জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ২৭/বিজন সাহা

ভজনেসেনস্কি সাবর

ভোলগা নদীর খোঁজে – ২৭

বিজন সাহা 

পেচেরস্কি ভজনেসেনস্কি মনাস্তির 

ভোলগা তীরের শহরে ঘুরতে ঘুরতে আমরা এসে পৌঁছি রাশিয়ার তৃতীয় শহর নভগোরাদ, যদিও ইদানীং কাজানও তৃতীয়ত্বের দাবি করে। ১৬১২ সালে বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে পোল্যান্ড যখন রাশিয়া দখল করে তখন এ শহরের ব্যবসায়ীরাই প্রিন্স পঝারস্কি আর ব্যবসায়ী কুজমা মিনিনের নেতৃত্বে রুশ দেশ শত্রু মুক্ত করে রোমানভ বংশের হাতে দেশে চালানোর দায়িত্ব দেন।  ভ্রমণের এক পর্যায়ে আমরা এসে উপস্থিত হই পিচরস্কি মুঝস্কই মনাস্তেরিতে। ছেলেরা এখানে থেকে ধর্ম শিক্ষা নেয়। রাশিয়ার মনাস্তেরিগুলোর বৈশিষ্ট্য হল সেখানে মিউজিয়ামের উপস্থিতি। সোভিয়েত আমলে জাগোরস্ক (সেরগিয়েভ পাসাদ), সুজদাল, রোস্তভ ভেলিকি, পেরেস্লাভল জালেস্কি, ভেলিকি নভগোরাদ বা পরবর্তীতে আলেক্সান্দ্রভ, ইউরিয়েভ পোলস্কি ইত্যাদি যেখানেই গেছি সেখানেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে মনাস্তিরের ভেতরে এসব মিউজিয়ামে। এসব মনাস্তিরে শুধু রাজ রাজাদের পোশাক পরিচ্ছদ, ঢাল, তলোয়ার এসবই থাকে না, বা সেই সময় চার্চের লোকেরা কী ধরণের পোশাক পরতেন সেই নমুনাই থাকে না, থাকে সেই সময়ের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের পোশাক পরিচ্ছদ, সেই সময়ের কৃষি, শিল্প এসবের নমুনা। আর যেহেতু জার আমলে মনাস্তেরি, গির্জা এসব স্থানেই বিয়ে, জন্ম, মৃত্যু ইত্যাদি রেজিস্ট্রি করা হত, তাই কোন এলাকার ইতিহাস জানতে হলে এখান থেকে শুরু করাই শ্রেয়। এখনও রাশিয়ায় কেউ যদি জারের আমলে জন্মগ্রহণকারী পূর্বপুরুষদের জন্ম নিবন্ধন ইত্যাদির কপি পেতে চায় তাদের অনেক সময়ই স্থানীয় গির্জায় খোঁজ নিতে হয়। সেদিক থেকে গির্জার ইতিহাসের মধ্যেই কমবেশি নিহিত দেশের ইতিহাস। এর আগে আমরা যখন তভের, উগলিচ, ইয়ারোস্লাভলের ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত বলেছি, দেখেছি কোথাও কোন রাজপুত্র ক্রেমলিন বা দুর্গ গড়ার প্রায় সাথে সাথেই সেখানে গড়েছেন গির্জা। তাছাড়া সে সময় সারা বিশ্বেই পুরোহিতরা প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী ছিলেন। রাজাদের ক্ষমতায় বসার বা টিকে থাকার জন্য পুরোহিতদের আশীর্বাদ দরকার হত। রাশিয়াও একই নিয়মে চলত, যদিও পিটার দ্য গ্রেট চার্চের সেই ক্ষমতা অনেকটাই ক্ষুণ্ণ করেন এবং নিজেকে বা রুশ সম্রাটকে চার্চের প্রধান বলে ঘোষণা করেন। আর এ সময়ই দেখা দেয় রুশ অর্থোডক্স চার্চের ভাঙ্গন। এ নিয়ে আমরা পরে বলব। ইউরোপে এটা কিছুটা হলেও কম, কেননা তখন সেখানকার রাজন্যরা ভ্যাটিকানের পোপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতেন। প্রাচীন ইজিপ্ট, মায়া, ইনকা এসব সভ্যতায় মন্দিরের গুরত্ব ছিল অপরিসীম। ভারতের দিকে তাকালেও দেখব প্রাচীন ইতিহাসের যেসব নিদর্শন আজও টিকে আছে তার একটা বড় অংশই মন্দির, মসজিদ, প্যাগোডা। এমনকি তখন নালন্দা, তক্ষশীলা এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৌদ্ধ ধর্মীয় স্থাপনা ও রীতিনীতির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল। তাই ধর্মে বিশ্বাস থাক আর নাই থাক ইহিতাস জানতে হলে ধর্মের ইতিহাস বাদ দিলে সেটা অপূর্ণ থাকবে।

পেচেরস্কি ভজনেসেনস্কি মনাস্তির

পেচেরস্কি ভজনেসেনস্কি পুরুষদের মনাস্তির ১৩২৮ থেকে ১৩৩০ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে এর প্রতিষ্ঠাতা গ্র্যান্ড ডিউক ইউরি ভসেভোলোদোভিচ। তিনি ১২১৯ সালে নভগরাদ থেকে দূরে এই মনাস্তির প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু জনপ্রিয় মত হচ্ছে মহান দিওনিসি এর প্রতিষ্ঠাতা। এই সন্যাসী কিয়েভের পেচোরস্কি মনাস্তির থেকে কয়েকটি আইকন নিয়ে নিঝনি নভগোরাদ আসেন এবং শহর থেকে কিছু দূরে গুহায় বসবাস শুরু করেন। ১৩৩৫ সালে তিনি এখানে ভজনেসেনিয়া গসপদা গির্জা সহ পেচেরস্কি ভজনেসেনস্কি  মনাস্তির প্রতিষ্ঠা করেন। অল্প দিনের মধ্যেই এই মনাস্তির সুজদাল-নিঝনিনভগোরাদের গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। এখানে সবাই কঠোর ভাবে সমষ্টি জীবন যাপন করত। কারো কোন ব্যক্তিগত সম্পদ ছিল না। সব সম্পদ ছিল সামাজিক। ছাত্র, শিক্ষক সবাই নিজে নিজে নিজের খাদ্য সংগ্রহ করত। মনাস্তিরের প্রধানের আদেশ ছাড়া কেউ বাইরে যেতে পারত না। এখানেই তৈরি হয় লাভরেন্তি পঞ্জিকা। এই মনাস্তিরের ছাত্রদের অনেকেই পরবর্তীতে রাশিয়ার আধ্যাত্মিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ষোড়শ শতকে মনাস্তির উন্নতির শিখরে পৌঁছে। কিন্তু ১৫৯৭ সালের ১৮ জুন পাহাড় ধ্বসে মনাস্তির ধ্বংস হয়ে যায়। ১৫৯৭ সালে মনাস্তির ভোলগার উজানে সরিয়ে আনা হয় আর আগের জায়গায় তৈরি হয় প্রেওব্রাঝেনিয়া গসপদনিয়া গির্জা। ধারণা করা হয় যে রুশ দেশের জাতীয় বীর কুজমা মিনিনের পিতা নতুন মনাস্তির তৈরিতে অবদান রাখেন। ১৬৩০ থেকে ১৬৪০ সালের মধ্যে বর্তমান কমপ্লেক্স তৈরি করেন স্থপতি আন্তিপ কনস্তান্তিনভ। বর্তমানে এখানে রয়েছে ভজনেসেনস্কি সাবর, উসপেনস্কি গির্জা, এফিম সুজদালস্কি গির্জা ও পিটার পাভেল গির্জা।    

এই মনাস্তির সম্পর্কে জানার আগ্রহ নিয়ে আমি

🍂

 মিউজিয়ামের গেটে বসা ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলতে শুরু করলাম।
- আপনি কি এখানেই কাজ করেন?
- হ্যাঁ।
- আপনি কি এখানেই থাকেন?
- না, এটা ছেলেদের মনাস্তেরি। আমি প্রতিদিন সকালে এসে কাজে জয়েন করি।
- তার মানে এটা অন্য দশটা কাজের মতই একটা। আপনি নিশ্চয়ই বেতন পান। কে দেয়?
- রুশ অর্থোডক্স চার্চ। ওরাই আমার কর্মদাতা।
- পেনশন কি ওরাই দেবে?     
- যেকোনো কোম্পানির মত ওরাও পেনশন ফাণ্ডে টাকা পাঠায়। ওখান থেকেই পেনশন পাব। সে অর্থে আমরা সরকার থেকেই পেনশন পাই অন্য দশজনের মত। 
- আর যদি কাজ ছেড়ে দিতে চান তাহলে?
- তাহলে আর কি? এখানে যে সময়টা কাজ করলাম সেটা আমার এক্সপেরিয়েন্স হিসেবে থাকবে আর পেনশনের সময় এটাও যোগ হবে।
- এখানে কারা থাকে?
- ছেলেরা, যারা ঈশ্বরের সেবা জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছে।
- কোন বয়সের?
- স্কুল শেষ করার পর এরা আসে। আসে প্রাপ্ত বয়স্ক (১৮ বছর) হলে যাতে নিজেদের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারে।
- এরা কি এখানে কোন পেশা পায়?
- ঈশ্বরের সেবাই এদের পেশা। এখানে তাদের পাঁচ বছর পড়াশুনা করতে হয়।
- এ যে দেখছি ইউনিভার্সিটির পড়াশুনার মত। সেটা কি উচ্চ শিক্ষার সরকারি কমিটি দ্বারা স্বীকৃত?
- অবশ্যই।
- তার মানে এই ডিপ্লোমা নিয়ে এরা চাকরি করতে পারবে।
- হ্যাঁ, শুধু নিজের পেশায়।
এখানে উল্লেখ করা দরকার একজন ডাক্তার যেমন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে না, ডাক্তার হিসেবেই কাজ করে, থিওলজির উপর পড়াশুনা করে এরা শুধু এ লাইনেই কাজ করতে পারে। 

- আর যদি কেউ এখান থেকে চলে যায়?
- সে চাইলে অন্যত্র কাজ করতে পারে। তখন এটা তার পেশা থাকবে না, তবে যেহেতু স্কুল শেষ করে এখানে আসে, নিজের একটা জায়গা সে ঠিকই খুঁজে নিতে পারে। বড় কথা হল ১৮ বছর বয়সে নিজের সিদ্ধান্তে যারা এখানে আসে তারা সাধারণত এখানেই থেকে যায়।

ঘুরে ফিরে দেখলাম সেমিনারিস্টরা শুধু এখানে পড়াশুনাই করে না, বাগান করা থেকে শুরু করে সমস্ত কাজকর্মই ওদের করতে হয়। এক কথায় এখানে ওদের বাস্তব জীবনের পুরো কোর্সটাই শেখানো হয়। তিন ধরণের সন্ন্যাসী বা মঙ্ক আছে। সাদা পাদ্রী এক দল আছে যাদের বৌ ছেলেমেয়ে আছে। তবে তারা পাদ্রী হন বিয়ের পরে আর পাদ্রী হবার পর বিপত্নীক হলে বিয়ে করতে পারেন না। দ্বিতীয় দল বিয়ে না করার প্রতিজ্ঞা করেন। এছাড়া সেলিবাতি নামে এক ধরণের ফর্ম আছে যখন মানুষ সন্ন্যাসী হয় না আবার বিয়েও করে না।

মনাস্তিরের বাইরে ফেরিস হুইল

এই মনাস্তিরের আরও একটা আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে রোমানভ বংশের সবার আবক্ষ মূর্তির গলি। এর নাম রোমানভ গলি। ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই পেচরস্কি ভজনেসেনস্কি মনাস্তিরের টেরিটরিতে রাশিয়ার রোমানভ বংশের ২১ জন শাসকের  আবক্ষ মূর্তি বসানো গলির উদ্বোধন করা হয়। এই গলির প্রথম অংশ  উদ্বোধন করা হয় ২০১৭ সালের মে মাসে যখন মাত্র ৬ টি আবক্ষ মূর্তি এখানে স্থাপিত হয়েছিল। সব মিলিয়ে জায়গাটা দেখার মত। বাইরের কলাহল নেই আবার জীবন আছে। বেশ ধীর জীবন। মঙ্কদের দেখে মনে হল তারা অসুখী নয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এসব জায়গায় চাইলে সারাদিন কাটিয়ে দেওয়া যায়। কোন কোন মনাস্তিরের বাইরে দু একজন ভিখিরি দেখা গেলেও সাধারণত এখানে তাদের উৎপাত নেই। সেক্ষেত্রে আমাদের সব উপাসনালয় থেকে একেবারেই ভিন্ন রকম, যদি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি দক্ষিণ ভারতের মন্দিরগুলোও বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। 

ছবিতে নিঝনি নভগোরাদ
http://bijansaha.ru/album.php?tag=248

নিঝনি নভগোরাদ ভিডিও
https://www.youtube.com/watch?v=mUP1yA5m0JE&t=1267s

 

Post a Comment

0 Comments