দূর দেশের লোক গল্প—তিব্বত (এশিয়া)
রাজার মনে সাহস নাই
চিন্ময় দাশ
বউ আর তিনটে বাচ্চা—এই নিয়ে পাঁচজনের সংসার শেয়ালের। বেশ বড়সড় একটা গ্রামের একটেরে বাসা তার। বেশ চলছিল। কোন ঝামেলা ঝঞ্ঝাট ছিল না।
কিন্তু সুখের দিন কি আর বেশি লম্বা হয় কারও? শেয়ালেরও হোল না। কিছুদিল হোল, গ্রামের কয়েকটা কুকুর বেশ উৎপাত শুরু করেছে। এদিকেই আনাগোনা করছে হতভাগাগুলো। এদিকে, বাচ্চাগুলোও তেমন বড়া হয়নি এখনও। বাসা ছেড়ে বেরুনোই দায় হয়ে উঠেছে।
বউয়ের সাথে পরামর্শ করে, এই এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও সরে যাবে, ঠিক করল শেয়াল। শেষমেশ একদিন সন্ধ্যা নামতেই, বউ বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়েই পড়ল।
রাস্তা চলছে, আর চোখ রেখেছে এদিক ওদিক। যুৎসই একটা জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে শেয়ালের চোখ দুটো। যেখানে সবাইকে নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা যাবে।
চলতে চলতে একটা ঘন বনের খানিকটা ভেতরে ঢুকেছে, হঠাৎই একটা বাঘের ডেরা চোখে পড়ে গেল শেয়ালের। বিদ্ঘুটে একটা বোঁটকা গন্ধ। শেয়ালী আর বাচ্চাগুলো তো ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছে। এ গন্ধ খুব চেনা সকলের। এক পাও এগোতে চাইছে না কেউ।
শেয়াল বলল—ঘাবড়ে যাচ্ছো কেন তোমরা? বাঘের নাড়িনক্ষত্র আমার চেনা। তার সাথে টেক্কা দিতে আমার কোন অসুবিধা হবে না। তোমরা একটু দাঁড়াও। আমি গিয়ে ভিতরটায় উঁকি দিয়ে আসি।
শেয়াল গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল খোঁদলটার দিকে। মোটামুটি বড়ই ডেরাটা। উঁকি দিয়ে দেখল, বাঘ নাই ভেতরে। বেরিয়েছে কোথাও, ফেরেনি এখনও। এক কোণে কিছু মাংস ডাঁই করা আছে।
মনে বেশ সাহস হোল শেয়ালের। বউ-বাচ্চাদের ডেকে বলল—এসো সবাই। ভেতরে ঢুকে পড়া যাক। খাসা খাবার-দাবার মজুদ আছে। পেট ভরে খাওয়া যাক আয়েস করে।
বউ ভয় পেয়ে বলল—মাথা খারাপ হোল না কি তোমার? বলছোটা কী? আরে, এটা যে স্বয়ং রাজার বাড়ি!
--বুঝেসুঝেই বলছি, গিন্নি। ভয় পাও কেন? আছি তো আমি। সব সামলে নেব। কেবল একটু মাথা খাটাতে হবে।
ভেতরে ঢুকে, সবাই মিলে ভরপেট ভোজ খাওয়া হোল। শেয়াল তার বউকে বলল—এবার যা বলছি, মন দিয়ে শোন। প্রথমে টেনে একটা ঘুম দিয়ে নাও তোমরা। আমি এই বাসাটার ওপরে গিয়ে পাহারা দিচ্ছি। বাঘ আসতে দেখলে, আমি জোরে জোরে ছাদে আঁচড় কাটব। তোমরা সবাই উঠে পড়বে।
🍂
তার পর কী করতে হবে, বুদ্ধি শিখিয়ে দিল শেয়াল। নীচের চারজন বাসাটার একদিকে দেওয়াল ঘেঁষে ঘুমিয়ে পড়ল। শেয়াল উপরে চলল পাহারা দিতে।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। শেয়াল বসে আছে উপরে। শেষমেষ একসময় শুকনো পাতার মচমচ শব্দ। ভোর হয়ে আসছে তখন। শেয়াল দেখল, বিশাল বপুর এক বাঘ হেলতে দুলতে ডেরায় ফিরছে। শেয়াল চটপট পাথর ঠুকে বউ-বাচ্চাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিল।
বাঘ কাছাকাছি এসে পড়েছে, বাচ্চাদের জোর কান্না শুরু হয়ে গেল ভিতর থেকে। তা শুনে বাঘ থমকে থেমে গেছে। ব্যাপারটা কী? তার নিজের ডেরায় কার এ কান্না?
চোখ টেরিয়ে বাঘকে দেখে নিয়েছে শেয়াল। গলা চড়িয়ে ওপর থেকে চেঁচিয়ে উঠল—কী হোল, গিন্নি? বাচ্চারা কাঁদে কেন?
--বাচ্চারা আবার কেন কাঁদে? খিদে পেয়েছে তাদের।
সব কথা কানে যাচ্ছে বাঘের। শেয়াল জিজ্ঞেস করল—এই তো সন্ধ্যেবেলা ভরপেট মাংস খাওয়া হোল। রাত না ফুরোতেই খিদে পেয়ে গেল?
বউ জবাব দিল—তুমি যে বলেছিলে, সকাল হলেই বাঘের মাংস খাওয়াবে। আসলে, সেই লোভেই কাঁদতে শুরু করেছে বদমাসগুলো।
শেয়াল ধমকে বলল—বলেছিই তো। এই তো সকাল হয়ে এলো। বাঘের ফিরতে আর তেমন দেরি নাই। একটু বাদেই সবাই মিলে আস্ত বাঘের টাটকা মাংস দিয়ে ভোজ হবে আমাদের। আর একটুখানি সবুর করতে বলো বাচ্চাদের। বলেছি যখন খাওয়া হবেই। বাঘের মাংসই খাবো আমরা।
বাঘের তো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। কে হতে পারে এরা। আমার ডেরাতে ঢুকেছে। আমারই জমানো মাংস খেয়েছে। এখন অপেক্ষা করে আছে স্বয়ং আমার মাংস খাবে বলে। বেচারা বাঘ একটু ঘাবড়েই গিয়েছে। এ নিশ্চয়ই কোন আরও বলশালী, আরও ভয়ঙ্কর কোন জীব হবে।
বাঘের মন বলল—আর এক মূহুর্তও এখানে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। অমনি লেজ গুটিয়ে সেই যে লাফ শুরু হোল, তার চিহ্নটিও দেখতে পাওয়া গেল না আর।
বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে এসেছে, সামনে এক বেবুন (লম্বাটে গড়নের মুখওয়ালা এক জাতের বানর। মুখের চারদিক জুড়ে সাদা লোমের বেড় দেওয়া।)।
সে হাঁক পেড়ে বলল—বাঘখুড়োর হোলটা কী? এমন দৌড়চ্ছো কেন?
--শুধু দৌড়চ্ছি না, হে। বাঘ হাঁফাতে হাঁফাতে বলল—প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছি।
বেবুন অবাক—বাঘ পালাচ্ছে প্রাণ নিয়ে? কোনও শিকারী তাড়া করেছে না কি?
বাঘ বলল—আর বোল না। কী এক আশ্চর্য জীব এসে ঢুকে বসে আছে আমার ডেরায়। পুরো সংসার নিয়ে এসেছে সাথে। আমার জমানো মাংস খেয়েছে রাতের বেলা। এখন অপেক্ষা করে আছে, বাঘের মাংস তার বাচ্চাদের খাওয়াবে বলে।
বেবুন বলল—বলছোটা কী?
--শুধু বলছি নাগো, নিজের চোখেই দেখে এলাম সব। বাঘ বলল—আমার ডেরার ছাদে বসে আছে বাপটা। আমার ফিরবার অপেক্ষায়। বাচ্চাদের বলছে, আর একটু অপেক্ষা কর বাছারা। বাঘের ফেরার সময় হয়ে এসেছে। নিজের কানেই শুনে এলাম কথাগুলো। ভাগ্যিস আমাকে চোখে পড়েনি তার। নইলে এতক্ষণে মারা পড়ে যেতাম। তাই ভাবলাম, অন্যের পেটে চলে যাওয়ার চেয়ে, সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
সব শুনে মাথা গোলমাল হওয়ার জোগাড় বেবুনের। এমন কে আছে এই দুনিয়ায়, যে নিজের বাচ্চাদের বাঘের মাংস খাওয়াবে বলে, পাহারা দিয়ে বসে আছে বঘের অপেক্ষায়। ভেবে বেশ মজা লাগল তার। খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল।
বাঘ বলল—হাসলে যে বড়?
--হাসবো না তো কি কাঁদতে বসব গলা ছেড়ে? আচ্ছা বুদ্ধু তো তুমি। বাঘের মাংস খাবে, এমন কে আছে এই বন-পাহাড়ে?
--কে আছে আমি তার কী জানি। তবে, আছে যে কেউ, সেটা নিজের চোখে দেখে এলাম। নইলে দৌড়ে পালাচ্ছি কি এমনি এমনি?
বেবুন বলল—এসো তো আমার সাথে। আমি দেখাব তোমাকে কত বড় ভয়ঙ্কর জীব সে। যদি থেকেও থাকে তেমন কেউ, তাকে কী করে শিক্ষা দিতে হয়, তাও দেখাব তোমাকে।
শুনে বাঘের মনে একটু সাহস এল বটে, কিন্তু সেই বিপজ্জনক জায়গায় ফিরে যেতে মন চাইছে না তার। বাঘ যত দোনামনা করে, বেবুন তত তাকে উত্তেজিত করতে চায়। শেষমেশ বাঘ বলল—যেতে পারি, তবে একটা শর্ত আছে আমার।
বেবুন খুশি হয়ে বলল—বলো, কী তোমার শর্ত? আমি রাজি।
বাঘ বলল—আমার লেজের সাথে তোমার লেজ বাঁধা হবে। যাতে বিপদের সময় তুমি আমাকে ফেলে পালিয়ে আসতে না পারো।
বেবুন হেসে বলল—ওহ, এই কথা! তা বাঁধো না কেন। বেশ শক্ত করেই বাঁধো তুমি। এমন করে বাঁধো, যাতে গিঁট না খুলে যায়।
এবার বাঘের মনে বেশ সাহস এলো। দুজনের লেজে শক্ত গিঁট বেঁধে, দুজনে ফিরে চলল বাঘের বাসায়।
যত বাসার কাছাকাছি হচ্ছে, ততই সাহস উড়ে যাচ্ছে বাঘের। একটু একটু করে চলার গতিও কমে আসছে তার। মন চঞ্চল হয়ে উঠছে। যাতে সামান্য বেগতিক দেখলে, পালিয়ে বাঁচতে পারে।
এতক্ষণ পাপাশি চলছিল দুজনে। এবার বাঘ সামনে করে নিয়েছে নিজেকে। যাতে দৌড়ে পালাবার প্রয়োজন হলে, সে নিজে সেটা শুরু করতে পারে।
এবার ঘটলো আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার। শেয়াল সেই ছাদেই বসে আছে তখন থেকে। সহজে বাঘ সব মেনে নেবে, সেটা তার মন বলছে না। যদি ফিরে আসে, সেই ভেবে, ঠায় বসে আছে ছাদের ওপরে।
তার মন যা ভেবেছিল, ঠিক তাই হয়েছে। বাঘ ফিরেই এসেছে। সাথে একটা বেবুন। শেয়াল অবাক হয়ে দেখল, দুজনের লম্বা লেজ দুটো গিঁট দিয়ে বাঁধা।
বাসার কাছাকাছি হয়েছে দুজনে, শেয়াল চেঁচিয়ে উঠল—হ্যাঁরে বেবুন, এই তোর কথার দাম? এই তোর প্রতিশ্রুতি রক্ষা? বললাম তোকে তিন-চারটা বাঘ ধরে আনতে। বাচ্চাগুলো হ্যাঁ করে বসে আছে তোর অপেক্ষায়। সেই কখন সূর্য উঠে গেছে। আর তুই কোন আক্কেলে মাত্র একটা বাঘকে বেঁধে, মাণিকজোড় সেজে চলে এলি?
আর যায় কোথায়? বাঘ বুঝে গেল, বেবুনটা ভারি শয়তান তো। এখানে কথা দিয়ে গিয়ে, রাস্তার ওপর বসেছিল। এইজন্য আমাকে বোঝাচ্ছিল সাতকাহন করে।
আর ভাবনা চিন্তা নয়। এক মূহুর্ত দেরিও নয়। বাঁচতে হলে, পালাতে হবে। সাথেসাথে গায়ে যত শক্তি ছিল বাঘের, প্রকাণ্ড এক লাফ। তার পর দৌড়, দৌড়, দৌড়।
বেচারা বেবুন তো গিঁট দিয়ে বাঘের পিছনে বাঁধা। বাঘ দৌড়চ্ছে। বেবুন টেনে-হিঁচড়ে চলেছে পিছনে পছনে। দৌড়তে দৌড়তে একটা নদীর ধারে এস থামল বাঘ। দম আটকে আসছে। বুক ফেটে যাবার জোগাড়। ধপাস করে বসে পড়ল বালির চরে।
কতক্ষণ দম নিয়ে, বেবুনটার কথা মনে পড়ল তার। এবার উচিত শিক্ষা দিতে হবে হতভাগাকে। কিন্তু কাকে কী শিক্ষা দেবে? পিছন ফিরে যা দেখল, দম নিতেও ভুলে গেল বাঘ।
বাঘের লেজের সাথে বেবুনের লেজটা তখনও গিঁটে বাঁধা। কেবল বেবুনটাই নাই। পাথরে, গাছের শেকড়-বাকড়ে ঠোক্কর খেতে খেতে, কোথায় যে তার দেহটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়ে গিয়েছে, টেরও পায়নি বাঘ।
বাঘ তার বাকি জীবনে বাসাটার কথা মনেও আনেনি কোন দিন। সেদিন থেকে শেয়ালও পুরো সংসার নিয়ে সেখানেই সুখে শান্তিতে বাস করে আছে আজও।
0 Comments