পর্ব- ৯৬
মকরের হাট
সূর্যকান্ত মাহাতো
"দূরে দূরে গ্রাম দশ বারোখানি , মাঝে একখানি হাট
সন্ধ্যায় সেথা জ্বলে না প্রদীপ, প্রভাতে পড়ে না ঝাঁট।
বেচাকেনা সেরে বিকেলবেলায়
যে যার ঘরে ঘরে ফিরে যায়;
বকের পাখায় আলোক লোকায় ছাড়িয়া পূবের মাঠ ;
দূরে দূরে গ্রামে জ্বলে উঠে দ্বীপ …আঁধারেতে থাকে হাট।"(হাট/ যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত)
জঙ্গলমহলের হাটগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সেটা হল সারাদিনের হাট। বেশ কিছু জায়গায় একবেলার হাট হলেও বেশিরভাগ জায়গাতেই হাটগুলো সারাদিন ধরে চলে। কোথাও কোথাও আবার রাত্রি পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। সারা বছর ধরে চলা এই হাটগুলোর মধ্যে সবথেকে বড় ও স্পেশাল হাট হল 'মকরের হাট'। ঐদিন হাটে মানুষের যে ঢল নামে তা প্রায় বর্ণনাতীত। দোকানের বৈচিত্রও ঐ হাটের দিন বহুগুণ বেড়ে যায়। অন্যান্য দিনের হাটগুলোর সঙ্গে মকরের হাটের একটু পার্থক্য আছে। আর সেটা হল লোকজনের বিপুল সমাগম। এ ছাড়াও এই হাটের সামগ্রিক পরিবেশটাও থাকে বেশ উৎসবমুখর। জঙ্গলমহল জুড়ে মকরের যে হাটগুলো বসে তাদের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। সব জায়গাতেই প্রায় একই চিত্র ধরা পড়ে।
মকরের হাটের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য হল, মানুষের ভিড়। ঐদিন হাটে এত মানুষের উপস্থিতি ঘটে যে রাস্তা সহ গোটা হাটে উপচে পড়ে সেই ভিড়। সর্বত্র শুধু মানুষের ঢল। প্রতিটি দোকানেই অসম্ভব রকমের ভিড়, কেনাকাটা, চিৎকার চেঁচামেচি, আর মাঝে মাঝেই ভেসে আসে দু-এক কলি টুসু গানের সুর। গানের পাশাপাশি মানুষের পায়ের ধুলাও ভেসে বেড়ায় হাট চত্বরে। অনেকগুলো নারী পুরুষের মাথা একসঙ্গে ঝুঁকে আছে দেখলেই বোঝা যায় ওখানে কোন কিছুর দোকান বসেছে এবং পসরা বিক্রি হচ্ছে। এই অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে কোন কোন হাটে সাইকেল ও মোটর সাইকেলের স্ট্যান্ডও বানাতে হয়। সেখানে নিরাপদে সাইকেল ও মোটরসাইকেল রাখার জন্য কমবেশি পাঁচ টাকা ও দশ টাকা ধার্য করাও থাকে। কেননা হাটে বিপুল সংখ্যক মানুষের ভিড় থাকায় চুরি হওয়ার ঘটনাও ঘটে।
হাটে বসা, দোকানগুলোর বৈশিষ্ট্যও বেশ। একটা ত্রিপল মাটিতে বিছিয়ে তার উপর পসরাগুলো সাজানো থাকে। কয়েকটি দোকানে কেবলমাত্র মাথার উপর ত্রিপল টাঙানো থাকে, বাকি প্রায় সবগুলোই খোলামেলা। এমনিতেই শীতে রোদের তাপ তেমন নেই বলে একটা বাড়তি সুবিধা থাকে। শহরে যেমন দুর্গা পূজাতে নতুন জামা কাপড় কেনার রীতি, তেমনি জঙ্গলমহলের গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে নতুন জামা কাপড় পড়ার চল রয়েছে। তাই জামা কাপড়ের দোকান থাকে মকরের হাটে সব থেকে বেশি। তার উপর শীতকাল বলে এই হাটে শীতের পোশাকের দোকানও থাকে চোখে পড়ার মতো। রঙিন পোশাকগুলো চারপাশে ঝোলানো থাকে। পাহাড়ি তথা দার্জিলিং ও নেপাল থেকে আসা ব্যবসায়ীরাও এই সময় শীতের পোশাক বিক্রি করতে জঙ্গলমহলে চলে আসেন। মকরের হাটগুলোই থাকে তাদের টার্গেট। কারণ ঐ হাটেই তাদের বিক্রিবাটা হয় সব থেকে বেশি।
মকরের হাটের আরো একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো 'টুসু'-র প্রতিমা বিক্রি। এই হাটেই টুসু প্রতিমা সব থেকে বেশি বিক্রি হয়। তাই একাধিক নারী পুরুষ টুসু বিক্রি করতে আসেন এই হাটে। মেয়েরাই যে কেবল গান করতে করতে টুসু কিনে বাড়ি ফিরে তাই নয়। পুরুষেরাও টুসু কেনে ছেলে মেয়ে কিংবা নাতি বা নাতনিকে কাঁধে তুলে তার হাতে দিয়ে গান করতে করতে বাড়ি ফিরে। এই হাটে টুসু গানের বইও পাওয়া যায়। এখনকার প্রজন্ম সেরকমভাবে টুসু গান জানেনা বলে তারা বই থেকেই গান গায়। তাই টুসু গানের বইগুলোও হাটে দেদার বিক্রি হয়।
মকরের পরদিন আইখ্যান। ঐদিন পয়লা মাঘ। একাধিক গ্রামে ঐ দিন 'গ্রাম দেবতা'-র পূজা হয়। তাই ওই পূজায় মাটির হাতি-ঘোড়া লাগে বলে মকরের হাটে মাটির হাতি ঘোড়াও বিক্রি হয়।
এমনিতেই হাটের সচরাচর যে বৈশিষ্ট্য তা তো মকরের হাটে থাকেই। শীতের টকটকে টাটকা শাক সবজির দোকান বসে। সবজিগুলো একটি ত্রিপলে বিছিয়ে রাখা থাকে। চাষিরা নিজেদের জমি থেকে তুলে এনে বসে বসে সেগুলো বিক্রি করে। সহজ পাঠের লাইনগুলোর মতোই---"জিনিসপত্র জুটিয়ে এনে/ গ্রামের মানুষ বেচে কেনে।" তাই সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে গুণমানে সেরা সবজিগুলোই হাটে ক্রেতারা কিছুটা কম দামে পায়। দিনভর চলে তার বেচাকেনা। অন্য এক সারিতে বসে আদা রসুন ও পেঁয়াজের দোকান। এমন দোকানের সংখ্যায় হাটে সব থেকে বেশি থাকে। গোটা মশলার পাশাপাশি গুঁড়ো মশলা যেমন- হলুদ গুঁড়ো, জিরা গুঁড়ো, লঙ্কাগুঁড়োও ঐ দোকানেই বিক্রি হয়। আরো অন্যান্য মশলার দোকানও বসে। বত্রিশা মশলা, চব্বিশা মশলা কতসব নাম। মাটির তৈরি জিনিসপত্র যেমন হাঁড়ি, কলসি, সরা বিক্রি হয়। যা দেখলেই মনে পড়ে যাবে সহজ পাঠের সেই দুটো লাইন---"কুমোর পাড়ার গোরুর গাড়ি/ বোঝাই করা কলশি হাঁড়ি", পাশাপাশি এলুমিনিয়াম ও কাঁসা পিতলের দোকানও বসে।
🍂
একদিকে বসে মাছিমারা, আরশোলা মারা, ইঁদুর মারা, ছারপোকা মারার বিষের দোকান। অদ্ভুত ভঙ্গিতে আর বুলিতে তারা খদ্দেরকে আকৃষ্ট করে। এক পাশে বসে লোহার তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যের দোকান সেখানে কোদাল, কাটারি কুঠার সহ ছুরি, কাঁচি, শাবলের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোও বিক্রি হয়। হাটে প্রায় সব জিনিসেরই সারাইয়ের দোকান বসে। যেমন জামা কাপড়ের জন্য দর্জি, টর্চ বা লাইট সারানোর জন্য লাইটের দোকান ও মিস্ত্রি, ঘড়ি সারানোর জন্য একজন ঘড়ি মিস্ত্রি, চশমা সারানোর জন্য একজন মিস্ত্রি, জুতো দোকানের পাশাপাশি জুতো সারানোর জন্য মুচিও বসে, ছাতা সারানোর জন্য একজন ছাতা মিস্ত্রিও প্রতিটি হাটের মতো মকরের হাটেও বসে। আগে লন্ঠন সারানোর মিস্ত্রি ছিল, এখন আর তারা নেই।
মাছ ধরার বিভিন্ন রকমের জাল যেমন বিক্রি হয় তেমনি জালের পাশাপাশি মাছধরার পাটা, ঘুনি প্রভৃতিও হাটে বিক্রি হয়। মাছ ধরার জালের মতো মাছও বিক্রি হচ্ছে। তবে সেটা শুকনো মাছ। দূর দূর পর্যন্ত ভেসে বেড়াচ্ছে শুকনো মাছের সেই গন্ধ।
বসে নানা রকমের খাবারের দোকান। এই হাট যেহেতু একটা উৎসবের মেজাজ ধারণ করে তাই মেলার মতোই সব রকমের খাবার এই হাটে পাওয়া যায় বলা যেতে পারে। তবে শীতকাল বলে খেজুর গুড়ের পাটালি ও মিষ্টির বেশি চাহিদা। ফলের দোকানও বসে সারি সারি। তারা জোর গলায় হাঁক পাড়ে কে কতটা কমে দিতে পারবে সেটা জানান দিতে।
হাটের উল্টোদিকে বসে দেশি হাঁস, মুরগি ও ছাগলের বেচাকেনা। বড় মোরগের দাম এই সময় থাকে আকাশ ছোঁয়া। কারণ লড়াইয়ের সিজন চলে বলে বড় মোরগদের চাহিদাও থাকে অনেক বেশি। তাছাড়া মকরে মাংসপিঠা ও মাংস খাওয়া হয় বলে দেশি মুরগির চাহিদাও থাকে একটু বেশিই। শীতকালে হাঁসের মাংস বেশ সুস্বাদু হয় বলে এ সময় হাঁসের চাহিদাও থাকে অনেক বেশি। মোরগগুলো কেনার আগে লড়াইয়ের উপযুক্ত কিনা তা যাচাই করে নিচ্ছে ক্রেতারা। কেবল হাঁস-মুরগি বিক্রি হয় তাই না,পাশাপাশি হাঁস মুরগির বিভিন্ন রকম রোগের ওষুধও বিক্রি হয় হাটে। একটা ছোট্ট মাইকে বলে চলে মুরগির সাদা পায়খানা, ঝিমুনি, টুনকি, মুরগির উকুন এই জাতীয় রোগের হাত থেকে মুরগিকে বাঁচানোর জন্য কোন ওষুধ ব্যবহার করতে হবে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে তার নির্দেশ।
হাঁস, মুরগির রোগের পাশাপাশি মানুষেরও বিভিন্ন রোগের ওষুধের দোকান বসে এই হাটে। বিভিন্ন রকমের বাত ও ব্যথার ওষুধও বিক্রি হয়। লাল তেলের গুণাগুনগুলো তাদেরও স্টলের মাইকে সর্বক্ষণ বেজে চলে।
ছেঁড়া নোটের বদলে নতুন নোট নিয়ে একজন জোর গলায় হাঁক পাড়ে। পাশেই ভাগ্য বদলানোর জন্য বিভিন্ন ধাতু দিয়ে নির্মিত আংটিও একজন বিক্রি করে। সেও বলে অন্যান্য হাটের থেকে মকরের হাটে বিক্রি একটু বেশিই হয়।
মকরে পুর পিঠা খুবই জনপ্রিয় খাবার। এই 'পুর' বানানোর জন্য 'নারকেলের পুর' খুবই সুস্বাদু। তাই নারকেলের দোকানও বসে অনেক। এই হাটে ভিড় যেহেতু বেশি তাই নানান ম্যাজিকের আসরও বসে রাস্তার পাশে।হাটের কিছুটা দূরে বিক্রি হয় হাঁড়িয়াও। মকর পরবের সমস্ত কেনাকাটা এই হাটেই করা হয়। তাই মানুষের উপস্থিতি থাকে চোখে পড়ার মতো। একটি পরিবারের চাহিদা অনুযায়ী সবরকমের প্রয়োজনীয় জিনিসই এই হাটে পাওয়া যায়। মকরের এই হাটের বর্ণনা করা সত্যিই কঠিন। তবে মকরের এই হাট একবার সকলেরই দেখা উচিত।
0 Comments