জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৯৬/প্রীতম সেনগুপ্ত

অধুনা ডানগ্যানন,  নিবেদিতার জন্মস্থান

পর্ব ৯৬

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত


মার্গারেট নোবল, শুরুর কথা

 বসুধা চক্রবর্তী তাঁর ‘ভগিনী নিবেদিতা’ গ্রন্থটিতে ( মূল-ইং Sister Nivedita ) লিখছেন – “কয়েক দশক পূর্বে আমাদের এক সুদক্ষ সমালোচক লিখেছিলেন ‘শুধু আয়ার্ল্যাণ্ডের করুণ রসাত্মক সাহিত্যের সঙ্গেই আমরা আমাদের মনের মিল খুঁজে পাই – কারণ, তারাও ছিল আমাদের মতো দীর্ঘকাল জীবনযুদ্ধে পরাজিত, যখনই তারা নিজেদের অধিকারের জন্য প্রবৃত্ত হতো তখনই তাদের পতন ঘটতো।’ আইরিশদের স্বাধীনতাসংগ্রাম যে আমাদের ও আমাদের অব্যবহিত পূর্বসূরীদের গভীর প্রেরণা জুগিয়েছিল, এই মন্তব্যে তারই পটভূমি বিবৃত হয়েছে। মার্গারেট নোবল নাম্নী আইরিশ মহিলা যে ভারতের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের মর্মমূলে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন এবং সেইসঙ্গে ঐ দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন, সে ঘটনারও ছিল একই পটভূমি। বস্তুত মনে হয়, যেন তিনি ভারতে তাঁর জীবনব্রত পালনের জন্যই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতামহ ও পিতামহী এবং তাঁর মাতামহ – এঁরা সবাই বৃটিশ শাসন থেকে স্বদেশের মুক্তিসংগ্রামে জড়িত ছিলেন। তাঁর পিতামহ জন নোবল ছিলেন উত্তর আয়ার্ল্যাণ্ডের ওয়েসলীয়ান ধর্মসম্প্রদায়ের একজন যাজক, কিন্তু তার জন্য তিনি তাঁর দেশের স্বাধীনতার জন্য ইংলণ্ডের চার্চের সার্বভৌম ধর্মনেতাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিরত থাকেন নি। নোবল পরিবার চতুর্দশ শতাব্দীতে স্কটল্যাণ্ড থেকে আয়ার্ল্যাণ্ডে বসবাসের জন্য চলে আসেন। জন মার্গারেট নীলাস নাম্নী এক মহিলাকে বিবাহ করেন, কিন্তু পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়সেই মারা যান।‌ স্যামুয়েল রিচমণ্ড ছিলেন তাঁদের চতুর্থ সন্তান; মা'কে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে তিনি ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হন – কিন্তু তা হন কতকটা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তিনি মেরী ইসাবেল হামিলটন নামে এক প্রতিবেশিনী বালিকাকে বিবাহ করেন। তাঁদের প্রথম সন্তান মার্গারেটের জন্ম হয় টাইরোন জেলার ডানগানন গ্রামে – ১৮৬৭ সালের আঠাশে অক্টোবর তারিখে। পরে প্রামাণ্য সূত্রে জানা গেছে যে, জন্ম মুহূর্তেই তাঁর জননী তাঁকে ভগবানের সেবায় উৎসর্গ করেছিলেন।” ( ভগিনী নিবেদিতা, বসুধা চক্রবর্তী, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইণ্ডিয়া, নয়াদিল্লি )

 এই বিষয়ে প্রব্রাজিকা আত্মপ্রাণা মাতাজী চমৎকার বর্ণনা দিচ্ছেন – “YOUNG MARY NOBLE was feeling anxious before the birth of her first child. Like all religious women she vowed that if her child was born safe she would dedicate it to the service of the Lord.

 And so was the vow fulfilled. The child, Margaret Elizabeth Noble, lived a great life of consecration and earned the name ‘Nivedita’ – the Dedicated – from her Guru, Swami Vivekananda. Disciplewise, in true Hindu style, she offered the fruits of her labours at the feet of her Guru and Parama-Guru by adding her name ‘Nivedita’ the attribute ‘Of Ramakrishna-Vivekananda’, thus pointing out the sanctuary where she got light and strength. 

 Nivedita’s life can be divided into three distinct periods. First, from her birth to the time she met Swami Vivekananda. Second, from her being aware of the great call in her life to the passing away of her Guru. And third, when she emerged as passionate, selfless worker.

 Thus runs the life-story of a dedicated soul.” ( Sister Nivedita of Ramakrishna-Vivekananda, Pravrajika Atmaprana, Sister Nivedita Girl’s School, Calcutta )

মার্গারেট নোবল, ১৭ বছর বয়সে

ভারতবর্ষকে জান, ভারতবর্ষকে ভালবাস

এক অসামান্য উৎসর্গীকৃত প্রাণের আখ্যান হল নিবেদিতার জীবন। ভারতবর্ষকে তিনি কী পরিমাণ ভালোবেসেছিলেন, পরাধীন একটি দেশের জন্য কীভাবে আত্মবলিদানে প্রয়াসী হয়েছিলেন তা জানলে বিস্মিত হতে হয়। এই বিষয়ে স্বামী বিমলাত্মানন্দজী লিখছেন – “একদা বালিকা নিবেদিতাকে তাঁর পিতৃবন্ধু এক ধর্মযাজক আশীর্বাদ করে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন: ‘ভারতবর্ষ একদিন তোমায় ডাক দেবে।’ তখন নিবেদিতা ভারতবর্ষের নাম পর্যন্ত জানতেন না। যৌবনে বুদ্ধজীবনী ‘Light of Asia’ পড়ে তাঁর একটা ধারণা হয়েছিল ভারতবর্ষ সম্বন্ধে। আটাশ বছর বয়সে লণ্ডনে স্বামীজীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর নিবেদিতার মানসপটে অঙ্কিত হয়েছিল ভারতবর্ষের চিত্র – ‘ভারতীয় উদ্যানে অথবা সূর্যাস্তকালে কূপের সমীপে কিংবা গ্রামের উপকণ্ঠে বৃক্ষতলে উপবিষ্ট সাধু ও তাঁহার চারিপার্শ্বে সমবেত শ্রোতৃবৃন্দ।’

🍂

 এরপর নিবেদিতা স্বামীজীর কাছে জানতে পেরেছিলেন ভারতবর্ষের কথা। সেসময় থেকে শিরায় শিরায় অবিরাম ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছিল পাঁচটি অক্ষর – ‘India’ – ‘ভারতবর্ষ’। আমৃত্যু তিনি জপ করেছিলেন ‘ভারতবর্ষ’ নামক পঞ্চাক্ষর মন্ত্রটি। নিবেদিতা নিজেই বলেছিলেন: ‘ধন্য ভারতবর্ষ! কী অশেষ ঋণী আমি তাহার নিকট! আমার মধ্যে এমন কিছু যোগ্যতা আছে কি, তাহা আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাহার নিকট লাভ করি নাই!’ তাঁর নিরন্তর প্রার্থনা ছিল: ‘আমি যেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভারতবর্ষেই অবস্থান করিতে পারি। অর্থাভাবে বা কোন ব্যক্তিগত কারণে আমাকে যেন এদেশ পরিত্যাগ করিতে না হয়।’

 নিবেদিতার এ-প্রার্থনা পূর্ণ হয়েছিল। ভারতের চিন্তা করতে করতেই নিবেদিতা ভারতের মাটিতে শেষশয্যা নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ভারতীয়দের দ্বারা বাহিত হয়ে হিন্দুর শ্মশানভূমিতে তাঁর মরদেহের হিন্দুমতে সৎকার করা হয়েছিল।

 অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু লিখেছেন: ‘স্বামীজী নিবেদিতাকে বলেছিলেন, ভারতবর্ষকে জান, ভারতবর্ষকে ভালবাস।’ ভারতবর্ষকে জানা ও ভালবাসার আনন্দ ও সান্ত্বনা নিবেদিতা বহন করেছেন। তখন ছিল পরাধীন ভারতবর্ষ। মুক্তদিনের আলোকলাভের তপস্যায় নিবেদিতা নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। স্বাধীন ভারতবর্ষে কিন্তু ভারতকে জানা ও ভালবাসার প্রয়োজন বিন্দুমাত্র কমেনি। গৃহে-পথে-প্রান্তরে অন্ধকার ক্রমেই গাঢ়তর। ভারতবাসী যেন নিবেদিতার আলোকিত জীবনের দীপ ধরে অগ্রসর হতে পারে – এই আশায় আচার্য জগদীশচন্দ্র একদা তাঁর বিজ্ঞানাগারের দ্বারপথে আলোকদূতী নিবেদিতার মূর্তি স্থাপন করেছিলেন। সেই মূর্তি এখনো দীপধারিণী – ভারতবর্ষের জন্য।” ( ভারতভগিনী নিবেদিতা, স্বামী বিমলাত্মানন্দ, উদ্বোধন:পুরাতনী সংখ্যা, বইমেলা ২০০৬ উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ সাহিত্য সংখ্যা, উদ্বোধন কার্যালয় )

ত্যাগ ও সেবা 

প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণা লিখছেন – “যে যুগসন্ধিক্ষণে শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও আধ্যাত্মিক শক্তিরূপিণী শ্রীসারদাদেবীর লীলাবিগ্রহধারণ এবং ভারতাত্মার পূর্ণ প্রতীক রূপে স্বামী বিবেকানন্দের আবির্ভাব, ভারতে পুনর্জাগরণের সেই গৌরবময় শুভ মুহূর্তে ভগিনী নিবেদিতার অভ্যুদয়ও সুপরিকল্পিত। ভারতীয় ইতিহাসের একটি বিশিষ্ট অধ্যায়ে তাঁহার অবদানও অতুলনীয়। ভারতের তথা সমগ্র বিশ্বের কল্যাণসাধনে শ্রীরাকৃষ্ণদেব যে মহাশক্তির উদ্বোধন করিয়া গেলেন, তাহার কী অপূর্ব প্রকাশই না ভগিনী নিবেদিতার জীবনে দেখা গিয়াছে! যুগপ্রয়োজনে শ্রীরামকৃষ্ণের সমগ্র শিক্ষাকে স্বামী বিবেকানন্দ মাত্র দুইটি সংক্ষিপ্ত শব্দে নির্দেশ করিয়া জগৎসমক্ষে স্থাপিত করিলেন, ‘ত্যাগ ও সেবা’। আর ভগিনী নিবেদিতার জীবনে সেই ত্যাগ ও সেবা বাস্তবরূপ গ্রহণ করিল।” ( ভগিনী নিবেদিতা, প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণা, সিস্টার নিবেদিতা গার্লস স্কুল )


Post a Comment

0 Comments