শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৩১
সালেহা খাতুন
টুকু ওবাই আমি আর বাবা মা, ঘরে তখন আমাদের পাঁচজনের সংসার। সেটারও আবার তিন দুইয়ে বিভাজন ছিল। আমি আর টুকু এবং বাবা-মা-ওবাই। এরকম কেন বলছি? অবাক হচ্ছেন? আসলে একটি ঘরে আমি আর টুকু থাকতাম। আর একটি ঘরে মা-বাবা আর ওবাই থাকতো। শুধু ঘরেই নয় বাবা মা যখন বেড়াতে যেতেন তখন তিনজনেই যেতেন। আমাকে আর বোনকে বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য রেখে যেতেন। জ্যাঠামশাই বা দাদুকে ভার দিয়ে যেতেন আমাদের দেখভালের জন্য। নিজেরা রান্না করতাম। দাদু থাকলে দাদুর যত্ন নিতে হতো বেশি। নিত্যনতুন রান্না করে দাদুকে তাক লাগিয়ে দিতাম। তিনি উৎসাহ দিয়ে আমাদের সব রান্নাকেই বলতেন প্যালেটেবল। আমরা খুশিতে ডগমগ। কিন্তু হায়! সেবার রাজগীর থেকে ফিরে মা যখন রান্না করলেন তখন খেয়েদেয়ে দাদু বললেন, “মা এতোদিনে মুখ ছাড়লো”।
বাবা সুন্দরবন গেছেন ভাইকে নিয়ে। রাজগীর গেছেন মা এবং ভাইকে নিয়ে। মা একবার দিঘা গেছিলেন আমাকে আর ভাইকে নিয়ে। সেবার বাবা আর টুকু ঘরে ছিলো। পাঁচজনে একসঙ্গে কি কোথাও যাওয়া হবে না? অনেক অপেক্ষার পর তিরানব্বইয়ের নভেম্বরে পাঁচজনে একসঙ্গে গেলাম পুরী। আঠারো নভেম্বর পুরীর উদ্দেশ্যে আমাদের বাস যাত্রা শুরু হলো। সবথেকে মজা হলো সেবার রেণুদিরা ভাইবোনসহ অনেকেই গিয়েছিল। রেণুদির দাদার ব্যবস্থাপনাতেই তাজমহল লাইব্রেরি থেকে এই ভ্রমণের আয়োজন করা হয়। নন্দন কাননে পৌঁছতে সকাল নটা বেজে গেল। স্নান ও আনুষঙ্গিক নানান কাজ সেরে ভ্রমণের আনন্দে আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেলাম।
রাজগীরে মা-বাবা-ওবাই ও অন্যান্যরা
২০ নভেম্বর ১৯৯৩ এর দিনলিপিতে আবদ্ধ শব্দ মালাকে মুক্ত করে দিই এই অবসরে। লিখেছিলাম – ভাবতে অবাক লাগছে থাকি কোথায় আর আজ আছি কোথায়! বেশ রাত হয়েছে এখন। লিখবো তো ভাবছি। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি রোজকার সেই ঘর নয়। হোটেল রুমানি। হোটেল রুমানি বেশ সুন্দর। নাম খানা ভারী মিষ্টি। বার বার বলতে ইচ্ছে করে ... রুমানি রুমানি। সমুদ্র সন্নিকটে গেলাম সূর্যোদয় দেখতে। কিন্তু তৃপ্ত হলাম না। মা বাবা জলে নামতে বারণ করলেও শুনছে কে? লাফিয়ে লাফিয়ে অনেকটা গেলাম। ভারী আনন্দ। আমাদের আনন্দ দেখে মা বাবাও জলে নামলেন। আরে বাবা তাঁরাও উঠতে চাইছেন না। কিছুতেই উঠবো না। আবার নটার সময় আসবো বলে ফিরে এলাম রুমানিতে।
🍂
রুমানি সমুদ্র থেকে বেশ দূরে। হেঁটে মিনিট পাঁচেক। কেবল মজা আর মজা। আবার কিছুটা ভিজলাম। দঙ্গল বেঁধে ছুটোছুটি। লিডার ছিল রেণুদি। হাকিমা, মঞ্জুমা, সুলতানা আরও অনেকে ছিল দলে। আবার এক রাউণ্ড ঘুরে সত্যিকারের জলে নামার জন্য সবাই রেডি হলাম। আছাড় প্রায় সবাই খেয়েছি। নোনা জলে অন্তঃকরণ ভেজাব ভাবলেও নাক, মুখ, কান ছাড়া তাদের গতিরুদ্ধ। মজা মাটি হলো মারপিট বাঁধতে। নীতিবিরুদ্ধভাবে ছবি তোলায়। ফলে সমুদ্র থেকে আমাদের তাড়াতাড়ি তুলে নিল সারফদ্দিন দাদা। দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমানো, ঘুম থেকে উঠে হোটেলে জমজমাট আড্ডা। সন্ধ্যায় বেড়ানো। বাজার এবং মন্দির ঘুরে ঘুরে কিছু জিনিস কেনা হলো। বাবার এক ছাত্রের পুরীতে মিষ্টির দোকান ছিল। হঠাৎ তার সঙ্গে দেখায় ছাত্র-শিক্ষকের অপূর্ব মিলনদৃশ্য প্রত্যক্ষ করলাম। সমুদ্রের ধারে অনেকক্ষণ আড্ডা দেওয়ার বাসনা থাকলেও বাবার নির্দেশ অমান্য করার উপায় নেই। ফিরলাম তেইশে নভেম্বর। আমাদের পাঁচজনের একসঙ্গে এভাবে বেড়ানো আর হয় নি।
বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে পুরীর সমুদ্রে
ফিরেই ডিসেম্বরের প্রথম দিন নিবেদিতা, বৈশাখী, চৈতালী, তনুজা, রীতা, বন্দনা, বোন আর আমি গেলাম বোটানিক্যাল গার্ডেনে। তখন বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও গেলে বেশির ভাগ সময়ই বোন সঙ্গে থাকতো। মণি-টুকু নামদ্বয় একসঙ্গে উচ্চারিত হতো। আমরা বন্ধুরা কত নতুন জায়গায় ঠিকানা খুঁজে খুঁজে গেছি আবার পথও হারিয়েছি। পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থার উদ্যোগ নিতাম আমরা। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ- এ নাম লেখাতে হাওড়ায় চলে গেলাম আমরা। ময়দানে খুব আনন্দ করলাম। ফেরার পথে বাকসাড়ার অমিতা একটা বাসে উঠে চলে গেলে আমরা হাওড়া স্টেশন যাবো বলে উল্টো রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা বাস ধরি। অনেকক্ষণ বাস চলছে অথচ হাওড়া আর আসছে না। বিচলিত হয়ে কনট্রাক্টরকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন বাস যাচ্ছে জাপান। ভীষণ মজা। বাসে করেই জাপান পৌঁছে যাবো! হেসে হেসে তনুজা,বন্দনা, চৈতালী, টুকু আর আমি পাগল হবার জোগাড়। আসলে বাস যাচ্ছিল জাপানি গেট। দাশনগরে নেমে ট্রেন ধরে সোজা বাড়ি এলাম।
(ক্রমশ)
0 Comments