জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য 
নির্মল বর্মন

প্রাবন্ধিক মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য আধুনিককালের গণনাট্য আন্দোলনের সর্বেসর্বা ছিলেন। ১৮৮৯ সালের  ২৬শে জানুয়ারি  অধুনা বাংলাদেশের ঢাকার বিক্রমপুরে মনোরঞ্জন বাবুর জন্ম গ্ৰহন করেছিলেন। পিতা - নবীনচন্দ্র। মনোরঞ্জন গ্রামের বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে প্রথমে কলকাতার ন্যাশনাল কলেজে ও পরবর্তী পর্যায়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। মূলতঃ রাজনৈতিক কারণে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন এবং কলকাতার  সিটি কলেজ থেকে অঙ্কে অনার্স নিয়ে  বি.এস.সি. পাশ করেছিলেন। এম.এস.সি. পড়ার সময় বাংলাদেশর চট্টগ্রামে ও পরে  পশ্চিমবঙ্গের হুগলীতে অন্তরীণ থাকেন।  মনোরঞ্জনের ঢাকায় বিপ্লবীদের সঙ্গে  গোপন আঁতাত ছাত্রাবস্থায় ছিল। সংসারের চাপ ও আর্থিক অস্বচ্ছলতার জন্য অবশ্য শেষ অবধি মনোরঞ্জন এম.এস.সি. পড়তে পারেন নি। সংসারের জন্য বেঙ্গল কেমিক্যালে যোগ দেন। অবসর সময়কে অবহেলা না করে দেশবন্ধু'র ব্যক্তিগত সেক্রেটারির কাজ করে সমাজকে উজ্জীবিত করার বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন।
মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ১৯২১ সালে  অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। বস্ততঃ চারমাস কারারুদ্ধ থাকতে হয়েছিল। এই পড়ন্ত সময়ে  বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেও বটে। সম্ভবত ডা. ঘোষের মাধ্যমে শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল। নট ও নাট্যকার  শিশির ভাদুড়ীর আহ্বানে 'সীতা' নাটকে "বাল্মীকি" চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছিলেন। ফলতঃ ১৯২৩ এ মনোরঞ্জনের অভিনয়  জীবন আরম্ভ হয়। এই সময় থেকেই মনোরঞ্জন 'মহর্ষি বাল্মীকি' র অভিনেতা রূপে 'মহর্ষি' নামে সুখ্যাত হন। ১৯৪৪ সাল  অবধি মনোরঞ্জন পেশাদার রঙ্গমঞ্চে শতাধিক চরিত্র চিত্রণে অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করতে পেরেছিলেন। তাছাড়া  পরেও  বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বাংলা সাহিত্যে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন।
নট মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রগতিমূলক নাট্য আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব পুরুষ রূপেই চিরস্মরণীয় থাকার কথা থাকলেও অসহায় সময় ও সমাজ তো ভুলে যেতে বসেছে। বিজন ভট্টাচার্যের "নবান্ন" নাটক মনোরঞ্জনের নির্দেশে মঞ্চে চটের দৃশ্য সজ্জা করা হয়েছিল।১৯৪৮ এ  'বহুরূপী' নাট্য সংস্থার জন্ম লগ্ন থেকেই মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য সভাপতি'র পদ অলংকরণ , আজীবন কাম আমৃত্যু অধিষ্ঠিত থেকে নাট্য সমাজকে সামনের সারিতে আনতে পেরেছেন। মহর্ষি মনোরঞ্জন আমেরিকা, সোভিয়েত রাশিয়াতেও সাফল্যের সহিত অভিনয় প্রদর্শন করছেন।  মনোরঞ্জন প্রথম জীবনে  গুপ্ত বিল্পবীদের সমর্থক থাকা সত্ত্বেও, শেষ জীবনে তিনিই সাম্যবাদী আন্দোলনে সামিল ও শরিক হয়েছিলেন।  শিল্পনগরী সোনার শহর বোম্বাই অ্যান্টিফ্যাসিস্ট সম্মেলনে সভাপতি'রআসন পাকা করেন।
 মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য অভিনয়  , সভাপতি ছাড়াও একাধিক নাটক ও থিয়েটার বিষয়ক প্রবন্ধ লিখে বাংলার সাহিত্য মহলে শোরগোল ফেলেছিলেন।  
 প্রাবন্ধিক মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের  উল্লেখ্য নাটক:-
" চক্রব্যূহ", "বন্দনার বিয়ে", "দেশবন্ধু" ইত্যাদি। ভট্টাচার্যের নাট্য বিষয়ক প্রবন্ধ গ্রন্থসমূহ:--
  "থিয়েটার প্রসঙ্গ"। ১৯৫৪ এর ২০শে জানুয়ারি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের নাট্য ব্যক্তিত্বের কর্মময় জীবনের অবসান ঘটেছিল এবং সেই সঙ্গে পরিসমাপ্তি ঘটে  গণনাট্য আন্দোলনের এক সোনালী অধ্যায়।
মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য মহোদয়ের 
"জনগণ ও থিয়েটার"  প্রবন্ধ  প্রথম "জনযুদ্ধ" পত্রিকায় প্রকাশিত। ১৯৪৩ এর ২৮ শেষ এপ্রিল পত্রিকাটি প্রথম সংখ্যা, দ্বিতীয় বর্ষ । ১৯৯০ এর মে মাসে  প্রবন্ধটি  পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি পত্রিকায়  পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল।
বাংলা  সাহিত্য ও থিয়েটোরের উদ্গাতা বিদেশী নট বা নাট্যকারেরা হওয়া সত্ত্বেও মাইকেল মধুসূদন দত্ত' ই প্রথমত মৌলিক নাটক রচনা করে "বঙ্গ-রঙ্গমঞ্চ"কে মর্যাদা দান  করতে পেরেছিলেন।  মধুসূদনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে উনিশ শতকে যেসব নাট্যব্যক্তিত্ব আসরে এসেছিলেন তাঁদের অন্যতম 'দীনবন্ধু মিত্র', 'জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর', 'গিরিশ চন্দ্র ঘোষ', 'অমৃতলাল বসু' প্রমুখ । বস্ততঃ বাংলা নাটকের তৎকালীন সময়ের গতি প্রকৃতির দিকে নজর দিলে  তার তিনটি ধারা চোখে পড়তে বাধ্য:- "পৌরাণিক", "ঐতিহাসিক"  ও "সামাজিক-পারিবারিক" নাটক। শেষ ভাবনা নাটক কখনো  প্রহসন বা কমেডি।
 ফলতঃ উনিশ শতকের সবসময় ও সবরকম নাট্য রচনা ও মঞ্চায়নের পিছনে ধনাঢ্য, অভিজাত ব্যক্তিগণ বা জমিদার সম্প্রদায়ের উৎসাহ ও  উদ্দীপনায় মনোরঞ্জন।  সাধারণত ধনী সম্প্রদায়ের বাড়িতে সাধারণ নাটক মঞ্চস্থ হতো।  কলকাতা' র "বেলগাছিয়া", "পাথুরিয়াঘাটা", "জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি" ইত্যাদির  নাম  স্মরণীয় বটে।নট ও নাট্যকার 'গিরিশচন্দ্র'ই প্রথম অনুভব করতে পেরেছিলেন যে- "সাধারণ দর্শকের জন্য থিয়েটার বা রঙ্গালয় দরকার"।  নট গিরিশ চন্দ্র ঘোষ ন্যাশন্যাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে  সেই অভাব পূর্ণ করলেন। পরবর্তী সময়ে ব্যাপক ডালপালা প্রসারিত হয়েছিল। তাসত্ত্বেও জনগণের সঙ্গে থিয়েটারের আত্মিক যোগ  খুব একটা ঘটেনি, "রোমাঁ রোলাঁ" র  "পিপলস্ থিয়েটার"  বাংলা তথা ভারতী নামক দেশে সেইভাবে মূল্য ও মর্যাদা পায়নি। তথাপ দীনবন্ধ'র "'নীলদর্পণ" নাটকের মঞ্চসাফল্য মনে রেখেও এই কথাটাই বলা যায়।
🍂
১৯৪৪-এ 'নবান্ন'র মঞ্চসফল অভিনয় ও  ক্লাসিক প্রযোজনা প্রথম সেই অভাব অভিযোগ দূর করল। জনসাধারণও থিয়েটারের আঁতুড় ঘরের অংশীদার হতে পেরেছিলেন। জনগণের সুখদুঃখ, আশা, আকাঙক্ষা ও প্রতিবিম্বিত হওয়ায় সারস্বত সমাজ আপ্লুত। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রায় সারাজীবন নাট্যশালা ও নাটকের সহিত অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে যুক্ত থেকে নিজস্ব অভিজ্ঞতায় উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন জনগণের সঙ্গে থিয়েটার যুক্ত না হলে সমাজের মুক্তি নেই। সময় ও সমাজকে বাঁচানো যাবে না। নাটক বা মঞ্চ মূলতঃ আড়ম্বর নয়, বাক্ চাতুর্যের ব্যাপার স্যাপার নয়, স্বাভাবিকতা ও সজীবতায় ভরপুর জীবন দর্শন।
জনসাধারণ ছাড়া একালের নাটক ও মঞ্চ  অবশ্যই ব্যর্থ। সিনেমার "চটুলতা" ও "জনপ্রিয়তা"র পাশে থিয়েটারকে পাক্কা স্থান করে নিতে হলে জনসংঘের সমর্থন ,সহযোগিতা   ও সামাজিক দায়বদ্ধতা দরকার। মহর্ষি'র প্রবন্ধ "জনগণের ভূমিকা" থিয়েটারে কতখানি  গুরুত্বপূর্ণ, তারই ধারাবাহিক আলোচনা প্রাধান্য  লাভ করেছে।  সুতরাং বিষয়মুখ্য ও বক্তব্যপ্রধান প্রবন্ধের নামকরণ সংগত ও যুক্তিযুক্ত।
শিল্প ও সাহিত্যের বিবিধ শাখার মধ্যে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব শক্তিশালী ও জনপ্রিয়তার স্বর্ণ শিখরে।  কারণ ,নাটকে বাস্তবজীবন ও যুগ যন্ত্রনা প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। বাস্তবিক যে নাটকে জনগণের হৃদয়ে র কথা যত বেশি থাকবে, যে নাটকে জনগণ তথাকথিত সুশীল সমাজ যত অংশ নেবেন, ততই তা প্রাণবন্ত ,স্বাভাবিক ও উজ্জ্বলতা লাভ করবে। চলচ্চিত্রের গুরুত্ব সমাজ জীবনে যথেষ্ট সমৃদ্ধ।  সামান্য খরচে সাধারণ মানুষ , এমনকি  বুদ্ধিজীবী মানুষ ও সময় কাটাতে, উপভোগ করতে সিনেমা হলে ছুটে যান । কিন্তু সিনেমার  বিনোদন  নিজস্ব অভিজ্ঞতায় বেশি ফলপ্রসূ নয়। সাধারণ মানুষের সুখদুঃখ দূরের কথা রং ঢং দেখিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি  প্রতিফলিত ।
সেজন্য নাটক বা থিয়েটার মানুষ উৎসুক চিত্তে স্মরণ করে।আদি-মধ্যযুগে রঙ্গমঞ্চ না থাকলেও, ছিল কিন্তু "পাঁচালি", "পালাগান", "যাত্রা", "কথকতা" , "বহুরূপী", "বেদে- বেদেনী"রা বাড়ি বাড়ি ঘুরে নানা চরিত্রচিত্রণ অভিনয়  ও উপস্থাপন করতেন। ফলতঃ মানুষ মজা ও আনন্দ উপভোগ করতে পারতেন। ইংরেজ ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের পর এদেশে থিয়েটার প্রসঙ্গ শুরু হয়েছিল। প্রথম প্রথম  বিনোদন, পরে  ব্যবসার স্থলে পরিণত।
সুতরাং  মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ভাবলেন- 'এমন নাটক লেখা ও অভিনয়ের দরকার, যাতে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙক্ষা প্রতিফলিত হয়'। তাই "আড়ম্বরপূর্ণ মঞ্চ", "সাজসজ্জা" কে গুরুত্ব না দিয়ে সাধারণ "মঞ্চ ও বেশভূষা" থাকলে তবেই না থিয়েটার জনগণের আরও কাছে যাবে। নাটক  কেবলমাত্র 'উচ্চবিত্ত'ও ' মধ্যবিত্ত'দের জীবন ও জীবিকার কথা কখনো নয়-'দরিদ্র, বঞ্চিত' মানুষেরও কথা লিপিবদ্ধ। 
 মহর্ষি, প্রাবন্ধিক,নাট্য গবেষক ও  নট ও নাট্যকার মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য মহোদয়ের রঙ্গমঞ্চের  সম্বন্ধে সুচিন্তিত মন্তব্য  প্রণিধানযোগ্য:-
"রঙ্গমঞ্চ বা থিয়েটার সম্পূর্ণ ইংরেজদের আমদানি। সাহেবরা এদেশে এসে প্রথমে উদাহরণ দেখান। তারপর কলকাতা শহরের ধনী ইংরেজিওয়ালারা তার সৌখিন অনুসরণ করতে আরম্ভ করেন। ক্রমে মধ্যশ্রেণির মধ্যে ব্যাপ্ত হ'য়ে থিয়েটার ব্যবসায় হিসাবে চলতে আরম্ভ হয়। ব্যবসায় হিসাবে চলার জন্য থিয়েটারকে জনপ্রিয় করবার তাগিদ আসে, আর জনপ্রিয় হবার সম্ভাবনা ছিল বলেই ব্যবসায়ীর দৃষ্টি থিয়েটারের ওপর পড়ে"।
 আবার মনোরঞ্জন "একালের থিয়েটার প্রসঙ্গ"  প্রবন্ধে থিয়েটার ও কলাকুশলী সম্পর্কে মূল্যবান অভিমত জ্ঞাপন করে  যুক্তিধর্মী সুললিত ভাষার মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:-  "থিয়েটার সর্বকলার সমষ্টি, সৌন্দর্য- পিপাসুর পানাগার। থিয়েটারের পসরা সৌন্দর্য, কিন্তু তার দেবতা শিব।...ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে মাঝে মাঝে সত্যের আসন যখন নড়ে ওঠে শিব তখন চঞ্চল হন, রুষ্ট হন, তখন সুন্দরকেও কাঁপতে হয়, জ্বলে উঠতে হয়।"
বস্তুতঃ প্রাবন্ধিক ও নাট্য গবেষক মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য বাংলার সারস্বত সমাজ ও সভ্যতা ও সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটিয়ে বিদগ্ধমহলে সুনাম অর্জন করলেও কালের অমোঘ আকর্ষণে আজ প্রায় বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক।

Post a Comment

0 Comments