পর্ব-৬
সুদীপ সেন
আমাদের চারপাশের দ্রুতগতির জীবনযাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে ছোটার তাগিদে, প্রতিযোগিতা আত্মপ্রদর্শন আর দেখনদারির বর্তমান দুনিয়ায় নিজেদের সাময়িক আনন্দ, রসনা তৃপ্তি বা খুশির খেয়ালে আমরা মনে করছি যে এই পৃথিবীটা তৈরি হয়েছে শুধু আমার একার ভোগের জন্য এবং সেটাও খুব স্বল্পকালীন সময়ের পটভূমিকায় । অন্য কারোর বাঁচা মরার কথা এমনকি সুদূর ভবিষ্যতে নিজের জন্য বা নিজের ছেলে মেয়েদের জন্যও কি বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে সেটা নিয়ে ভাবার সময়ও আমাদের নেই। পরিবেশ ধ্বংসের কাজে আমরা সবাই অনেকটা করেই অংশ নিচ্ছি ( যথেচ্ছ প্লাস্টিকের ব্যবহার এবং অপব্যবহার, অনাবশ্যক বিদ্যুৎ আর জল অপচয়, বাজি পটকা পোড়ানোর মত আত্মঘাতী বায়ুদূষণ, অস্বাভাবিক জোরে মাইক / DJ বাজিয়ে শব্দ দূষণ, যথেচ্ছ গাছ কাটা এবং নতুন নতুন কন্সট্রাক্সন এর ধুলো ধোঁয়া সৃষ্টি ইত্যাদি ) কিন্তু পরিবেশ রক্ষার কাজের কথা উঠলে ‘আমি একা আর কি করতে পারি !’, ‘ওসব ছাড়ো তো, আজ আছি কাল নেই,যা হবার তা হবে’, ‘সরকার এর পরিবেশ দপ্তরের কর্মীরা সব চোখ বুজে আছে’, ‘ধনী উন্নত দেশগুলোই সব থেকে বেশি পরিবেশ ধংস করছে’, ‘যার যা নিয়তি তার তাই হবে, বেশি ভেবে লাভ নেই’, ‘পেটে ভাত নেই, পরিবেশ বাঁচিয়ে কি হবে ?’ ইত্যাদি রকমারি মনগড়া যুক্তির পাহাড় সামনে চলে আসে ।
একে তাকে দোষারোপ না করে, নিজেদের ভবিষ্যৎ দিনগুলো ক্রমশ নিয়তির নামে ভয়ঙ্কর পরিনতির দিকে ঠেলে না নিয়ে ভাবতে হবে যে সবাই মিলে একটু একটু করে যদি পরিবেশ ধংস করতে পারি তাহলে সবাই মিলেই একটু একটু চেষ্টা করলে প্রাকৃতিক পরিবেশ সুস্থও করে তুলতে পারি। আমরাই তো বাঁচবো, তাই জীবনটাকে যতটা পারা যায় আনন্দময় রেখেই বাঁচবো। আর এটাও খেয়াল রাখবো যে আমাদের পরের প্রজন্মের জন্যও সুস্থ পরিবেশেই বেঁচে থাকার পরিকাঠামো রেখে যাবো। বর্তমান প্রজন্মের সবাই যদি শুধু নিজেদের ছেলে – মেয়ের সুস্থ পরিবেশে বাঁচার চিন্তা মাথায় রেখে বর্তমানে কাজ করেন তাহলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে কারন বিশুদ্ধ পানযোগ্য জল – পরিষ্কার দূষণহীন বাতাস – সহনযোগ্য তাপমাত্রা ইত্যাদি এমন এক প্রাণদায়ী বিষয় ( বা প্রাণঘাতী ) যা জাতি – ধর্ম – ভাষা - আঞ্চলিকতা – প্রাদেশিকতা – আর্থিক সামর্থ্য – সামাজিক প্রতিপত্তির গণ্ডির অনেক উপরে এবং সবার জন্য একইভাবে তার সুফল ( বা কুফল) পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে প্রকৃতি কোন রকম পক্ষপাতিত্ব করে না। প্রচলিত কথায় বলে ‘প্রকৃতির মার, দুনিয়ার বার’ । তাই এই দুনিয়ায় টিকে থাকতে হলে প্রকৃতির রোষে পড়া চলবে না।
সবুজ গাছপালা আমাদের বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন সরবরাহের মূল উৎস, অক্সিজেন ছাড়া আমরা মাত্র এক-দুই মিনিটের বেশি বাঁচবো না, সেটা জেনেও বিভিন্ন প্রয়োজনে আমাদের কখনো কখনো কিছু গাছ কাটতে হয়। কিন্তু যদি অপ্রয়োজনে বা বিনোদনের – শখ পূরণের প্রয়োজনে গাছ কাটি ( এবং ক্ষতিপূরণ হিসাবে নতুন গাছ না লাগাই ) তাহলে তো আমরা আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আর আমাদের ছেলেমেয়েদের গ্যাস চেম্বারের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি । মৃত্যুর আগে মানুষ একটু জল খেতে চায় । কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত – পরিকল্পনাহীন ভাবে প্রাকৃতিক জল ব্যবহার ( এবং অপব্যবহার – দূষণ – অপচয় ) করে গেলে আমাদের ছেলেমেয়েরা অক্সিজেনহীন শ্বাসরোধকারী মৃত্যুর মুখে দাড়িয়ে একটু বিশুদ্ধ পানযোগ্য জল কোথায় পাবে ! আর সেই সাথে যদি বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়তে বাড়তে আমাদের সহনশীলতার সীমা অতিক্রম করে যায় তাহলে কি আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য এক অতি উষ্ণ শ্বাসরোধকারী শুষ্ক নির্জলা পৃথিবী তৈরি করে তুলছি না !
বিপদের মোকাবিলায় আমরা অনেক কিছুই করতে পারি। ছোট ছোট কাজ, সবাই করতে পারি আর তার জন্য কাউকে বিরাট কিছু সাক্রিফাইসও করতে হবে না। সবাই মিলে করলে তার সুফল অনেকটাই দেখা যাবে । বোঝার সুবিধার জন্য একটা এরকম কাজের উদাহরণ দিই । আমরা অনেকেই কালীপূজোয় / দীপাবলিতে / বিয়ে বাড়িতে / খেলায় জিতলে / ঠাকুর ভাসানে বাজি - পটকা পোড়াই। বাতাসে গলগল করে বাজির বিষাক্ত ধোঁয়া উগরে দেয়ার ব্যবস্থা করি, আলোর ঝলকানি আর তীব্র শব্দের তাণ্ডবে সমস্ত জীবিত প্রানীর ( নিজের পরিবারের লোক এবং প্রতিবেশিসহ ) প্রান কিছুক্ষনের জন্য দুর্বিষহ করে তুলি এবং নিজেরা খুব আনন্দ পাই। খেয়াল করলে দেখা যাবে এগুলো সবই আমাদের আনন্দের উদযাপন । তাই বাজি পোড়ানর জন্য চোর – পুলিস খেলা শুরু হয়ে যায়, কোথাও বাজি পোড়ানর প্রতিযোগিতাও হয় ( আদতে গ্যাস চেম্বারে শ্বাসকষ্ট নিয়ে মৃত্যুর আহ্বান, তারও আবার প্রতিযোগিতা !), কোথাও কোথাও তর্কাতর্কি মারামারিও হয়ে যায়। আমাদের আজকের আনন্দের উদযাপনে যেদিন আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের শ্বাসরোধী নির্জলা মৃত্যুর ছায়া দেখতে পাবো সেদিন মনে হয় আমরা আনন্দ উদযাপনের জন্য বাজি পোড়ানর মত আত্মঘাতী কাজে লিপ্ত হবো না । বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধের বারুদের ধোঁয়া এমনিতেই মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলছে। তার সাথে শুধুমাত্র ক্ষণিকের আনন্দ উদযাপনের জন্য আরও কালো কালো বিষাক্ত বারুদের ধোঁয়া বাতাসে ছেড়ে সেই ধোয়ার বিষযুক্ত বাতাসে শ্বাস নিয়ে নিজেদেরই ফুসফুসকে ( নিজের স্ত্রী ছেলেমেয়ের/বাবা মায়েরও ) কালো করার আত্মঘাতী কাজে বিরত হওয়ার এখন সময়। আশপাশের সব মানুষকেও বিরত হতে অনুরোধ করার, সচেতন করার এখন সময়। সামনেই কালীপূজো – দীপাবলি, বড় পরীক্ষার দিন। ‘সবাই’ শুধু নিজেরা বাজি পোড়াবো না এইটুকু অঙ্গীকার রক্ষা করলেই, পাড়াজুড়ে রাজ্যজুড়ে বা দেশজুড়ে প্রকৃতিকে রক্ষার লড়াইয়ে একটা বিরাট বিশাল পদক্ষেপ হয়। এই প্রান বাঁচানোর লড়াইয়ে আমরা সবাই সৈনিক, যে যেভাবে পারি যতটা পারি সামিল হতে হবে, তবেই প্রকৃতি বাঁচবে , আমরাও বাঁচবো , আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও বাঁচবে ।
"প্রকৃতি - পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, মানুষ বাঁচলে তবেই বাকি সবকিছু কাজে লাগবে"।
0 Comments