মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৮২
মানবেন্দ্রনাথ রায় (স্বাধীনতা সংগ্রামী, ঘাটাল)
ভাস্করব্রত পতি
'বাঁশ বাদুড় ভূত
এই তিন নিয়ে ক্ষেপুত'--
লৌকিক ছড়ার বেড়া ডিঙিয়ে ক্ষেপুত গর্ব করে আর একটি হিরকখণ্ডের জন্য। সকলেই মান্যতা দেন ক্ষেপুতের সন্তান মানবেন্দ্রনাথ রায়। মেদিনীপুরবাসী হিসেবে এই সম্মান তাঁকে এখনও দেওয়া হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের ক্ষেপুত গ্রামে পৈতৃক বাসভূমি বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়ের। এখানকার উত্তরবাড় গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেন তাঁর বাবা দীনবন্ধু ভট্টাচার্যের। যদিও এঁদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন হুগলীর বাসিন্দা। এই উত্তরবাড় গ্রামে পূজাপাঠ করতেন দীনবন্ধু বাবু। কিন্তু একসময় তিনি পূজার কাজ ছেড়ে উত্তর ২৪ পরগণার আড়বেলিয়া চলে যান হেড পণ্ডিতের কাজের জন্য। সেখানে ১৮৮৭ এর ২২ শে মার্চ জন্মগ্রহণ করেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। যদিও তাঁর প্রকৃত নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু 'ভারত পথিক' গ্রন্থে লিখেছেন, 'কোদালিয়া, চিংড়িপোতা হরিনাভি, মালঞ্চ, রাজপুর ইত্যাদি গ্রাম গুলি আবার কর্ম কোলাহলমুখর হয়ে ওঠে। .... বিশ্ববিখ্যাত কমরেড এম এন রায় এখানেই জন্মগ্রহণ করেন'। কিন্তু 'ঘাটালের কথা'তে পঞ্চানন রায় তা অস্বীকার করেছেন। তিনি লিখেছেন, 'বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায় দাসপুর থানার ক্ষেপুত গ্রামে ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে জন্মগ্রহণ করেন। ক্ষেপুতের প্রসিদ্ধ দেবী ক্ষেপুতেশ্বরীর পূজক ভৈরবচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পুত্র পণ্ডিত দীনবন্ধু ভট্টাচার্যের দ্বিতীয়া পত্নীর গর্ভজাত দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন নরেন্দ্রনাথ'। যাইহোক, মেদিনীপুরে জন্মগ্রহণ না করলেও পারিবারিক সূত্রে কিন্তু তিনি মেদিনীপুরের সন্তান। মেদিনীপুরের সত্যিকারের মানুষ রতন।
স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত থাকাকালীন বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন নামে নিজের পরিচয় দিতেন। জানতেন ফরাসি, স্প্যানিশ, জার্মান সহ বিশ্বের মোট ১৭ ধরনের ভাষা। ফলে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে বেগ পেতে হয়নি কখনো। অসাধারণ পদ্ধতিতে সারা বিশ্ব জুড়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন ছদ্মবেশে। ছদ্মনামে। কখনো তিনি হরি সিং, কখনো বা সি. মার্টিন। এছাড়াও এম. এন. রায়, ডি. গার্সিয়া, ডাঃ মাহমুদ, মিঃ ব্যানার্জী, মিঃ হোয়াইট নামেও পরিচিত ছিলেন। তবে সর্বাধিক পরিচিত এই 'মানবেন্দ্রনাথ রায়' নামটি দিয়েছিলেন বিপ্লবী ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়।
১৯১৫ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে জার্মানির উদ্দেশ্যে ভারত ছেড়েছিলেন এই অকুতোভয় মানুষটি। তাঁর লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। মজফরপুর ও মুরারীপুকুর বোমার মামলায় বেশিরভাগ লোকজন গ্রেফতার হয়ে গেলে তিনি বাঘা যতীনের সঙ্গে গুপ্ত সংগঠন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। বিদেশের সঙ্গে বাড়িয়ে তোলেন যোগাযোগ। এক সময় সি. মার্টিন ছদ্মনাম নিয়ে বাটাভিয়া যাত্রা করেন বিপ্লবের রশদ সংগ্রহ করতে। জার্মানি থেকে অস্ত্র আসছে ভারতে। জেনে যায় ব্রিটিশ পুলিশ। চারিদিকে সজাগ নজর। মানবেন্দ্রনাথ রায় তখন গোয়ায় লুকিয়ে। তাঁর সাথে শলা পরামর্শ করতে বাঘা যতীন পাঠালেন বিপ্লবী ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়কে। যথারীতি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে মৃত্যু হয় তাঁর। ফের মানবেন্দ্রনাথ রায় ১৯১৫ সালের ১৫ আগস্ট চললেন ফিলিপাইনস। এবার তিনি নিলেন হরি সিং ছদ্মনাম। এরপর মি. হোয়াইট নাম নিয়ে চলে গেলেন জাপানের নাগাসাকিতে। সেখানে সাক্ষাৎ করলেন রাসবিহারী বসুর সাথে। কেউ তাঁর টিকিটিও ধরতে পারে নি। অবশেষে পিকিং, ইউনান, টোকিও ঘুরে পৌঁছে গেলেন সান ফ্রান্সিসকো। সেটা ১৯১৬ সাল। সেখানেই নেন 'মানবেন্দ্রনাথ রায়' ছদ্মনামটি।
১৯১৬ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এবং ঋষি অরবিন্দের বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেইসাথে আরেক বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষের দলে যুক্ত হন। জার্মানি যাওয়ার পর তিনি যান নিউইয়র্ক। সেখানে তাঁর সাথে দেখা হয় লাজপত রায়ের সঙ্গে। জার্মানিতে অস্ত্র না পেয়ে ১৯১৭ তে চলে যান মেক্সিকো। সেখানেই আলাপ হয় মিখাইল বরোদিনের সঙ্গে। মেক্সিকান সোশ্যালিস্ট পার্টিতে তার প্রভাব বাড়তে থাকে। এক বছরের মধ্যেই তিনি মেক্সিকান সোশ্যালিস্ট পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন। রাশিয়ার বাইরে মেক্সিকান সোশ্যালিস্ট পার্টিই প্রথম কমিউনিস্ট হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করে। ১৯১৯ তে লেনিনের ডাকে রাশিয়ায় যান এবং ট্রটস্কির সহযোগী হয়ে কাজ করতে থাকেন। ১৯২৭ সালে মস্কোতে ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি গঠন করে ভারতীয় শাখার সম্পাদক নির্বাচিত হন। কিন্তু কোনো কারনে মতবিরোধ হলে ১৯৩০ এ ভারতে ফিরে আসেন এবং কারারুদ্ধ হন। ১৯৩৬ সালে জেলমুক্ত হয়ে কংগ্রেসে যোগ দেন। সেখানেও মতবিরোধ হওয়ায় ১৯৪০ এ কংগ্রেস ত্যাগ করেন।
১৯১৬ তে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এভেলিন লিওনোরা ট্রেন্টের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। তিনিই তাঁর প্রথম স্ত্রী। এর সাথেই তাঁর বিয়ে হয়। ১৯৩৯ এ ক্ষেপুত এ এসেছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। ১৯৪০ এর ১৬ ই অক্টোবর 'রাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পিপলস পার্টি' গঠন করেন এই মানুষটি। জানতেন ১৭ টি ভাষা। লিখেছেন ৬৭ টি গ্রন্থ এবং ৩৯ টি পুস্তিকা। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধমালা হল -- New Humanism, Revolution and counter Revolution in China, The Indian Trade Union Congress, Reason Romanticism and Revolution, Hunger and Revolution in India, Hunger and Revolution in India II, The Awakening of the East, Theses on the Eastern Question, The Political Situation in India, On Rallying the Masses, Speech in Discussion of Eastern Question, On Intellectuals, The Liberalism of the British Labour Party, The Peasant Movement in India, The Empire and the Revolution, The Turkish Victory, On Economic Determinism, India in Transition Stage, The Railway Strike in India, A Review of the Indian Situation, Speech in Discussion of the World Economic Crisis and the New Tasks of the Communist International, Letter to Singaravelu Chettiar, Madras ইত্যাদি।
তিনি ১৯৩৭ এর ৪ ঠা এপ্রিল মুম্বাই থেকে শুরু করলেন 'ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইণ্ডিয়া' নামে একটি পত্রিকার প্রকাশনা। ১৯৩৯ এ তা নাম বদলে করেন 'রাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট'। প্রথম স্ত্রী ইভলিন ট্রেন্ট তথা শান্তি দেবীর (১৯১৭-১৯২৫) সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর ইউরোপীয় কৃষক সমিতির সম্পাদিকা এলেন গটসচেককে (১৯৩৭-১৯৫৪) বিয়ে করে দেরাদুনে থাকতেন। সেখানে ১৯৫৪ সালের ২৫ শে জানুয়ারি তাঁর জীবনাবসান ঘটে। ভারতীয় বৈপ্লবিক কার্যকলাপে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মতো এই মানুষটিও বিদেশযাত্রা করেছিলেন নিজের জীবনকে বাজি রেখে। যে বিপ্লবমন্ত্রের বীজ তিনি পুঁতেছিলেন, তা কিন্তু ব্যর্থ করতে পারেনি ব্রিটিশ পুলিশ।
🍂
0 Comments