পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৯৯
কার্তিক লড়াই
ভাস্করব্রত পতি
কার্তিকেয়ং প্রবক্ষ্যামি তরুণাদিত্যসন্নিভম্। কমলোদরবর্ণাভং সুকুমারং কুমারকম্।। দণ্ডকৈশ্চিরকৈর্যুক্তং ময়ূরবরাবাহনম্।
স্থাপয়েৎ স্বেষ্টনগরে ভূজান্ দ্বাদশ কল্পয়েৎ।।
চতুর্ভুজঃ খৰ্ব্বটে স্যাদ বনে গ্রামে দ্বিবাহুকঃ।
শক্তিঃ পাশস্তথা খড়গঃ শরঃ শূলং তথৈব চ৷৷ বরদশ্চৈকহস্তঃ স্যাদথ চাভয়দো ভবেৎ।
এতে দক্ষিণতো জ্ঞেয়াঃ কেয়ূরকটকোজ্জ্বলাঃ৷৷
ধনুঃ পতাকা মুষ্টিশ্চ তর্জ্জনী তু প্রসারিতা।
খেটকং তাম্রচূড়ঞ্চ বামহস্তে তু শস্যতে।।
দ্বিভুজস্য করে শক্তিৰ্ব্বামে স্যাৎ কুক্কুটোঽপরে।
চতুর্ভুজে শক্তিপাশৌ বামতো দক্ষিণে ত্বসিঃ। বরদোহভয়দো বাপি দক্ষিণঃ স্যাত্তুরীয়কঃ৷৷
কার্তিক হলেন নবোদিত সূৰ্য্যসদৃশ প্রভাবিশিষ্ট। তাঁর বর্ণ পদ্মগর্ভতুল্য এবং সুকুমার কুমারমূর্ত্তির অধিকারী। তিনি ময়ুরের ওপর উপবিষ্ট, দণ্ড সমন্বিত ও উত্তম বস্ত্রভূষিত। খর্ব্বটে তথা ক্ষুদ্র নগরে চতুর্ভুজ, বনে বা গ্রামে দ্বিভুজ এবং ইষ্টনগরে দ্বাদশভুজ কার্তিকেয়মূর্তি স্থাপন করতে হয়। দ্বিভুজমূর্তির ডান হাতে শক্তি (অস্ত্র বিশেষ) এবং বাম হাতে কুক্কুট থাকবে। চতুর্ভুজ মূর্ত্তির বামদিকের হাতে শক্তি ও পাশ এবং ডানদিকের এক হাতে তরবারি ও চতুর্থ হাতে বর ও অভয় শোভিত হবে। দ্বাদশভুজ মূর্ত্তির ডান দিকের কেয়ূরকটকোজ্জ্বল হাতে শক্তি, পাশ, খড়গ, শর, শূল, বর বা অভয়; বামদিকের হাতে ধনুঃ, পতাকা, মুষ্টি, প্রসারিত তর্জ্জনী, খেটক এবং তাম্রচূড় অবশ্যই থাকবে। সন্তানের কামনায় কার্তিক পূজার রেওয়াজ রয়েছে। সদ্য বিবাহিত বা বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও সন্তানাদি না হওয়া বা পুত্র সন্তান না হয়ে কেবল কন্যা সন্তান হওয়া -- এসব ক্ষেত্রে ঐ পরিবারের দুয়ারে ইয়ারদোস্ত কিংবা আত্মীয় স্বজন মিলে কার্তিক দিয়ে আসে। পরে তা কার্তিক পূজার দিন শাস্ত্র মতো পূজা হয়। ব্রতপালন করেন সন্তান কামনায় থাকা স্বামী এবং স্ত্রী।
কালীকিশোর বিদ্যাবিনোদ কার্তিক মাসে কার্তিকেয় ব্রত পালনের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি এই ব্রতের কাহিনী সম্পর্কে লিখেছেন, "একদিন ধর্মাত্মা বসুদেব দেবর্ষি নারদকে বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করলেন -- 'হে ঋষিবর, আমার পত্নী দেবকী যে সব পুত্র প্রসব করছে তাঁদের সকলকেই দুরাত্মা কংস হত্যা করেছে। এখন কি করলে আমদের পুত্র দীর্ঘায়ু লাভ করবে দয়া করে তা আমাকে বলুন'। দেবর্ষি বললেন, 'হে বসুদেব! পূর্বকালে সুভগা নামে এক ধর্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণের দক্ষিণা নাম্নী সত্যবাদিনী ও পতিব্রতা এক পত্নী ছিল। তাঁদের কোন সন্তানাদি ছিল না। এই দুঃখে একদিন সুভগা গৃহত্যাগ করে গভীর বনে যাত্রা করলে তাঁর স্ত্রী দক্ষিণাও তাঁকে অনুসরণ করল। ব্রাহ্মণ পত্নীসহ সেই বনে ঘুরতে ঘুরতে এক সরোবর তীরে উপস্থিত হয়ে দেখল, কয়েকজন নারী সেই স্থানে সমবেত হয়ে ধানের অঙ্কুর দ্বারা শোভিত স্থানে অষ্টদলপদ্ম রচনা করে তার মধ্যে কার্তিকের মূর্তি স্থাপন করে ব্রত করছে। দক্ষিণা তাঁদের কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল, তাঁরা কার্তিকেয় ব্রত করছে। তখন সেই নারীদের কাছে দক্ষিণা জানতে চাইল যে, এই ব্রত করলে কি ফল হয়? তাঁরা বলল, 'নারীরা পুত্র কামনা করে কার্তিক মাসের বৃশ্চিকরাশিস্থিত সংক্রান্তির দিনে এই ব্রত করবে। ধানের অঙ্কুরে শোভিত স্থানে অষ্টদলপদ্ম রচনা করে তার মধ্যে সামর্থ্যানুযায়ী সোনার, রূপোর, তামার বা মাটির কার্তিকেয় মূর্তি স্থাপন করে মূর্তির সামনে ঘট স্থাপন করবে। এই ঘটে যথাক্রমে — গণেশ, নারায়ণ, ব্রহ্মা, শিব, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, লোকপাল, নবগ্রহ এবং ময়ূর ও গরুড়ের পুজো করে যথাবিধি কার্তিকের ধ্যান করবে। তারপর কার্তিকের ষোড়শোপচারে পুজো করে লোহার তৈরী খড়্গ প্রদান করবে। এইভাবে প্রহরে প্রহরে স্নানাদি পুজো করে ব্রতকথা শুনবে। কার্তিকের পুজো সন্ধ্যার সময় আরম্ভ করে পরের দিন প্রভাতকালে মূর্তি বিসর্জন করতে হয়। এইভাবে চার বছর পুজো করার পর উদ্যাপন করতে হয়। উদ্যাপনের সময় চারখানা ডালা বস্ত্র, ভোজ্যাদি ও নানারকমের বস্তু দান করতে হয়। নারীরা এই ব্রত পালন করলে ইহকালে পুত্র পৌত্রাদি নিয়ে সুখে জীবনযাপন করে পরকালে পরম প্রীতিলাভ করে থাকে। কার্তিকের পুজো করলে সন্তানহীনা নারীদের সুস্থ, সবল ও জ্ঞানী পুত্র লাভ হয়। এরপর দক্ষিণা নিজ গৃহে ফিরে এসে ভক্তি ও নিষ্ঠা সহকারে কার্তিকেয় ব্রত আরম্ভ করল। এই ব্রতের মাহাত্ম্যে তাঁরা পুত্র পৌত্র লাভ করে সুখে কালযাপন করে যথাসময়ে দেহত্যাগ করে বৈকুণ্ঠে যাত্রা করল'। এরপর দেবর্ষি নারদ পুত্রহারা বসুদেবকে উপদেশ দিলেন, 'হে পুণ্যাত্মা বসুদেব! তোমরা স্বামী স্ত্রী উভয়ে মিলে কার্তিকেয় ব্রত আচরণ কর, তাহলে পরবর্তী যে পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবেন তিনি দীর্ঘায়ু লাভ করে ত্রিজগতের অশেষ কল্যাণসাধন করবেন'। দেবর্ষির কথামত বসুদেব ও দেবকী কার্তিকেয় ব্রত করে ত্রিলোকপতি নারায়ণকে পুত্ররূপে লাভ করেছিলেন"।
দক্ষিণ ভারতের সাতবাহন বংশের লোকজনেরা ছিলেন কার্তিকের উপাসক। কার্তিকের অন্য নাম বিশাখদেব। তাঁর নামেই হয়েছে বিশাখাপত্তনম। দক্ষিণ ভারতীয় দেবতা আয়াপ্পান কার্তিক ও নারায়ণের মিলিত রূপ। মাদুরাই এবং কন্যাকুমারীতে যে ধনুর্ধারী দেবতার পূজা হয় তিনি আসলে বিশাখদেব বা থিরু থাম্বিদেবম। এই দেবতার পূজা করেন সেইসব মহিলারা, যাঁদের সন্তান হয়নি। বাংলায় কার্তিক পূজার প্রচলন সম্পর্কে ড. সুমহান বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, "বাঙলার সঙ্গে দক্ষিণ ভারতকে জুড়ে এই কার্তিক পূজাকেন্দ্রিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে আর একটি মত হলো, দক্ষিণ ভারতের চোল রাজবংশের দ্বারা বাঙলার কার্তিকপূজা প্রবর্তিত হয়েছিল। শৈব চোল রাজবংশের উপাস্য দেবতা ছিলেন কার্তিক। দিগ্বিজয়ে বহির্গত হয়ে, এই দেবতার মূর্তি স্থাপনের প্রয়াস দেখা গিয়েছিল অনুগামী বণিক ও অনুচরদের মধ্যে। এঁরাই সপ্তগাম, ত্রিবেণী, বাঁশবেড়িয়া অঞ্চলে কার্তিকপূজার প্রচলন ও প্রসার ঘটান। বাস্তবে এই তিনটি স্থানই ছিল বন্দর অঞ্চল ও বণিক অধ্যুষিত। রাজ উপাস্য কার্তিককে নিয়ে আরও যে বিষয়টি বলার তা হলো রাজ পরিপোষণার দীর্ঘকালীন অভাব, বন্দর হিসাবে সপ্তগ্রাম, ত্রিবেণী ইত্যাদির অবলুপ্তি কার্তিকপূজাকে এতটা মান্যতা দিতে পারত না; যতটা বর্তমানে রয়েছে। একথা অস্বীকার করা যায় না, পূর্বের যে বিস্তার কার্তিক পূজার ছিল, এখন তা আর নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও যেভাবে ঐসব অঞ্চলে আজও কার্তিক উপাসিত হচ্ছেন তার কারণ বোধহয় আরও গভীরে"।
প্রজননের দেবতা কার্তিক পূজাতে যেসব উপকরণের প্রয়োজন, সেগুলি হল -- সিঁদুর, কাৰ্ত্তিক পূজার ধুতি ৪ টি, ময়ূর পূজার ধুতি ৪ টি, বিষ্ণু পূজার ধুতি ১ টি, চাঁদমালা ৪ টি, পুষ্পমালা ৪ টি, পুষ্প, দুৰ্ব্বা, তুলসী, বেলপাতা, ধূপ, প্রদীপ, ধুনা, আসনাঙ্গুরী ৯ টি, আচার্য্যবরণ ১ টি, বরণাঙ্গুরী ২ টি, কুঁচা নৈবেদ্য ১ টি, তীরধনুক ১ টি, লৌহখড়্গ ১ টি, যজ্ঞোপবীত ১০ টি, পূজবকরণ ১ টি, তিল, হরীতকী ১, পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চগব্য, পঞ্চশস্য, পঞ্চরত্ন, পঞ্চপল্লব, মাদুর ১ টি, বালিস ১ টি, বালি, কাঠ, খোড়কে, বরণডালা, ঘট, কুণ্ডহাঁড়ি, একসরা আতপচাল, দর্পণ ১ টি, তেকাঠা ১ টি, শীষযুক্ত ডাব ১ টি, তীর ৪ টি, ঘটাচ্ছাদন গামছা ১, মধুপর্কের বাটী ৯ টি, নৈবেদ্য ৯ টি, থাল ৪ টি, ঘটী ৪ টি, দধি, মধু, চিনি, খেলনা, ভেটা বা ভাঁড় ১ টি, গব্যঘৃত আধ সের, হোমের বেলপাতা ২৮ টি, ভোজ্য, ভোগের দ্রব্য, রচনা ৪ টি, পূর্ণপাত্র ১ টি এবং দক্ষিণা সাধ্যমত।
এই কার্তিক পূজার সাথেই সম্পৃক্ত 'কার্তিক লড়াই'। যার মূল বিষয় হল 'থাকা' সাজানো। কাটোয়া শহরের কার্তিক লড়াই একটি অভিনব লৌকিক উৎসব। কার্তিক পূজার আগের দিন আয়োজিত হয়। এখানে কার্তিক মুখ্য আরাধ্য দেবতা হলেও মূর্তির গঠনে এটি গৌণ। কেননা, থাকাতে থাকা অন্যান্য মূর্তি গুলি আকারে আয়তনে বিশাল। কখনো কখনো ৪, ৫, ৬, ৭ বা ৮ থাকের কার্তিকও সাজানো হয় এখানে। সিঁড়ির ধাপের মতো থাকা সাজানো হয়। কার্তিক পূজার মূলমন্ত্র আসলে বিষ্ণুপূজার মন্ত্র। একসময় এখানে নানা রঙের সঙ সেজে বের হতে দেখা যেত। এখন বিলুপ্তপ্রায়। কাটোয়ার সুবোধ স্মৃতি রোডে উইলিয়াম কেরি জুনিয়ারের সমাধিক্ষেত্রকে শ্রদ্ধা জানিয়ে হয় সাহেব কার্তিকের আরাধনা। সিপিআইএম পার্টি অফিসের সামনে পুজো হয় জামাই কার্তিক, তাঁতিপাড়ার রক্ষণশীল বনেদিয়ানার প্রতীক সাতভাই কার্তিক, কাশিগঞ্জ পাড়াতে বাংলা কার্তিক বেশ জনপ্রিয়। এছাড়াও খ্যাপাকালীতলা, হরিসভাপাড়া, মণ্ডলপাড়া, পশারিপট্টি, পঞ্চাননতলাতেও থাকা কার্তিক লক্ষ্য করা যায়। কার্তিক পূজার পরের দিন হয় বিসর্জন। কাটোয়াতে এই বিসর্জনের নাম 'বাইচ' বা 'বাইচ' বা 'বাঁচ'।
একসময় কাটোয়াতে ছিল বারবণিতাদের অবস্থান। আসলে বর্গী দস্যু ভাস্কর পণ্ডিত কাটোয়াকে রাজধানী করার পর গোটা দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে অবাধে লুটপাট চালাতে শুরু করে। এই বর্গীদের মনোরঞ্জনের জন্য গ্রাম থেকে যুবতীদের জোর করে ধরে এনে কাটোয়ার কিছু এলাকায় রাখা হয়। পরবর্তীতে বর্গীরা পালিয়ে গেলেও বারবণিতারা রয়ে যান। তখন সেখানে বাবু সমাজের বহু মানুষ নিত্য যাতায়াত শুরু করেন। একসময় বারবণিতাদের মনে হলো তাঁরাও মা হবে। তাঁদের অন্ধকারময় জীবনে চাই সন্তানের আলো। তখন তাঁদের আর্তি ফুটে বেরোলো বাবুদের কাছে। কিন্তু বারবণিতার সন্তান? এটা কি মানা যায়? বাবুদের কাছে তাঁদের আর্তির জন্য বাবুরা সেই রেড লাইট এরিয়াতে প্রজননের দেবতা কার্তিক পূজার প্রচলন করল। যা ছিল বারবণিতাদের নিজস্ব বিনোদন। ইতিহাস গবেষকদের অনুমান, আলীবর্দীর শাসনের শেষ সময় তথা ১৭৫০ সাল নাগাদ বারবণিতারা এখানে প্রথম কার্তিক পুজোর প্রচলন করে। ক্রমশঃ জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করল সেই খোকা কার্তিক বা ন্যাংটো কার্তিক। ধীরে ধীরে বাবুদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল -- কার কার্তিক পূজা কতখানি জাঁকজমকপূর্ণ হয়, এই নিয়ে। দেদার খরচ শুরু হল কার্তিক পূজাকে কেন্দ্র করে। শোভাযাত্রা, আলোকমালা থেকে শুরু করে নানা ধরনের আতিশয্যে ক্রমশঃ জমজমাট হয়ে উঠলো বাবুদের চালু করা কার্তিক পূজা। ধীরে ধীরে বাবু কালচার সরে গিয়ে ক্লাব কালচার চালু হল। যা এখন পুরোপুরি ক্লাবগুলোর হাতে। কার্তিকের শোভাযাত্রা এখন আভিজাত্যের লড়াইতে পর্যবসিত হয়ে 'কার্তিক লড়াই'তে পরিনত। মূলতঃ বারবণিতাদের কার্তিক পূজাকে জাতে তুলতেই কার্তিকের সঙ্গে অন্যান্য দেবতার পূজার্চনা শুরু হয়। পরবর্তীতে দেবতার সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে 'থাকা'র ব্যবহার চালু হয়ে যায়। কোথাও কোথাও কার্তিককে চোরের দেবতা হিসেবে পূজা করার রেওয়াজ রয়েছে। মাছ চুরির হাত থেকে রক্ষার জন্য কৈখালিতে পূজা পান 'খোকাঠাকুর'। এই কার্তিককে খোকা বা ছেলের মতো পূজা করেন বারবণিতারা। যেহেতু তাঁদের ছেলে নেই, তাই কার্তিক তাঁদের কাছে খোকা।
কাটোয়া ছাড়াও হুগলির চুঁচুড়া, বাঁশবেড়িয়া, সাঁকো মোড়, গোলাবাগান, ঠাকুরগলি, কামারপাড়া, কনকশালী অঞ্চলে কার্তিক পূজার চল রয়েছে। এই চুঁচুড়া ও বাঁশবেড়িয়ার একটি পরিচিত প্রবাদ হল 'কার্তিক কাঁসারি উদ্গেড়ে / এই তিন নিয়ে বাঁশবেড়ে'। যা থেকে সহজেই বোঝা যায় এখানকার কার্তিকের জমজমাট উপস্থিতি। এসব এলাকায় দক্ষিণ ভারতের দণ্ডেরি অনুষ্ঠানের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কনকশালী এলাকায় সোমবংশীয় জমিদার রামচরণ সোম ১৬৮৬ সালে কার্তিক পূজার প্রচলন করেন বলে কথিত। তিনি সেসময় চুঁচুড়ার ওলন্দাজদের দেওয়ান ছিলেন।
কার্তিক লড়াইতে নতুন নতুন থিম উপস্থাপন করে অন্যকে টেক্কা দেওয়াই মূল উপজীব্য বিষয়। 'থাকা’ বা গ্যালারিতে শুধুমাত্র কার্তিকের মূর্তিই থাকেনা। বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি অনুসরণ করে দেবদেবী, মুনি, ঋষি, দৈত্য, দানব, অপ্সরাদের মূর্তিও সাজানো থাকে। প্রত্যেক ‘থাকা'র একেবারে চূড়ায় বা টঙে থাকে কার্তিকের মূর্তি, তারপর নিচের দিকে নেমে আসে পৌরাণিক কাহিনির অন্যান্য কুশীলবরা। কার্তিকের সঙ্গে এই সমস্ত কাহিনির কোনও সংস্পর্শ নেই। কিন্তু থাকাতে সাজানো এই পৌরাণিক কাহিনিগুলি জনসাধারণের কাছে খুবই আকর্ষণীয় এবং আগ্রহের বিষয়। দুর্গাপূজায় যেমন সর্বজনীন বারোয়ারি কমিটিগুলি প্রতিবছর নিত্যনতুন থিম বানিয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জন করে, ঠিক তেমনি এখানেও প্রতি বছর আলাদা আলাদা 'থাকা' বানানো হয়। অন্যদের ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা গঠনশৈলী, সাজসজ্জা, বিন্যাস, উপস্থাপন, বিষয়, আলোকমালা, মূর্তির গঠনশৈলীতে পৃথক পৃথক ভাবনার মিশেল আনতে সচেষ্ট হয়। যাতে অন্যদের সঙ্গে কোনও রকম মিল না থাকে।
নানা ধরনের কার্তিকের দেখা মেলে কার্তিক লড়াইতে। বাংলার লৌকিক সংস্কৃতিতে এক অন্যতম উদাহরণ।নটরাজ কার্তিক, বাংলা কার্তিক, অর্জুন কার্তিক, রাজা কার্তিক, নবানে কার্তিক, জামাই কার্তিক, জাংড়া কার্তিক, খোকা কার্তিক, ষড়ানন কার্তিক, বাবু কার্তিক, লড়াই কার্তিক, মায়ের কোলে থাকা ছোট কার্তিক, ন্যাংটা কার্তিক, শিশু কার্তিক ইত্যাদি। এছাড়াও থাকে কার্তিকের সঙ্গে শিব, কার্তিকের সঙ্গে গনেশ, কার্তিক সঙ্গে সন্তোষী, কার্তিকের সঙ্গে কালীয় দমন, কার্তিকের সঙ্গে সতীর দেহত্যাগ, কাত্যায়নীর কোলে কার্তিক ইত্যাদি। বাংলা কার্তিক ময়ূরের উপর উপবিষ্ট। হাতে থাকে তীর ধনুক। আকারেও বড়। লড়াই কার্তিকের আকার থাকে মহিষাসুরের লড়াইয়ের আদলে। ন্যাংটা কার্তিকের পরণে থাকে জন্মদিনের পোশাক। সন্তান কামনায় পূজিত কার্তিক হল শিশু কার্তিক। বাবু কার্তিকের সাথে সাজানো থাকে সুতো, ঘুড়ি, লাটাই, মারবেল সহ নানা ধরনের খেলনা। বাচ্চার মন ভোলানোর জন্য যেমন চকোলেট, মোয়া, মিস্টি, লাড্ডু, কদমা ইত্যাদি দেওয়া হয়, ঠিক তেমনি এখানেও কোথাও কোথাও মানতকারীরা এইসব ভোগ দেয় কার্তিকের কাছে। এছাড়াও দেওয়া হয় খেলার বল, লাটিম, বেলুন ইত্যাদি।
সুধীর চন্দ্র সরকার কার্তিকেয়র জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে লিখেছেন, "মহাদেব পার্বতীর পুত্র। দেবতাদের সহিত যুদ্ধে দানবরা সর্বদা জয়ী হয় দেখে, ইন্দ্র একজন উপযুক্ত সেনাপতির অনুসন্ধান করতে থাকেন। একদিন মানস পর্বতে স্ত্রীকণ্ঠের আর্তনাদ শুনে নিকটে গিয়ে ইন্দ্র দেখেন যে, কেশী দানব প্রজাপতির কন্যাসেনাকে হরণ করতে চেষ্টা করছে। ইন্দ্র উক্ত দানবের হাত হতে তাঁকে রক্ষা করে ব্রহ্মার কাছে নিয়ে যান। দেব তাঁকে দেখে বলেন যে, এক মহা বিক্রমশালী পুরুষ এই কন্যার পতি হবেন, আর তিনিই হবেন দেবসেনাপতি। দক্ষকন্যা স্বাহা অগ্নিকে কামনা করতেন। একদিন অগ্নি সপ্তর্ষিদের পত্নীগণকে দেখে কামাতুর হয়ে পড়েন। স্বাহা মহর্ষি অঙ্গিরার স্ত্রী শিবার রূপ ধারণপূর্বক অগ্নির কাছে এসে সহবাস করেন এবং অগ্নির শুক্র নিয়ে গরুড় পক্ষিণী হয়ে এক কাঞ্চন কুণ্ডে নিক্ষেপ করেন। এতেও তৃপ্ত না হয়ে তিনি সপ্তর্ষিদের প্রত্যেকের স্ত্রীর রূপ ধারণ করে পূর্বের মত অগ্নির সঙ্গে মিলিত হন। কেবলমাত্র বশিষ্ঠের স্ত্রী অরুন্ধতীর তপস্যার প্রভাবে স্বাহা তাঁর রূপ ধারণ করতে অক্ষম হন। এইভাবে স্বাহা ষষ্ঠবার কাঞ্চন কুণ্ডে অগ্নির শুক্র নিক্ষেপ করেন। সেই সম্মিলিত শুক্র থেকে স্কন্দ, অর্থাৎ কার্তিকেয়র জন্ম হয়। তাঁর ছয়টি মস্তক, একটি গ্রীবা এবং একটি উদর হয়। কার্তিকেয়র জন্মের পর সপ্তর্ষিরা তাঁদের স্ত্রীদের ত্যাগ করেন। তাঁরা ভাবলেন যে, তাঁদের স্ত্রীরাই স্বন্দের জননী। ক। কিন্তু স্বাহা বারংবার বললেন যে, স্কন্দই তাঁর পুত্র। মহামুনি বিশ্বামিত্র প্রকৃত ঘটনা জ্ঞাত ছিলেন। কিন্তু সপ্তর্ষিরা তাঁর কথা বিশ্বাস করলেন না। স্কন্দের বৃত্তান্ত শ্রবণান্তে দেবতারা এঁকে বধ করবার জন্য ইন্দ্রকে বললেন। কারণ, এঁর অমিত বল তাঁদের অসহ্য। কিন্তু ইন্দ্ৰ এই কার্যে সাহসী হলেননা। এঁকে মারবার জন্য তখন দেবতারা লোকমাতাদের (শিবের অনুচরী— মাতৃকা ) প্রেরণ করলেন। কিন্তু তাঁরা গিয়ে বালককে নিজেদের পুত্রজ্ঞান করে তাঁদের স্তন্যপান করালেন। পরে স্কন্দকে পরাজিত করবার জন্য ইন্দ্ৰ সদলবলে অগ্রসর হলেন। । কিন্তু অগ্নিপুত্র স্বন্ধ মুখনির্গত অগ্নিশিখায় দেবসৈন্যদের দগ্ধ করে ফেললেন। তখন ইন্দ্র বজ্র নিক্ষেপ করলে, কার্তিকেয়র দক্ষিণপার্শ্ব বিদীর্ণ হয়ে বিশাষ নামে (কার্তিকেয়র অপর নাম) এক কাঞ্চনবর্ণ যুবার আবির্ভাব হ'ল। তখন দেবরাজ ভীত হয়ে কার্তিকেয়কে দেবসেনাপতি পদে বরণ করলেন। রুদ্রকে অগ্নি বলা হয়, সেজন্য কার্তিকেয় মহাদেবের পুত্র। মহাদেব অগ্নির শরীরে প্রবেশ করে এই পুত্র উৎপাদন করেছিলেন। স্কন্দ দেবসেনাপতি পদে নিযুক্ত হবার পর ইন্দ্র এঁর হাতে সকল দেবসেনাকে সমর্পণ করেন। তারপর দেবাসুরের যুদ্ধে কার্তিক সেনাপতি রূপে যুদ্ধে অগ্রসর হন। প্রায় সমস্ত দানবই তাঁর শরাঘাতে বিনষ্ট হয়। যুদ্ধ শেষে সমস্ত দানবকে নিহত করে তিনি দেবতাদের রক্ষা করেন। (মহাভারত) ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে কার্তিকেয়র জন্ম সম্বন্ধে লিখিত আছে যে, কার্তিকেয় মহাদেবের তেজে জন্মগ্রহণ করেন"।
🍂
0 Comments