পর্ব ৯৫
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
প্রীতম সেনগুপ্ত
কৃস্টিন, নিবেদিতার বিদ্যালয় ও কৃস্টিনের শেষ দিনগুলি
স্বামীজীর দেহত্যাগের পর প্রায় আঠাশ বছর ( ২৭ মার্চ, ১৯৩০ ) কৃস্টিন এই ধরাধামে ছিলেন। ১৯০২ সালের জুন মাসে নিবেদিতা কলকাতায় ফিরে আসেন এবং তাঁর বিদ্যালয়টির কাজ আরম্ভ করেন। প্রায় আটমাস হিমালয়ে কাটিয়ে ১৯০৩ সালে কৃস্টিন কলকাতায় এসে নিবেদিতার সঙ্গে যোগ দেন। কৃস্টিন বাস্তবিকই একজন অভিজ্ঞ শিক্ষিকা এবং সমসাময়িক শিক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। ফলে কৃস্টিনকে কাছে পেয়ে নিবেদিতার সুবিধা হল বিস্তর। ফলে যেটা দাঁড়াল তা হল, দুই প্রতিভাময়ী পাশ্চাত্য মহিলা স্বামী বিবেকানন্দের অনুপ্রেরণায় ভারতে স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে বিশেষভাবে প্রয়াসী হয়ে উঠলেন। এই বিষয়ে প্রব্রাজিকা ব্রজপ্রাণা লিখছেন – “১৯০৩ সালের ২ নভেম্বর জগদ্ধাত্রী পূজার দিনে মহিলা বিভাগের শুভ উদ্বোধন হয়। মহিলাদের শিক্ষা দেবার একমাত্র সুযোগ ছিল কেবলমাত্র বিকালবেলায়। অন্য সময়টা ছিল বিশ্রামের জন্য সংরক্ষিত। একটি গাড়িও রাখা হয়েছিল আগ্রহী ছাত্রীদের ১৭ নং বোসপাড়া লেনের বাড়িতে আনা নেওয়ার জন্য। যেটা শীঘ্রই ‘ভগিনী’দের বাড়ি বলে লোকালয়ে পরিচিত হলো। কৃস্টিন ও নিবেদিতা বেশ আশঙ্কার মধ্যে ছিলেন। কারণ তাঁদের আশঙ্কা ছিল যদি কোন মহিলা পাশ্চাত্য দেশীয়দের ম্লেচ্ছ বাড়িতে গিয়ে শেখবার মতো সাহসী না হয়। অন্যান্য কার্যসূচীগুলি বোসপাড়া লেনে বেশ ভালভাবেই চলছিল। যেমন ভারতীয় মহাকাব্যের থেকে আবৃত্তি করা হতো। প্রশ্নটা ছিল – ভারতীয় মহিলারা কি পার্থিব বিদ্যার্জনের জন্য ‘ভগিনীদের বাড়ি’ যাবে? তাঁরা দুজনেই ( কৃস্টিন ও নিবেদিতা ) সিদ্ধান্ত করেছেন যদি দশ বারোজন মহিলাও আসে, তাহলে তাঁরা পরীক্ষায় আশাতীত সফল হয়েছেন বলে মনে করবেন। ‘মহিলা বিভাগের’ উদ্বোধনের দিন শিখতে আগ্রহী ২৫ জন মহিলা উপস্থিত হয়েছিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই উপস্থিতির সংখ্যা দাঁড়াল ৬০ থেকে ৭০ জনের মধ্যে।” ( স্বামীজীর কৃস্টিন, প্রব্রাজিকা ব্রজপ্রাণা, উদ্বোধন কার্যালয় )
১৯০৭ সালে নিবেদিতা ইংলণ্ডে ফেরেন, দু-বছর পর অর্থাৎ ১৯০৯ সালের জুলাই মাসে কলকাতায় বাগবাজারস্থ বোসপাড়া লেনে প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে বিদ্যালয়টি কৃস্টিন ও তাঁর সহযোগী ভগিনী সুধীরার পরিচালনায় বিশেষ উন্নতিলাভ করে। তাই ভারতে ফিরে আসার পর নিবেদিতা বিদ্যালয়ের এই অবস্থা পরিদর্শনে স্বভাবতই প্রীত হন। বিশেষত এটা বোঝেন যে, এই পরিস্থিতির মূল হোতা ছিলেন কৃস্টিন। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কাজের পরিধি বিস্তৃত হওয়ায় ১৭ নম্বর বোসপাড়া লেনের ছোট বাড়িতে স্থান-সংকুলানের অভাব মেটাতে ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের বাড়িটি ভাড়া করা হয়।
কৃস্টিন জন্মগ্রহণ করেন জার্মানিতে, কিন্তু আমেরিকায় বসবাসের সুবাদে সেই দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করেছিলেন। সেটা বজায় রাখতে আমেরিকায় যেতে বাধ্য হতেন। ১৯১০ সালের এপ্রিল মাসে সেই কারণেই আমেরিকায় যান, ১৯১১ সালের প্রথমদিকে ফিরে আসেন। কলকাতায় কিছুদিন অতিবাহিত করে চলে যান মায়াবতী। এই সময় সিস্টার নিবেদিতার সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়েছিল। এরপর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য পুনরায় আমেরিকায় ফিরে যেতে বাধ্য হন। কিছুদিন পর যথেষ্ট সুস্থ হয়ে উঠলেও কলকাতায় ফেরাটা দুরূহ হয়ে ওঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেইসময়কার মার্কিন সরকার তাঁকে ভারতে ফেরার সম্মতি দেয় নি। ফলে প্রায় ১০ বছর ভারতের বাইরে থাকতে হয়েছিল ওঁকে। ১৯২৪-এর আগে ভারতে ফিরতে পারেন নি। ভারতে এসে দেখলেন ১৭ নম্বর বোসপাড়া লেনের ভগ্নদশা। বুঝলেন এই বিদ্যালয়, যেটিকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন, তার আর তাঁকে প্রয়োজন নেই। পদত্যাগ করলেন।
১৯২৮ সালের মার্চ মাসে কৃস্টিন আমেরিকায় যান। আর ভারতে ফেরা হয়নি তাঁর। ১৯৩০ সালের ২৭ মার্চ তিনি স্বামীজীর পাদপদ্মে চিরবিলীন হন। নিউইয়র্কে একটি নার্সিংহোমে দেহত্যাগ করেন।
স্বামী বিবেকানন্দ, ১৮৯৫ সালে, লণ্ডনে
নভেম্বর মাসের এক শীতল অপরাহ্ন…
“মনে করিলে আশ্চর্য বোধ হয়, কিন্তু নিশ্চিতই আমার সৌভাগ্য বলিতে হইবে যে, আমার গুরুদেব শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতাবলী তাঁহার ১৮৯৫ ও ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে ইংলণ্ড-আগমনকালে – উভয়বারই আমি শ্রবণ করিয়াছিলাম, তথাপি ১৮৯৮ খ্রীস্টাব্দের প্রথম দিকে ভারতে আসিবার পূর্বে তাঁহার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অতি অল্পই জানিতাম; এমনকি কিছুই জানিতাম না বলিলেও চলে। সৌভাগ্য, কেন না পূর্ব পরিচয় না থাকার ফলেই আমি মানসনেত্রে স্বামীজীর ব্যক্তিত্বের যে স্বতঃপ্রকাশ ঘটিত তাহার প্রতি পদে, ভারতীয় অরণ্য নগর ও রাজপথ রূপ যথার্থ পরিবেশের মধ্যেই তাঁহাকে দেখিতে পাই – প্রাচ্য আচার্যকে প্রাচ্য জগতের আবেষ্টনীর মধ্যেই দেখিয়া থাকি। এমনকি সুদূর লণ্ডনেও যখন আমি তাঁহাকে প্রথম দেখি, এখন ঐ ঘটনা স্মরণ করিয়া আমার চিত্ত যেরূপ আলোড়িত হয়, সূর্যালোকমণ্ডিত স্বদেশের বহু স্মৃতিপরম্পরা তাঁহার চিত্তও সেইরূপ আলোড়িত করিয়া থাকিবে। সময়টি ছিল নভেম্বর মাসের এক শীতল অপরাহ্ন। স্থান ওয়েস্ট এণ্ডের এক ড্রইংরুম। অর্ধবৃত্তাকারে উপবিষ্ট শ্রোতৃমণ্ডলীর দিকে মুখ করিয়া তিনি বসিয়াছিলেন। তাঁহার পশ্চাতে ছিল কক্ষে অগ্নি রাখিবার স্থানে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি। আর যখন তিনি প্রশ্নের পর প্রশ্নের উত্তর দিতেছিলেন, এবং মধ্যে মধ্যে উত্তরটি উদাহরণ দ্বারা ব্যাখ্যা করিতে গিয়া কোন সংস্কৃত গ্রন্থ হইতে সুর করিয়া আবৃত্তি করিতেছিলেন, তখন গোধূলি ও অন্ধকারের মিলন সম্ভূত সেই দৃশ্যটি নিশ্চয়ই ভারতের কোন উদ্যানে, অথবা সূর্যাস্তকালে কূপের নিকটে, কিংবা গ্রামের উপকণ্ঠে বৃক্ষতলে উপবিষ্ট সাধু এবং তাহার চারিদিকে সমবেত শ্রোতৃবৃন্দ – এইরূপ এক দৃশ্যেরই কৌতুককর রূপান্তর বলিয়া তাঁহার বোধ হইয়া থাকিবে। ইংলণ্ডে আচার্য হিসাবে স্বামীজীকে আর কখনও এমন সাদাসিধাভাবে দেখি নাই। পরবর্তীকালে তিনি সর্বদাই বক্তৃতা দিতেন; অথবা প্রশ্নাদির উত্তর দিতেন। প্রশ্নগুলি সমাগত বহুসংখ্যক শ্রোতৃবৃন্দের মধ্যে কেহ কেহ নিয়মমাফিক উত্থাপন করিতেন। কেবল এই প্রথমবারেই আমরা মাত্র পনর-ষোলজন অভ্যাগত ছিলাম। আমাদের মধ্যে অনেকেই আবার ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। স্বামীজী আমাদের মধ্যে উপবিষ্ট ছিলেন – তাঁহার পরিধানে ছিল গৈরিক পরিচ্ছদ ও কোমরবন্ধ – যেন তিনি আমাদের নিকট কোন্ এক দূরদেশের বার্তা বহন করিয়া আনিয়াছেন। মধ্যে মধ্যে তিনি এক অদ্ভুত অভ্যাসমতো ‘শিব! শিব!’ বলিয়া উঠিতেছিলেন। তাঁহার প্রশান্ত আননে বিরাজ করিতেছিল কোমল ও মহত্ত্বব্যঞ্জক ভাবের সংমিশ্রণ – তাহা সাধারণতঃ ধ্যানপরায়ণ ব্যক্তিদের মুখমণ্ডলে দেখা যায়। সম্ভবতঃ ঐ ভাবই রাফেল তাঁহার দিব্য শিশুর ( Sistine Child -এর ) ললাটে অঙ্কিত করিয়া দেখাইয়া গিয়াছেন।” ( স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি, ভগিনী নিবেদিতা, উদ্বোধন কার্যালয়)
স্বামী বিবেকানন্দের প্রথম সংস্পর্শে আসার অভিজ্ঞতা এমনভাবেই বর্ণনা করেছেন ভগিনী নিবেদিতা। যা অপূর্ব, কবিত্বময়!
0 Comments