বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক ভবতোষ দত্ত
নির্মল বর্মন
"যতদিন পারি পরাজয় স্বীকার করব না"
( ভবতোষ দত্ত)
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ , কবি সাহিত্যিক অধ্যাপক ড. ভবতোষ দত্ত । বর্তমান সমাজ ও সভ্যতার চিন্তানায়ক।বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকও বটে। ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯১১ বিহারের পাটনার বাঁকিপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হেমেন্দ্রকিশোর দত্ত ও মাতা যোগমায়া দত্তের সুসন্তান ভবতোষ দত্ত, পিতার কর্মস্থলে পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। প্রাবন্ধিক ভবতোষ দত্তের পিতা হেমেন্দ্রকিশোর দত্ত , পাটনা ন্যাশনাল কলেজের রসায়নে অধ্যাপক ছিলেন। পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের শ্রীহট্টের লখাই নামক স্থান। সুতরাং পড়াশোনা ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল থেকে তৃতীয় স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ঢাকা জগন্নাথ কলেজ থেকে প্রথম স্থান অধিকার করে আই.এ পাস করার পর কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে বি.এ পাশ করেন। ১৯৩২ এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম.এ পাস করেন। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স এ গবেষণা করে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। গবেষণার বিষয়- "পিছিয়ে থাকা অর্থনীতি"। অর্থনীতির গবেষক হিসাবে অর্থনীতির আলোচনা প্রাঞ্জল ও সুখপাঠ্য হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত।
অধ্যাপক ড. ভবতোষ দত্ত চাকরিজীবন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে বর্ধমান রাজ কলেজ হয়ে রিপন কলেজ ও ইসলামিয়া কলেজ অধ্যাপনা করেছিলেন।অবশেষে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপক হিসাবে সুনামের সঙ্গে কাজ করার পর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকেই অবসর গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্সির ইমেরিটাস অধ্যাপক হন। অধ্যাপক দত্ত সর্বদা সজাগ তীক্ষ্ণ সংবেদনশীল হৃদয় ও মস্তিষ্কের অধিকারী ছিলেন। সব সময় কাজ হিসেবে পড়াশোনা কে বেছে নিয়েছিলেন। শেষ বয়সে দৃষ্টিহীন হয়ে কাটিয়েছেন। ছাত্ররা প্রায় লেখালেখিতে সহযোগিতা করতেন। স্ত্রী অমলা দত্তের প্রাণ বিয়োগের পর খুব ভেঙে পড়েছিলেন। শেষমেষ ৬৫ বছর বয়সে কলকাতাতে ১২ ই জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে মৃত্যু ঘটে প্রখ্যাত ভারতীয় অর্থনীতিবিদ , প্রথিতযশা অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখক ভবতোষ দত্ত মহোদয়ের।
অধ্যাপক ড. ভবতোষ দত্ত বিশ্বভারতী পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর তাগিদে ভারতীয় মনীষীদের অর্থনীতি সংক্রান্ত প্রবন্ধ রচনায় ব্রতী হয়ে বাজিমাত করে দিয়ে ছিলেন। বিশ্বভারতী পত্রিকা ছাড়াও অন্যান্য পত্রিকায় সুললিত ভাষায় রচিত বিভিন্ন অর্থনীতি বিষয়ক প্রবন্ধগুলি "অর্থনীতির পথে" গ্রন্থে সংকলিত । অর্থনীতি বিষয়ে ভবতোষ দত্তের জনপ্রিয় গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল :-— "অর্থবিজ্ঞান", "আর্থিক উন্নয়ন", "দৃষ্টিকোণ", "তামসী", "ভারতের আর্থিক উন্নয়ন" প্রভৃতি। এছাড়া
ইংরেজি ভাষায় রচিত গ্ৰন্থগুলির মধ্যে দৃষ্টান্ত স্থাপন গ্ৰন্থ হল :-
" দা ইভলিউশন অফ ইকোনমিক থিঙ্কিং ইন ইন্ডিয়া",
"ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট এন্ড এক্সপোর্ট; এ স্টাডি অব দ্য ইম্প্যাক্ট অফ ইন্ডিয়ান ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অন এক্সপোর্ট"।
"এসেজ ইন প্ল্যান ইকনোমিক্সঃ এ কমেন্টটারি অন ইন্ডিয়ান এক্সপেরিয়েন্স"।
"ইন্ডিয়ান ইকোনমিক থট ইন টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি পারসসেপটিভস"।
" ইকোনমিক্স অব ইন্ডাসস্ট্রিয়ালাইজেশন"ইত্যাদি।
প্রাবন্ধিক ড .ভবতোষ দত্তের খ্যাতির উচ্চাঙ্গ শিখরে অধিষ্ঠানের কারণ হল –
তিনি মূলত চিন্তা নায়ক হিসেবে পরিচ্ছন্নতা ও স্বচ্ছতা, সততা,যৌক্তিক পারম্পর্য, নিখুঁত তথ্যের সুসমাবেশ সৃষ্টি করে সহজ, সরল গদ্যভাষা—যা পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও কচকচি, কূটিলতা মুক্ত। তাই সমকালীন অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও সমাজনীতি সুসমঞ্জস্য প্রতিফলন প্রাবন্ধিক ভবতোষ দত্তের লেখনীতে অবলীলাক্রমে ঝরে পড়েছে। বস্ততঃ ভবতোষ দত্তের জীবনদর্শন প্রণিধানযোগ্য—“জীবনকে সহজভাবে নিতে হবে, করণীয় কাজটা বিনা অভিযোগে করতে হবে, কাজ থেকে আনন্দ আহরণ করতে হবে, চোখ থাকবে খোলা, মন থাকবে সর্বপ্রকার যুক্তি, তথ্য ও রসগ্রহণের জন্য উন্মুক্ত, ভবিষ্যতের ভাবনাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে না—এই জীবনদর্শনেই আমরা নিজেদের আবিষ্ট করেছিলাম।” ফলত এই জীবনদর্শনই অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ভবতোষ দত্তকে প্রাবন্ধিক হিসেবে বাংলার সারস্বত সমাজে বিস্তৃতি দান করেছে।
গবেষক ভবতোষ দত্ত অর্থনীতিকেন্দ্রিক আলোচনার মধ্যে চিন্তার স্বকীয়তা বর্তমান সমাজে কার্যকর ভূমিকা পালন করে চলেছে। উদাহরণ – -“ইকনমিকস্ অব্ ইনডাসট্রিয়ালাইজেশন"। গবেষক দত্ত বাহাদুরের,সমাজ জীবনে দুই বিশ্বযুদ্ধের কুপ্রভাব ও কু প্রতিভার, বিশ্বব্যাপী মন্দা অর্থনীতি,, দুর্ভিক্ষ, মহামারী ,দাঙ্গা ভারত
বিভাজনএবং নানা আর্থ-সামাজিক উত্থান-পতনের ঠাসবুননের কথা বিভিন্ন গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট রয়েছে। তা সত্ত্বে ও তথ্যের সমাবেশে এবং চিন্তার স্বচ্ছতায় প্রবন্ধ যে কত মনোরম ও আস্বাদনীয় অনুভূতি লাভ করতে পারে, ভবতোষ দত্তের প্রবন্ধগুলি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। অধ্যাপক দত্তে'র "আটদশক" প্রবন্ধ গ্রন্থটি স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ হলেও প্রাবন্ধিক হিসেবে বিদগ্ধমহলে পরিচয় উক্ত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে "অর্থনীতির পথে" গ্রন্থে "সমবায় ও রবীন্দ্রনাথ" প্রবন্ধটিতে -- রবীন্দ্রনাথ সমবায় নিয়ে যেসব ভাবনা চিন্তার মূল্যবান বক্তব্য বিভিন্ন জায়গায় পরিবেশন করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের উক্ত বিষয়ের মানসিকতা ও ভাবনৈতিকতাকে অবলম্বন করে রচিত হয়েছে এই সাড়াসাগানো প্রবন্ধটি।
প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ পরাধীন ভারতবর্ষে বঙ্গভঙ্গের পর ভারতে বসবাসকারী জাতিকে স্বনির্ভর ,স্বাবলম্বী ও আত্মবিশ্বাসী করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। স্বায়ত্তশাসন, পঞ্চায়েত ভাবনা প্রভৃতি আলোচনার পর নানা প্রবন্ধ নিবন্ধে সমবায় প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে প্রাবন্ধিক ড.ভবতোষ দত্ত রবীন্দ্রনাথের সমবায় সম্পর্কিত ধ্যান ধারণাকে এই প্রবন্ধে সুললিত ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন।
ভারতের সমবায় সমিতির প্রধান কাজ গরীব মানুষের জন্য ঋণদান সমিতি গঠন। প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ‘ভাণ্ডার' পত্রিকায় সে সময়ের ঋণদান সমিতির সংখ্যা ও তাদের গুনাবলী ও কার্যাবলী সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। প্রসঙ্গান্তরে এই "ভান্ডার" পত্রিকায় জ্বলদর্চি র জনপ্রিয় সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠী,কবি দেবাশিস প্রধান ও ড.নির্মল বর্মন লিখে চলেছেন।
রবীন্দ্রনাথ সমবায় সম্পর্কে সহজ ও সর্বজনগ্রাহ্য যুক্তি ও বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছেন বিভিন্ন প্রবন্ধে। “রাশিয়ার চিঠি'র বিভিন্ন জায়গায় সমবায় সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মনোরঞ্জন আলোচনা বেশ মনোজ্ঞ। রাশিয়া বা অন্যান্য দেশে সমবায়ের মাধ্যমে যখন আমাদের নীচের তলায় একটা কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে তখন ভারতের সমবায় টাকা ধার দেবার প্রতিষ্ঠান হিসাবে জ্বলজ্বল করছে।
সমবায় কেন্দ্রীক প্রবন্ধগুলি 'তে সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য :-
১. চাষীদের পৃথকভাবে কাজ না করে একত্রিত হয়ে কাজ করা।
২. চাষের কাজে পাশ্চাত্য ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করবার পদ্ধতি জানা।
৩.দরিদ্র চাষীদের ক্ষেত্রে সমবায় পদ্ধতিতে চাষ করাটা উন্নতির উপায়।
৪. সমবায়ের কুফল তাকে তখনো প্রভাবিত করেনি।
‘সমবায় নীতি' সংক্রান্ত ভাবনা নানা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন তার কয়েকটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:–
১. সমবায়ের নীতি হবে সকলের মিলনে উন্নতি সাধন, তার মধ্যে কোন চাতুরি বা কৌশল থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। ২.সমবায় প্রণালীতে ধন উপার্জন যা তৎকালীন বিশ্বের মানুষেরা অর্থনীতির ক্ষেত্রে সূত্র হিসেবে মেনে নিয়েছে।
৩. সমবায় প্রণালী শুধু ব্যক্তি মানুষের উপার্জন পদ্ধতিকে একত্রিত করে না বরং সমবায় বিকেন্দ্রীকরণের সহায়তা করবে বলে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন।
🍂
৪. সমবায় ফুড ও বৃহৎ উৎপাদন সংস্থার অসুবিধা দূর করে কর্মদক্ষ শ্রমিক ও উৎপাদন পদ্ধতির সূচনা করবে।
প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথের সময়ে ভারতবর্ষে "হোমরুল আন্দোলন", "জালিয়ানওয়ালাবাগ" এবং "অসহযোগ আন্দোলন" মানুষের মনে আস্থা ঠিক মতো আনতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতি দিয়েএই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে- "আবেদন-নিবেদনের থেকে স্বাবলম্বনই সবচেয়ে জরুরী"।
আর্থিক অসাম্যের অন্যায়-এর কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন ।
কিন্তু আর্থিক অসাম্য রাশিয়াতে ছিল না, কারণ সোভিয়েত রাশিয়ার নীতি ছিল বৈষম্যের বিরোধী। ‘রাশিয়ার চিঠি'তে রাশিয়ার ধর্মগরিমার অনুপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন স্বয়ং কবি। রাশিয়াতে ধনী দরিদ্র বৈষম্য দূর হয়েছে সোভিয়েট বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে।
রবীন্দ্রনাথ কে রাশিয়া আকৃষ্ট করেছিল তার কারণ কৃষির উন্নতি । রাশিয়ার কালেক্টিভ ফার্ম, এর সঙ্গে কৃষি সম্পর্কিত ধারণার মিল । রাশিয়াতে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন—"সমবেত কৃষি ব্যবস্থা ও কৃষিতে আধুনিকতম প্রণালীর ব্যবহার, যান্ত্রিক কৃষির প্রসার এবং সেজন্য উৎপাদনের হার বৃদ্ধি"। ড . ভবতোষ দত্ত মহোদয় রবীন্দ্রনাথের কলমে - "রাশিয়াতে ব্যক্তিগত সম্পত্তি সমবায় প্রথায় কৃষির জন্য যৌথ সম্পত্তি হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ভারতে হবু সোভিয়েটরা এজন্য জবরদস্তি করেছে। সেজন্য জবরদস্তি বাদ দিয়ে ঐকত্রিক চাষ বা কো-অপারেটিভ ফার্মিং-এর কথা উল্লেখ করেছেন"।
সুতরাং প্রথিতযশা অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ,ও বিশিষ্ট লেখক ড.ভবতোষ দত্তের অর্থনীতির নৈতিকভাবনা ও রচিত মূল্যায়ন বর্তমান সময় ও সমাজের প্রতিবিম্ব।
অধ্যাপক ড. ভবতোষ দত্ত ১৯৬২ সালে অবসর গ্রহণের পর ১."পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা অধিকর্তা" পদে নিযুক্ত হন। সেই সঙ্গে:-
২. পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা সচিব।
৩. ব্যাংকিং কমিশনের সদস্য।
৪. সংবাদপত্রের আর্থিক অবস্থা সমীক্ষা কমিশনের সদস্য।
৫. রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার পরিচালক মন্ডলীর সদস্য।
৬. শিল্প পুনর্গঠন কর্পোরেশনের অধিকর্তা।
৭. ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ সোশ্যাল সায়েন্স এন্ড রিসার্চের কর্মকর্তা।
ড.দত্ত জীবনকৃতি অর্থনীতি ,সামাজিক কাজকর্ম ও লেখালেখি'র জন্য ভারত সরকার ১৯৯০ এ অসামরিক মহান সম্মান "পদ্মবিভূষণ" পুরস্কার প্রদান করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার "রবীন্দ্র পুরস্কার"-১৯৯১ এ ভূষিত করেছেন। তাসত্ত্বেও কালের অমোঘ বিধানে বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক হয়েও বাংলার সারস্বত সমাজ তথা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
0 Comments