বাগদি চরিত ( ত্রয়োত্রিংশতি পর্ব )
শ্রীজিৎ জানা
খুদা গুণীনের মনসামন্দির প্রতিষ্ঠার আয়োজন ধুমধাম করে শুরু হয়। সেদিনের মিটিংয়ে তেমনভাবে গন্ডগোল হয়নি। দু'একবার তেড়ে তেড়ে উঠেছিল খুদা আর লোখা। সাগরী তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় গলা তাড়তে শুরু করে দ্যায়। ময়নাও পাল্টা তর্ক করতে ছাড়ে না। খুদা বার কয়েক সাগরীকে দাবড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সাগরী তার ধমকানিকে গ্রাহ্যই করে না। উল্টে খুদার উপরে এক চোট নেয়,
—তুমি এগদম মোকে থামাবেনি। অরা যাই বোলবে, মোদের দিকে তাই শুনে লিতে হবে নাকি! তমাকে ম্যা-মিয়া পেইচে বোলেই ত অরা চেপে বোসচে।
—কে কাদের উবরে চেপে বোসচে, সেটা গেরামের লোকেরা জানে। মোদের ত আর লোকবল নাই।
— কি কোরে থাকবে লো? তোর ভাতারের গুণে ত গেরামের কেউই তোদের মুখে ম্যাটা লাগায়নি।
— মোদের নাইলে মুখ খারাব,আর তমার! তমার মুখের কথা আর কারো জানতে বাকি নাই। শিকড়বাকড়ের ভয়ে কেউ কিছু বোলেনি বোলে। কত লোকেকে ত তমরা ওষুদ কোরে মুখ বন্ধ করে দিচু। কত লোককে ত বান মেরেচু লোকে জানেনি মনে করেচু।
— অমন কথা কুন বেদা গুরবেটারা বলে?,তাদের সব্বনাশ হবে লো। তাদের কে খরিশে চটাবে লো। সন্ধাবজ্জর তার মাথায় পোড়বে। কুন বেটাখেকারা বলে লো? কুন ঝি-খাকিরা বোলে লো?
—কি গো এখন শুনতে পাওনি? এই ভর সন্ধাবেলা বেটাঝিয়ের মাথা যে খায়ঠে তমরা কি কিছু বোলবেনি?
ময়না একবার লোখার দিকে চেয়ে, একবার লোকজনদের দিকে চেয়ে জানতে চায়। ময়না জানে সাগরীর সঙ্গে মুখের দৌড়ে পেরে ওঠা খুব মুশকিল। তার উপরে গ্রামের খগেন মাস্টার সহ পার্টির লোকজন আছে। তাদের কাছে অভাষা কুভাষা সে কখনোই মুখে আনতে পারবে না। তার ঝগড়া করবার দক্ষতা তেমন একটা নেই বললেই চলে। ময়নার সেজ জাও তেমন মুখরা নয়। তার উপরে স্বামী তার নিরুদ্দেশে যাওয়ার পর থেকে ক্যামন যেন হাউড়ির মতো চুপচাপ থাকত। লোখার উপরে অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল। ময়নাও তার জাকে কখনো দুই দুই করত না। তবে বছর দেড়েক হল আরতির ভাবগতিক ভাল ঠেকছে না ময়নার চোখে। লোখাকেও সে বলে আরতির চালচলনের কথা। লোখা কিছুতেই কোন কথা কানে নেয় না। উল্টে ময়নাকে ধমকধামক করে।
— কার নামে কি বোলুঠু,জানু? সেজ বৌদি কুনু দিনও ওরকম নয়। তোরা মেইয়া জাত,তোদের মনটাই ছোট।
— হ্যাঁ,মোর মন ছোটই ত। কিন্তু যেদিন হাটে হাঁড়ি ভাঙবে সেদিন বুজবে। লোকে বোল্লে বিশ্বাস কোত্তম নি। অনেকবার মোর চোখে পোড়েছে। পথমে নিজেই বিশ্বাস কোত্তম নি। কুন্তু পরে এগদিন নিজের চোক্ষে দেখেছি।
— তোর রাতচরা স্বভাবের নাম লুকি ছাড়ব এগদিন, দেখবি! লোজ্জাও করেনি তোর নিজের জা - ভাসুরের দিকে নজর রাখা।
— কিসের লোজ্জা? অ্যাগ ঘরে থেকে বেলেল্লাপনা কোরবে,বেভিচার কোরবে আর আমরা চোক বুজি থাকবো? তাবাদে একটা কথা তুমি ভেবে দেখ দিখি, আগে তমার সেজ বৌদির মোদের দিকে ছাড়া চোলত নি। কুন্তু এখন ক্যানে আলাদা খায়? আলাদা চাষবাস করে?
— বেশ করে। তার পসায়নি,সেই জন্নে আলাদা থাকে। তায় তোর গায়ের জ্বালা কেনে? সে যেমন বুজচে তেমন কোচ্চে।
— সে নিজে থিকে বুজেনি,তাকে বাজাচ্ছে। কথায় আছে নি, সাপ কাটলে বিষ নামবে কুন্তু মানুষ কাটলে বিষ নামবেনি। তমার সেজ বৌদিকে লাচাচ্চে,বুজতে পারনি!
—নাহ্,বুজতে পারিনি। মোর বুজার দরকার নাই। তোদের জাতটাই এরকম। শুকুনের মত সুদু ভাগাড় খুঁজা।
— আচ্ছা,মোকে আজগে ত তুমি নানাস্তানি কোচ্চ,এগদিন তমাকে হাতেনাতে পমাণ করি ছাড়ব। নাইলে মোর নাম ময়না বাগদি নয়।
🍂
ময়নার আর সাগরী যখন ঝুনেপুনে ঝগড়া করে আরতি তখন চুপ থাকে। নিজে কোন উত্তর করে না। এমনকি দুই জা'য়ের কাউকেও থামাতে এগিয়ে আসে না। ময়না আশা করেছিল,হয়তো আরতি তার কথায় সায় দেবে। কিন্তু আরতির নীরবতায়, সে ভিতরে ভিতরে রাগে গরগর করে। তার মনের ভিতরে যে ধারণা আবছা হয়ে ছিল, তা আরতির আজকের আচরণে ময়নার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। আরতির অমন চুপ থাকাটা লোখারও চোখ এড়ায় না। ওই পরিস্থিতিতেও তার মনে ময়নার কথাটা ভেসে ওঠে। তার মনকেও ভাবতে বাধ্য করায়,
—সত্যিই কি তবে সেজ বৌদি তার মেজদার সঙ্গে আছে! তবে কি ময়না ঠিকই বোলেছে!
সে বউয়ের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট পায়। নিরীহ বউটাকে তার এভাবে অপদস্থ হতে দেবে না সে। এবার লোখা নিজেই নামে রণাঙ্গনে।
— দাদা,তোর বউকে থামতে বল,নাইলে একটা খুনখারাপি হই যাবে।
— বোলু কিরে! তুই আগে তোর বউকে থামা। সাগরী ত অনাজ্জ বলেনি। কাদের দিকে আমরা ওষুদ করে মুখ বন্দ কোরেচি আজগে মিটিংয়ে পমান দে। যেদি দিতে পারু পাঁচ জনের জুতা দাঁতে কোরে গেরামে ঘুরব।
—তাবলে তোর বউ যা খুশি গাল পাড়বে! শাপশাপান্ত কোরবে!
সাগরী এবার ময়নাকে ছেড়ে লোখার উবরে ভীমরুলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে।
— তুই চুপ কর কুরকুটা লাউঠা। মোদের আয় উন্নতি দেখে ত জোলেপুড়ে মোরুঠু। অই জন্নে ত পেছানে লেগেচু। কিচ্ছু কোত্তে পারবিনি মোদের। মাথার উবরে মা আছে। মোদের বাঁকা বালকে সজা কোত্তে পারবিনি কুনুদি।
— তাবলে কি তরা মাগ-ভাতারে যা কোরবি মেনে লুব নাকি। বাপের ভিটায় সমান অধিকার। কে হে তমরা লাটের বাঁট! নিজেদের পছন্দ মত চারচৌকা জাগা লিয়ে লিবে! আর বোলতে গেলেই বোলবে নেয়াঙড়ি করিঠি! মেকান পেইচু!
এবার খুদাও তার গলা তাড়তে শুরু করে।
— তোর একার গায়ে হিং লেগেচে ক্যানে। অই ত দাদা বোসে আছে,সে ত কিছু বোলেনি। সেজ বৌদি ত বাধা দেয়নি।
— দাদা ক্যানে দিবে? উ ত ভদ্দর লোক। চাগরিবালা। ভিটাবাস্রু বিকে দিয়ে পালি যাবে। মোকে ত ছেনা- বউ লিয়ে থাকতে হবে। মোর ভালমন্দটা ত মোকেই বুজতে হবে।নেজ্জ কথাটা বোলচি বোলেই কুরকুটা হইঠি। আর তুই ত মা মনসার ভক্ত থাইলে তুই এমন কোরুঠু ক্যানে। তোর বউকে নাকি আবার মা মনসা ভর করে। তোদের মুখের যে ভাষা,তোদের যে চোজ্জা মা মনসা ভর করে নাকি লোককে পেলকান দেখাও কে জানে।
— তুও ত হরিনাম কোরু। থাইলে তোর মুখের ভাষা কেন অমন। নিজেকে আগে বিচার কর। চালনির পঁদ ঝরঝর করে, চালনি ছুঁচের বিচার করে। সেই ধারা তোর হইচে।
এতক্ষণ ধরে ঝন্টু কটাল কোন কথা বলছিল না। খগেন মাস্টার সহ বাকিরাও চুপচাপই ছিল। কিন্তু এবার প্রথম ধমকানিটা ঝন্টুর কাছ থেকেই আসে,
—তরা কি ন্যাংটামির হাটবাট পেইচু নাকি – বল দিখি? মোদের দিকে ডেকে নিজেরা কাউচান লাগিচু। অ্যার পরে যেদি একটা কথা বলেচু তরা, তবে সবাই আসন ছেড়ে পালি যাব। কুনু সমাধান হবেনি। দেখি তরা কিভাবে ডিসিজান লেউ। তুমি কি বোলছো, মাস্টারদা?
বাধ্য হয়েই খগেন মাস্টার মুখ খোলে। ঝন্টুর কোন কথায় তার সায় দিতে বিরক্ত লাগে। কিন্তু এই মুহূর্তে ঝন্টুর কথাকে সমর্থন করাটাই সঠিক হবে। অগত্যা ঝন্টুর কথার সঙ্গে নিজের কথা জুড়তে বাধ্য হয়। স্বাভাবিক ভাবে লোখার দিকে চেয়েই খগেন মাস্টার কথা ছুঁড়ে দেয়।
—ইটা ত ঠিক কথাই বোলচে ঝন্টু। তরা যেদি কাউচান কোরবি,থাইলে মোদের দিকে ডেকেচু ক্যানে? তোদের মুরগি লড়াই দেকতে ত আমরা আসিনি। তরা থামবি নাকি বলে দে, নাইলে সত্যিই মোদের পালি যেতে হবে।
—যে যার বউকে আগে তরা থামা। মেইয়া মানুষরা হাউসে কুনু কথা বোলবেনি। দরকার পোল্লে তখন জিগাস কোরবো।তার আগে এগবারে টুডুব বন্দ থাকবে। বোলে দিলম।
ঝন্টু কোটাল লোখার চেয়ে বয়সে ছোট। তবু সে তুই তুকারি করেই তার সঙ্গে সবদিন কথা বলে। কিন্তু খুদা গুনীন ঝন্টুর চেয়ে অনেক বড়। তাই লোখা বুঝতে পারে ঝন্টু তাকেই টার্গেট করে কথাগুলো বলছে। লোখা ছাড়বার পাত্র নয়।
— ঝোন্টা তুই কি মোকে আর মোর বউকেই থামতে বোলচু।নাকি সবাইকেই বোলচু।
— ক্যানে তোর কি মনে হয়ঠে যে তোকে টার্গেট কোরে কথা বোলিঠি। হাউসে তুই হউ আর খুদাদ্দা হউ,মোর কাছে সবাই সমান। মোর কাছে কুনু কেটাফেরাস কথা পাবিনি। চুপ কোত্তে বোলচি মানে উভয়কেই চুপ কোত্তে হবে।
কথাটা শেষ করেই আড় চোখে তাকায় সাগরীর দিকে। সেই তাকানোর ভাষা শুধুমাত্র সাগরী জানে। এরকম চাউনির সাথে সাগরী এই কদিন ধরেই পরিচিত হয়ে আসছে। ঝন্টু কটাল যতবার তাকিয়েছে তার দিকে,ততবার তার সারা গা কেমন শিরশির করে উঠেছে। ছেলে মেয়ে বড় হলে কি হবে। সাগরীর শরীরের আড়নগড়নে তেমন একটা ভাঙন ধরেনি। চামড়ায় এখনো বয়সের রেখা ফুটে ওঠেনি। বুকের স্ফীত মাংসপিণ্ড এখনো ধারালো ছুরির মতো। এখনো তার ভিতরে শিলাইয়ের বানবন্যার জলের প্রবল তোড়। সেই জলের স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে যেকোন দক্ষ ডুবুরিকেও। খুদা তার জলের তোড় সামলাতে পারে না। কিন্তু বাঁধ ভেঙে সেই ক্ষুধার্ত জলরাশি বাইরেও এতদিন বেরোতে পারেনি। হঠাৎ ঝন্টুর অমন চাউনি যেন এতদিন পর সাগরীকে বেসামাল করে দেয়।
0 Comments