বুড়ির বাড়ি পায়েস ভোজন
চিন্ময় দাশ
সেনাবাহিনী থেকে ছুটি হয়ে গেছে এক সৈনিকের। বয়স হলে সব সেনাকেই ঘরে যেতে হয়। এরও হয়েছে। জিনিষপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে চলেছে লোকটি।
সারাদিন অনেকটা পথ হেঁটেছে সে। শরীর ক্লান্ত। আর এদিকে, খিদেও খুব। সন্ধ্যাও নেমে আসছে। রাতটুকুর জন্য মাথা গোঁজার মতো কোথাও একটু ঠাঁই পাওয়া দরকার। সেই সাথে একটু খাবারও।
চলতে চলতে একটা গ্রামে এসে পৌঁছল লোকটি। প্রথমেই যে বাড়িটা চোখে পড়ল, সেটার দরজায় গিয়ে কড়া নাড়তে লাগল সৈনিকটি।
এক বুড়ির বাড়ি সেটা। বুড়ি দরজা খুলে দেখল, একজন অচেনা মানুষ তার সামনে দাঁডিয়ে। বুড়ি তাকে জিজ্ঞেস করল—কী চাই গো?
--চাকরি থেকে ছুটি হয়ে গেল। বাড়ি যাচ্ছি এখন। কিন্তু আরও অনেকটাই পথ যেতে হবে আমাকে। রাত টুকুর জন্য একটু জায়গা হবে এখানে, বুড়ি মা?
লোকটির আপাদ মস্তক চোখ বুলিয়ে নিল বুড়ি। বলল—হবে। ভিতরে চলে এসো।
ঘরে ঢুকে ভারি ব্যাগটা ঘরের এক কোণে রাখল সৈনিকটি। একটু আরাম বোধ হোল তাতে। বুড়িকে বলল—কষ্ট করে আমাকে কিছু খেতে দিতে পারো, বুড়িমা? অনেকক্ষণ পেটে পড়েনি কিছু।
বুড়ির ঘরে খাবারের ঘাটতি নাই। কিন্তু হলে কী হবে? স্বভাবে ভারি কৃপণ সে। খাবারের ভাগ অন্য কাউকে দিতে রাজি নয়। তাড়াতাড়ি বলে উঠল—কিচ্ছুটি নাই গো আমার ঘরে। সারাটা দিন আমারও কিছু জোটেনি আজ।
কিন্তু সেনাবাহিনীর মানুষের চোখকে ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ কাজ নয়। বুড়ি যে মিথ্যে কথা বলে, কিপটেমি করছে, বুঝতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু বুড়িকে সেটা বুঝতে দেওয়া যাবে না।
ঘরটার এক কোণে একটা কুড়ুল পড়ে ছিল। সৈনিক বলে উঠল—আরে, এই তো পেয়ে গেছি। এই কুড়ুলটা দিয়েই তো দিব্বি পায়েস বানিয়ে ফেলা যাবে।
এমন কথা দুনিয়ার কে কোথায় শুনেছে! বুড়ি তো আকাশ থেকে পড়ল এ কথা শুনে। বলে উঠল—বলছো কী তুমি? কুড়ুল দিয়ে পায়েস? তাই আবার হয় না কি?
--আমরা সেনারা কত কিছু দিয়ে যে কত কিছু খাবার বানিয়ে ফেলি, তোমরা ভাবতেও পারবে না। এক কাজ করো, বুড়িমা। কুড়ুলটা ভালো করে ধুয়ে এনে দাও তো। তার পর দ্যাখো, কী ভাবে পায়েস বানিয়ে ফেলি।
--বাপ-ঠাকুরদার কালেও এমন উদ্ভট কথা শুনিনি কখনও।
--আগে শোননি, তাতে কী হয়েছে? আজ নিজের চোখে দেখে নাও। অভাবের সময় কাজে লেগে যবে।
বুড়ি গিয়ে কুড়ুলটা ধুয়ে এনে দিল। সৈনিক বলল—এবার শুধু কড়াইটা দাও তোমার। তার পর দ্যাখো, কেমন করে কুড়ুল দিয়ে পায়েস বানাতে হয়।
বুড়ির কৌতুহল যত বাড়ছে, তৎপরতাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। রান্নাঘরে গিয়ে, চটপট একটা কড়াই এনে দিল।
মুখে হাসি সৈনিকের। জল ছিল তার ভারি ব্যাগটাতে। উনুনে কড়াই বসিয়ে, জল ঢেলে দিল। খানিক বাদে জল ফুটতে শুরু হোল। কুড়ুলটাকে ফেলে দিল ফুটন্ত কড়াইয়ে। দেখে শুনে, বুড়ির চোখ গোল গোল। মুখে কথা সরছে না।
জল টগবগ করে ফুটে উঠতে লাগল যেই, সৈনিক চামচ দিয়ে নেড়ে নেড়ে দিতে লাগল। এবার চামচে জল তুলে মুখে দিল, যেন চেখে দেখছে। বলে উঠল—আর দু’-এক মিনিট। পায়েস হয়ে এসছে। যা স্বাদ হয়েছে না, বলবার নয়।
বুড়ি বলে উঠল—স্বাদেও ভালো হয়েছে?
--সে তো হয়েইছে। তবে,আরও ভালো হোত, তোমার ঘরে যদি একটু লবণ থাকতো। কী আর করা যাবে।
বুড়ি বলল—না, না। লবণ আছে আমার ঘরে। দৌড়ে গিয়ে খানিকটা লবণ এনে, ধরিয়ে দিল।
কড়াইতে লবণ ফেলে দিয়ে, নেড়ে চেড়ে আবার একবার চেখে দেখল সৈনিক। মুখে বলল—হ্যাঁ, এবার বেশ হয়েছে। আরও ভালো করা যেত পায়েসটা। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হোল, তোমার ঘরে ওটস নাই। থাকলে, স্বাদ আরও ভালো হোত।
বুড়ি বলল—একটু সবুর করো তো। আমি দেখছি, ওটস পাই কি না। বলেই, দৌড় লাগালো বুড়ি। খানিক বাদে একটা ঢাউস ব্যাগ এনে ধরিয়ে দিল সৈনিককে। যতটা দরকার নিয়ে নাও তুমি। পায়েস যেন ভালো হয়।
প্রয়োজন মতো ওটস কড়াইতে দিয়ে, মাঝে মাঝে নেড়ে দিচ্ছে সৈনিক। বুড়ি চেয়ে চেয়ে দেখছে। চোখে মুখে বেশ খুশির ছাপ। কুড়ুল দিয়ে পায়েস রান্না করা যায়, কখনও দেখেনি সে।
আবার একবার এক চামচ পায়েস তুলে চেখে দেখল সৈনিক—বাহ, হয়ে এসেছে এবার। স্বাদ যা হয়েছে না, বলবার নয়।
একটু থেমে, বুড়িকে বল--আরও সুস্বাদু করা যেত, পায়েসে যদি খানিকটা দুধ দিয়ে দেওয়া যেত। অনেক দিন জিভে লেগে থাকত পায়েসের স্বাদ। বুড়িমা, এটা কিন্তু ভারি দুঃখের কথা, তোমার ঘরে একটু দুধ নাই। দুধ দিতে পারলে, ভারি মিষ্টি সুগন্ধ বেরুত পায়েস থেকে।
--দাঁড়াও গো, ভালোমানুষের পো। একটু সবুর করো। বলেই, ছুটে রান্নাঘরে চলে গেল বুড়ি। ফিরে এলো এক জাগ ভর্তি দুধ নিয়ে। এই নাও দুধ। যতটা দরকার নাও। কিপটেমি কোর না।
🍂
ভালো পরিমাণ দুধ মেশানো হোল। কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে, একবার আবার চেখে দেখে, সৈনিক বলল—স্বাদ যা হয়েছে, বলবার নয়। এতে যদি খানিকটা মাখন ছড়িয়ে দেওয়া যেত, দেখতে হোত না আর।
বুড়ি ভিতরে দৌড়ে গেল। ফিরে এলো মাখনের ভাঁড় বিয়ে—যতটা দরকার নিয়ে ছড়িয়ে দাও। কম নিয়ো না যেন।
পায়েসে মাখন ফেলে, ভালো করে ঘেঁটে দিল সৈনিক। বুড়িকে বলল— পায়েস রান্না হয়ে গেছে। এবার দুটো বাটি আর দুটো চামচ নিয়ে এসো। না কি, চামচও নাই তোমার?
বুড়ি হেসে বলল—কী যে বলো না তুমি। গেরস্ত বাড়ি। তাতে চামচ থাকবে না?
বুড়ি বাটি নিয়ে এলো। চামচও নিয়ে এলো। দুজনে খেতে বসে গেল। যা দরকার, সবই দেওয়া হয়েছে। স্বাদও ভালো হয়েছে তাতে।
বুড়ি আহ্লাদে ডগমগ। বলে উঠল—ভাগ্যিস তুমি এসেছিলে আমার কুঁড়েঘরে! কুড়ুল দিয়ে এমন তোফা পায়েস বানানো যায়,জানতাম না আমি! অন্যভাবেও বলতে পারো, কুড়ুলের পায়েস এমন সুস্বাদু হয় খেতে, জানতামই না।
সৈনিকের মুখে কোন জবাব নাই। চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। আর হাসছে নিজের মনে।
🍁
বাড়িতে বসেই রেজি.ডাক মাধ্যমে জ্বলদর্চির বিশেষ সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। যোগাযোগ হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৭৩২৫৩৪৪৮৪
0 Comments