গগলস পেয়ে খুশি
সৌমেন রায়
আজকের পৃথিবীতে হাতে মুঠোফোন নিয়ে বসে ভাবতেই অবাক লাগে আমাদের পূর্বপুরুষরা বনে বাদাড়ে পশু শিকার করে বেড়াত। মোটামুটি তিন লক্ষ বছর আগে বানর জাতীয় প্রাণী থেকে মানুষের সৃষ্টি। বিভিন্ন স্থানে , বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রজাতির মানুষ পৃথিবীতে বাস করেছে। হয়তো বা একইসঙ্গে বিভিন্ন প্রকার মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বাস করত। তাদের বিভিন্ন নামও ছিল। মোটামুটি পরিচিত নাম নিয়ানডার্থাল, হোমো ইরেকটাস ইত্যাদি। আর আমরা এখন পৃথিবী জুড়ে যে মানুষেরা বাস করি তারা হচ্ছে হোমো সেপিয়েন্স । আমাদের পূর্বপুরুষরা আফ্রিকা থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। হোমো সেপিয়েন্স এর আগের মানুষেরা খেয়েদেয়ে সন্তান উৎপাদন করে খুশি ছিল। তাদেরও নিশ্চয় একটা সমাজ ছিল, সে সমাজে নিশ্চয়ই কিছু নিয়ম কানুন ছিল। ছোটখাটো প্রয়োজনীয় জিনিস তারা বানাতে পারতো।কিন্তু হোমো সেপিয়েন্সের মত মস্তিষ্ক দিয়ে বিশ্বজয় করার চেষ্টা তারা করেনি। তারা সে কথা ভাবতেও পারেনি। কারণ পৃথিবী সম্পর্কে তাদের ধারণাই ছিল না।গোটা পৃথিবী ঘোরা তো দূরের কথা। আমরা চাঁদে পর্যন্ত গেছি, রোগ জ্বালাকে অনেকাংশে বশীভূত করেছি,পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় নিয়েছি। আমাদের কৃতিত্বের তালিকা করতে একফালি পৃথিবী লেগে যাবে। কিন্তু সত্যিই কি আমরা আমাদের পূর্বজদের থেকে ভালো আছি, সুখে আছি? আমাদের মস্তিষ্কের বিজয় রথ পৃথিবীর অন্যদের, এমনকি আমাদেরও বিপন্ন করে দেয় নি তো ? আমাদের উন্নতির সুউচ্চ শিখরের পাশেই নেই তো অতলান্ত খাদ ? 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম' এমন নস্টালজিক কথা বলছি না,বলছি এখন কি সুখে আছি?
আধুনিক সভ্যতা আমাদের জীবনযাত্রা সহজ ,গতিময় করেছে নিঃসন্দেহে।প্রথমে যোগাযোগ ব্যবস্থার কথাই ধরা যাক। খুব আগে যোগাযোগের দরকারই ছিলনা।মোটামুটি একটা ভদ্রস্থ সময়ে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চিঠি । এখন হয়েছে ইমেল, অতি দ্রুত আদান-প্রদান করা যায়। কিন্তু তেমন ব্যবস্থার ফলে কি আমাদের হাতে সময় কিছু বেঁচেছে? যারা অফিস-কাছারীতে কাজ করেন তারা জানেন এটার অশান্তিটা কি! প্রেরক বারোটার সময় মেল পাঠিয়ে বারোটা পাঁচ থেকে উত্তর প্রত্যাশা করে। বারোটা ত্রিশের মধ্যে না পেলে অস্থির হয়ে ওঠে। প্রাপক যখন প্রেরক হয় তখন তাঁরও একই অবস্থা। সময় বাঁচবে কি দশ মিনিট ছাড়া মেল চেক করতে গিয়ে মনের শান্তিটাই নষ্ট। হোয়াটস অ্যাপ এর ক্ষেত্রে এ কথাটা আরো বড় রকমের সত্য। যারা এইগুলো ব্যাবহার করেন না বা কম করেন তাদের মাধ্যম ফোন। সেখানে আবার তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাশিত ব্যক্তিকে পাওয়ার প্রত্যাশা এতটাই যে স্নান করতে ঢুকলেও মনে হয় কেউ ফোন করল না তো ? একবার ফোনে না পেলে মা ভাবে ছেলের কিছু হলো নাকি! মানসিক উদ্বেগ বাড়ে। বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে মা দিনে চারবার কথা বলে। কারন ফোন কোম্পানিগুলো নীতি হল একটি নির্দিষ্ট রিচার্জ করলে আপনি যত খুশি কথা বলতে পারেন। এতো কথা বললে অনাবশ্যক কথা তো হবেই। ফলত মেয়ের বাড়ি রান্নাবান্না, সকাল থেকে সন্ধ্যা রুটিন, মায় জামাইএর সাপ্তাহিক বাতকর্মের চার্ট পর্যন্ত শাশুড়ির নখদর্পণে। অজান্তে মা অনধিকার প্রবেশ করেন মেয়ের সংসারে। আগে চিঠি দিয়ে মানুষ ভুলেই যেত। তারপর কোন অনির্বাচিত দুপুরে সুহৃদের বার্তা নিয়ে আসতো সেই চিঠির উত্তর। সেই অনির্বচনীয় আনন্দটি হারিয়ে, বাৎসরিক মিলনের তীব্রতম অনুভূতি হারিয়ে অর্জন করেছি মানসিক উদ্বেগ ও অস্থিরতা।রাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেস এখন অতীত। বিমান যোগে চব্বিশ ঘন্টায় পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া যায়।কিন্তু বেঁচে যাওয়া সময় কি মনের আনন্দে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া যায় ? নাকি দ্রুত আবার পরের টার্গেট পূরণ করতে ছুটতে হয়?
সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেট এক অনন্ত সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে আমাদের কাছে।এখন যে কোন তথ্য এক ক্লিকে স্যাটাক দুম, হাতের মুঠোয়। পাশ বালিশে হেলান দিয়ে বিনা শ্রমে জানা যায় যে কোনো বিষয়ের কথা। সে কথা গভীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের হোক, স্বাস্থ্যের হোক বা রান্নার ! এখন ব্যাংকে যেতে হয়না, ট্রেনের টিকিট কাটতে যেতে হয়না । সব ঘরে বসে করা যায়। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে একজন প্রান্তিক মানুষ তার মতামত প্রকাশ করতে পারেন। আমি হরিদাস পাল এক্ষুনি একটি ভিডিও ইউটিউবে দিতে পারি ভারতের বিদেশ নীতি সম্পর্কে মতামত জানিয়ে। আগে কখনো এত বড়ো স্বাধীনতা কেউ কাউকে দিয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু কতটা লাভ হয়েছে বিনাশ্রমে পাওয়া সেই সব তথ্য ভান্ডারে।সেসব কতটুকু স্থায়ী হয় আমাদের মনে? প্রতিদিন সকালের গুড মর্নিংএর পোস্টে লেখা সুন্দর কথাগুলি প্রয়োগ করা দূরের কথা মনেও রাখতে পারি কি ? ঠিক যেমন ডিজিটাল ফটোগ্রাফির পর আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে ধরে রাখতে শিখেছি।এমন কি বেড়ানোর তুঙ্গ মুহূর্তগুলি পর্যন্ত খালি চোখের তুলনায় ক্যামেরার লেন্স দিয়ে দেখি বেশি। কিন্তু পরে একবারও সেগুলি খুলে দেখার সময় পাইনি। যতদিনে কর্মহীন অবসর আসে ততদিনে উৎসাহ হারিয়ে যায়।ইন্টারনেট এর নূতন নূতন কন্টেন্ট আমাদের ডোপামিন – সেরেটোনিন বাড়িয়েই চলে।ফলে স্বাভাবিক কাজকর্ম, এমনকি যেটি করে কম্মে পেটে ভাত জোটে সেটিকেও খুব ম্যাড়মেড়ে লাগে। বিরিয়ানির পর ডাল ভাত ? ছিঃ! কিন্তু লাভ কি হয়েছে? তথ্য, বিকৃত তথ্যের ভারে চারিদিক গলিত, স্খলিত। আসল মানিক্যগুলি চিনতে পারা মুশকিল। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন তাদের সময় উপকরণ ছিল কম তাই আমের আটি টুকু পর্যন্ত চুষে সবটুকু রস ভোগ করতেন। আমরা খাচ্ছি ছড়িয়ে ছিটিয়ে,চারিদিক কে করে তুলছি পুতিগন্ধময়।পাশের লোকের দিকে না তাকিয়ে চেয়ে আছি ছয় ইঞ্চি স্ক্রিনের দিকে।স্ত্রী স্বামীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে ফেসবুকে,স্বামী ধন্যবাদ জানাচ্ছে কমেন্টে।জগতটাই ভার্চুয়াল হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে চিমটি কেটে দেখে নিতে হয় স্বয়ং ভার্চুয়াল হয়ে গেলাম কিনা।তাৎক্ষণিক উত্তেজনার টানে ডোপামিনের নিঃসরণ ক্রমশ এমন জায়গায় যাচ্ছে যে মানুষ হয়তো আর কিছুদিন পরে যৌনতার মাঝে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে চেক করবে।
বলাবাহুল্য পৃথিবী শুধু মানুষের জন্য নয়। অন্য অনেক প্রজাতির জীব ও উদ্ভিদের বাসস্থান এই পৃথিবী। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে তো আরো সর্বনাশ চোখে পড়বে। হোমো সেপিয়েন্সরা তাদের ভারী মস্তিষ্কের দৌলতে সবাইকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। কিছু প্রজাতিকে খাঁচায় ভরেছে।কিছুকে লুপ্ত করে দিয়েছে। আর যাদের এখনো বাইরে রেখেছে তারা প্রায় সবাই বিপন্ন। যাদের খাঁচায় পুরেছে তাদের দিকে তাকালে হৃদয় আদ্র হবে। শহরের খাটালে গরু, মহিষ গুলি সারাজীবন একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। একই স্থানে খায়, ঘুমায়, সন্তান প্রসব করে, মলমূত্র ত্যাগ করে। মুক্ত আকাশ , সবুজ ঘাস তারা দেখেনা। এমনকি তাদের স্বাভাবিক যৌন চাহিদাও মেটানো হয় না। কৃত্রিমভাবে গর্ভবতী করা হয়। আর স্লটার হাউসগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। সেখানে জন্মের পরে এমন ভাবে পশুগুলোকে রাখা হয় যাতে নড়াচড়া বেশি না করতে পারে। কারণ বেশি নড়লে পেশী শক্ত হয়ে যাবে। মহার্ঘ্য রেস্টুরেন্টে হোমোসেপিয়েন্সের পাতে নরম মাংস লাগবে যে!পাখ পাখালিরা ,বন্য পশুরা তাদের স্বাভাবিক বাসস্থান হারাচ্ছে। তাদের জন্য অভয়ারণ্য বানিয়ে আমরা আবার সাফারির নাম করে তাদের কাঠি করতে যাই। খাঁচায়় রাখা বাঘ বা সাপ বনে থাকা বাঘ বা সাপের থেকে অধিক দিন বাঁচে,এটা সত্য। কিন্তু তাদের মানসিক স্থিতির কথা ভাবার সময় আমাদের নেই। অবশ্য এও ঠিক যে স্থির নিশ্চিত করে বলা যাবে না তারাও এই খাদ্যের নিরাপত্তা ছেড়ে বনে বাদাড়ে যেতে চাইবে কিনা। বুলবুলি পাখিগুলো প্রতিবার গাছ ছেড়ে সিঁড়ির অসুরক্ষিত জায়গায় বাসা বানায় কি জন্য ? বৃষ্টি ,রোদ থেকে বাঁচতে? ওরাও কি আরাম চায়? শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে মানুষ খাদ্যের নিশ্চয়তার বিনিময়ে মেনে নিয়েছিল ঘুপচি, অন্ধকার বাসগৃহ। পশু পাখিরাও কি মানুষেরই মতো আরাম চায়?
চিকিৎসাব্যবস্থা ক্রমাগত মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ এবং যন্ত্রণা মুক্ত করেছে। কত রোগব্যাধির অসহায়তা থেকে মুক্তি দিয়েছে, বাঁচিয়েছে অমূল্য প্রাণ । অন্যথায় হয়তো কোন মা সন্তানকে, কোনো সন্তান অপরিণত বয়সে বাবা মাকে হারত। বিষয়টিকে আমার ছেলে ,আমার বাবা, আমার মা, আমার স্ত্রী এই ঘেরাটোপের বাইরে থেকে যদি দেখা যায় তাহলে কেমন লাগবে?গুহাবাসী একজন মানুষকে এমনিতেই ক্রমাগত নিজের স্কিল বাড়াতে হত। ঘসে মেজে নিজেকে প্রতিনিয়ত তৈরি করতে হত। কারণ প্রতিনিয়ত তাকে খাদ্য সংগ্রহ করতে হত, আত্মরক্ষা করতে হত। ফলে তাদের জিনগত উন্নতি ঘটতো। যারা দুর্বল তারা হারিয়ে যেত। সে বালাই এখন নেই। কেউ নিশ্চিন্তে সারা জীবন অফিস ঝাঁট দিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। শুধুমাত্র বেচারি ঝাড়ুদারের উদাহরণ দিলে চলে না। প্রায় অনেক ক্ষেত্রেই তাই সত্যি। এই আমার মত মাস্টার স্ব-আরোপিত কিছু চ্যালেঞ্জ না নিয়ে এলে, শুধুমাত্র 'পরের ছেলে পরমানন্দ' এইটুকু মন্ত্র জপলেই সুন্দর একটা চ্যালেঞ্জবিহীন জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়।হাসবেন না, কভিদের সময় কথাটা মনে এসেছিল।তখন স্কুল বন্ধ।মনে হলো অর্জিত গান্ধী ছাপ কাগজ গুলো বাতিল হয়ে গেলে আমার আয়ু নির্ভর করবে উপবাসের ক্ষমতার উপর।পড়ানো ছাড়া আর কোনো স্কিল নেই যে! কেউ সারাদিন মদ খেয়ে পড়ে থাকলে, ঘরে এসে বউ পেটালেও সে মানুষ। তারও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার জন্য বিনামূল্যে খাবার থেকে ওষুধ সবই ব্যবস্থা করে। এমনকি মৃত্যুর পরবর্তী দাহ করার ভাতাটুকুও দেয়। আর একটু বেশি খেয়ে মরে যেতে পারলে তো কথাই নেই। পরিবারের কিছু টাকা রোজগার হয়ে যাবে ক্ষতিপূরণ বাবদ! তাই আমাদের জনসংখ্যা ,সঙ্গে অ- উৎপাদনশীল জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে।তার উপর উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা। মাতাল, গুন্ডা,খুনি সকলেই চিকিৎসা পাওয়ার যোগ্য , কারণ সকলেই মানুষ।অতি বৃদ্ধ শয্যাশায়ী যে নিজেও পরপারে গেলে বাঁচে, তাকেও সমাজ জোর করে বাঁচিয়ে রাখে ওষুধের জোরে। রিচার্ড ফাইনম্যান ডায়ালিসিস রিফিউজ করতে পারেন কিন্তু সবাই পারিনা। করুন দৃষ্টিতে সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে হাত ধরে তুলে দেয় ডায়ালিসিস টেবিলে ( চিকিৎসার বিরোধিতা না,ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা)। কজন আর বলতে পারে, 'জিন্দেগি লম্বি নেহি বড়ি হোনি চাহিয়ে বাবু সাহেব।' তাই জনসংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে ৭৬ মিলিয়ন করে।চলতি সময়ে মাত্র বাহাত্তর বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা(1987- 2059)।তার আগে হয়েছিল ৩৭ বছরে। বৃদ্ধির হার কমছে বলে উৎসাহিত হওয়ার কিছু নেই। সেখানে আবার উল্টো বিপদ। যুবক যুবতীদের মধ্যে, বিশেষ করে মেট্রোপলিটন সিটিতে যুবক যুবতীদের যৌন চাহিদা নাকি কমছে। তাদের কাজের চাপ ও বিবিধ আনন্দের হাতছানি যৌন চাহিদা থেকে তাদের দূরে রাখছে। উন্নত দেশে আবার কেউ কেউ নাকি মানবিক ঝামেলা এড়িয়ে পুতুল টুতুল দিয়ে কাজ চালাচ্ছেন। মানুষের স্পার্ম কাউন্ট নাকি দিন দিন কমে যাচ্ছে। এটা শোনা কথা নয়, পড়া কথা। এ তো ভয়ানক বিপদ!সে না হয় পরে ভাবা যাবে।আপাতত বিপুল জনসংখ্যার চাপে, তাদের প্রয়োজন এবং লোভ মেটাতে বসুন্ধরার নাভিশ্বাস উঠছে। পাহাড় চুরি হয়ে যাচ্ছে বাসস্থানের স্টোন চিপস যোগান দিতে । নদী বালি তৈরি করতে করতে ক্লান্ত। রাজস্থানের মার্বেল পাথরের পাহাড়গুলি আর কতকাল বাড়ির মার্বেল যোগান দেবে বোঝা মুশকিল। নদীর অববাহিকা বন্ধ করে , জলা জায়গা বুজিয়ে গড়ে উঠছে লোকালয় । তারপর ডেঙ্গু হলে সরকারকে দোষারোপ করে আমরা বেঁচে আছি। প্রতি বছর এভারেস্টের বেস ক্যাম্পে প্রায় মেলা বসে যায়। কোনদিন হয়তো দেখা যাবে টুপি মাথায় সেখানে লিকার চা বিক্রি করছে পাড়ার হরেন দা । যা খনিজ আছে আতিপাতি খুঁজে বের করছে, কাজে লাগাচ্ছে মানুষ। কিন্তু অনন্ত ভান্ডার তো নয়। শেষ তো একদিন হবেই! সেদিন কি হবে কেউ জানে না। মাটির নিচে জল ভান্ডার ক্রমশ কমে আসছে। মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে জমা জল উন্মাদের মতো তুলে আনছে।সে জলে এমনকি পিছন পর্যন্ত পরিষ্কার করছে!আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ লোক জলের কষ্টে থাকবে,সেদিকে নজর নেই। বায়ু ভয়াবহ রকমের দূষিত হয়ে উঠছে। বড় শহরের বাতাস শ্বাস যোগ্যতার মানদণ্ডে ফেল করছে ক্রমাগত। সমুদ্রের নিচে পর্যন্ত আমরা প্লাস্টিক বিছিয়ে দিয়েছি। পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে অতি দ্রুত গতিতে। রাষ্ট্রপুঞ্জ সম্প্রতি বলেছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং শেষ, সামনে আসছে গ্লোবাল বয়েলিং। ইউরোপএ তাপ প্রবাহ তেমন ইঙ্গিত দিচ্ছে। দুরারোগ্য অনেক রোগেরই ওষুধ আমরা আবিষ্কার করেছি বা আবিষ্কার করতে চলেছি। কিন্তু সুকুমার রায়ের ‘চোরধরা ‘ র মতো পিছন দিকে বিড়ালে নিয়ে যাচ্ছে খাবার। কলেরা, যক্ষার মতো রোগ গুলি আটকাতে পেরেছি কিন্তু চোখ রাঙাচ্ছে ডায়াবেটিস,মানসিক অবসাদ ,আলজাইমার্স এর মতো রোগ। ইনসুলিন আবিষ্কার করেও রোখা যাচ্ছেনা ডায়াবেটিস কে। মানসিক অবসাদ, অ্যালজাইমার মহামারী হয়ে উঠছে।নূতন নূতন জীবানু আমাদের নাজেহাল করে ছাড়ছে।রাষ্ট্রনায়করা কিছু করছে না এটা বলা উচিত হবেনা । তারা মাঝে মধ্যে এদিক ওদিক সেলিকল লাগাচ্ছে।
আবার অর্থনীতির ব্যাপারটা বেশ মজার। তার চাহিদা হচ্ছে ‘ দেখো আমি বাড়ছি মাম্মি ‘। তাকে আড়ে - বহরে ক্রমাগত বাড়াতে হবে। না হলেই মন্দা, মানুষের খাদ্য সহ সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান কমে যাবে। সেই জন্যই টুথপেস্টে নমক দিতে হয়, হাত ধোয়ার সাবানে ভিটামিন। জলকে বিষাক্ত করে কোল্ড ড্রিংকস বানানো হয়। আর সেলসম্যানদের শেখানো হয় কিভাবে এস্কিমোদের ফ্রিজ বেচতে হয়। সময় বাঁচানো যন্ত্র বের হয় বিচিত্র রকমের কিন্তু বেঁচে যাওয়া সময় কাজে লাগে না।অর্থনীতির বেলুনটি ফুলাতে হবে বলেই যোশীমঠ, বদ্রীনাথ এর মত ভঙ্গুর ভূপ্রকৃতি যুক্ত স্থানে নির্মাণ কাজ করতে হয়। এভারেস্টের যে খাড়া অংশটি উঠাই সর্বাধিক চ্যালেঞ্জ সেটিতে সিঁড়ি বসিয়ে দিতে হয়। প্লাস্টিকের কারখানা বন্ধ না করে বাজারে প্লাস্টিক বন্ধ করার নাটক করতে হয়। স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য হয়ে ওঠে ৫০% ডিসকাউন্টে শপিং। ভ্যালেন্টাইনস ডে মানে কয়েকশো কোটির ব্যবসা। প্রশ্ন হচ্ছে এভাবে কতদিন ফুলিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বেলুনটি? কেউ জানে না ! সম্প্রতি জানা গেল (মাশুল গুণবে পৃথিবী ,আনন্দবাজার, অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়, ১৪-১১-২০২৩,) অর্বুদ পতিরা জানেন তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য পৃথিবীর নাভিশ্বাস উঠছে, ভয়ংকর দিন আসন্ন । তারা নাকি নিরাপদ জায়গা খুঁজছেন, বাঙ্কার বানাচ্ছেন ধ্বংসের সেই দিনটির আগে পলায়নের জন্য। তবু সাম্রাজ্য গুটিয়ে নেওয়ার ভাবনা নেই। তারা পালিয়ে যেতে চান স্বরচিত উন্নয়নের গ্রাস থেকে।ডগলাস রসকোভ তার টিম হিউম্যান পডকাস্টএ নাকি এমনটাই বলেছেন।অবিশ্যি সব কথা বিশ্বাস হয়না এখন আর। মনে হয় এটাও নিজের পডকাস্ট এর ব্যাবসা বাড়ানোর ফন্দি নয়তো? ভাবুন অবিশ্বাস কোথায় গেছে। কাউকে বিশ্বাস করা যাচ্ছেনা এমনকি নিজের ছায়াকেও ।অবিশ্বাসের বুদবুদের মধ্যে ভালো আছি বলছেন?
এত দূর পর্যন্ত যদি কেউ পড়ে থাকেন তাহলে আপনার মন বিদ্রোহ করবে। আপনি ভাববেন এসব ব্রণ খুঁটে ঘা করা। আমরা তো এখন অনেক শান্তিতে আছি, সুখে আছি । তেমন ভাবে যুদ্ধবিগ্রহ নেই,অন্তত বেশিরভাগ স্থানে নেই।জীবনের,সম্পদের নিরাপত্তা আছে। আমরা সবাই স্বাধীন ভাবে বাঁচতে পারছি। এইরকম শান্তি আগে কখনো কি ছিল? এটা সত্য যে তেমন বিশ্বজোড়া বড় যুদ্ধ নেই। কিন্তু হবেনা একথা বলা যাবেনা। হচ্ছেও দু একটা। তাছাড়া যুদ্ধের ধরন পাল্টেছে, দখলদারির ধরন পাল্টেছে। দখল করতে এখন আর যুদ্ধের দরকার হয় না । দরিদ্র দেশগুলি এখন সবাই উন্নত দেশগুলির ফ্রাঞ্চাইজি। যেমন পাকিস্তান এখন চিনের ফ্রাঞ্চাইজি, অতীতে ছিল আমেরিকার। পরাধীনতা এখন আসছে ভিন্ন রূপে। কর্মক্ষেত্রে যেসব চুক্তি ভিত্তিক শ্রমিকরা কাজ করেন তাদের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। তাদের মানবাধিকার বলে কিছু নেই। হোম ডেলিভারি বয়রা, কেয়ার গিভাররা সকলেই বিশেষ প্রজাতির দাসের মতো। এদের জীবন প্রাচীনকালের চাকর থেকে কোন অংশে ভালো নয়। এমনকি কখনো কখনো ক্রীতদাস এর মতই! ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের সকলকেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স(AI) এর দাসত্ব করতে হবে। তখন আর সাহিত্য রচনা, ছবি আঁকা, ছবি তোলা,জটিল অপারেশন করা কোন কিছুতেই মানুষের প্রয়োজন হবে না। করে দেবে আর্টিফিশিয়ালি ইন্টেলিজেন্ট রোবট। তর্ক উঠবে রোবট বানাবে বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সফটওয়্যারটা তৈরী করবে তো মানুষ। হ্যাঁ কথাটা সত্য। মুষ্টিমেয় বুদ্ধিমান মানুষ সেগুলো বানাবে। নিয়ন্ত্রণ থাকবে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে। আর আপামর জনসাধারণ পরিণত হবে দাসে। এখনো যে খানিকটা তেমনই চলছে তা না বলে দিলেও চলে।
এবার আসা যাক সুখের ব্যাপারে। আমরা রেস্টুরেন্টে বেশ গাল ভরা নামের খাবার অর্ডার করে, বড় বিলাসবহুল গাড়ি চেপে , দশ তলায় ফ্ল্যাট কিনে ভাবি আমরা কত সুখে আছি। অতীতে মানুষ কতই না অসুখে ছিল।না ছিল ভালো খাবার,না যানবাহন,না চকচকে বাসস্থান। কিন্তু জানেন কি এসবই ডোপামিন আর সেরাটোনিন এর খেলা। এরা হলো নিউরোট্রান্সমিটার। আপনার মনের সুখ, দুঃখ, আবেগ এইসব অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। এখন আপনি যে সমস্ত আধুনিক কর্ম করে আনন্দ লাভ করছেন প্রাচীন মানুষও একই রকম আনন্দে ছিল। হয়তো বা একটু বেশি আনন্দেই ছিল।কারণ মানসিক উদ্বেগ কম ছিল।আমাদের মেট্রোপলিটন সিটিতে ফ্ল্যাট কেনার আনন্দ আর আদিম মানুষের প্রথম কুড়ে ঘর বানানোর আনন্দ একই।এখন বরং অভিজাত মানুষ পয়সা খরচ করে বন ফায়ার করে । আগে তো হরিণ শিকার করে এমনই গোল হয়ে বসে সবাই মিলে খেত। মনে পড়ে ছোটবেলায় কদাচিৎ পাউরুটি পেয়ে গেলে চায়ে ডুবিয়ে খেতে যে আনন্দ হতো অনেক পরে বার্গার খেয়ে তার থেকে কোনো অংশে বেশি আনন্দ হয়নি। পুরাটাই কিন্তু নিউরোট্রান্সমিটারের খেলা। ক্ষরণ যত বেশি তত আনন্দ। বয়স কালে এগুলির ক্ষরণ কমে যায় বলে মানুষ আর কিশোর বেলার মতো সামান্য কারণে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারে না । এই সমস্ত কেমিক্যাল এর খেলা পুরো না হলেও কিছুটা অন্তত সহজেই বোঝা যায়। দেখবেন আপনারই আশেপাশে এমন লোক আছে যারা সবেতেই খুশি, এমনকি ব্যর্থতাতেও। আবার এমনও লোক পাবেন যে কিছুতেই খুশি নয়। তারা লটারি পেয়ে গেলে টাকাটা নিয়ে করবে কি সেই দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারে না। এমনকি সেই মুহূর্তটুকুও আনন্দ করতে পারে না। আসলে এদের পার্থক্য ওই নিউরোট্রান্সমিটারের লেভেলের পার্থক্য। তাই আমরা সুখে আছি না পূর্বজরা সুখী ছিল সেটা মাপা দুরুহ নয়, প্রায় অসম্ভব।অনেক সুখে আছি নিঃসংশয়ে বলা যাবে কি?
আবার হয়তো আপনি বলবেন এত বড় বড় লেকচার তো দিলেন, তাহলে করবেন কি ? আবার বনে গিয়ে বাস করবেন? মোটেও না। বনে যাওয়ার পথও বন্ধ হয়ে গেছে। সেই বিধাতা পুরুষ যেদিন বৃষস্কন্ধ আর উন্মুক্ত প্রান্তর কেড়ে নিয়ে প্রাচীন হোমো স্যাপিয়েন্সের হাতে গগলসটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন( পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতা); সেই চকচকে গগলস পরে যেদিন সেই প্রাচীন মানুষটি স্বাক্ষর করেছিল চুক্তি পত্রে সেদিন থেকে বন্ধ হয়ে গেছে পেছনে ফেরা। কেউ কেউ জৈব পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করে, স্বনির্ভর গ্রাম গড়ে, সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্টের কথা বলে, বাঁধ বা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, ভেগান ডায়েট খেয়ে কিম্বা ডান নাক দিয়ে শ্বাস নিয়ে বাম নাক দিয়ে নিশ্বাস ছেড়ে চেষ্টা করেন ফিরে যাওয়ার। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ফিরে যাওয়ার কখনই সম্ভব নয়।
তাহলে উপায় কি? আমরা কি ধ্বংসের দিকে ধাবমান? কোন কি উপায় নেই? উপায় আছে। প্রকৃতি, ধরিত্রী মাতাই সেই উপায় করে দিতে পারে।কোনো কোয়ান্টাম কম্পিউটার পারবে না। একসময় বাতাসে যখন অক্সিজেন ছিল না তখন গোটা পৃথিবী ছুড়ে জুড়ে ছিল অবায়ুজীবী জীবদের রাজত্ব। যাদের বাঁচার জন্য সরাসরি অক্সিজেন লাগত না। তারপর যখন আস্তে আস্তে জল ভেঙে অক্সিজেন তৈরি হলো, বাতাস অক্সিজেনে পূর্ণ হল তখন আস্তে আস্তে উদ্ভব হল বায়ুজীবী জীবের। এখন পৃথিবীজুড়ে বায়ুজীবী জীবের প্রাধান্য। অবায়ুজীবীরা এখন সংখ্যালঘু। আমরা আমাদের অবিমৃষ্যকারিতার জন্য উপকারী ওজোন স্তরে ফুটো করে দিয়েছি (প্রকৃতপক্ষে স্তর পাতলা হওয়া)। আশ্চর্যজনকভাবে মেরু অঞ্চলে প্রকৃতি নিজে নিজেই সেলাই করে নিচ্ছে ওজোন স্তর। চেরনোবিল এ পারমাণবিক দুর্ঘটনায় ভয়াবহ তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল।হিসাব অনুযায়ী সেখানে আরো কয়েকশো বছর কোন জীব থাকা সম্ভব নয় । কিন্তু সেখানে গাছপালা তো জন্মেছে, সঙ্গে ছোট ছোট শেয়াল জাতীয় প্রাণী নাকি দেখা গেছে যাদের তেজস্ক্রিয়তা সহ্য করার ক্ষমতা অধিক। তাই প্রকৃতি ভরসা। মানুষই হয়তো একদিন বিবর্তিত হয়ে যাবে বা মানুষের মতোই অন্য কোন জীব পৃথিবীতে আবির্ভূত হবে যারা প্লাস্টিক থেকে পুষ্টি সাধন করবে । এতো প্লাস্টিক বানানোর জন্য পুর্বজদের মানে আমাদের প্রশংসা করবে। যারা অক্সিজেনের বদলে কার্বন ডাই অক্সাইড এর সাহায্যে বিপাক ক্রিয়া চালাবে। উষ্ণ পৃথিবী হয়তো তাদের কাছে পরম মনোহর বাসযোগ্য স্থান হয়ে উঠবে।আপাতত এটুকু ভরসা রেখে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। চলুন এগিয়ে যাই। ওহো দাঁড়ান একটু গ্রামটা ঘুরে যাই, মানে ইনস্টাগ্রামটা।
সংগ্রহ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ -৯৭৩২৫৩৪৪৮৪
0 Comments