কথাসাহিত্যিক নলিনী বেরা-র সাক্ষাৎকার
অখিলেশ সুর
অখিলেশ সুর : আপনার গ্রামের নাম বাছুরখোঁয়াড় হলো কেন?
নলিনী বেরা : আমার গ্রামের নাম জন্মাবধি শুনে আসছি বাছুরখোঁয়াড়। শৈশব থেকে দেখেছি আমার গ্রামে সরকারি পশুরখোঁয়াড় ছিল। যে সব গৃহপালিত পশু শস্যের ক্ষতি করতো, তাদের ধরে এনে ওই খোঁয়াড়ে পোরা হত। ক্ষেতমালিকই জমা করতেন। সেই গবাদি পশু —গরু, বাছুর, ছাগল, ভেড়া,শূকর ইত্যাদি। পশুপিছু জরিমানার রেট দিন ঘণ্টা পিছু বোর্ডে লেখাও থাকতো। উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ বা জরিমানা দিলে তবেই সেই পশু ছাড়া হতো। ঠিক সেই কারণে কিনা জানি না, তবে এরকম একটা কারণ হলেও হতে পারে।
অখিলেশ : শৈশবে পড়াশোনা কিভাবে করেছেন? ওই সময়ের কোনও স্মৃতি আছে?
নলিনী : শৈশবে আমার গ্রামের নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়। পরে আমাদের পাঠরত অবস্থায় নাম হয় প্রি প্রাইমারি স্কুল। একবার একটা গ্রুপ এসে আমাদের স্কুলে ফিল্ম দেখানোর আয়োজন করেছিল। কিন্তু তখন সেই বিদ্যালয় খুব ফাটাফুটো ছিল। ভাঙাচোরা, মরচেধরা। কাঠের দরজা-জানালাও ভাঙা ছিল। সিনেমা দেখানোর জন্য একটু অন্ধকার ঘর দরকার ছিল। আমরা সেই স্কুলঘরকে অন্ধকার করার জন্য গাছের ডালপালা এনে জানলা ঘিরে দিয়েছিলাম, কিন্তু তাতেও অন্ধকার হলো না। তখন হেড মাস্টারমশাই পাশের এক গৃহস্থ বাড়ির সুবৃহৎ গোয়ালঘরে সিনেমা দেখানোর জন্য ব্যবস্থা করেন। সেই সিনেমা নাম ছিল 'পথের পাঁচালী'।
অখিলেশ : আপনি সাহিত্য জগতে প্রবেশ করলেন কীভাবে?
নলিনী : নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা থেকেই আমার সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আমি প্রত্যন্ত গ্রামে থাকতাম। শিক্ষিত মানুষ ছিল না। বড়জোর এখানে ফোর পাশ করতো। তারপর পড়ার মতো কোনও বিদ্যালয় ছিল না। এমনকি আমার বিদ্যালয়ের মাস্টারমশাই ছিলেন এম. ই.পাশ। অর্থাৎ মাইনর এডুকেশন। কিন্তু গ্রামে কথকতা, রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত ইত্যাদি পাঠ করা হতো। এই সব পাঠ করার জন্য আমার ডাক পড়তো। এমনকি অগ্রহায়ণ মাসে প্রতি বৃহস্পতিবার, প্রতিটা ঘরে ঘরে গোময় দিয়ে নিকানো হতো, আলপনা আঁকা হতো, প্রদীপ জ্বালা হতো, পিঠে পুলি হতো এবং গভীর রাতে বৃহৎ লক্ষ্মী চরিত্র পাঠ হতো। তাতে বিনন্দ রাখালের পালা, রতু কাঠুরিয়া পালা ইত্যাদি গল্প কাহিনি ছিল। শুদ্ধাচার পালনের সঙ্গে সঙ্গে এই সব কাহিনিও খুব মন দিয়ে শুনতাম। আমি এঘর ওঘর ঘুরে পাঠ করতাম। আমার বাবা চাষাবাদ করতে পারতেন না। কারণ, উনার একটা হাত প্রতিবন্ধী ছিল। কিন্তু আমার বাবা এই সব পাঠ করতেন অত্যন্ত মিস্টি সুরে যা এখনও আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। পুঁথি পাঠ ও ব্যাখ্যা করতেন অতি সুন্দর ভাবে। যার দু একটা পদ এখনও আমার মনে আছে-" আলো জ্বালি দেখো এবে যাজ্ঞসেনী সতী, তোমা হিন্চে কীচকের এহেন দুর্গতি।"তেমনিভাবে - "মহাভারতের কথা অমৃত সমান কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।" শীতকালে প্রচণ্ড শীতে বাবাকে আঁকড়ে জড়িয়ে ধরে আছি একটু উষ্ণতার জন্য। ছেঁড়া কাঁথা গায়ে দিয়ে, দড়ির খাটিয়ায় শুতাম। ভোরবেলা বাবা ঠেলে তুলে দিতেন। তারপর লাল শালু কাপড়ে বাঁধা পুঁথি খুলে পাঠ করতেন। পাঠের আগে একটা সুর ভাঁজতেন। সেই সুরটা অদ্যাবধি আমার হৃদয়ের অন্তঃস্থলে গেঁথে আছে। হে গোবিন্দ, হে গোবিন্দ, হে গোবিন্দ হরে। কৃপা করো রমা নাথ মুকুন্দ মুরারে।" এইগুলো ছিল আমার সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির উপাদান। এই সুরে আবার মহাভারত পাঠ করতেন। এই সব আমাকে সাহিত্য চর্চার অনুপ্রেরণা দেয়। তারপর তো বড়ো স্কুলে ভর্তি হলাম। পাঠের আগ্রহ জাগল। পাঠ্য বইয়ের গল্প ছিল। পি কে কে দে সরকার -এর গ্রামার ছিল আমাদের। তাতে ট্রান্সলেশন অংশে বাংলা উদ্ধৃতি থেকে ইংরেজি করতে হতো। সেখানেই অনেক গল্পের উপাদান, গল্পাংশ ছিল। যেমন - সন্ন্যাসী গৃহে প্রবেশ করিয়া কহিলেন, মৃত্যুঞ্জয় তুমি কী চাও? মৃত্যুঞ্জয় কহিল আমি কিছুই চাই না, আমি এই অন্ধকার হইতে, এই সুড়ঙ্গ হইতে, মুক্তি চাই, আলোক চাই। এই সব টুকরো টুকরো গল্পাংশ আমার হৃদয়ে এতোটাই গেঁথে যেতো, পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে যেত। কলেজ লাইফে, ইউনিভার্সিটি লাইফে, চাকরি জীবনে এগুলো বেশি করে প্রভাব বিস্তার করে। এইভাবে বোধহয় সাহিত্য জগতে প্রবেশ করি।
অখিলেশ : আপনার প্রকাশিত প্রথম গল্প কি?
নলিনী : প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তখন দেশ সাপ্তাহিক ছিল। ১৯৭৯ সালে আগষ্ট মাসে। তখন আমার মতো আনকোরা লেখকের লেখা দেশ-এ প্রকাশ হতো না। কী করে যে আমার গল্প প্রকাশ হলো, আমি জানি না। গল্পটা ছিল 'বাবার স্মৃতি।' গল্পটি প্রভূত প্রশংসা পেয়েছিল। প্রচুর চিঠিপত্র এসেছিল।
অখিলেশ : আপনার শবর চরিত, সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা, ফুলকুসমা, কুসুম তলা, হলুদ বনের টুসু - এগুলো বাংলার জঙ্গল মহলের অন্ধকার থেকে তুলে আনা কাহিনি। কেন আপনি জঙ্গল মহলের গভীরে প্রবেশ করতে গেলেন?
নলিনী : গ্রামের দেখা জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা তো ছিল, যখন লেখালেখি করতে শুরু করি, তখন এইসব অভিজ্ঞতা ছবির মতো ফুটে ওঠে।
অখিলেশ : ঝিঙা ফুল কাঁকুড় ফুল, আম ফুল জাম ফুলের দেশ, কুসুম তলা, রোদনের ভাষায় জঙ্গল মহলের গোপন জীবনযাপনকে তুলে ধরেছেন। এই নিবিড় অনুশীলনের সুযোগ কীভাবে পেলেন?
নলিনী : আমি তো গরু বাগালদের সঙ্গে ঘুরতাম। ওদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম বনে জঙ্গলে। সেই ঘোরাঘুরির সুবাদে এইসব উপাদান সংগ্রহ করেছি।
অখিলেশ : জঙ্গল মহল এখন আদিবাসী ও কুড়মী সম্প্রদায়ে রাজনৈতিক ভাবে বিভাজিত। এই বিভাজনের ভবিষ্যত কী?
নলিনী : এটা তো জাতীয় বিষয়। এই সব আদিবাসী ও মাহাতো সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমার শৈশব কৈশোর জীবন কেটেছে। এরা জঙ্গলে পাশাপাশি থাকেন। ইংরেজদের সময় মাহাতোরা আদিবাসী হিসেবে বিবেচিত হতো। মাঝখানে আদিবাসীদের বাইরের জাতি হিসেবে থাকতে পছন্দ করতেন। আবার এখন দেখছি ওরা আদিবাসী হিসেবে বিবেচিত হতে চাইছেন। এর মধ্য দিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব আমি দেখছি না। কিন্তু দেশের সরকারকে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। দাবি দাওয়া থাকতে পারে, কিন্তু তাই নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি হয়নি এখনও। মনিপুরে একই রকম সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তবে এখানে মনিপুরের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আমি তো আজকেও একটি আদিবাসী গ্রামে ঘুরে এলাম, কোনও সমস্যা চোখে পড়লো না।
🍂
অখিলেশ : জঙ্গল মহলের বিশাল সাম্রাজ্য। ছোটনাগপুর মালভূমি পেরিয়ে বিন্ধ পর্বতমালা। এই বিস্তৃত জীবনের অবহেলিত মানুষের জন্য আপনার বার্তা কি?
নলিনী : ভারতবর্ষের এটা একটা জ্বলন্ত সমস্যা। এই তথাকথিত অন্তজ সম্প্রদায়ের মানুষ তো আশি ভাগ। অথচ আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা পড়েছি - অনার্য ভারতের কাছে আর্য ভারত নুয়ে আছে। জঙ্গল মহলের যা চিত্র চরিত্র, তা অন্যান্য রাজ্যেও একই রকম। দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন যাপন।
অখিলেশ : আপনার কবিতা ভারতবর্ষ, কীর্তনখোলা, সুবর্ণ রেখা, টেলিফোন, আড্ডাবাজের জীবন, চন্দ্র পূজা, চাঁদের জন্যই প্রভৃতি এক একটি গল্প । কবিতাকে কাহিনি দেন কী করে?
নলিনী : না, ওগুলো ঠিক গল্প নয়, এক একটি চিত্রকল্প।
অখিলেশ : বাংলা সাহিত্য জঙ্গল মহলের কাছে কতখানি ঋণী?
নলিনী : এইসব আদিবাসী, বনবাসীদের নিয়ে বাংলা সাহিত্য তেমন চর্চা করেনি। মহাশ্বেতা দেবী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা বুদ্ধদেব গুহর মতো বিচ্ছিন্ন কয়েকজন সাহিত্যিক ছাড়া তেমন কেউ লেখালেখি করেননি। এখন একটা ট্রেন্ড এসেছে এইসব মানুষদের নিয়ে লেখার।
অখিলেশ : আপনি নিজে ছোট পত্রিকা থেকে উঠে এসেছেন। বর্তমান বাংলা সাহিত্য চর্চার জন্য ছোট পত্রিকার ভূমিকা কতটুকু?
নলিনী : লিটল ম্যাগাজিন বাংলা সাহিত্যের বড়ো অংশ ধরে রেখেছে। বড় পত্রিকা বাণিজ্য নিয়ে চিন্তা করে কিন্তু বাণিজ্য দিয়ে তো সাহিত্য হয় না। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের বুকের পাটা আছে, সাহসী পদক্ষেপ নেবার। তাই লিটল ম্যাগাজিনের গুরুত্ব বাংলা সাহিত্যে একেবারেই উঁচু তলায়।
অখিলেশ : বর্তমান ডিজিটাল পাঠকদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
নলিনী : বিজ্ঞানের যুগে এটা মেনে নিতে হবে। আমরা তো এক সময় প্রচুর রেডিও শুনতাম। তাতে কি সাহিত্য চর্চা কমেছে? প্রসঙ্গত বলি — আলেকজান্দ্রিয়াতে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো লাইব্রেরি আছে। যেখানে এখনও পাঠকের সংখ্যা বাড়ছে। প্রযুক্তি সাহিত্যের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি।
অখিলেশ : শেষ প্রশ্ন করি, বর্তমান বাংলা সাহিত্য কি যৌনতাকে অধিক প্রশ্রয় দিচ্ছে ?
নলিনী : না না, সাহিত্যে যৌনতা প্রাচীন কাল থেকেই আছে। রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গল কাব্যতেও ছিল। এবার এটাকে সাহিত্যিকরা কীভাবে কাজে লাগান, সেটার উপর নির্ভর করছে।
অখিলেশ : লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের প্রতি আপনার পরামর্শ?
নলিনী : আর একটু যত্ন নিয়ে, লেখাগুলো একটু খুঁটিয়ে দেখে প্রকাশ করলে ভালো হয়।
0 Comments