জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —২২/সুমিত্রা ঘোষ

লোকমাতা রানি রাসমণি —২২
সুমিত্রা  ঘোষ

উল্লেখ করা হয়েছে রানির তৃতীয়া কন্যা করুণাময়ীর বিবাহ হয়েছিল তৎকালীন হিন্দু কলেজের ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত মথুরামোহন বিশ্বাসের সঙ্গে। নিয়তির অমোঘ বিধানে করুণাময়ী অল্প বয়সে প্রথম পুত্রের জন্ম দেওয়ার পর মারা যায়। পুত্রের নাম রাখা হয় গোপাল। রানি নিজের পছন্দ করা এক মেয়ের সঙ্গে নাতির (করুণাময়ীর সন্তান) বিবাহ দিয়েছিলেন। মেয়েটি খুবই গরীব ঘরের, অল্পবয়সে মাতৃহীনা হয়। পিতা ছাড়া আর কোনো আপনজন ছিল না। মেয়েটির নাম প্রসন্নময়ী।  সকলে প্রসন্ন বলে ডাকত। তখনকার দিনে মেয়েদের লেখাপড়া করতে দেওয়া হত না। সমাজপতিরা বাধা দিত। বলত, মেয়েরা লেখাপড়া করলে সমাজ রসাতলে যাবে। যে কারণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আজীবন নারীজাতির শিক্ষার জন্য লড়াই করে যেতে হয়েছিল। তিনি বর্ণপরিচয় লিখে ভেবেছিলেন ঘরে ঘরে বর্ণপরিচর পৌঁছে গেলে মেয়েদের অক্ষর পরিচয় হবে, লিখতে-পড়তে পারবে। করুণাময়ীর ছেলে গোপাল চাইত মেয়েরা লেখাপড়া শিখে মাথা উঁচু করে চলুক, নিজের বিবাহের পর স্ত্রী প্রসন্নময়ীকে বইপত্তর এনে দিলেন লেখাপড়া করার জন্য। ঐ সময়ে একদিন বিদ্যাসাগর মহাশয় জানবাজারের জমিদার বাড়িতে এসে শুনেছিলেন প্রসন্ন লেখাপড়া করছেন। তিনি একখানা বর্ণপরিচয় এনে প্রসন্নময়ীকে দিয়ে বলেছিলেন, এই বইটি পড়ে আমায় বলবে তোমার কেমন লাগল? নারীজাতির প্রতি অসাধারণ স্নেহ-ভালবাসা না থাকলে তাদের লেখাপড়ার জন্য এমন আকুলতা থাকে না। প্রসন্ন বইখানি পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল।
অপরাপর গুণের মধ্যে রানি রাসমণির এক মহত্তর গুণের অধিকারিণী ছিলেন। সেই গুণটি হচ্ছে তিনি সমাজসংস্কারের কাজে হাত মিলিয়েছেন। এ ব্যাপারে আর এক বিদগ্ধ সমাজ- সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে অদ্ভুত মিল ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র রানিকে পিসীমা সম্বোধন করে তাঁর শ্রদ্ধা-ভক্তি উজাড় করে দিয়েছেন; বিপরীত মেরুতে রানি রাসমণি ঈশ্বরকে অত্যধিক  ভালবাসা দানে তাঁকে প্রীত করেছেন এবং কাছে টেনে নিয়েছেন। দীর্ঘ সাতাশ বছরের ব্যবধান কোন কিছুর তোয়াক্কা করেনি। প্রিয় পাঠকদের কথা মাথায় রেখে এঁদের দুজনের জন্মতারিখ আর একবার উল্লেখ করা হচ্ছে - রানি রাসমণির জন্ম ইং ১৭৯৩ সাল (বাংলা ১২০০ সাল) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম  ইং ১৮২০ সালে উভয়ের মধ্যে  ২৭ বছর বয়সের পার্থক্য।
রানি রাসমণির অশেষ গুণরজির মধ্যে একটি বিশেষ গুণ হচ্ছে তিনি পুণ্যবতী এবং ঈশ্বরে বিশ্বাসী পরিপূর্ণ মানবী। যে কর্মের প্রভাবে রানি রাসমণি গোটা বিশ্বে মহিমান্বিত হয়েছেন  তা হল কলকাতায় দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি বলা যায়। মন্দির প্রতিষ্ঠার আগে থেকে ঈশ্বর তাঁকে নানাভাবে দেখা দিয়েছেন। যেমন গৃহদেবতা রঘুবীরের কথা উল্লেখ করে বলা যায়, সময়ে- অসময়ে রঘুবীর ছদ্মবেশে রানির সামনে আবির্ভূত হয়েছেন। ছেলেবেলা থেকে রানি পূত চরিত্রের ছিলেন। ঈশ্বরচিন্তা-জপ-তপ এসব নিয়মিত তাঁর মনে স্থান করে নিয়েছিল। আর একটা মহৎ জ্ঞান ছিল দরিদ্র জনসাধারণকে নারায়ণ বেশে সেবা করার প্রবণতা। আমরা জানি অভুক্ত - আশ্রয়হীন - রোগক্লিষ্ট মানুষের সেবার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরলাভ হয়। যেকথা শ্রী লোকনাথ বাবা, শ্রী রামকৃষ্ণদেব, স্বামী বিবেকানন্দ, মা সারদা প্রমুখেরা কাজের মাধ্যমে দেখিয়েছেন। কিন্তু সবকিছু জেনেবুঝেও আমরা অবুজ থেকে যাই যার ফলে সমাজের অবক্ষয় বেড়েই চলে।
ক্রমশ
🍂

Post a Comment

0 Comments