জ্বলদর্চি

নাট্যব্যক্তিত্ব দেবশঙ্কর হালদার-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বাগতা পাণ্ডে

নাট্যব্যক্তিত্ব দেবশঙ্কর হালদার-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বাগতা পাণ্ডে

 কখনও চব্বিশটা কখনওবা তারও বেশি নাটকে অভিনয়। ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতার অধিকারী না হলে তা বোধহয় করা প্রায় অসম্ভব। এমন বিষ্ময়কর প্রতিভাসম্পন্ন অভিনেতার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে যে প্রশ্নটা অবধারিত ভাবেই প্রথমে আসে সেটা দিয়েই সাক্ষাৎকার শুরু।

স্বাগতা পাণ্ডে: ভালবেসে আপনার যে অভিনয় — তার হাতেখড়ি কোথায় ? কার কাছে ?

দেবশঙ্কর হালদার: আমার বাবা অভিনেতা ছিলেন, সেটা একটা বড় ব্যাপার, আমার অভিনয় জগতে আসার এটা একটা কারণ । যেমন সকলের বাবা কোনও না কোনও একটা কাজ করেন, সেই কাজটা তাঁর উপর যেমন প্রভাব ফেলে। সে সেই কাজটা করতেও পারে , আবার না-ও পারে। 
আমার বাবা যেহেতু যাত্রার অভিনেতা ছিলেন তাই আমি জ্ঞান হওয়া ইস্তক অভিনয় বিষয়টা দেখেছি। বাবাকে বাড়িতে বা বাইরে রিহার্সাল করতে দেখেছি। হতেই পারে সেইগুলোই অবচেতনে কোনওভাবে আমার উপর প্রভাব ফেলেছে।

স্বাগতা: আপনার বাবা যেহেতু অভিনয় করতেন, তাই কখনো কি আপনার ছোটবেলায় এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে যে, আপনি পরবর্তীকালে অভিনয় জগতে আসবেন কিনা ? 

দেবশঙ্কর : যেহেতু বাবা অভিনয় করতেন তাই সকলেই জিজ্ঞেস করতেন আমি বা আমরা চার ভাই এক বোন, আমরা কি বাবার লাইনে যাব ? যদিও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা করণিকদের ছেলেমেয়েদের সাধারণত জিজ্ঞেস করা হয় না , যদিও তাঁরা অনেকেই শিল্পের পথে হেঁটেছেন। কিন্তু অভিনয় সংক্রান্ত ব্যাপার হলে, তাঁদেরকে এটা লোকে জিজ্ঞেস করে। যেমন ম্যাজিসিয়ানের ছেলেকে জিজ্ঞেস করা হয়, তুমি নিশ্চয় বাবার লাইনেই যাবে। তেমনি অভিনেতার ছেলেমেয়েদেরকেও 'লাইন' শব্দটা ব্যবহার করে জিজ্ঞেস করা হতো। ছোটবেলায় মাষ্টারমশাইরা, গুরুজনেরা, বন্ধুবান্ধবরাও জিজ্ঞেস করেছেন ।

স্বাগতা: ছোটবেলায় এত বেশি অভিনেতা হবার কথা জিজ্ঞেস করা হয়েছে আপনাকে, এতে কখনো আপনার মনে অন্য কোনো ভাব তৈরি করেনি ? 

দেবশঙ্কর : (অল্প হেসে) হ্যাঁ, ফলত আমার এটাই মনে হয়েছিল, আর যাই করি না কেন, অভিনয় করব না কখনও। অন্যান্য কাজ করব। যেহেতু আমি খেলাধূলা করতাম, তাই ভেবেছিলাম খেলোয়াড হবো। একথা আমি অনেক পত্র- পত্রিকায়, সাক্ষাৎকারে অনেকবার বলেছি। আবার বললাম, রিপিটেশন হবে। পরে একটা সময় ভেবেছিলাম লেখালেখি করব। লেখার চর্চাও করতাম ক্লাস টেন- ইলেভেনে পড়ার সময়।

স্বাগতা: অল্পবয়সে অভিনয় দেখার অভ্যাস আর ভালোলাগাটা কি শুধুমাত্র যাত্রার  অভিনয় দেখা? না কি সব রকম অভিনয়ই দেখা? 

দেবশঙ্কর: যাত্রার অভিনয় দেখা তো আছেই। তবে যাত্রাপালার বাইরে থিয়েটারও দেখতাম। অন্য ধারার থিয়েটার, গ্রুপ থিয়েটার। তখন আমি স্কুলে পড়ি। সেই দেখার থেকেই থিয়েটার সম্পর্কে একটা আগ্রহ জন্মায়। পরবর্তী কালে,  আমি যখন স্কটিশ কলেজে পড়ি, তখন ছাত্র রাজনীতিও করেছি । ভেবেছিলাম সেই কাজটাই করব যেটা সমাজের জন্য ভালো হবে। কিন্তু পরবর্তীকালে ছাত্র রাজনীতি আর করতে পারিনি।

স্বাগতা: অভিনয়ে প্রথম পা রাখলেন কবে, বা প্রথম সশরীরে এলেন কবে ? 

‌দেবশঙ্কর : যখন আমি চাকরি-টাকরি করব ঠিক করে নিয়েছি, তখন 'নান্দীকার' এর একটা ওয়ার্কশপে  গিয়ে পৌঁছেছিলাম। সেখানে চান্সও পেয়েছিলাম। সেই তখন থেকে আজ অবধি সেই কাজটাই শিখছি এবং করছি। এই ভাবেই আমার থিয়েটারে এসে পড়া। এককথায়, একটু হঠাৎ করেই, একটু না আসতে চেয়ে, একটু আচম্বিতে, একটু পূর্বপরিকল্পনাহীন এসে পড়া। কিন্তু একেবারেই যে পূর্বপরিকল্পনাহীন তা বলব না, কারণ ভেতরে ভেতরে অভিনেতার স্পৃহা নিশ্চয়ই কাজ করছিল। এটা হতে পারে, আমার বাবাকে দেখা, আমার আগের থিয়েটার দেখা। এগুলো থেকে ভেতরে ভেতরে কোথাও একটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেই 'মন'টা হয়তো কোনও ক্ষেত্র বা জমি পাচ্ছিল না যে, সেখানে ফসল ফলাবে।  আমি ঠিক করলাম যে কী ভাবে থিয়েটার হয় বা অভিনয় হয়, তার রান্নঘর বা তার আঁতুড়ঘরে যদি একটু ঢোকা যায়। সেই জন্য নান্দীকার-এর কর্মশালা, যেটা অবশ্য হবে ঠিক হয়ে ছিল প্রায় একবছর ব্যাপী। তারই আ্যডভারটাইজমেন্ট দেখি কাগজে, এবং গিয়ে পৌঁছই, এবং সেটার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাই। আর তারপর আর কোনদিন চাকরিও করিনি, অন্য কাজেও যাইনি, থিয়েটারের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছি আর আজ অবধি সেটাই করে চলেছি— এই আর কী! 

স্বাগতা: যে কথাগুলো দিয়ে সাক্ষাৎকার শুরু করেছিলাম, সেই কথাগুলোই আরেকবার বলি। একই সময়ে একই সাথে কখনো তেইশটা কখনো সাতাশটা নাটকে অভিনয় করে চলেন। এ এক অলৌকিক প্রতিভা, এক বিষ্ময়কর বিষ্ময়। আপনার স্মরণশক্তিকে আমি প্রণাম জানাই। কী ভাবে আপনি এতগুলো চরিত্রকে মনের মধ্যে ধরে রাখেন, এর ফর্মুলাটা কী ? 

দেবশঙ্কর: অভিনয় মানে কিন্তু শুধু মনে রাখা নয়। এক সাথে অনেকগুলো স্কিল। মনে রাখাটা শুধু যোগ্যতা নয়। অভিনয়টা এক ধরনের দক্ষতা, শিল্পের ধরন। মানে বলা যেতে পারে যে অভিনয় শিল্পের যে কৃৎকৌশল, সেইটি প্রকাশ করাই হচ্ছে আসল। মনে কিন্তু অনেকেই রাখতে পারবেন যদি সেটা করেন কেউ। মনে রাখার ঊর্ধ্বে একটা জিনিস আছে যেটা, শ্রম এবং সময় এবং আকাঙ্ক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা। তার মধ্যে শুধু মেমোরি নেই, তার মধ্যে শরীর আছে, পরিশ্রম আছে, ঘাম আছে এবং আকাঙ্ক্ষা আছে। এ সমস্তটা মেনেই একটা 'মনে থাকা' । 

স্বাগতা: তাহলে বলা যেতে পারে , মনে থাকার মধ্যে মহড়ার তো একটা ভূমিকা থেকেই যায় ।

দেবশঙ্কর : মহড়া করে অভিনয় তৈরি করলে সেটা শরীরের মধ্যে, মনের মধ্যে, মেধার মধ্যে, রক্তের মধ্যে , স্মৃতির মধ্যে, স্বপ্নের মধ্যে সেটা থেকে যায়। মনে যদি রাখতে চায় কেউ, তবে রাখতে চাইলে তো তাকে  জায়গা করে দিতে হবে, তবে সেই জায়গা করে দিতে গেলে, একটু ধাক্কাধাক্কি হবে ভেতরে। তবে মনের বা হৃদয়ের ক্ষেত্রটা অনেক বিস্তীর্ণ। তবে এর কোন ফর্মুলা আমি জানি না। তবে মনে রাখাটা কোনও বিষয় না, মনে সবাই রাখতে পারে। তবে প্রত্যেক দিন অভিনয় করা, এটাই হচ্ছে আসল। এবং সেটাকে শ্রম,  দক্ষতা দিয়ে পুনর্নির্মাণ করতে হয় প্রতিদিন। আর সেই কাজটা করে আমি আনন্দ পেয়েছি, করতে পেরেছি। আর সেই প্রকাশটা চলে কখনও ২৩ টা, কখনও ১৭ টা, কখনও ২৭ টা, কখনও ১২ টা হয়, এই রকম ভাবেই চলে। এবং এদেরকে কখনও ত্যাগ করিনি, অন্য কাজ করতে গিয়ে। মনে রেখেছি এবং আমার স্বপ্নের মধ্যে রেখেছি । 

স্বাগতা :  আপনার সৃষ্ট কোন চরিত্রটি তথা কোন কোন নাটকগুলো আপনার মনের খুব কাছের? 

দেবশঙ্কর : এই প্রশ্ন আগেও আমাকে একাধিক বার করা হয়েছে। এই তালিকা আমি আগেও করতে পারিনি। সব কটা নাটকই প্রিয়, তা না হলে আমি লালন- ই বা করছি কেন । তবে কিছু কিছু নাটক সামগ্রিক ভাবে, মানে শুধু আমার অভিনয়-এর কারণে নয়, সামগ্রিক ভাবেই মানুষের মনের কাছে বেশি জনপ্রিয়তা বা সংযোগ তৈরি করতে পেরেছে। এখনও মানুষজন আমাকে চিহ্নিত করে 'রুদ্ধসঙ্গীত'-এর দেবব্রত বিশ্বাস বলে, 'নিঃসঙ্গ সম্রাট'-এর শিশির ভাদুড়ী বলে, 'উইংকেল টুইংকেল'-এর সব্যসাচী সেন বলে , 'বিলে' নাটকের বিবেকানন্দ বলে, 'ফুড়ুৎ'-এর রাজা বলে এই আর কী । মানে যার যার পছন্দ অনুযায়ী বলেন। কিন্তু বেশ কিছু নাটকের চরিত্রায়ন, নির্মাণ আমার কাছে দামী বলে মনে হয়। অন্য নাটক যেগুলো কম প্রচারিত সেগুলোতেও যখন অভিনয় করি, আমার কাছে ভীষণ প্রিয় বলে মনে হয়, সেই ভাবেই তাদেরও নির্মাণ করি ।

স্বাগতা : চলচ্চিত্র আপনার অভিনেতা জীবনের আরেকটি স্তম্ভ। চলচ্চিত্র ও নাটক এই দুটিকে ঠিক কি ভাবে আপনি দেখেন? 

দেবশঙ্কর : চলচ্চিত্র একটা অন্য মাধ্যম। নাটক ও চলচ্চিত্র দুয়েই অভিনয় করতে হয়। এবং এই দুইয়ে অভিনেতা নিজেকে প্রকাশ করেন। তবে নাটকে নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া অনেক তীব্রভাবে তৈরি হয় বলে মনে হয়। দুটো মাধ্যমেই এখনও শিখতে শিখতে যাই, বুঝতে বুঝতে যাই । তবে চলচ্চিত্র ও নাটক এই দুটো মাধ্যম যেহেতু আলাদা তাই সেই প্রয়োজনীয়তা বুঝে অভিনয় করার চেষ্টা করতে হয়। তাই কখনও পারি কখনও পারি না , এই আর কী ( মৃদু হাসি)।

স্বাগতা : এবার আপনার লেখা সম্পর্কে দু একটা কথা শুনব। 

দেবশঙ্কর :  আমি খুব একটা লিখতে-টিখতে পারি না। আসলে লিখতে গিয়ে দেখেছি, মন একরকম ভাবে বলে-ভাবে , আর লিখতে গিয়ে দেখি,না কলম থেকে যে শব্দগুলো বেরিয়ে এলো সেগুলো আরেক দিকে যেতে চায়। তারপর তাকে মুক্তি দিলে সে আর একরকম ভাবে গড়ে ওঠে। 
তবে আমি সত্যি কথাই বলছি, লেখায় আমি খুব দক্ষ নই । তবে ছোটদের জন্য নাটক লিখেছি, বড়দের জন্যও দু- একটা লিখেছি বা অনুবাদ করেছি। নাটক আমি খুব বেশি লিখতে চাইনি কোনওদিন, কারণ অভিনয় করতে চেয়েছি বলে। এর বাইরে কচ্চিৎ-কদাচিৎ কবিতা চর্চাও করেছি কম বয়সে। কিন্তু এখন আর ওই ভাবে করি না। তবে এখন আমার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছি অনেক জায়গায়। কখনও বা বিশেষ একটি বিষয় নিয়ে আমার অনুভবকেও প্রকাশ করেছি । তবে সেগুলো একেবারেই অনুভব নির্ভর। তবে লিখতে বসে লিখব বলে কিছু লিখতে পারি না।

স্বাগতা :  কবিতার কথা যখন এলো, তখন আমি নিজে একজন বাচিক শিল্পী হিসেবে জানতে খুব ইচ্ছে করছে আবৃত্তি বা আবৃত্তি চর্চা নিয়ে কখনো কিছু করার কথা ভেবেছেন? 

দেবশঙ্কর : কবিতার ক্লাস কোনওদিন করিনি। কবিতা পড়েছি। অভিনয়ে উচ্চারণগত দিক ঠিক রাখার জন্য কবিতা পড়তে হয়, এবং নিজের কানে নিজেকে শুনে, নিজেকে প্রকাশ করতে হয়। কিংবদন্তি শম্ভু মিত্র, তিনি তো শুধু আবৃত্তিকার নন, তিনি অনেক বড় শিল্পী। তাঁদের সব শুনেছি , মানে বুঝবার চেষ্টা করেছি, নকল না করে নিজের মতো কিছু প্রকাশ ভঙ্গি তৈরি করার চেষ্টা এখনও করি। আমি আবৃত্তিকার নই। আমি কবিতা পড়তে ভালবাসি। মাঝে মাঝে জোরে উচ্চারণ করে পড়ি, তবে সবটাই আমার অভিনয়ের জন্যই করি ।

স্বাগতা : আপনার এই সাক্ষাৎকার আমাকে ব্যক্তিগত ভাবে ঋদ্ধ করলো। আমার নিজের পক্ষ থেকে এবং জ্বলদর্চির পক্ষ থেকে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। একেবারে শেষ প্রশ্ন আপনার কাছে। জ্বলদর্চির জন্য কি বার্তা দিতে চান ? 

দেবশঙ্কর : জ্বলদর্চি নিজের মত করে কাজ করছে। এই পত্রিকার অভিমুখ ও রূপরেখা তাঁরা যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান, সেই উদ্দেশ্য সফল হোক, সত্য হোক, সুন্দর হোক। আমি চাইব যে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, তাঁরা আজকের দিনের কথার সঙ্গে অতীত ও ভবিষ্যৎ এর প্রকাশ হাত ধরাধরি করে সুন্দরের দিকে এগিয়ে যেতে পারবেন। তাঁরা নিশ্চয়ই সেই ভাবেই হাঁটছেন।

🍂
ad


Post a Comment

0 Comments