জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা /পর্ব- ১৮/গৌতম বাড়ই

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ১৮
গৌতম বাড়ই

সেই বীরাঙ্গনা বঙ্গেশ্বরের কন্যা, আমাদের সুদূর ইতিহাসের অন্ধকারে ঢেকে থাকা পৌরাণিক গল্পকথার রাজকন্যা সুসীমা প্রবল তেজশালী সিংহরাজের সাথে গুহাবাসে তার দিন কাটাতে লাগলো। সুশোভনবাবু বসন্তসেনাকে জিগ্গেস করলেন- " বলতো হাসনু মা এই সুসীমার পৌরাণিক গল্পকথা এলো কোথা থেকে? " 

বসন্তসেনা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললে- " হ্যাঁ বাবা জানি।" 

সুশোভন বললেন-" বল দেখি মা।"
 
বসন্তসেনা বলতে শুরু করল-" পালি ভাষায় দ্বীপবংশ ও মহাবংশ নামক প্রাচীন বৌদ্ধ পুরাণ গ্রন্থে সুসীমার  এই কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে।  তার কিছুটাও যদি  ঐতিহাসিকভাবে সত্য হয়, তাহলে বলতে হয় যে, এ ইতিহাস বাঙালীর শৌর্য-বীর্যের ইতিহাস।"

সুশোভনবাবু বললেন -" একদম ঠিক। তুইও তাহলে পড়েছিস মা!" 

বসন্তসেনা বললে-" পড়েছি মানে, আগে তো তোমার মুখেই  শুনেছি। তারপর না হয় পড়েছি। পড়েছি দীনেশ চন্দ্র সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গ’ও। সে বইও তোমার সংগ্রহে আছে। তোমার লাইব্রেরী থেকে নিয়ে পড়া। মা তো তখন বেঁচেছিল। " 

তার বাবা বললেন -"এই ইতিহাসের পথে হেঁটে যাওয়া মানে পেছনে হাঁটা নয়, যে কোনও দেশের কৃষ্টি সংস্কৃতি ভাষার ইতিহাস জানলে, আমাদের জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়, গবাক্ষ দিয়ে চোখ মেললেও আমরা সমগ্র এই বিশ্বকে খুঁজতে থাকি ওই একটুকরো দৃশ্যে। তারপর সময়ের গভীর অতলে  কীভাবে যেন নেমে পড়ি। যাপনে থাকে  অনন্ত উচ্ছ্বাস আর আনন্দ । অন্তরের চেতনা ঋদ্ধ হয়।  এই তোর ধর না পালিভাষা, আজ আর সাধারণের মধ্যে এই ভাষার প্রচলন নেই। অথচ বহু মানুষের ধর্মজীবনে এই ভাষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বৌদ্ধ ধর্মের তত্ত্বকথা ও বৌদ্ধসাহিত্যের প্রধান অংশ রচিত হয়েছে পালি ভাষায়।" 
এই বলে সুশোভনবাবু কিছুক্ষণ থামলেন। দেখলেন তার হাসনু-মা, কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে দুই গালে দুটো হাত রেখেছেন। তার মেয়েই হল  সুশোভনবাবুর সবচেয়ে মনোযোগী ছাত্র। এরকম একজন ছাত্র বা ছাত্রী পেলে পৃথিবীর সব শিক্ষক-ই তার মনের সেরা ভাবগুলো, তার ভান্ডারের সেরা সব কিছু উগরে দিতে চান। 

আবার বলতে শুরু করলেন তিনি-" আমাদের এই দেশ, ভারতবর্ষ , বহু ভাষাভাষীর দেশ। আমরা সবাই অল্পবিস্তর তা জানি। প্রত্যেকটি ভাষার ঐতিহ্য এবং ইতিহাস স্বতন্ত্র। কোনও কোনও ভাষায় কথা বলে কোটি কোটি লোক  আর কোনও ভাষায় লাখ খানেক। ঐ গুটিকতক বলতে পারিস। বিস্তৃত অঞ্চলে প্রসারিত কোনও ভাষা, আবার কোনও ভাষা ছোট কোনো অঞ্চলে, দূর্গম রাজ্যে পাহাড়ি অঞ্চলে কিংবা অরণ্য পরিবেশে সীমাবদ্ধ। কোনও কোনও ভাষা অতি প্রাচীন , যেমন তামিল। আবার এমনও ভাষা আছে যার বয়স হাজার বছরের চেয়ে কম। "

সুশোভনবাবুর কথার মাঝে ছেদ পড়ল কারণ হঠাৎ করে বাড়ির ডোর বেল বেজে উঠলো। বসন্তসেনা বিরক্তিকর মুখে বলে উঠল -"এই অসময়ে কে রে আবার!"

সুশোভন বললেন- " হাসনু-মা নিশ্চয় কেউ প্রয়োজনেই এসেছে। আর এখন তো সবে রাত আটটা বেজেছে।‌ তুই বোস আমি গিয়ে দেখছি। "

দরজা না খুলে, আগে ঘরের ভেতর থেকে বললেন তিনি -" কে? কে?"

বাইরে থেকে গলার আওয়াজ ভেসে এলো- " আমি। আমি----।" শুধু গলার আওয়াজে বসন্তসেনা ছুটে বাবার কাছে এসে বলল- " বাবা অঙ্কুশ! আমি দরজা খুলছি।"
সুশোভন বললেন হাসতে হাসতে - " উত্তেজিত হোস না, আমি দরজা খুলছি।" 

অঙ্কুশের সাথে বসে এই প্রথম সুশোভনবাবুর অনেক কথা হল, গল্প হল। তিনজনে মিলে যাকে বলে জমিয়ে আড্ডা চলল। তারপর ডিনার শেষ করে অঙ্কুশ নিজের বাসস্থানে ফিরে গেল। 
🍂
অঙ্কুশ চলে যেতেই সুশোভনবাবু বললেন বসন্তসেনাকে-  "অঙ্কুশ যে আজ আসবে তুই জানিস না। আজ ছুটির দিন। তোর সাথে অফিসেও আজ দেখা হয়নি। ও যে আসছে এখানে, তোকে তা জানিয়ে মোবাইলে ফোনও করেনি। কিন্তু তোকে সারাদিন মিস করেছে। আর বিশেষ করে,  আমার সাথে অন্তরঙ্গ হবার জন্য বা বন্ধুত্ব পাতানোর জন্য এই হঠাৎ আমাদের বাড়িতে আসা একদম না বলে কয়ে। ঠিক বললাম তো?" 

বসন্তসেনার মুখে মুচকি হাসি- " হ্যাঁ বাবা ঠিক। তোমার পর্যবেক্ষণ আর ভাবনা ভুল বলব কী করে? "

সুশোভন বললেন- " না, মানুষকে পুরোপুরি বোঝা দায়!  হয়ত এর কিছুটা বা অনেকটা অনুমান ঠিক হতে পারে। পুরোপুরি আমি ঠিক তা বলছি না। একজন মানুষ নিজেকেই নিজে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত চিনে উঠতে পারে না, অন্যকে চিনবে কী করে! আমার কী মনে হয় জানিস? আমরা প্রতিটি মানুষ এক একজন একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। প্রতিটি দ্বীপের এক নিজস্ব নির্জনতা, একাকীত্ব থাকে। মানুষ দিনের শেষে একদম একা এবং ভীষণভাবে একা। এই একাকীত্ব উদযাপনের মাধ্যমে আমাদের নিজেদের সেরা চিন্তা ভাবনাগুলো জেগে ওঠে। লোকের কাছে আমরা প্রত্যেকে আমাদের যে ভাবে মেলে ধরি, তা তো এক সাজানো নাটক। তাতে অনেক ফাঁক ও ফাঁকি থাকে। এ তো জীবনবোধের অনেক কঠিন কঠিন কথা বললাম। এবার অঙ্কুশে ফিরে আসি আবার। " 

বসন্তসেনা বলল-" বাবা আর নয় এখন। এবার অন্য কথা বল।" 

সুশোভনবাবু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন - " একেই বলে পূর্বরাগ। তুই মুখে বললেও কী হবে! অন্তরে চাইছিস বাবা আরও কিছু বলুক অঙ্কুশকে নিয়ে। ঠিক কিনা?"

"বাবা!"- বসন্তসেনা লাজুক মুখে তাকায় বাবার দিকে। 

সুশোভনবাবু বললেন-" অঙ্কুশ তোকে ভালবাসে। ও এখন থেকেই ওর আগামী দিনের কথা ভেবে মনে- মনে তোকে অনেক মিস করছে। এই কলকাতা ছেড়ে যাওয়া ওর মনের মধ্যে এখন ভীষণ চাপ সৃষ্টি করেছে। ওর সাথে কথা বলে মনে হল, এখন সে একটা বিন্দুতে অবস্থান করছে। আগেকার  দাঁড়িপাল্লার সেই নিউট্রাল পয়েন্টের মতন। যার একদিকে তুই, আর একদিকে তার বেঙ্গালুরুর নতুন চাকরি। একদিকে ঝুঁকলে আর একদিক উঠে আসছে। যতদিন যাবে ততদিন শুধু অঙ্কুশ নয়, দুজনাই, এই সমস্যার গভীরে তলিয়ে যাবি। তবে আমি আজও কথার মাঝে অঙ্কুশকে এই কথাটি স্মরণ করে দিয়েছি, নিজের কেরিয়ারকে যেন দুনিয়ার আর সব কিছুর কাছে অবজ্ঞা না করে। ভালো সুযোগ বারবার ফিরে আসে না। তোকেও তাই বলছি হাসনু- মা। "

বসন্তসেনা বলে ওঠে- " তুমি আমায় যতই এটা-ওটা বলো, আমি তোমায় ছেড়ে এখনই কোথাও যাচ্ছি না বাবা। আমি আমার বাবাকে ছেড়ে এই মুহূর্তে পৃথিবীর বসবাসের সেরা কোনও জায়গাতেই যাব না। নিজের সবকিছুই ত্যাগ করতে রাজি আছি। " 

সুশোভনবাবু বললেন- " এরকম ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবি না। সময় মানুষকে শেষ কথা বলে। সময়ের মুখে দাঁড়িয়ে নিজের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারাটাই মানুষকে সঠিক অবস্থানে দাঁড় করায়। এখনও সময় আসেনি, সময়ের মুখে দাঁড়িয়ে কথাটি বলবি মা। এইটুকু বলছি।" 
তারপর----
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত বসন্তসেনা তাদের ব্যালকনিতে বসে রইল। এই ব্যালকনিতে দাঁড়ালে মনে হয় যেন আকাশের কাছাকাছি সে  দাঁড়িয়ে রয়েছে। বসে বসেই সে রাতের আকাশ নিরীক্ষণ করছিল। চাঁদ আজ মৃত, তার আলো গলে পড়া দৃশ্য যেমন মনোরম , আরও মনোরম অবগুন্ঠনে ঢাকা অন্ধকার এই রহস্যময় রাত আর রাতের আকাশ। অঙ্কুশের চেহারায় বীরত্বের কোনও ছিটেফোঁটা নেই, একদম সাদামাঠা সাধারণ চেহারার ছেলে, অথচ তার হৃদয়ের গভীর কোণে যে ভালোবাসার মেঘ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে তা তার মনের মাঝে সবসময় ছুঁয়ে যায়, এই ভালোবাসাই তাকে অঙ্কুশের প্রতি অনুরাগী করে তুলেছে।আর আছে তার সুগভীর জীবনবোধ।  তার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব বসন্তসেনাকে অবশ্যই সমৃদ্ধ করেছে। তার চিন্তা ভাবনায় অনেক পরিবর্তন এনেছে। মনে পড়লেই সে অঙ্কুশকে ফোন করে না, কিন্তু তাকে মনে মনে খুব উপভোগ করে। এইরকম এক মন নিয়ে সুসীমা ছুটে চলে গিয়েছিল অনিশ্চিতের পথে একদিন আড়াইহাজার বছরেরও আগে এই বঙ্গদেশে। বসন্তসেনার ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসে। বসন্তসেনা ঘুমোতে ঘুমোতে আবার জেগে উঠবে, এই ব্যালকনিতে। আকাশের অন্ধকার একটু যেন হালকা হয়ে উঠল। তবে কী এই আকাশ আবার এক্ষুনি আলোয় ভরে উঠবে! 

ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments