জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত (একচত্বারিংশতি পর্ব ) /শ্রীজিৎ জানা


শিল্পী- আরাধ্যা জানা

বাগদি চরিত  ( একচত্বারিংশতি পর্ব ) 

শ্রীজিৎ জানা

খগেন মাস্টার মনে করে রাজা শোভা সিংহ ছিলেন জাতে বাগদি। কিন্তু তার মনে করায় কার কি আসে যায়। তাছাড়া আজকাল জাতপাত নিয়ে কারা অত মাথা ঘামাচ্ছে! লোখা তাকে বহুবার বলেছে,
—- ক্যানে যে তুমি মোদের এত জাতটাকে লিয়ে মাথা ঘামাও বল দিখি? আজগের দিনে জাতপাত কেউ মানে নি! তুমি একটা মেস্টার লোগ হোয়ে ইসব লিয়ে মাথা ঘামাওঠ কেনে?
—জাতটাত লিয়ে মোরও তেমন মাথাব্যথা নাই। কুন্তু যখন কেউ ছোট জাত বলে দেগে দ্যায়, ঘিন্না করে তখন মাথায় রক্ত উঠে যায়! অই রাগের নিজের জাতটার ইতিহাস লিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করি। অন্য জাতের লোকেদের কাছে ইটা দেখাতে চাই যে মোদের জাতের দাপট ক্যান ছিল আগে।
শীতের বিকেল। সূর্য কখন হারিয়ে গেছে শিলাবতীর পশ্চিবম পাড়ে। নদীর বাঁধ ডিঙিয়ে আসা উত্তুরে হাওয়া পাক খাচ্ছে কালসাবার মাঠে। যেটুকু তাপ জমা ছিল মাঠে,তা যেন ঠান্ডা বাতাসের দাপটে নেতিয়ে পড়ছে। লোখা চাদরটাকে ভালভাবে গায়ে জড়িয়ে নেয়। মাথায় তার কান চেপে মাফলার বাঁধা। বিলের পাড়ে পাশাপাশি বসে আছে তারা দুজনে। কনকনে শীতের আঁচড় কামড় ভালোই টের পাচ্ছে তারা। সন্ধা ক্রমে গাঢ় হচ্ছে। কালসাবায় এসময়ে তেমন ভয়ের কিছু নেই। সাপ খোপ এমন ঠান্ডায় বেরোয় না। লোখার ঘর ফেরার তাড়া নেই। এঁঠাল কাদার মতো চিটিয়ে বসে আছে সে খগেন মাস্টারের পাশে।  সামনে আধভরা বিলের জল একবারে নিশ্চুপ।  লোখার মনে হয় বিলের জল, বিলপাড়ের কলমীফুল,জলের নিচে থাকা মীন সবাই যেন চুপ মেরে তাদের কথা শুনছে। তবে চারপাশ থেকে ভেসে আসছে কত রকমের আওয়াজ। রাতপোকরা হাজর রকম শব্দে ভরিয়ে রাখে। গায়ের কাছ দিয়ে দু'চারটা জোনাকি এঁকেবেঁকে চক্কর কাটছে। ছোট্টরা কালো শ্লেটে পেন্সিল বুলিয়ে ইড়িংবিড়িং আঁচড় কেটে যেভাবে প্রথম লেখা শেখে। এরই মাঝে নদী বাঁধ থেকে দলবেঁধে শেয়াল ডেকে ওঠে। লোখার লুঙ্গির ট্যাঁকে বিড়ি আর লাইটার গুঁজা আছে। মাস্টারের কাছে সে বিড়ি খায়। শীত করছে তার। মনে হচ্ছে একটা ধরালে মন্দ হয় না। কিন্তু ভাবে তার আগে একটু আগুন জ্বালালে বেশ হয়।

দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে নিয়মিত : জ্বলদর্চি। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
🍂

— বলি কি মেস্টার! এখন ত ঘর যাউয়া হবেনি। থাইলে এট্টু কি আগুন পুয়াবে?  জ্বালব?
—বোলুঠু?  থাইলে জ্বাল। সেই ছোটবেলায় লাড়া নয়তো খড়- কুটি জ্বেলে গোল হয়ে সবাই আগুন পুয়াতম। রাতে উনান শালে বোসতম।  এখনকার ছোটছেনারা উসবের ধারেপাশে নাই। তখন আসলে এত চাদর শয়টার কিনার মুরাদ ছিল নি মোদের সব ঘরে।
— সে আর কাদের ছিল। খুব মনে আছে ফাঁকা জাঁজলায় খড় গুঁজা দিত অনেকেই। থোলা টাঙাত। যাদের ছিটাবেড়ার ঘরছিল,তাের গত্তপরা জাঁজলায় কাপড় গুঁজে দিত। ঠাগমাকে েকতম মুড়িভাজা খলায় ঘুঁটার আগুন কোরে তার শুয়ার ঘরে রাকত। সারারাত ঘরটা খুম গরম থাকত। আমরা ত শীতকালে ঠাগমার ঘরে শুবার জন্নে ভাইয়ে ভাইয়ে মারপিট লেগে যেতম।
কথা বৱতে বলতেই লোখা সামনের জমি থেকে লাড়া ছিঁড়তে শুরে করে দেয়। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে শিশিরে পড়তে শুরু করে দিয়েছে লাড়ার গায়ে। লোখা এক কাঁড়ি আধভেজা লাড়া ছিঁড়ে তাদের বসার সামনে রাখে। ট্যাঁক থেকে লাইটার বের করে। সহজে আগুন ধরতে চায় না। ধোঁয়া হয়। লোখা ঝুঁকে পড়ে ফুঁ দেয়। মা্টার উপরের লাড়াগুলোকে তুলে আগুন ধরাতে সাহায্য করে। ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে ওঠে। লোখা আরো চাট্টি লাড়া ছিঁড়ে এনে পাশে রাখে। তাপে বেশ আরাম লাগে দুজনের। সামনে ধিকধিক  করে জ্বলছে আধভেজা লাড়া। লোখা বেশ চাকমন্ডলা করে বসে পড়ে। আগুনের আঁচের দিকে ঘন ঘন হাতের চেটা দুটা বাড়িয়ে দেয়। ট্যাঁক থেকে বিড়ির বন্ডিল বের করে। আড় চোখে মাস্টারের দিকে এক ঝলক তাকায়। ঠোঁটের কোণে হাসি আড়াল করে বলে,
—মেস্টার,লিবে নাকি একটা। তুমি ইসব খাউনি, জানি। কুন্তু পুরুষ মানুষ,তাবাদে জাত বাগদি, এট্টু নেশাটেশা না কল্লে ত আর কি কল্লে জীবনে।
— তোর আবার কথার ছিরি, মাইরি! বাগদি হলেই উসব খেতে হবে? নেশাভাঙ সবাই করে। অন্যরা নেশা খায় আর মোদের জাতের লোকেদের নেশা খেয়ে লেয়। বিড়ি - সিগারেট খেতে পুরুষও হতে হবে নি। আর দুলা- বাগদিও হবার দরকার নাই। দে দিখি একটা, ধরাই।
আহ্লাদে গদগদ হয়ে মাস্টারের দিকে একটা বাড়িয়ে দেয়। লাড়ার আগুিনে দুজনে বিড়ি ধরিয়ে সুখটান দিতে থাকে। এবার মাস্টার হাসি হাসি মুখ করে বলতে শুরু করে,
— তোর একটা ঘটনা মনে আছে?
— কুন ঘটনা বল দিখি?
—- আরে,সেই ছোটবেলার ঘটনা। তখন বোধয় আমরা ফোরে পড়ি। এই শীতকালেই হইছিল কান্ডটা। 
—ধুর্ শালা! কুনু মতেই মনে কত্তে পরিনি। তাবাদে অই সময় কম বেদামি কোত্তম। পড়ার নামে ত অষ্টরম্ভা! নামের ইস্কুল ত যেতম। তমরা সব ভাল ছাত্র ছিল। তবে তুমিও কম ডিংরা ছিল নি! কুন্তু কুন ঘটনাটার কথা বলঠ বল দিখি?
— আরে খুদি পিসির লাড়ায় আগুন ধরি দিয়ার কথাটা বোলিঠি।
— অরেব্বাস! সেই একটা কান্ড হইছিল বোলতে হবে। ঘাঁটি পাড়ার খুদি বুড়ি ধান সিদ্ধর জন্ন লাড়া ছিঁড়ে জাঁং দিয়ে রেখছিল। আর ধোরবি ত ধর, তায় আগুন ধরে এগবারে চাঁচরি হয়ে গেইল। তবে উটা তমার জন্নেই হইছিল।
—আরে আমি ত আলের শুকনা বেনাঝাড়ে আগুন ধরিছিলম। তবে একটু দূরেই ছিল লাড়া জোড়ো করা। আমরা ত সবাই ধরানার পর পালি এলম। অই আগুন যে ধরে ধরে লাড়ার জাঙকে চলে যাবে কে জানে! আগুন দেখে ত পাড়া থিকে সবাই ছুটে গেল। পরের দিন খুদি পিসির সেকি গাল পাড়া রে বাবা!
—- তবে মোদের কথা কুন্তু কেউ জানতে পারে নি।
মাস্টার হাসতে থাকে। লোখা বিড়িটায় শেষ টান দিয়ে পোঁদিটাকে মাঠের ফাটলে গুঁজে দেয়। লাড়া ফুরি এসেছে। আগুনের শিখাটাও আর আগের মত তীব্র নয়।  লাল আগুনের আলোয় মাস্টার লোখার মুখের চিন্তার রেখা স্পষ্ট দেখতে পায়। জিগ্যেস করে,
— কিরে তুই চুপ মেরে গেলি যে হুট করে? আবার কি হইচে? ময়নার সঙে কুঁদুল করেচু?
—-উসব ছাড় দিখি। বরঞ্চ তুমি কুন রাজার কথা বোলছিলে যে,সেটা বল।
—- সেটা ত বোলবোই। কিন্তু তোর একটা কিছু হইচে বোধয়। তুই লুকাচ্চু। দেখে বুজা যাচ্ছে। বল দিখিনি, কী হইচে?
— তমাকে ত সব কথা বোলি। কুন্তু এই কথাটা বোলতে কেমন যেন লাগেঠে। তারচে তমার গল্পটাই বল। মোর কথাটা বাদ দাও।
— আরে ইটা ইতিহাস বইয়ের কথা। সবটা গল্প নয়। তবে আরো অনেককিছু জানার আছে। অই রাজাটাকে লিয়ে সব তখ্য খোঁজ করিঠি। মোদের বাগদি জাতকে লিয়ে গটা রাজ্য জুরে একটা কমিটি হইচে জানু ত।
— তা আবার জানবোনি। তমাকে ত সেই কমিটিবর জেলার সভাপতি করেচে। যাই বল তুমি সভাপতি হতে মোদের ঢোলের সবাই খুম খুশি হইচে। তবে সবার চে বেশি খুশি হইচে আমার। সেদিন কালিতলায় মিটিংয়ের পর ত যারা জুটেছিলম,তারা সবাই আলোচনা করেচি।
— তরা আবার কি আলোচনা কোল্লু।
— আলোচনা বোলতে এই যে সংগঠন টা হইচে তার সঙ্গে মোেদের সবাইকে জুিড়ে থাকতে হবে। বিশেষ কোরে তসার পিছনে থাকব আমরা। মোদের জাতের নামকে কিছুতেই ছোট হতে দুবনি। কুন্তু সে ত আমরা আছি তমার সঙে। তার আগে রাজাটার কথাটা শুিরুি কর। রাত বাড়েঠে। ঘরকে কি যাবেনি।
— আসলে অই সংগঠনের জন্নেই অই রাজার জাত লিয়ে মোর এত মথাব্যথা।  অনেক বই পড়তে হচ্চে। তার সঙে এগবার সেই ঊমানাথ ঠাকুরের কাছে যাব ভাবিঠি। তার কি মত রাজার জাত লিয়ে সেটা আগে জানি তারপর তোেকে সব বোলবো।
— মোেকেও এগবার লিয়ে চল না তার ঘরকে। এগবারই তাকে বাজারের রাসের মেলায় তাকে দেখেছিলম। সে কি বলে আমিও শুনব।
— সে লিয়ে যাব খন। তার আগে এবার বল দিখি কেনে তুই মুখটা ঝুলি আছু।
— কি কাোরে তমাকে বোলবো তাই ভাবিঠি। উ শালা মেইয়া জাতের কথা কি বোলবো তমাকে। কিছু একটা ছুঁত পেলেই অদের গয়েন্দাগিরি শুরু হই যাবে।
— কিব হইচে আগে বল না। কেনে ময়নাকে দোষ দেউঠু!
—ঢ্যামনা মেইয়া কবে  দেখেচে, মোর খুদাদ্দা নাকি সেজ বৌদির ঘরে ঢুকেচে। সেই লিয়ে কম অশান্তি শুরু করেচে উ বেদা জাত। সাদে কি বলে বেগদানি মেইয়া। ইটা কি রকম লোজ্জার কথা বল দিখি মেস্টার।  সেজ বৌদিকে তমার ওরকম মেইয়া বোলে মনে হয়?
লোখার কথা শুনে হাসি চেপে রাখতে পারে না মাস্টার। তার হেসে গড়িয়ে পড়া দেখে লোখা হকচকিয়ে যায়। ভেবে পায় না কি হল মাস্টারের। নিজেকে তার গালিগালাজ করতে ইচ্ছা হয়। কেনইবা যে বোলতে গেল মাস্টারকে কথাটা! নিজেই ভিতরে ভিতরে গজগজ করতে শুরু করে।
—মেইয়াটাকে পচাল পাড়ি বঠে,কুন্তু উ ঠিকই বলে, মোর পেটে আলচাল মিলায় নি মোটেই। মোর বাবোও বোলত আহাম্মক ছয়,যে ঘরের কথা পরকে কয়। বোলত ঠিক আছে,কুন্তু মেস্টারকে ত কুনুদিন আমি পর ভাবিনি। তাকে বোলবোনি ত কাকে বোলবো! নিজের ভেবে বোলতে গেলস,ইদিকে মেস্টারের হানিটা েন মোকে ফেউ বানি দেয়ঠে।
মাস্টারের হাসি দেখে লোখা বিরক্ত হয়। আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। রাগে বলে ওঠে,
—ইটাকে তুমি হেসে উড়ি দাওঠ। মোর কথাটার কুনু ভেলু নাই।
খগেন মাস্টার হাসি থামায়। লোখাকে সে ভাল করে চেনে। কিছুটা আনাড়িপনা তার মধ্যে আছে। একবার গোঁ ধরলে তাকে সহজে বাগে আনা মুশকিল। বাধ্য হয়েই লোখার কথার মাস্টার উত্তর দেয়।
—আরে, হাঁসির কথা বোল্লে হাঁসবোনি! তার আগে বল দিখি, ইসব কথা ত ভগী খুড়ার সঙে আলোচনা কোরবি। মোকে জিগ্যাস কোল্লে আর কি বোলবো!
—তুমি ভাব কি আমি তার সঙে আলোচনা কোরিনি! তাকে বোলতে ত সে মোকে যা শুনাল,সেসব যেদি বউকে শুনাই ত,ঝেঁটিয়ে বিষ উলে দিবে মোর!
— কেনে? ভগী খুড়া আবার কি বোল্ল?

Post a Comment

0 Comments