন খুলেছে ছোটকাকুর ল্যাপটপটা। দুজনের মধ্যে খুনসুটি চলছে। সুমন বলে — আমি আগে ছবিগুলো দেখাবো। আর তিতলি বলে — না, আমি আগে 'ব্যাথিস্কোপ সিটি' বেড়ানোর ঘটনা পড়ে শোনাবো।
  সুমনের মা বলেন — তিতু, ওরকম করে না! আগে ছবিগুলো দেখে নিই, তাহলে তোমার বর্ণনা বুঝতে আমাদের সুবিধা হবে। 
  সুমন বাঁহাতের বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে দিদিকে কাঁচকলা দেখায়, নাকি সেনাবাহিনীর ঢঙে 'ঠিক আছে' বলে, ওই জানে।   
  সুমন ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটার পর একটা ছবি নিয়ে আসে আর সংক্ষেপে সেটার বর্ণনা দেয়। এভাবে সমস্ত ছবি দেখতে প্রায় আধঘণ্টা সময় চলে যায়। তিতলির তো আর তর সইছে না! কখন যে লেখাটা পরে শোনাবে! অবশেষে একসময় ওঁর লেখা পাঠ করার সুযোগ আসে।          
  তিতলি শুরু করেঃ   
রোজ আমরা টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখি — 'সমুদ্রের মাঝে এক আজব-নগরী! ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে আসুন।' ওই আজব-নগরীতে গতকাল রবিবারে ছোটকাকু আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। আজব নগরীর নাম 'ব্যাথিস্কোপ সিটি'। ওখানে যাওয়ার জন্য আমরা ভোরবেলা উঠে চটপট তৈরি হয়ে নিলাম। কাকুর নতুন গ্র্যাভিটার গাড়িতে চড়ে আমরা ন’টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম ডায়মন্ড হারবার। সেখান থেকে ছোট্ট একখানা জাহাজে চড়ে এক দঙ্গল ছেলে-মেয়ে আর সকলের মা-বাবা-কাকারা পৌঁছে গেলাম বি পি বি সিটি। সময় লাগল ঘন্টখানেক। দূর থেকেই দেখতে পেয়েছি জলের মাঝে হঠাৎ যেন একটা আশ্চর্যনগরী জেগে উঠেছে। পেল্লায় এক বাড়ির মাথায় গ্লো-সাইন বক্সে লেখা — বীব প্রফুল্ল ব্যাথিস্কোপ সিটি।
  আমরা সবাই খুশিতে চিৎকার করে উঠলাম। প্রথম জাহাজে চড়ার আনন্দ, তার সঙ্গে আবার সমুদ্রের গভীরে নামবো ভেবে গা-শিরশিরানি। কাকুকে জিগ্যেস করলাম — কাকু! এই আশ্চর্যনগরীর নামটা কি ‘বীর প্রফুল্ল ব্যাথিস্কোপ সিটি’ হবে? র-এর ফুটকিটা মুছে গেছে?  
  কাকু হেসে ওঠে — দূর পাগলি! ওটা হচ্ছে বীব। উইলিয়াম বীব। যিনি সমুদ্রের গভীরে নামার যন্ত্র ব্যাথিস্ফিয়ার তৈরি করেছিলেন। আর প্রফুল্ল, বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী নয়; উনি হলেন প্রফুল্ল ঘোষ, যিনি উনআশি ঘন্টা চৌদ্দ মিনিট সমুদ্রের জলে ভেসে থেকে বিশ্বরেকর্ড করেছিলেন। এই দু’জনের স্মৃতিতেই এই নামকরণ। মজার কথা হলো, এই বিশাল বাড়িটা সমুদ্রের মাঝে ভেসে আছে। আমাকে যখন কাকু নামকরণের ব্যাপারটা বলছেন, তখন দেখি, ভাই সেসব না শুনে ওই গ্লো-সাইন বক্সের ছবি তুলে যাচ্ছে। 
  আমরা জাহাজেই টিফিন সেরে নিয়েছি। ওখানে পৌঁছে ‘টয়লেট’ সেরে নিলাম। তারপর ওখানকার উর্দিপরা কর্মী এসে, দু’জন করে ছেলে বা মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে খোপ-খোপ ছোট্ট ঘরে নিয়ে গেল। ওগুলো পোশাক বদলানোর ঘর। প্রত্যেকটা ঘরের নাম আছে। ছেলেদের ঘরগুলোর নাম মিহির, মাসুদুর এইসব। আর মেয়েদের ঘরগুলোর নাম আরতি, বুলা, আরও কী কী যেন! কাকু প্রশ্ন করলেন  — বল তো এগুলো কাদের নাম?  
  এ উত্তর আমার জানা। চেঁচিয়ে বললাম — সাঁতারুদের। 
শুধু আমি একা নয়। অনেকেই সঠিক উত্তর দিয়েছে। ওই সাঁতারুদের নামওয়ালা ঘরে একটা চাকা লাগানো বাক্সের মতো যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে আমাদেরকে অদ্ভুত ধরনের পোশাক পরিয়ে দেওয়া হলো। জিজ্ঞেস  করে জানলাম, ওই বাক্সের মতো যন্ত্রের নাম বেদিং-মেশিন। আর আমাদের গায়ের জবরজং পোশাকটার নাম হলো বেদিং-কস্টিউম্। আমি ভাবলাম, ‘বেদিং-কস্টিউম্’ মানে তো স্নানের পোশাক। আমরা এখানে সমুদ্র স্নান করতে এলাম নাকি? 
  মনের মধ্যে প্রশ্নটা ঘোরাফেরা করছে, এমন সময় আমাদের কাছে ওইরকম পোশাক পরা একজন কাকু এলো। গলা থেকে পা অবধি এক ধরনের ফোলানো পোশাক। সেটার প্রান্তগুলো শরীরে চেপে বসে আছে। মাথায় একটা হেলমেটের মতোন টুপি। টুপির সামনের দিকে কাচ কিংবা ফাইবারের স্বচ্ছ ঢাকনা। কপালের জায়গায় একটা বাতি লাগানো আছে। সুইচ দিলেই  জোরালো আলো। নাকের সামনে একটা নল লাগানো। সেটা পিঠে ঝোলানো সিলিন্ডারে গিয়ে ঢুকেছে। মুখের সামনে একটা ছোট্ট যন্ত্র। দেখে মনে হয় কর্ডলেস মাইক্রোফোন। আর দু’কানের ওপর চেপে বসেছে দুটো ছোট বোতাম। বোধহয় স্পিকার। ওই কাকুটাকে এবং আমাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে যেন এক-একটা রোবট। ছোটকাকুকে তো চিনতেই পারছি না। সবাই একরকম। কাকুকে তো গলার আওয়াজে বুঝলাম! তারপর আর কাকুর হাত ছাড়িনি। ওই কাকুটা সবাইকে একটা হলঘরে ডেকে নিয়ে গেল। তারপর গোল করে সবাইকে দাঁড় করিয়ে বলল — আপনারা এবং ছোটরা, সবাইকে বলছি মন দিয়ে শুনুন। আপনার বুকের ওপরে লাগানো সুইচটা অন্ করে দিন। পোশাকের মধ্যে হাওয়া ভর্তি হয়ে ‘এয়ার-টাইট’ হয়ে যাবে। এই পোশাকে আমরা যাবো সমুদ্রের অনেক গভীরে। তখন এ পোশাক জলের প্রচণ্ড চাপ, বায়ুর চাপ ও তাপকে নিয়ন্ত্রণ করবে। মাথার আলোটা জ্বললে সামনের জিনিস দেখা যাবে। মুখের সামনে মাইক্রোফোন আছে। কথা বললে কানের ওপর লাগানো স্পিকারে একে অপরের কথা শোনা যাবে। নাকের সামনের নল দিয়ে পিঠের সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন এসে শ্বাস-প্রশ্বাসে সাহায্য করবে। ছোটরা! তোমাদের বলছি, তোমরা কেউ নাকের সামনের নলটা যেন টেনে খুলে ফেলবে না। আর বুকের ওপর সুইচটা অফ্ করবে না। আমরা দশজন করে এক-একটা খাঁচার মতো ঘরে ঢুকবো। ওই খাঁচার নাম হলো ব্যাথিস্ফিয়ার। ওটা আমাদেরকে আস্তে-আস্তে নিয়ে যাবে সমুদ্রের প্রায় দশ হাজার ফুট গভীরে। তবে, তোমাদের ভয়ের কিচ্ছু নেই! মনে হবে কোনও  অ্যাকোয়ারিয়াম দেখছ তোমরা। জলের তলায় অনেক ভয়ঙ্কর প্রাণীর মুখোমুখি হবে ঠিকই, তবে ওরা তোমাদের নাগাল পাবে না। ঠিক আছে সবাই রেডি! এখন আমরা যাবো অন্য এক জগতে। যেখানে শুধু শিহরণ, মজা আর আনন্দ! আর একটা কথা — কিছু জিগ্যেস করতে হলে আমাকে তোমরা ‘গাইড-কাকু’ বলে ডাকবে। ঠিক আছে! চলো সবাই। 
  তিতলি একটানা এতখানি পড়ে একটু দম নেয়। ছোটকাকু বলে ওঠেন — পেরজাপতি, অসাধারণ লিখেছিস! বড় হয়ে অবশ্যই তুই লেখিকা হবি। পড়ে যা পড়ে যা, দারুণ লাগছে।  
  তিতলি ডায়েরির পাতা ওলটায় — আস্তে-আস্তে খাঁচা নামতে শুরু করল জলের তলায়। খাঁচায় আমরা দশজন আর গাইড-কাকু! আমি ছোটকাকুর পাশে। আর সুমন  তো কাকুর হাত চেপে ধরে আছে। ও ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। আমরা সবাই চুপচাপ। এমনকি ছোটকাকু বিজ্ঞানী, তবুও কোনো কথা বলছে না। বেশ কিছুটা নামতে বাঁদিকে তাকিয়ে দেখি, কালো একটা এবড়ো-খেবড়ো দেওয়াল। গাইড-কাকু বলে — ওটা হচ্ছে ডুবো পাহাড়। তবে, আসল নয়, নকল।    
  পাহাড়টা কালো হলেও কিন্তু অন্ধকার নয়। ভোরবেলার মতো মিষ্টি আলো ছড়ানো পাহাড়ের গায়ে। ওটা আসল কি নকল তা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। গাইড-কাকু বললো — পাহাড়ের গায়ে যে আলো দেখছ, ওগুলো প্রাণীজ বিদ্যুতের আলো।   
  ভাই জিজ্ঞেস করে — প্রাণীজ বিদ্যুৎ কী? 
  গাইড-কাকু বলে — সমুদ্রের নিচে বেশ কয়েক ধরনের মাছ আছে, যাদের শরীর থেকে বিদ্যুৎ তৈরি হয়। যেমন ধরো বজ্রনাদ মাছ, বৈদ্যুতিক বাইন, স্কেট এসব। এদের শরীরে উৎপন্ন বিদ্যুৎকে যান্ত্রিক উপায়ে ধরে রেখে আলো জ্বালানোর কাজে লাগানো হয়।  
  ওই মিষ্টি আলোয় আমরা দেখতে পাচ্ছি পাহাড়ের  গায়ে কত রকমের শ্যাওলা, গাছপালা! আমাদের টুপির আলোয় সেগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কোনোটা ঘন সবুজ, কোনোটা ফিকে। কোথাও আবার আমগাছের মতো বড় পাতাওয়ালা গাছ। কোনোটা আবার ব্যাঙের ছাতার মতো। কেউ যেন ঠিক কদমফুল! পাহাড়ের খাঁজে এক জায়গায় দেখি মস্ত লম্বা সাপের মতো এক ধরনের লতা। গাইড-কাকু বলল — ওর নাম কেল্প্ লতা। অনেকে বলে ‘দানবের জুতোর ফিতে’।   
  আমি ভেবেছিলাম ডুবো পাহাড়টার মতো, তার গায়ে শেওলা, লতা-পাতাগুলো নকল! ভাইকে বললাম সে কথা। তা শুনে ছোটকাকু বলল — না গো পেরজাপতি! ওগুলো আসল উদ্ভিদ। সমুদ্রের নিচে এরকম প্রচুর উদ্ভিদ আছে। সামুদ্রিক প্রাণীরা এসব লতা-পাতা, উদ্ভিদও খায়। ওই কেল্প্ লতাগুলো মানুষেও খায়। জাপানীরা ওই লতা দিয়ে দারুন সুস্বাদু খাবার তৈরি করে। আমি যখন জাপানে গিয়েছিলাম তখন খেয়েছি — দারুন টেস্ট!   
  ভাই শুধোয় — কাকু! মাছেরা কি শুধু শ্যাওলা আর লতাপাতা খায়, নাকি অন্য কিছু?  
  গাইড-কাকু বলে — বাঃ! তোমার তো দেখছি জানার খুব আগ্রহ! তুমি ক্লাসের ফার্স্টবয় বুঝি?     
  ভাই লজ্জা পেয়ে যায়। মুখ নিচু করে। আমি বলে উঠি — হ্যাঁ কাকু ও ফার্স্ট বয়। তবে কখনো-সখনো সেকেন্ডও হয়ে যায় ফাঁকি মারার জন্য।  
  গাইড-কাকু হেসে ওঠে। তারপর বলে — শোনো। সমুদ্রের মাছেদের প্রধান খাদ্য হলো প্ল্যাঙ্কটন ও ডায়াটম।  না-না, এগুলো কারখানায় তৈরি করে নিয়ে সমুদ্রে ঢালতে হয় না। অসংখ্য জলজ প্রাণীর ডিম ফুটে বেরোনো শূককীট আর জলজ উদ্ভিদের কণা মিলেমিশে যা হয়, তাকেই বলে প্ল্যাঙ্কটন। আর একটু বড় আকারের শুধু উদ্ভিদকণাকে বলে ডায়াটম। মাছেরা এসব তো খায়ই। এছাড়া বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে। ছোট মাছগুলো আবার আরও ক্ষুদ্র সামুদ্রিক প্রাণীকে গিলে নিয়ে ব্রেকফাস্ট কিংবা লাঞ্চ সারে।  
ভাই হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে — ইরিব্বাস! দিদি, দিদি,  এদিকে দ্যাখ্, এদিকে দ্যাখ্। 
  আমাদের খাঁচার একদিকে পাহাড় থাকলেও অন্য তিনদিকে তো পাহাড় নেই। সে দিকে শুধু নীলচে জল। ভাইয়ের চিৎকারে ওদিকে তাকাই। দেখে মনে হচ্ছে  যেন রামধনু! আসলে লাল-নীল মাছের ঝাঁক সাঁই-সাঁই করে দৌড়চ্ছে একদিক থেকে অন্যদিকে। কী সুন্দর যে লাগছে দেখতে! হাজার-হাজার নয়, লক্ষ-লক্ষ মাছ।  
  গাইড-কাকু বলতে থাকে — ওগুলো পাইলট মাছ ও রেমোরা মাছের ঝাঁক। আরও হাজারো রকমের মাছ আছে, তোমরা বড় হয়ে পড়বে সে সব। 
  মা দুর্গার হাতের চক্রের মতো একটা প্রাণী দেখিয়ে গাইড কাকু বলে — ওই দেখ স্টার-ফিস, তারামাছ।  
  আমরা সবাই তো তারামাছ দেখার জন্য খাঁচাটার এক পাশে ভিড় করেছি। ভাইয়ের ছবি তুলতে অসুবিধা হচ্ছে। তাই ও অন্য দিকে ছবি তোলার চেষ্টা করছে।  ও হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে — কাকু! অক্টোপাশ! ওই দেখ অক্টোপাশ! তাই না?    
  গাইড কাকু উৎসাহ দেয় — বাঃ! তুমি ঠিক চিনেছ তো! ওর আটখানা শুঁড় আছে। শুঁড় দিয়ে কাউকে একবার জড়িয়ে ধরলে ছাড়ানো খুব মুশকিল। ওই শুঁড়ের নিচের দিকে আছে রক্তরস চুষে নেওয়ার ছোট-ছোট শুঁড়। যাকে ধরে, তার শরীরের রক্ত-রস চুষে খেয়ে শেষ করে। সেজন্য ওদেরকে অনেক প্রাণী ভয় পায়। তবে ওদের ভয় নেই এটা ভেবো না! ওরাও কিছু প্রাণীকে ভয় পায়। কোনো বিপদ বুঝলেই ওরা শরীর থেকে কালির মতো রস বের করে, আশপাশের জল কালো করে নিমেষে চম্পট দেয়। 
  গাইড-কাকুর কথার মাঝে একটা ভয়ার্ত চিৎকার শোনা যায় — বাবা গো! 
  কাকু বলে — ভয় পাবে না, ভয় পাবে না। ওরা তোমায় খাবে না। ওরা আমাদেরকে দেখতে পেলেও ভেতরে ঢুকতে পারবে না।  
  ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ভয়ানক এক জন্তু। হাঁ করে আছে। মুখের ভেতর দাঁতগুলো চকচক্ করছে। 
  গাইড কাকু বলে — এ হলো হাঙর। সমুদ্রের মধ্যে সবচেয়ে হিংস্র প্রাণী। অনেক রকমের হাঙর আছে। হাতুড়িমাথা হাঙর, কালো হাঙর। এটা হলো সিলভার হাঙর। দেখো রূপোর মতো চকচকে ওর গায়ের রং। 
  হঠাৎ দেখি, হাঙরটা দূরে চলে যাচ্ছে। ব্যাটা নিশ্চয়  আমাদের দেখে ভয় পেয়েছে। গাইড কাকু বলে — ও চলে গিয়েছে ভেবো না তোমরা। আশপাশেই আছে। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে নিচে নামছে। একটু পরেই আবার ওর দেখা পাবে। তোমাদের ভাগ্য ভালো হলে তিমিও দেখতে পাবে। তবে ছোট তিমি। বড় তিমিগুলোকে ব্যাথিস্কোপ সিটির বাইরে রাখা হয়েছে। ওরা ভীষণ শক্তিশালী। সব ভেঙেচুরে দিতে পারে। 
  সুমন মনে মনে খুব খুশি হয়, ডায়েরিতে দিদি তার কথাগুলো সুন্দর করে  লিখেছে। ওর এখন দিদিকে খুব ভালো লাগে। ও বলে — দিদি, একটু জল খাবি? তোর গলা শুকিয়ে গেছে।   
  তিতলি বলে — না, আর মাত্র দু’পাতা আছে, এখুনি   শেষ হয়ে যাবে।   
  ঠিক আছে পড় — একটু ধীরে ধীরে পড়। 
  তিতলি আবার ডায়েরি পড়া শুরু করে — এরপর আমরা গভীর সমুদ্রে নামতে শুরু করলাম। আমাদের ব্যাথিস্ফিয়ার এবার বেশ জোরে নিচে নামছে। আমাদের শরীরটা কেমন হালকা মনে হচ্ছে। যেন কোনো ওজন নেই! নাগরদোলায় চেপে নামার সময় যেমন অনুভূতি হয়, অনেকটা সেইরকম অনুভূতি! হাত-পাগুলো কেমন পেটের মধ্যে ঢুকে যাবে মনে হচ্ছিল। পেটের মধ্যে গুড়গুড় শব্দ! একজন তো অসুস্থ হয়ে পড়লো। বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। গাইড-কাকু অ্যালার্ম সুইচ-এর একটা টিপে দিতে ব্যাথিস্ফিয়ারের গতি কমে প্রায় শূন্য হয়ে গেল। কাকু স্মেলিং-সল্ট বা ওই জাতীয় কিছু একটা গ্যাস ওর নাকে লাগানো পাইপের মধ্যে সিরিঞ্জ দিয়ে ঢুকিয়ে দিল অল্প পরিমাণে। একটু পরেই ওর জ্ঞান ফিরলো। উঠে বসলো ছেলেটা। গাইড-কাকু ওকে সাহস দেওয়ার জন্য বলল — উঠে দাঁড়াও। কিচ্ছু হয়নি। দেখ সবাই তোমাকে দেখে কেমন হাসছে। নাগরদোলায় চড়নি বোধহয় কোনোদিন! 
   যাই হোক, ছেলেটা তো কোনোরকমে উঠে দাঁড়ালো। আমাদের খাঁচাঘর আবার নামতে থাকলো নিচে। তবে কিছুটা ধীর গতিতে। এই নামার সময় কত রকমের প্রাণী যে দেখলাম, সব মনে রাখা মুশকিল! কোনোটা ফুলের মতো, কোনোটা ছাতার মতো! যেমন অদ্ভুত সেগুলোর আকার-প্রকার তেমন তার রঙ! 
  খাঁচাটার ভেতরের গায়ে একটা লেসার বোর্ড। গাইড-কাকু সেটাকে দেখিয়ে বলল — এই দিকে তাকাও। এটা হলো সিঙ্কগেজ। আমরা কত ফুট নিচে নামছি তা সঙ্গে সঙ্গে মেপে দিচ্ছে এই যন্ত্র। দেখ আমরা এখন ন’হাজার সাত’শ আশি ফুট নিচে নেমেছি। আমরা এতক্ষণে সমুদ্রের ঢালু অংশ অর্থাৎ মহী-সোপান দিয়ে নামছিলাম। এবার পৌঁছে গেছি মহীগাত্র বা ‘কন্টিনেন্টাল স্লোপ’-এ। এটাই হলো ডাঙা অর্থাৎ স্থলভাগের গোড়া। এর পর শুরু হবে সমুদ্রের আসল খাদ। আমরা অবশ্য ওই আসল খাদে নামবো না। এই দেখ সবাই এদিকে তাকাও।  
  আমরা দেখি মিশকালো জলের মধ্যে জোনাকি পোকার মতো আলো জ্বলছে। লাল-নীল, সবুজ, বেগুনি, নানা রঙের ছোট্ট-ছোট্ট অজস্র আলোর বিন্দু। 
  কাকু আবার সরব — ভাবছ সমুদ্রের এত নিচে দেওয়ালি অনুষ্ঠান হচ্ছে নাকি! তা নয়, আসলে এগুলো হলো গভীর জলের মাছের আলো। এত নিচে তো সূর্যের আলো এসে পৌঁছয় না। এই অন্ধকার অতলে যারা থাকে তাদেরও তো খিদে-টিদে পায় নাকি! অন্ধকারে ওরা  শিকার ধরবে কী করে? তাই নিজেদের শরীর থেকেই আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা করেছে। ওই যে সবুজ আর বেগুনি আলো দেখছ, ওগুলো হ্যাচেট ফিস্ বা কুড়ুল মাছের গায়ের আলো। আর ওই জোনাকি পোকার মতো জ্বলছে-নিভছে, নানা রঙে বদলে যাচ্ছে, ওগুলো হলো এক শ্রেণীর ‘স্কুইড’।    
  ভাই জিগ্যেস করে — গাইডকাকু! গভীর জলের সমস্ত প্রাণীরই কি নিজস্ব আলো থাকে?  
  গাইডকাকু বলে ওঠে — খুব ভালো প্রশ্ন করেছ। সবাই শোনো। সব প্রাণীর নিজস্ব আলো থাকে না। কিছু মাছের আছে, যাদের আলো দূরের কথা চোখই থাকে না। ওরা চলতে চলতে সামনে যা পায়, তাই খায়। আর একটা কথা — গভীর জলের মাছের সাইজ কিন্তু বেশি বড় হয় না। খুব বেশি হলে বারো ইঞ্চি। কিন্তু তা হলে কি হবে ওদের স্বভাব-চরিত্তির মোটেও ভালো নয়। ওদের নাম শুনলেই তা বুঝতে পারবে। কারও নাম রাক্ষুসে মাছ, কারও নাম শয়তান মাছ। বুঝতেই পারছ ব্যবহারই ওদের পরিচয়। 
  হঠাৎ আমাদের কানে আসে বিপ বিপ বিপ বিপ একটানা একটা শব্দ। শব্দটা আসছে ব্যাথিস্ফিয়ারের কোণে লাগানো একটা স্পিকার থেকে। 
  গাইড-কাকু বলে — এটা হলো অ্যালার্টনেস হুইশল। অর্থাৎ সতর্কীকরণ বাঁশি। যন্ত্র আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে আরও গভীরে যাওয়া চলবে না। কারণ আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের রসদ অক্সিজেন তো সীমিত। তাছাড়া আরও গভীরে জলের চাপও বেশি। অর্থাৎ এবার আমাদের ফেরার পালা। 
  আমাদের মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায়। এই অজানা আশ্চর্য জগৎ থেকে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু মন বেশিক্ষণ খারাপ থাকার সময় পায় না। আমাদের ব্যাথিস্ফিয়ার উপরে উঠতে শুরু করেছে। বিপ-বিপ শব্দটাও থেমে গেছে। শুরু হয়েছে জাতীয় সঙ্গীতের সুর। আমরাও মনে মনে গুনগুনিয়ে উঠি। 
  গাইড-কাকু বলে ওঠে — তোমরা সবাই মাথার আলোটা এরকমভাবে নিচের দিকে নামিয়ে দাও। এখন এক দারুণ জিনিস দেখবে। কেউ ভয় পাবে না কিন্তু। 
কাকু একটা সুইচ টিপে দিতেই আমাদের পায়ের তলার ধাতব পাতখানা আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকে। আমরা কিন্তু কেউ জলে পড়ে যাই না। দেখি আমরা দাঁড়িয়ে আছি কাঁচের মতো স্বচ্ছ ফাইবারের ওপর। ওর নিচে থেকে ধাতুর পাতখানা সরে যাচ্ছে। 
  কাকু বলে — সবাই নিচের দিকে তাকিয়ে থাকবে। আমরা এবার মহী-সোপান অর্থাৎ ঢালু অংশ দিয়ে যাওয়ার সময় মাটি ঘেঁষে যাবো। তোমরা দেখতে থাকো রত্নাকরকে। সমুদ্রকে কেন রত্নাকর বলে বুঝতে পারবে।  
  আমাদের সকলের চোখ নিচের দিকে। সকলের কপালে লাগানো সার্চলাইটগুলো ছাড়াও আরও চারটে লাইট ব্যাথিস্ফিয়ারের সিলিংয়ে জ্বলে উঠেছে। প্রায় দিনের মতো আলো পড়ছে নিচে। সে আলোয় আমরা দেখি কতরকমের শঙ্খ, ঝিনুক, প্রবালের ঢিপি। কোনোটা জ্যান্ত, কোনটা আবার মৃত। 
  গাইড-কাকু বলে — ওই যে শুক্তিগুলো দেখছ, ওগুলোর মধ্যে কারও পেটে থাকতেও পারে ‘বেরেসফোর্ড হোপ’-এর চেয়েও বড় আকারের মুক্তো! আচ্ছা তোমরা কেউ বলতে পারো বিশ্বের মধ্যে এখন অবধি খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে বড় মুক্তো ‘বেরেসফোর্ড হোপ’ কোথায় আছে এবং তার ওজন কত?   
  সবাই চুপ। এমনকি বিজ্ঞানী ছোটকাকুও! ভাই ঝট্ করে বলে ওঠে — মুক্তোটা লন্ডনে আছে এবং সেটার ওজন দশ তোলা। 
  গাইড-কাকুর গলায় উচ্ছ্বাস — কারেক্ট! একদম সঠিক উত্তর! এই দশজনের মধ্যে সাধারণ জ্ঞানে তুমিই সেরা। কি নাম তোমার?   
  ভাই নাম বলে। গাইড-কাকু বলে — সাধারণ জ্ঞানের জন্য ‘ব্যাথিস্কোপ সিটি’-র পক্ষ থেকে সুমনকে পুরস্কার দেওয়া হবে একটা মুক্তো। এটা প্রতি গ্রুপ-এর জন্য আমাদের পূজা গিফ্ট্ হ্যাম্পার। সুমনের জন্য সবাই একবার হাততালি দাও। 
  তিতলি ডায়েরিখানা বন্ধ করে বলে — এখানেই আমার লেখা শেষ।   
  সুমনের মা বলেন — হ্যাঁ রে! মুক্তো উপহার পেয়েছিস, বলিসনি তো!
  সুমন হেসে বলে — কাকু আগে বলতে নিষেধ করেছিল। এখন দেখাবো। 
  এই বলে সুমন হাফ প্যান্টের পকেট থেকে উপহার পাওয়া মুক্তোটা বের করে। মটরদানার মতো সাইজের মুক্তোটা বের করে সুমন মায়ের হাতে দেয়। মায়ের হাত থেকে বাবার হাতে, কাকার হাতে ঘুরতে থাকে মুক্তো।  
(ক্রমশ)

চঙ-র‍্যাং-গিং 
শ্যামলী আচার্য 

ঘররর-ফ্যাঁশ।  
অনেকক্ষণ ধরে জানলার বাইরে আওয়াজ চলছে। গোল্লু ঘড়িতে দেখল সবেমাত্র সাড়ে দশটা বাজে। এখন এইসব শব্দ হওয়ার কথা নয়। এসব শব্দের উৎস বাড়ির একতলায় গোল্লুর দিদার বাগান। ঠিক বাগান নয়, সেমি জঙ্গল। ওইখানেই বাঘের বদলে বাঘের মাসিরা আড্ডা দিতে বসেন। কিন্তু তাদের আড্ডার সেরা সময় ভরদুপুর। ভরপেট খেয়েদেয়ে গুছিয়ে বসে তারা দ্বিপ্রাহরিক সুখ-দুঃখ অভাব-অভিযোগ বিনিময় করে থাকেন। 
আজ এমন অসময়ে?   
গোল্লু বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিল। ওর জানলা অবধি উঠতে ইচ্ছে করল না। 
গোল্লুর সবে পরীক্ষা শেষ। আই এস সি পরীক্ষা হয়ে গেলে জীবনটা কেমন ফুরফুরে হয়ে যায়। কতদিনে কলেজের ফর্ম বেরোবে, কোথায় ভর্তি, কবে ভর্তি, কী নিয়ে ভর্তি তা’ নিয়ে ভেবে এখন খামোখা সময় নষ্ট। তার চেয়ে ঢের ভাল না-পড়া গল্পের বইগুলো গুছিয়ে নিয়ে পড়ে ফেলা। বিছানায় বই নিয়ে শুয়ে-বসে থাকলে গোল্লুর বাবা-মা অন্তত ভারি খুশি হন। গোল্লুও আপাতত সাধু কালাচাঁদের কীর্তিকলাপের মধ্যে ডুবে রয়েছে। 
ঘেঁইয়াও মিয়ঁ ম্যাঅ্যাঅ্যাওঁ।
উফ! এরা শান্তি দেবে না। গোল্লু উঠে জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখে চং এবং তার আরও দুই সাকরেদ। তিন বিচ্ছু তিনজনের দিকে তেড়েফুঁড়ে কীসব উত্তেজিত বাক্যালাপ করছে।  
“অ্যাই, হচ্ছেটা কি? চিল্লিয়ে পাড়া মাথায় করছিস কেন? কাজকর্ম নেই তোদের?”
গোল্লুর হাঁক শুনে দোতলার জানলার দিকে গলা তুলে তাকাল চং। তোমরা চংকে চেনো। তিস্তু-গোল্লু দুই বোনের পোষা বেড়াল। যার প্রতিটি কথা ওরা দুই বোন স্পষ্ট বুঝতে পারে। চং ওপর দিকে তাকালেও ওর অন্য দুই বন্ধু গোল্লুকে পাত্তা দিল না। তাদের মধ্যে একজন গিয়ে বসল মিটার বক্স ঘরের ছাদে। সেখানে বসে বিরাট হাই তুলল একটা। আর অন্যজন রঙ্গনফুলের টবের পাশে বসে থাবা চাটতে লাগল। 
চং গোমড়া মুখে প্রথমে পাঁচিলে লাফিয়ে উঠল, তারপর সেখান থেকে দোতলার জানলার কার্নিশে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দেখা গেল চং গোল্লুর জানলার বাইরে এসে গুছিয়ে বসেছে।
“সিরিয়াস আলোচনা হচ্ছিল। দিলি তো জল ঢেলে?”
“শোন, বেশি মানুষ-মানুষ হাবভাব দেখাবি না। মনে রাখবি, তুই একটা বেড়াল।” 
“ইঃ! নিজেকে কী ভাবিস রে তোরা! শুনে রাখ, আমাদের যেমন তোরা পোষ্য মনে করিস... আমরাও আসলে তোদের ওরকমই ভাবি...”
গোল্লুর চোখদুটো আরও গোল হয়ে গেল। বলে কি! এই সেদিনের বেড়াল, তার এত চ্যাটাং চ্যাটাং কথা! কী দিনকাল পড়ল ভাই! 
“বয়ে গেল তোদের ভাবনা নিয়ে। আগে বল এত চ্যাঁচাচ্ছিলি কেন?”
“চেঁচাইনি তো। আলোচনা করছিলাম। আর আলোচনায় সহমত না হলে গলা চড়বেই।  জানিস না?”
“তোদের আলোচনা? হি হি হি... তা’ বিষয়টা কি শুনি... দুপুরের মেনুতে কাঁটা আর তেলচচ্চড়ি আছে কি নেই, তাই নিয়ে সভা?”
“হেঃ, ওই তোদের দোষ। সারাক্ষণ এক খাই-খাই চিন্তা। যেমন তিস্তু, তেমন তুই। দিনরাত হাবিজাবি খাচ্ছিস আর ফুলছিস।”
“অ্যাই বডি শেমিং করবি না বলে দিলাম। আমরা যা খাই তোকে ভাগ দিয়ে খাই। আর তুই কি জিরো সাইজ নাকি! কী মনে করিস নিজেকে?” 
চং গোঁফ চাটল একবার। “ওই তোদের পাল্লায় পরে চাট্টি খেয়েদেয়ে ফুলছি, যাই বলিস, আমি হ্যাংলা নই।”   
গোল্লু ভাবল ওর লোভী কান্ডগুলো সব এক এক করে বলবে কিনা। কিন্তু বিছানায় সাধু কালাচাঁদের বাকি গল্পগুলো ওকে টানছে। কথা বাড়াতে ইচ্ছে করল না। 
“শোন একটু চুপচাপ থাক। ঘ্যাঁও ম্যাঁও করে কানের পাশে চিল্লাস না। বই পড়তে খুব অসুবিধে হয়।” 
“শুনবি না, কী নিয়ে আলোচনা?” 
“আচ্ছা বল ছোট্ট করে। সংক্ষেপে বলবি।” 
চং সামনের ডান পায়ের থাবা দিয়ে গলা চুলকে নেয় একবার। 
“টপিক হল, র‍্যাং গিং।”
গোল্লু কেমন ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে বলে, “সেটা কী! চিনে খাবারের নাম কোনও?” 
“তুই এত অশিক্ষিত কেন রে? সকালে খবরের কাগজটা অবধি পড়িস না? চারদিক তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে... ইস্কুল কলেজে কীসব র‍্যাং গিং করছিস তোরা। চায়ের দোকানে তুমুল তক্কো হচ্ছিল। সকালে কান পেতে শুনলাম। বিশু জ্যাঠা দুধে ভেজানো বিস্কুট খেতে দিয়ে বলল, আজকাল ছেলেপুলেরা যত পড়াশুনো শেখে, তত অমানুষ হয়। সেই থেকে ভাবছি, বাপ-মায়েরা কি ইস্কুলে র‍্যাং গিং শিখতে পাঠায়? তোরা এসব বদমায়েশি শিখিস কোথায়? এই তো ওপাড়ার মিষ্টিদিদার আদরের নকশি আর ভুলোকাকুর ন্যাওটা আরশি আমার পাশেই বসেছিল। আমরা আমাদের ছানাদের শিকার ধরতে শেখাই, পোকামাকড় বেছে খেতে বলি, কোন মানুষ কেমন চিনিয়ে দিই... আর তোরা! ছি ছি ছি!”
গোল্লু এত অবাক হয়ে গেল, তার মুখে কোনও কথা বেরোল না। অনেক কষ্টে বলল, “র‍্যাগিং?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ ওই হল। একটা অনুস্বার বেশি পড়ে গেছে। সব কথায় অত ভুল ধরিস কেন, অ্যাঁ?”
“খামোখা বন্ধুদের ওপর অত্যাচার করে এত আনন্দ পাস কেন, কে জানে বাবা। শোন গোল্লু, একটা কথা বলি, এই যে বেড়াল-বেড়াল বলে কখনও আদিখ্যেতা কচ্ছিস, কখনও হতচ্ছেদ্দা কচ্ছিস, মনে রাখিস তোদের থেকে আমরা অনেক বেশি ভদ্র আর শিক্ষিত।”
গোল্লু আর থাকতে না পেরে ঝাঁঝিয়ে বলে, “এই বড্ড জ্ঞান দিচ্ছিস আজ, থাম একটু।”
চং কটমট করে তাকায়। ভাবখানা এমন হাতের কাছে পেলে কান মলে দিত। 
“শোন ভাই, র‍্যাগিং কোনও নতুন ঘটনা নয়। ওসব আমার দাদুর আমলেও হত, জেঠুর কাছেও শুনেছি। বাবা কত গল্প করেছে। ওসব বাদ দে। কলেজ-ইউনিভির্সিটিতে একটু মানিয়ে-গুছিয়ে চলতে হয়। বুঝলি?”
গোল্লুর কথা শুনে চং ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে হাসে, “হে হে, তুইও দুদিন পরেই ওইসব কলেজে পড়তে যাবি, যা না, তুইও বুঝবি মজা।” 
গোল্লু গম্ভীর হয়ে বলে, “মোটেই না। সব্বাই মোটেই ওর’ম করে না।”  
“হি হি হি... শোন গোল্লু, তোকে একটা পরামর্শ দিই। আরে তোরা আমাকে ভালবাসিস, খেতে-পরতে দিস, আমারও তো একটা কৃতজ্ঞতা আছে, তাই না? তুই যখন কলেজে ভর্তি হবি, আমাকেও একটু রাস্তাটা চিনিয়ে দিস তো। আমি নকশি আর আরশিকেও নিয়ে যাব। একবার চিনিয়ে দিস। তারপর আর যেতে অসুবিধে হবে না।”
“তোরা কলেজ গিয়ে কী করবি শুনি?”
“আমরা একটা অ্যান্টি র‍্যাং-গিং কমিটি খুলেছি, বুঝলি? আরও সদস্য নিচ্ছি। তোর কলেজ দিয়েই শুরু করব। হস্টেলের পাঁচিল বেয়ে চলাফেরা করা আমাদের পক্ষে জাস্ট কোনও ব্যাপার না। কার্নিশে উঠব, জানলা, বারান্দা সব জায়গায় আমাদের কমরেডরা থাকবে। ঘরের মধ্যে একটা বেচাল দেখলেই সংকেত। চারদিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। জানলা দরজা বারান্দা কার্নিশ... সব জায়গায় গেরিলা বাহিনির কায়দায়। একজনকে একদিক থেকে তাড়া দিলে অন্যজন অন্যদিক থেকে ঝাঁপিয়ে আঁচড়ে দেবে। জাস্ট এইভাবে কয়েকটাকে আঁচড়ে কামড়ে হাওয়া। এক ঘন্টা পরপর অ্যাকশন। যেই টের পাব বদমাইশ ছেলেপুলেগুলো অসভ্যতা শুরু করছে, অমনি ব্যাক টু অ্যাকশন। আমাদের গ্রুপটায় কয়েকটা কেলেপানা হুলো খুঁজছি। এই শোন,” হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে গেল চঙের, “তোদের ওই ইন্সটা আর ফেসবুকে ‘কালো বেড়াল চাই, সত্বর যোগাযোগ করুন’ বলে একটা পোস্ট ছাড় তো, রাতের দিকে কালো হুলোদের দিয়ে টিম বানিয়ে হস্টেলের কার্নিশে পাঠাতে হবে। সব যুদ্ধ সামনাসামনি জেতা যায় না বুঝলি? অনেক গেম প্ল্যান আছে। হেঃ... রাতদিন ওই মার্ভেলের সিনেমা দেখে আর হ্যারি পটার পড়ে তোদের মগজের ঘিলুটিলু সব ঘেঁটে গেছে...”
গোল্লু মার্ভেলের নামে কোনও বাজে কথা সহ্য করতে পারে না, চেঁচিয়ে ওঠে, “ওঃ কী আমার গেরিলা কমরেড এলেন রে!” 
চং মুখ বাঁকাল। মনে হল ভেংচে দিল একবার। 
“তোদের কলেজ দিয়েই শুরু করব, যাই টিম মীটিংগুলো সেরে ফেলতে হবে পর পর। নতুন সেশন শুরু, আমাদের অ্যাকশন শুরু...”
চং লাফ দিল কার্নিশ থেকে। 
গোল্লু দেখল, ছেলেটা বেঁচে গেল... ছেলেগুলো বেঁচে গেল। একদল মারকুটে বিড়ালকে নিয়ে খবর লেখা হচ্ছে কাগজের পাতায়... হস্টেলগুলোতে সন্ধে পেরিয়ে রাত হলেই...
🍂

মিতালী
সুমনা সাহা

বনের মধ্যে সিংহমশাই একলা বসে আছে,
নাচতে নাচতে নেংটি ইঁদুর এলো তার কাছে।
“কেমন আছেন, সিংহমশাই? মুখটা কেন ভার?”
সিংহ বললো, “কী আর বলি, মনখারাপ আমার!”
“পাচ্ছে খিদে? মাংস খান। পাননি আজ শিকার?”
“সেজন্য না, বড্ড একা, সাথী নেই আমার।”
“চলুন তবে আমার সঙ্গে আমার গর্ত বাসায়,
আমরা সেথায় দল বেঁধে থাকি বেজায় মজায়।”
নেংটির কথা শুনে সিংহ উঠল বিকট হেসে।
অট্টহাসির কাঁপন লেগে পড়ছে পাতা খসে।
ভয়ের চোটে নেংটি তখন দিয়েছে চম্পট।
ভাবছে, “বাপরে, অসভ্যটার হাসির কী দাপট!
মাথা গরম সিংহব্যাটার একলা থাকার ফলে,
কেশরগুলো কামিয়ে দিতাম একটু সুযোগ পেলে।”
সিংহ ভাবছে, “আজকে মজা হলো বটে জবর,
নেংটি বাবা আবার আসিস, নিতে আমার খবর!”

বুধিমতী বেল্লামি
দীপক কুমার মাইতি

(সাইবেরিয়ার রূপকথার অবলম্বনে রিচিত) 

অনেকদিন আগের কথা। এক গ্রামে গরীব বিপত্নীক মিখাইল ও তার সুন্দরী, বুদ্ধিমতী মেয়ে বেল্লামী থাকত। গ্রামের লোকেরা নানা সমস্যায় পড়লে সমাধানের জন্য তার কাছে আসত। সেও সকলকে বিপদে আপদে বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করত। দেশের রাজা রাজপুত্রের জন্য একজন বুদ্ধিমতী মেয়ে খুঁজছেন। তিনি ঢেঁড়া পিটিয়ে প্রজাদের বুদ্ধীমতী মেয়ের খোঁজ দিতে প্রজাদের জানালেন। গ্রামের প্রজারাও ভাবত সুন্দরী বেল্লামীই রাজকুমারের যোগ্য পাত্রী। তারা রাজসভায় মহারাজের কানে বেল্লামীর কথা তোলে। রাজামশায় মিখাইলকে ডেকে পাঠালেন। মিখাইল ভয়ে ভয়ে রাজদরবারে হাজির হয়। রাজামশাই বললেন – শুনলাম তোমার মেয়ে খুব বুদ্ধিমতী। তা বাপু এই ডিমগুলি নিয়ে যাও। তাকে বলবে ডিমগুলি ফুটিয়ে বাচ্চা করে আমাকে পাঠাতে।
মিখাইল বাড়ি এসে বেল্লামীকে রাজার হুকুম জানাল। সে ডিমগুলি পরীক্ষা করে বলে – এতো খুব সোজা কাজ। তুমি এই মটরদানা কয়েকটা মহারাজকে দিয়ে বলবে মটর চাষের ব্যবস্থা করে দিতে। কারন এত মুরগী বাচ্চা হলে তো তাদের দানা দিতে হবে।
মিখাইল বাড়ি থেকে বেরানোর সময় বেল্লামী তার কানে কানে কিছু বলে দেয়। রাজ দরবারে এসে মিখাইল রাজাকে মটরদানাগুলি দেয় ও বেল্লামীর আবেদন জানায়। রাজা মটরদানা পরীক্ষা করে রেগে ওঠেন – এই সেদ্ধ মটরদানা দিয়ে কী চাষ করা যায়?
মিখাইল হাত জোড় করে – মহারাজ কেন হবে না। মেয়ে বলেছে সেদ্ধ ডিম ফুটিয়ে যদি মুরগী বাচ্চা হয়, তবে সেদ্ধ মটরদানা দিয়েও মটর গাছ হবে।
রাজা হাসেন – তা ঠিক। রাজবাড়ি থেকে এক বিড়া খড় নিয়ে যাও। তোমার মেয়েকে একটা সুন্দর পালতোলা নৌকা তৈরি করে দিতে বল।
পরেরদিন মিখাইল একটা ছোট কাঠের টুকরো নিয়ে ফিরে আসে – মহারাজ আমার মেয়ে এই কাঠের টুকরো পাঠিয়েছে। বলেছে খড় দিয়ে নৌকা তো হবে। কিন্তু খড়ের নৌকার জন্য বিশেষ কাপড়ের পাল চাই। তাঁতিকে দিয়ে এই কাঠটুকরো থেকে পালের জন্য কাপড়  বোনার ব্যবস্থা করে দিতে। 
রাজা হাসেন। বুঝতে পারেন মেয়েটি বুদ্ধিমতী। কিন্তু তিনি আর একবার মেয়েটিকে পরীক্ষা করতে চান। তিনি একটা ছোট গ্লাস দেন মিখাইলকে – শোন, তোমার মেয়েকে বলবে এই গ্লাস দিয়ে রাজ্যের উওত্তরের সাগরের সব জল সেচে ফেলতে হবে।
মিখাইল মাথা নেড়ে চলে যায়। কয়েকদিন পর ফিরে আসে। মহারাজ জানতে চান – কি হে! তোমার মেয়ে সাগরের সব সেচে ফেলেছে?
মিখাইল হাতজোড় করে বলে – মেয়ে জানাল জল প্রায় শুকিয়ে এসেছিল। কিন্তু রোজ নদী ও খালের জল এসে আবার সাগর ভরে দিচ্ছে। সে এই শোলার ছিপিগুলি দিয়ে নদী ও খালের মুখগুলি বন্ধ করে দিতে অনুরোধ করেছে।
রাজা খুশি হয়ে সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ান – চল আমি তোমার বাড়ি যাব। তোমার মেয়ের সাথে আলাপ করব।
রাজা মিখাইলের বাড়ি আসেন। বেল্লামীকে কথা বলে খুশি হন। তিনি তাকে প্রস্তাব দেন – আমি তোমাকে আমার পুত্রবধূ করতে চাই। তুমি রাজি?
বেল্লামী মাথা নিচু করে বলে – আমি রাজি। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।
বিস্মিত কন্ঠস্বর রাজার – শর্ত! কী তোমার শর্ত?
মেয়েটি বলে – মহারাজ আমরা বড়ই গরীব। কোনদিন রাজপুত্র আমাকে তাড়িয়ে দিলে আমি খুব অসহায় হব। তাই আমার শর্ত আমাকে রাজপুত্র যদি কোনদিন তাড়িয়ে দেন, সেদিন যেন আমি আমার প্রিয় জিনিসটা সঙ্গে করে আনতে পারি। সেদিন যেন কেউ বাধা না দেয়। আপনি সেই নির্দেশ কী জারী করবেন?
রাজা সম্মতি জানান। রাজপুত্রের সাথে বেল্লামীর বিয়ে হয়ে যায়। তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে রাজামশায় খুব খুশি। তিনি রাজ্য পরিচালনার জন্য বেল্লামীর সঙ্গে পরামর্শ করতেন। এসব দেখে রাজপুত্রের হীনম্মন্যতায় ভুগতে লাগল। তাছাড়া মহারাজ তার থেকে বেল্লামীকে বেশি ভালো বাসেন ও রাজ্য চালানোর জন্য তার সাথেই আলোচনাই করেন না। প্রায় রাতে রাজকুমারের সাথে কোন না কোন বিষয়ে মতের অমিল হত। রাজকুমার একদিন সামান্য কথাকাটির পর রেগে মহারানীর কক্ষে চলে আসেন। সে মহারানীকে জানায় – মা, আমি বেল্লামীর সাথে থাকতে পারব না। আমাকে মানুষ বলে মনে করে না। কথায় কথায় আমাকে অপমান করে। বেল্লামিকে ত্যাগ করতে চাই। নয়ত আমি দেশান্তরিত হব। 
মহারাজ মেয়েটিকে বেশি ভালোবাসেন বলে মহারানীও খুশি ছিলেন না। শুধু তাই নয় রাজ অন্দর মহলে সকলে বেল্লামীকে ভালোবাসে। তাদের নানা সমস্যার কথা বলে সাহায্য চায়। যা আগে তারা মহারানীর কাছে করত। তিনি ভাবতেন বেল্লামী ক্রমে ক্রমে তার জায়গা দখল করে নিচ্ছে। এরকম চললে কেউ আর তাঁকে মান্য করবে না। মহারাজও এখন বেল্লামীর পরামর্শ নেন। তিনিও তলে তলে বেল্লামীকে তাড়ানোর চিন্তা করছিলেন। মহারানি রাজাকে বললেন – রাজপুত্র বেল্লামীর উপর অসন্তুষ্ট। তার সাথে সংসার করতে চায় না। তাকে ত্যাগ করতে চায়। নয়ত সে দেশান্তরিত হবে। 
মহারাজ যেন এমন একটা কিছুর আশংকা করেছিলেন। তিনি হাসলেন – তা তোমার মত কী? তুমি কী বেল্লামীকে ত্যাগ করতে চাও?
মহারানী বলেন – রাজকুমার আমাদের একমাত্র সন্তান। তাকে ছেড়ে থাকব কী করে। আপনি ওকে নির্বাসনে পাঠান। 
মহারাজ হাসলেন সব শুনে। ভাবলেন এবার বেল্লামীর আসল পরীক্ষা। তিনি বেল্লামীকে ডেকে পাঠালেন। সে আসতে তিনি রাজকুমার ও মহারানীর ইচ্ছের কথা জানালেন। তিনি বেল্লামীকে রাজপ্রাসাদ থেকে চলে আদেশ দিলেন। সব শুনে বিচলিত না হয়ে বেল্লামী শান্ত গলায় বলল – মহারাজ আপনার আদেশ শিরোধার্য। আমি একবস্ত্রে নির্বাসনে বনে চলে যাব। বিয়ের আগে আমি  একটা শর্ত দিয়েছিলাম। তা আপনাকে রাখতে হবে।
রাজা এবারও হাসেন – নিশ্চয়ই। তোমার শর্ত ছিল, যুবরাজ তোমাকে ত্যাগ করলে তুমি তোমার প্রিয় জিনিস তোমার সাথে নিয়ে যাবে। রাজবাড়িতে তোমার সবচেয়ে প্রিয় যা আছে তা তোমার সাথে নিয়ে যেতে পার। আমি অনুমতি দিলাম।
বেল্লামীর নিম্ন কণ্ঠস্বর – মহারাজ সেই ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি। তার মুখটাও মনে নেই। রাজবাড়িতে রানীমার মধ্যে আমার মাকে খুঁজে পেয়েছি। রাজপুত্রের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি আমার স্বামী। মেয়েদের পরম সম্পদ তার স্বামী। এঁরা দুজনেই আমার পরম প্রিয় পাত্র। আমি এঁদের সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাই। আপনার অনুমতি চাই।
রাজা খুব খুশি হন। তিনি ভাবেন বুদ্ধির পরীক্ষায় এবারও বেল্লামী উত্তীর্ণ। তিনি হাসি মুখে রাজকুমার ও মহারাণীর দিকে তাকান – আমি রাজি। কিন্তু তোমারা কী রাজি?
রাজকুমার ও মহারানী তাদের ভুল বুঝতে পারেন। মহারানী বেল্লামীকে জড়িয়ে ধরেন – ক্ষমতার লোভে আমি অন্ধ ছিলাম। আমার ছেলেও ছিল। আমাদের ক্ষমা করে দাও।
বেল্লামী চোখের জলে মহারানিকে জড়িয়ে ধরে।


ভয়
রাজর্ষি মন্ডল

পরপর গ্রামেগ্রামে 
ডুবুডুবু ভয়
ধীরেধীরে কেঁদেকেঁদে 
কারা কথা কয় ?

লুচিফুচি খাবোখাবো 
গুনগুন সুর
চুপচাপ রাঁধাবাড়া 
বুক দুরদুর।

ঘড়ঘড় গড়গড় 
গুরুগুরু নাদ
কানাকানি জনেজনে 
কে যে বজ্জাত!

শীতশীত যাবোযাবো 
ভারভার মন
পথেপথে খিলখিল 
হাসে কোনজন ?

শেষমেশ বড়সড় 
ঢাকঢোল নিয়ে
পিঠটান ভূতটার 
ঘুষঘাস দিয়ে।

উত্তরাধিকার              
কৃষ্ণা  দাস

আমাদের বাড়ি দক্ষিন কলকাতা সরসুনায়।এখানে একান্নবর্তী পরিবারে আমাদের বসবাস।আমাদের বাড়িটিও বিশাল।ইংরেজ আমলের কোঠাবাড়ি।বিশাল তার ঘর বারান্দা জানালা দরজা। বাড়ির পিছনে পুকুর আর বাগান। সামনে বেশ সুন্দর ফুলের বাগান আর খোলা লন।এ বাড়িটা আমার বড়দাদুর। আমার নিজের ঠাকুর্দা নেই।ঠাকুমাও নেই। দুজনেই গত হয়েছেন আমার জন্মের পরেই। কিন্তু আমার ঠাকুর্দার বাবা মানে বড়দাদু এখনো বেঁচে আছেন। আগামী কাল রাত বারোটায় তাঁর একশ বছর পূর্ণ হবে।লম্বা বিশালদেহী মানুষটা এখন রোগা ও কুঁজো হয়ে ছোট হয়ে গেছেন। লাঠি হাতে বাগানে খুটখুট করে হাঁটতেন বেশ। তবে ইদানিং বাইরে আর বেরোতে দেখছি না। ওই ঘরের মধ্যেই যা একটু হাঁটাচলা। রোগ বলতে তেমন কিছুই নেই, শুধু বয়স জনিত দুর্বলতা। বাবার কাছে শুনেছি সে যুগে গোয়ালিওর রাজবাড়ির অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন বড়দাদু। সে আমলে ইংরেজরা যখন একে একে সব দেশীয় রাজাদের ক্ষমতাচ্যুত করছিল তখন এক সময় গোয়ালিওর রাজ্যও ইংরেজরা কেড়ে নেয়। তখনই বড়দাদুর চাকরি চলে যায় এবং ফিরে আসেন নিজের বাবার বাড়িতে এখানে।
    বড়দাদু এমনিতে বেশ শান্তশিষ্ট।তবে রেগে গেলে তাঁকে সামলানো দায়। শুধু নাতির ঘরে পুঁতিদের মানে আমাদের সঙ্গ পেলে তাঁর আর কিচ্ছু চাই না। খুনখুনে গলায় ডাক দেবে “কই রে আমার কাঁচাটাকা, সিকি, আধুলি, গিনি, তোরা সব কোথায়”? 
     বড়দাদুর দুই ছেলের এক ছেলে আমার দাদু অর্থাৎ ঠাকুরদা।ঠাকুরদার দাদা বিলেতে আইন পড়াশোনা করে ওখানেই থেকে যান। বর্তমানে তিনি গত হলেও তাঁর বংশধররা লন্ডনেই রয়েগেছেন।
     আমার ঠাকুরদার দুই ছেলে এক মেয়ে। দুই ছেলেই এ বাড়িতেই থাকেন। আমার বাবা বড়। আমি অরিত্র। পড়ি ক্লাস টুয়েল্ভ’এ।আমি বড়দাদুর ‘কাঁচাটাকা’। কাকুর দুইছেলে অয়ন আর আয়ুষ, পড়ে ক্লাস টেন আর সেভেন’এ,ওরা যথাক্রমে দাদুর ‘আধুলি’ আর ‘সিকি’। আর পিসিমনির মেয়ে মিঙ্কি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো।পড়ে কেজি টুতে।সে হল দাদুর ‘গিনি’। ওরাও গতকাল এসেছে বড়দাদুর জন্মদিন উদযাপন করবে বলে।
     বড়দাদু আমাকে ছোটবেলায় শুধু নয়, কিছু বছর আগেও অঙ্ক শেখাতেন। শুধু তাই নয় ইতিহাসও যেন গল্পের মত বুঝিয়ে বলেন। সন তারিখ যেন গল্পের মত মাথায় ঢুকে যায়।
     বড়দাদু আমাদের খুউব ভালোবাসেন। কত যে গল্প বলেন।আমরা গোল হয়ে তাঁর খাটে বসে আবদার করি “গল্প বলো বড়দাদু”।ভূতের গল্প, ডাকাতের গল্প, ভালো ইংরেজ, খারাপ ইংরেজএর গল্প, বন্যা-খরার গল্প, দেশ ভাগ মহামারী দাঙ্গা সব ছিল সে গল্পে।সে গল্প যখন বলতেন দেখতাম কখনো রাগে তাঁর চোখ জ্বলছে, কখনো দুঃখে তাঁর চোখ বেদনাময়।
     যাই হোক আমাদের প্ল্যান বড়দাদুর জন্মদিনটা খুব ধুমধাম সহকারে করব। সেই মত সামনের বাগানে প্যান্ডেল বাঁধা হয়েগেছে।সবাই যে যার আত্মীয় বন্ধুদের নিমন্ত্রণও সেরে ফেলেছি। কী কী চমকপ্রদ মেনু হবে ক্যাটারিং এ বলা হয়ে গেছে। আগামীকাল সকাল থেকেই আমরা ভাই বোনে মিলে পুরো প্যান্ডেল বেলুন দিয়ে সাজিয়ে বড়দাদুকে চমকে দেব। আজ রবিবার।বাবা কাকু সবার ছুটি। অন্য রবিবারের মত সকাল থেকেই মা কাকিমা রান্নাঘরে লুচি আর সাদাআলুর চচ্চরি বানিয়েছেন জলখাবারের জন্য।কাকু মোড়ের মাথার দোকান থেকে গরম গরম জিলিপি এনেছেন। বাবা কাকু আর আমরা ভাইবোনেরা বসেছি বিশাল সেগুন কাঠের ডাইনিং টেবিলে। পিসিমনি সার্ভ করছেন। হঠাৎ বড়দাদুর ঘর থেকে খুনখুনে চিৎকার। আমরা সবাই যে যার খওয়া ফেলে ছুটে গেলাম বড় দাদুর ঘরে। দেখি ঘরে খোলা কাচের আলমারির সামনে হাতে লাঠির ওপর ভর করে কুজোঁ হয়ে দাঁড়িয়ে বড়দাদু। আমাদের দেখে খুনখুনে গলায় যেন হুঙ্কার দিলেন, “আমার ছাতা কোথায় গেল? কে ওটা চুরি করল? এক্ষুণি তোমরা ওটা খুঁজে বের করো, আমি জানিনা নইলে ফল ভালো হবে না এই বলে দিচ্ছি”।
     আমরা তো আকাশ থেকে পড়লাম। দেখি সত্যিই আলমারির পাল্লা খোলা, ভেতরে সব আছে কেবল দাদুর ছাতাটিই নেই।বাবা কাকু মা কাকিমা এমনকি পোষা ভুলোটা পর্যন্ত চোখ কপালে তুলে আলমারির দিকে তাকিয়ে থাকল।সবাই সবার মুখ চাওয়াচায়ি করছে। কী ভাবে ছাতাটি খোয়া যেতে পারে কারোর মাথাতেই এল না।
     আসলে মেহগনি কাঠের নক্সাকরা বড় হাতলের ছাতাটি সিল্কের কালো কাপড়ের। ছাতাটির একটা ইতিহাস আছে। আজ থেকে সত্তর বছর আগে গোয়ালিয়রের রাজা উপহার দিয়েছিলেন আমার বড়দাদুর কাজে খুশি হয়ে। বড়দাদু তখন শিক্ষকতা ছাড়াও রাজ পরিবারের অন্যতম উপদেষ্টা। সে সব কথা বড়দাদু সুযোগ পেলেই শুধু আমাদেরই নয়, বাড়িতে যত আত্মীয়স্বজন বেড়াতে আসেন তাদেরও বহুবার শুনিয়েছেন। তবে দাদু ছাতাটি ব্যবহার করতেন না।জন্ম থেকে দেখছি শীতগ্রীষ্মবর্ষা ছাতাটি দাদুর ঘরের কাচের বড় পাল্লার আলমারিতে শোভা পাচ্ছে।আলমারির চাবিটিও দাদু সর্বক্ষণ নিজের কোমরে সরু দড়ি সহযোগে বেঁধে রাখেন।
     বাবা বললেন, “চাবি তো তোমার কাছে থাকে দাদু, তবে আলমারি খুলল কে”?
     বড়দাদু খাটে বসতে বসতে হুঙ্কার দিলেন, “সেইটেই তো কথা।আমি কি তবে পুলিশে খবর দেব”?
     সবাই আবার মুখচাওয়াচায়ি করল। মিঙ্কি বড়দাদুর পাশে খাটে গিয়ে বসে বিজ্ঞের মতো বলল, “পুলিশ যদি খুঁজে না পায় বদ্দাদু?”
     বড়দাদু শিরাওঠা হাতে মিঙ্কির মাথার চুলে হাতবুলিয়ে বললেন, “তবে তুমি খুঁজে দেবে। পারবে না গিনি দিদিভাই”?
      মিঙ্কি পাদুলিয়ে বলল, “পারলেও করব না”।
      বড়দাদু চোখ বড় বড় করে বললেন, “কেন? কেন?”
      “যাস্ট একটা আম্ব্রেলার জন্য আমি বাড়ির কাউকে প্রিজ়নে দেব না”। মিঙ্কি কাঁধ দুটো তুলে ছেড়ে দিয়ে বিজ্ঞের মত চোখমুখ করল।
       ওর কথা শুনে ঘরভর্তি লোক হাসতে গিয়েও নিজেদের সামলে নিল। আমি অনেকক্ষণ ধরে ভাবছি ছাতাটা গেল কোথায়? আলমারিতে একশবছর আগেকার অনেক দামী দামী ব্রোঞ্জ, পোর্সেলিন এর মূর্তি ও বাসন আছে, যার বাজার দর বর্তমানে আকাশ চড়া। সেগুলোর একটাও খোয়া যায়নি, সব আছে।অথচ বড়দাদুর একটা পুরনো ছাতাই শুধু গায়েব। পরিবারের বাইরের লোক গতকাল বা আজ সকালের মধ্যে কেউই আসেনি।তাহলে নিলো কে? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথায় ক্লিক করল একটা বিষয়।
      আমি গম্ভীর স্বরে বললাম, “আমি জানি কে ছাতাটি জায়গা থেকে সরিয়েছে। ছাতাটি অত্যন্ত মূল্যবান, বাজার দর যার কয়েক কোটি টাকা”। 
      সবাই শুনে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল আমার মুখে। আমার দৃষ্টি বড়দাদুর দিকে। এবং আমার ভাবনাকে রূপ দিতেই যেন তিনি চমকে উঠলেন। 
      সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর গলায় বললাম, “কী বড়দাদু কোথায় রেখেছ? বার করো এবার ছাতাটাকে”।
      আমার কথা শুনে সবাই এবার বড়দাদুর দিকে তাকালেন। বড়দাদু তখন মিঙ্কির মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, “কাঁচাটাকা দাদুভাই, বলি আমার কাছেই যদি থাকবে তবে তোমাদের ডেকেচি কেন”?
      আমি বললাম, “সব বলছি।তার আগে তুমি ওটা বার করো”। আমার বলার মধ্যে কিছু একটা ছিল যার ফলে বড়দাদু ফোকলা হেসে ফেললেন, “কাঁচা টাকা দাদুভাই, ছাতা কেন মূল্যবান হবে”?
       আমিও হেঁসে বললাম। “ইজি, আমি মূল্যবান বলতেই যদি তুমি চমকে না উঠতে মনে করতাম ওটা আর পাঁচটা সাধারণ ছাতার মতোই একটা সাধারণ ছাতা। কিন্তু তুমি চমকে উঠতেই বুঝলাম ওটা সত্যিই দামি। আর এও বুঝলাম আসলে তুমি বিষয়টা সবাইকে জানাতেই লুকিয়েছ।”
      ঘর শুদ্ধু সবাই যেন হাঁ হয়ে গেছে। কারো মুখেই কোনো কথা নেই।সবাই যেন কোনো রুদ্ধশ্বাস নাটক দেখছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
      বড়দাদু চুপ হয়ে থাকলেন ঘাড় গুঁজে। কিছুক্ষণ পর মুখ তুললেন।কোঠোরে বসা চোখের কোন চিকচিক করছে। তবে কী বড়দাদু কাঁদছেন? থেমে থেমে বললেন, “আমার সময় যে এগিয়ে এসেছে দাদুভাই। যেকোনও দিন যে কোনো সময় ডাক আসবে। তাই আমার উত্তরাধিকারীদের জানানো দরকার ছাতাটার প্রকৃত রহস্য। ছাতাটা আমার খাটের নীচে তোষকের তলাতেই আছে, বের করো”।
     ছাতাটা বার করা হল। বিছানায় বসে ঘর ভর্তি উত্তরাধীকারীদের সামনে বড়দাদু ছাতাটির হাতল বিশেষ কায়দায় ঘোরাতেই হড়হড় করে বেরিয়ে এলো চকচকে মোহর...অনেক অজস্র।
     সে রাতেই বড়দাদু চিরকালের জন্য চোখ বুজলেন। সকালে আর আমাদের বেলুন সাজানো হল না।


খোকার শরৎ
বানীয়া সাহা


ওই যে দেখি ছোট্ট ছেলে খেলছে কেমন কাশের বনে
সবুজ ঘাসের আদর মেখে ছুটছে সে যে আপন মনে।

মিষ্টি রোদে সোনালী মাঠ শিউলিতে আজ ছড়াছড়ি
খোকার সাথে বইয়ের ব্যাগও ধুলোয় তখন গড়াগড়ি।

নীল শরতে সারি বেঁধে যারা দূরের আকাশ ঢাকে,
ছোট্ট সোনা হাত বাড়িয়ে আকুল স্বরে ওদের ডাকে।

ওই দেখা যায় গাছের ফাঁকে আগমনীর খুশির আলো,
এমন দিনে পড়াশোনা খোকার কি আর লাগে ভালো!

ব্যস্ত কত কুমারটুলি দিন থেকে রাত রঙের খেলায়
খোকার সকল অপেক্ষারাও অস্ত গেছে শারদ বেলায়।

নদীর পাড়ে কে যেন তাই ঢাকের কাঠির শব্দ শোনে
ব্যকুল ছেলে আপন মনে মায়ের আসার সময় গোনে।


Post a Comment

0 Comments