সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ১৯
গৌতম বাড়ই
লাঙুলবাবার ডেরায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে তাদের অর্দ্ধবেলা হয়ে এল। সূর্য মাথার ওপর থেকে একটু পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। এই গোটা পথ পাড়ি দিতে সিংহরাজের যারপরনাই পরিশ্রম আর কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। এত যে অসীম শক্তির অধিকারী সে, তবুও কিনা এই কঠোর পরিশ্রমে মনে মনে লাঙুলবাবার ওপর ক্ষুব্ধ হল। সারা বন পাহাড় কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল সিংহরাজ - " লাঙুলবাবা! লাঙুলবাবা!" প্রায় ঝোপঝাড়ে ঢাকা এক গুহার মধ্যে থেকে আওয়াজ ভেসে এল- " এদিকে আয়।" সিংহরাজ সুসীমার হাত শক্ত করে ধরে এবারে ঐ গুহার দিকে চললেন।
লাঙুলবাবা চোখ বন্ধ করে ছিলেন। এবার ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে সিংহরাজ ও সুসীমাকে দেখতে পেলেন। অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন লাঙুলবাবা। সুসীমার রূপের সৌন্দর্যে এতটাই মোহিত হলেন যে, সুসীমার দিকে চেয়েই রইলেন। তারপর সিংহের দিকে তাকিয়ে বললেন- " এই মনুষ্য নারী তো সাধারণা নয়, এর রূপ আর সৌন্দর্য, এর চোখ মুখের দ্বীপ্তি বলছে এ নারী কোনও উচ্চ বংশের ।তুই একে লুন্ঠন করে একা- একা ভোগ করছিস? তুই জানিস এই বন পাহাড় এই লাঢ়ের দেশে কী বিধান নিহিত আছে? "
সিংহরাজের মৃদু নাসিকাগর্জন টের পেলেন পাশে থেকে সুসীমা। বুঝতে পারলেন সিংহরাজ ভিতরে ভিতরে এই কথায় ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়েছেন। আগাম কোনও বিপদ সংকেত নয় তো!
সিংহরাজ বললেন- " আমার জানা নেই এই বিধান। আমি আমার নিজস্ব নিয়মে চলি। আমি আমাদের সিংহদের প্রধান পুরুষ আপনার কথার মর্যাদা রাখতেই এখানে এক ডাকে আমার স্ত্রীকে নিয়ে চলে এসেছি। তাই এমন কোনও অসম্মান করবেন না, যাতে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে ওঠে। "
লাঙুলবাবা চকিতে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন- "সিংহরাজ তুমি তোমার এক্তিয়ারের বহির্ভূত কথা বলছো। কিসের স্ত্রী? এই সিংহদের দেশে সবাই এই নারীকে তোমার স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছে? আজ রাতে এখানে আমাদের সেই বরণ করে নেবার উৎসব হবে। হাজির হবে আশপাশের সিংহ অধিবাসীরা। আর বছরের পর বছর ধরে চলে আসা সেই অমোঘ বিধান, বরণের প্রথম রাতে নববধূ থাকবে আমার কাছে।
সুসীমা সিংহরাজের দিকে তাকিয়ে তাকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে না করলে। সিংহরাজের এতে চাপা ক্রোধ ভিতরে ভিতরে আরও আগুন জ্বালিয়ে দিল। তা স্বত্তেও সুসীমার নীরব আর কাতর মৌন আবেদনে চুপ করে রইলো। তবে সহজে ছাই হবে না এ অঙ্গার।
লাঙুলবাবা- "সিংহরাজ, তোমার প্রবল পরাক্রমশালী আর অসীম তেজে মুগ্ধ হয়ে আমি তোমায় ঐ নামেই ডাকি। তুমি তাতেই সুপরিচিত এ রাঢ়ের দেশে, এই লালমাটির দেশে। এই আবেগকে আমার দূর্বলতা বলে ভেবোনা। আমার এক সোচ্চারে বা হাততালিতে শতখানেক সিংহমানুষ মুহূর্তে হাজির হবে এখানে। তাদের শারীরিক শক্তি তোমার থেকে কম হলেও, তাদের সন্মিলিত শক্তি তোমাকে কিন্তু এক তুড়িতেই সংহার করবে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। আর আমি জানি রাজাধিরাজ বঙ্গেশ্বরের এই সুন্দরী রাজকন্যাই তোমার বলপ্রয়োগ করে নিজের কাছে বন্দী করে রাখা সুসীমা। যাকে স্ত্রী বলে পরিচয় করাচ্ছো। এ তো একদম ঠিক, একদম মিথ্যে নয় বলো?"
🍂
সিংহরাজ এই কথা শোনামাত্র হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন- "ব্যাস অনেক হয়েছে। আপনার সত্যিজ্ঞানের বহর দেখে আমি যারপরনাই চমকিত! তবে অনেক সময় বেশি সত্যি জেনে গেলে তাকে তারজন্য মূল্য চোকাতে হয়। "
লাঙুলবাবা দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগলেন ক্রোধে, বললেন- " সাহস ভালো তবে দুঃসাহস প্রায় সময় অনিষ্ট বহন করে আসে , যিনি দুঃসাহস দেখান তার প্রতি। "হুঙ্কার ছাড়লেন আর শাসানি দিলেন বাবাজি সিংহরাজের প্রতি। আর সুসীমা সিংহরাজকে নিরস্ত করবার আগেই ঘটে গেল চরম এক অঘটন। এক ভারী প্রস্তরখন্ড দুইবাহুতে তুলে লাঙুলবাবার মস্তিষ্কে সজোরে আঘাত করলেন সিংহরাজ। লাঙুলবাবার মাথার পুরো আসল আকৃতি তক্ষুণি অদৃশ্য হয়ে গেল। মাটিতে আছড়ে পড়লেন লাঙুলবাবা। রক্তে ভেসে গেল চারধার। কিছুক্ষণ কাঁপতে কাঁপতে স্থির হয়ে এলো তার দেহ। এক হাতে সুসীমাকে ধরে সিংহরাজ দ্রুত ফিরে চললেন আবার তার ডেরায়, সেই দূরে ফেলে আসা জঙ্গলের ভেতরে গুহার অন্দরে। রাজকন্যা সুসীমা সিংহের এই অতর্কিত নিষ্ঠুর আচরণে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল তার বারবার ভয়েতেই। কাছ থেকে মানুষ হত্যা যে আগে দেখেনি তা নয়, তবে এই হত্যার নিষ্ঠুরতা তাকে মূক বানিয়ে দিয়েছে। লাঙুলবাবার একটি কথাও তার কানে বাজছে এখনও, সে যে বঙ্গেশ্বরের কন্যা এ কথা কীভাবে জানলো সে? তাহলে বঙ্গেশ্বর রাজকন্যার সন্ধানে এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন!
সিংহরাজ ডাক ছেড়ে বললেন এই জঙ্গল পাহাড় প্রকৃতির কোলে - " আমার জীবিত অবস্থায় যতদিন আমার পূর্ণশক্তি আছে, আমি এখানকার রাজা। আমার আদেশ সবাইকে পালন করতে হবে। এর অন্যথা হলে বিপদ এবং ভয়ানক বিপদ হবে তার । এই আমি আজ প্রকাশ্যে ঘোষণা করলাম। "
সমস্ত চরাচর আজ এই ঘোষণার প্রতিধ্বনিতে কেঁপে কেঁপে উঠল। সিংহগোষ্ঠীর মানুষেরা দূর থেকে তা শুনতে পেলেন। ভয়েই সব আজ আড়াল নিয়েছেন। তখনও তারা জানেন না আজ এই রাঢ়ের জঙ্গলে এক ভয়ানক হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
বনভূমি জোছনায় ভাসছে। চাঁদের মায়াবী আলোয় এক আদিম থেকে আরও অতি আদিম জগত সৃষ্টি করেছে। প্রকৃতির বুকে রহস্যের জাল যেন ঘিরে ধরেছে। সুসীমা সিংহরাজের সঙ্গে দ্রুত চলতে চলতে ঘামে ভিজে আসছিল তার সারা শরীর। এরকম এক পশুরাজের সাথে অধিক জীবন কাটানোর চিন্তা করতে পারছে না সে। সুসীমার মনোভাব যেন টের পেল সিংহরাজ। জিজ্ঞাসা করলেন তাকে- " তোমার গতি , যখন আমার কাঁধ থেকে নেমে হাঁটছো অতি শ্লথ কেন? "
সুসীমা বললে- " না রাজা তা নয় তো!"
সিংহরাজ বললেন- " সিংহের দু-চোখ সমস্ত রহস্যের সবকিছু ধরতে জানে।"
এইভাবে এগিয়ে চলল তারা।
0 Comments