জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ২৯ / সালেহা খাতুন

কালো চশমায় আমার মাতামহ মহ.মুস্তাফা হোসেন।


শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ২৯ / সালেহা খাতুন 

জন্ম থেকেই তো আমি দাদুর নয়নের মণি। আমার পড়াশোনার সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসাহদাতা তিনিই। মাধ্যমিকের পর আমাকে আর পড়াবেন কিনা এ দোটানায় বাবা যখন চুপচাপ ছিলেন দাদু এসে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করেছিলেন। বলেছিলেন, “কী ভেবেছেন আপনি? এতো ব্রেনি মেয়েকে আপনি পড়াবেন না?” সে যুদ্ধে দাদু জয়ী হয়েছিলেন। অমন বাঙালি ভদ্রলোক আমি আর দেখিনি। সারাজীবন ধুতি পাঞ্জাবী পরেছেন। সুঠাম শরীরে নব্বই বছরের উপর পার্থিব পরমায়ু পেয়েছিলেন। 

আমাদের বাড়িতে বেশিদিন আসতে দেরি করলে, তাঁর সঙ্গে আমার পত্রালাপ হতো। ১৯৯২- ১৯৯৩ এ একটি পত্রে তিনি লিখলেন, “ সুচরিতাসু, তুমি লিখেছ তোমার অন্তরাত্মা আমাকে একান্তভাবেই ডাকছে। কেন ডাকছে সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার সেই চিরদিনের বাসনা আমার জীবনকাহিনি শোনার। নিশ্চয়ই তোমাদের ওখানে যাবো। একটা মাস ধৈর্য ধরো, তোমার ওখানে গিয়ে একেবারে এক সপ্তাহ থাকবো। জীবনের উপান্তবেলায় এসে পৌঁছে গেছি। এখনও সংসার আমাকে ছুটি দিচ্ছে না। এক সপ্তাহের জন্য যাবো তাও আবার দরখাস্ত করতে হবে। ভাবতে পারো, আমি এদের বৃদ্ধ বাবা; কোথায় আমার একটু যত্ন করবে, না আগের জীবনের পাওনা কড়ি সব সুদে আসলে মিটিয়ে নিচ্ছে। তোমার ওখান থেকে ফিরে এসে আবার জবাবদিহি করতে হবে, এতোদিন থাকলে সংসার অচল হয়ে যাবে।
তুমি আবার কী খাঁদু-দাদু লিখে পাঠিয়েছ সেটা পড়েছি। সত্যি সংসার নামক অসার বস্তুটার রাশ টেনে আমি এখন আমার খাড়া নাকটাকে হারিয়ে তোমার খাঁদুদাদুই হয়ে গেছি। আগে থেকেই বলে রাখি আমি এখন অপাংক্তেয়, আমার কোনো মূল্য নেই। আমি বর্তমানে সবার করুণার পাত্র। কী শুনবে বলোতো আমার জীবনকাহিনি? আর কিছু লিখছি না। কেননা বুঝতেই পারছো চোখে এখন খুব কম দেখি। উত্তর না দিলে অভিমান করে কথা বলবে না তাই লিখলাম। কষ্ট করে উদ্ধার করো।
         তুমি আমার স্নেহ চুম্বন নিও।”

যখন আমি অনার্স পড়ছি, তখন দাদু এলে আমার পাশে ঠায় বসে থাকতেন। মন দিয়ে শুনতেন। আমি জোরে জোরে শব্দ করেই পড়তাম। দাদু কোনো কোনো জায়গা আমাকে একাধিকবার পড়তে বলতেন। বলতেন, “আর একবার বলোতো শুনি ওই জায়গাটা আমি ঠিক বুঝতে পারিনি”। কী অসাধারণ তাঁর জ্ঞানস্পৃহা! স্টেশনে বসে ট্রেনের অপেক্ষা করতেন আর টাইমটেবিল পড়তেন। বলতেন কত জায়গা আছে! আমরা হয়তো সব জায়গায় যেতে পারব না কিন্তু জেনে তো রাখি। 
১৯৯২-৯৩ এ লেখা কবিতার পাণ্ডুলিপি

সাহিত্য যা পাঠ করছি তার সমস্তই দাদুর উপর প্রয়োগ করতাম। ঐ সময় যা লেখালেখি করতাম তার সবকিছু দাদু পড়তেন আর আমাকে উৎসাহ দিতেন। ডায়েরি লিখতে গিয়ে সংসারের কাজে বা পড়াশোনায় ফাঁকি দিচ্ছি, এই মর্মে মা মাঝে মাঝেই বলতেন ডায়েরি মেন্টেন করলে হবে না।
🍂
কিন্তু হায়! সেই ডায়েরিতেই দাদুর সঙ্গে কথোপকথনের কত নিদর্শন এখন পেয়ে যাই। আর নিজেই নিজের পিঠ চাপড়াই। বারেক খুঁটিনাটি কথাগুলো লিখে রেখেছিলাম না হলে স্মৃতিতে যাতায়াতের পথ এতো সুগম হতো না।
দাদু দুঃখের কথা শোনালে আমি হো হো করে হাসতাম। দাদু বলতেন, “ওরে বদমাশ মেয়ে আমার কথায় তোমার হাসি পায়, আর বলবো না যাও”। দাদুকে বলতাম আমার হাসি ক্রন্দনের ন্যায় শোকোদ্দীপক এবং ক্রন্দন হাসির ন্যায় চিত্তহারি। অতএব আমাকে ভুল বুঝবেন না। দাদু তো আমার সব পড়া শুনতেন। বললেন বুঝেছি তুমি মোহিতলালের ‘আমি’ পড়েছ।
দাদুকে স্মরণ

 নজরুল ইসলামকে দাদু স্বচক্ষে দেখেছেন।দাদু যেহেতু পোস্টমাস্টার ছিলেন বিভিন্ন জায়গায় তিনি কাজ করেছেন। ১৯৩৩-৩৪ সালে হুগলিতে নজরুল ইসলামকে ‘চল্ চল্’ গানটা গাইতে দেখেছিলেন। নজরুলের মতো করেই তিনি আমাকে সেই গান গেয়ে শুনিয়ে ছিলেন। আমিও দাদুর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সে সময় নজরুলকে নিয়ে একটি কবিতা লিখে দাদুকে উপহার দিয়েছিলাম –
ওগো নজরুল

বিধির দর্প খর্বকারী ওগো নজরুল
তুমি ভেঙেছ কত সাম্প্রদায়িক মূল 
বাধা নিষেধের তরী বেয়ে
চলেছিলে আল্লার নাম আর শ্যামামায়ের গান গেয়ে।

সৈনিক কবি ওগো কাজী
‘শনিবারের চিঠি’ দিত গালি রোজই।
ছিলে তুমি বিশ্বকবির অতি স্নেহাসক্ত
আমরা বাঙালি তোমারই যে ভক্ত।

রাজবন্দী ওগো বিদ্রোহী বীর 
তুমিই শেখালে উচ্চ করিতে শির,
জাতির জীবনে তুমি এনেছিলে বসন্ত
কবিগুরু তাই তোমায় দিলেন ‘বসন্ত’।

সাম্যবাদী ওগো নজরুল ইসলাম
‘মোহাম্মদী’ বলেছিল তুমি নাকি ইসলামের দুষমন!
মানিনা আমরা এ সকল কথা
জানি শুধু লিখে গেছো মানুষেরই ব্যথা।

নবযুগের ওগো বার্তাবাহক
দারিদ্র্যতাই ছিল তোমার একমাত্র সহায়ক,
দারিদ্র্যই তোমায় করেছিল মহান
হিন্দুমুসলমানকে তুমি করেছিলে সমান।

বাল্যকালের ওগো দুখুমিয়া
তোমার জন্মভূমি ছিল চুরুলিয়া।
ওগো ‘তারা খ্যাপা’ আর ‘নজর আলি’
আধুনিক মানুষ আর তোমারে দেয় না গালি।

প্রেমেন্দ্র মিত্রের বাণী আজ সত্যরূপেই দিয়েছে ধরা – “তাহারে বরিতে আজ মহাকাল আপনার হাতে আঁকে জয়টিকা!” অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ চিরকালই ত্রিকালদর্শীর হাতে কেমন ধরা থাকে দেখে অবাক হচ্ছি।
(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments