জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৩৩ /বিজন সাহা

কুল-শরীফের ভেতরের কারুকাজ

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৩৩

বিজন সাহা 

কাজান ক্রেমলিন 

বাউমান স্ট্রীট ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাওয়া যায় কাজান ক্রেমলিনে। পথ তো মাত্র মিনিট পনেরোর। সামনে  ক্রেমলিনের সাদা দেওয়াল। এখানে খেয়াল করেছি শহরগুলোর ক্রেমলিন বা দুর্গের দেয়াল হয় লাল না হয় সাদা। তবে সাদার পরিমানই বেশি। কাজানকা নদীর তীরে বেশ উঁচু জায়গায় অবস্থিত ক্রেমলিন একই সাথে শহর দেখার এক উৎকৃষ্ট জায়গা। এখন প্রথমেই যেটা চোখে পড়বে তা হল কাজানের প্রধান মসজিদ কুল-শরীফ।  ২০০৫ সালে এই মসজিদ তৈরি করা হয়। কাজান খানদের বিখ্যাত ও বহু মিনার বিশিষ্ট মসজিদ পুনর্নির্মাণের তাড়না থেকে এর কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে সব ক্রেমলিনই হয় উঁচু জায়গায় অবস্থিত অথবা চারিদিক থেকে নদী বা বাধ দিয়ে ঘেরা। এটা প্রতিরক্ষার তাগিদ থেকে।       

আজ কাজানকে বলা হয় রাশিয়ার তৃতীয় রাজধানী। কিন্তু মাত্র ২০-৩০ বছর আগেও কাজান ছিল আর দশটা মফঃস্বল শহরের একটা। বাউমান রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে ক্রেমলভস্কায়া মেট্রোর কাছে এলেই চোখে পড়বে কাজানের ড্রাগন জিলান্ত। এই জিলান্তের প্রতিকৃতি আঁকা আছে কাজানের ও স্থানীয় ফুটবল দল রুবিনের পতাকায়। আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলে দেখা যাবে দক্ষিণ-পশ্চিম টাওয়ার। ১৫৫২ সালে ইভান গ্রজনি কাজান দখলের পরে কাজানের খানদের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের উপর বেলোকামেননি বা সাদা পাথরের ক্রেমলিন তৈরি করেন যার স্থপতি ছিলেন পস্কভের ইয়াকভলেভ ও শিরিইয়া। এ দুজনের হাতেই এর আগে সৃষ্টি হয়েছিল মস্কোর রেড স্কয়ারে সেন্ট ভাসিলি গির্জা যা কিনা আজও রাশিয়ার অন্যতম প্রধান প্রতীক। এই দক্ষিণ-পশ্চিম টাওয়ার পস্কভের নির্মাণশৈলীর ক্ল্যাসিকাল নিদর্শন। ক্রেমলিনের দেয়ালের বাইরে দেখা যাবে ১৯৬৬ সালে স্থাপিত মুসা জলিলের মূর্তি যিনি জার্মান বন্দী শিবির থেকে পালিয়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী কর্ম চালিয়ে যান।  আর তার পরেই স্পাসস্কি টাওয়ারা। এটা বর্তমানে ক্রেমলিনে ঢোকার তোরণ হিসেবে কাজ করে। শুরুর দিকে এই তোরণ ছিল না কারণ সেখানে ছিল স্পাসস্কায়া গির্জা আর টাওয়ারের সামনে ছিল জার দ্বিতীয় আলেক্সান্দরের মূর্তি। তবে অক্টোবর বিপ্লবের পর গির্জা ও জারের মূর্তি দুটোই ভেঙ্গে ফেলে সেখানে এই তোরণ নির্মাণ করা হয়। স্পাসস্কি টাওয়ার থেকে ক্রেমলিনের ভেতরে সোজা রাস্তা চলে গেছে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। পাশে আছে ছোট ছোট স্কয়ার যেখানে তাতারস্তানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিবসে বিভিন্ন ধরণের উৎসবের আয়োজন করা হয়। 

এখান থেকে আমরা মোড় নেব বাঁ দিকে। সেখানে বিভিন্ন রকমের স্ট্যাচু আর মঞ্চ মত। মনে পড়ে এরকম এক উৎসবে আমরা সেখানে গেছিলাম। এটা ছিল কাজানের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। বিশাল এক কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছিল ক্রেমলিনের ভেতরে এ উপলক্ষ্যে। এটা মনে হয় ছিল ২০১৯ সাল। আর আমরা মিলিত হয়েছিলাম ব্রিক্স কনফারেন্স উপলক্ষ্যে। তবে মস্কো ক্রেমলিনের মত এখানে কোন কনসার্ট হল নেই। বর্তমানে কনসার্ট হল নামে পরিচিত মস্কো ক্রেমলিনের এই হল আসলে দ্ভরেসৎ সিইয়েজদভ বা কংগ্রেস হল। সোভিয়েত আমলে এখানে পার্টির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হত, যদিও তখনও এখানে বিভিন্ন কালচারাল প্রোগ্রাম হত। বিশেষ করে বলশয় থিয়েটারের অনেক ব্যালে আর নববর্ষের আগে বাচ্চাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান। সেদিক থেকে কাজান ক্রেমলিনের মঞ্চ  উন্মুক্ত বা ওপেন এয়ার।  

🍂

এরপরে দেখা যাবে দক্ষিণ-পশ্চিম টাওয়ারের আভ্যন্তরীণ দিক। সেখানে যে ছোট ছোট জানালা মত ছিদ্র আছে সেসব আসলে দুর্গের প্রতিরক্ষা কাজে ব্যবহৃত হত। ২০০৭ সালে আমি যখন প্রথম কাজান ক্রেমলিন দেখতে আসি তখন শহরে আজকের মত এত সুপার মার্কেট ছিল না। সে সময় ক্রেমলিনের দেয়ালের ভেতরে ছোট ছোট ঘরে বিভিন্ন স্যুভেনীর বিক্রি হত। আমি সেসময় দোকানের ছবি তুলতে গেলে বিক্রেতা মহিলা বেশ মাইন্ড করেছিলেন। এরপর অনেক বার ক্রেমলিনে গেলেও ওদিকে আর যাওয়া হয়নি, তাই সেই সব দোকানপাট এখনও আছে কিনা সেটা বলতে পারব না। 

এখান থেকে স্পাসস্কি টাওয়ারের উপরে পাঁচ কোণা তারা আমাদের দৃষ্টি কেড়ে নেবে। ১৯১৭ সালে সোভিয়েত শাসন প্রতিষ্ঠার পরে জারের রাশিয়ার প্রতীক দুই মাথাওয়ালা ঈগলের জায়গায় এই তারা স্থাপন করা হয়। যদিও নতুন রাশিয়া নিজের প্রতীক হিসেবে দুই মাথাওয়ালা ঈগল বেছে নিয়েছে, তারপরেও স্পাসস্কি টাওয়ারের উপর থেকে তারা সরিয়ে নতুন প্রতীক স্থাপন করা হয়নি। পাশের উঠানে চোখে পড়বে প্রেওব্রাঝেনস্কি টাওয়ার। অন্যান্য বৃত্তাকার টাওয়ারগুলোর পাশে বর্গাকার এই টাওয়ার দেখতে অন্যরকম লাগে। মস্কোর নির্মাণ কর্মীরা এই টাওয়ার এভাবে তৈরি করেন।      

মুসা জলিলের স্ট্যাচু

এর আগেই আমরা কাজান ক্রেমলিনে কুল-শরীফ মসজিদের কথা বলেছি। ১৫৫২ সালে কাজান দখলের সময় সেখানকার মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল। তখন সেখানে শ্বেত পাথরের মসজিদ শোভা পেত। ১৯৯৬ সালে সেই মসজিদ পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০০৫ সালে কাজানের হাজার বছর পূর্তি অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে। এই মসজিদ তৈরিতে তুরস্ক সার্বিক ভাবে সাহায্য করে। ফলে তুরস্কের স্টাইলেই এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে তাতারস্তান সহ মধ্য এশিয়ার সমস্ত মুসলিম প্রধান দেশ বা প্রদেশের ভাষা তুর্ক গোত্রের। ৫৮ মিটার উঁচু এই মসজিদ এতই সুন্দর যে তা অচিরেই কাজানের অন্যতম প্রধান  আকর্ষণীয় প্রতীকে পরিণত হয়। পাশেই এক কাঁচের ঘরে অবিরাম কোরআন পাঠ করা হয়। এটা শুধু তাতারস্তানের জন্যই নয়, সমস্ত রাশিয়ার জন্যই অনন্য এক ঘটনা। কারণ এখানেই প্রথম অষ্টপ্রহর ব্যাপী কোরআন পাঠের আয়োজন করা হয়। কুল-শরীফ শুধু মসজিদই নয়, মিউজিয়ামও। প্রবেশ পথে মেয়েদের জন্য মাথা ঢাকার রুমাল দেয়া হয় যেমনটা দেয়া হয় অর্থোডক্স চার্চে। তবে ভেতরে ঢুকতে হয় মেটাল ডিটেক্টরের ভেতর দিয়ে। সুন্দর সিঁড়ি বেয়ে সোজা উঠে যাওয়া যায় দুই বা তিন তলায়। এক তলাতে আছে মসজিদের মাকেট বা প্রোটোটাইপ আর বড় বড় ঝাড়বাতি। উপর থেকে চোখে পড়ে সুন্দর কারুকাজ করা দেয়াল। সে কারণে কুল-শরীফ আমাকে অর্থোডক্স চার্চের কথা মনে করিয়ে দেয় যার ভেতরের দেয়াল বিভিন্ন রকমের ফ্রেস্কো দিয়ে ভরা। সেখানে মানুষ যত না উপাসনা করতে আসে তারচেয়ে বেশি আসে মসজিদের ভেতরের সৌন্দর্য দেখার জন্য। বেসমেন্টে আছে যাদুঘর। সেখানে বিভিন্ন খলিফাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সংগৃহীত আছে। তবে সেখানে ঢুকতে হয় টিকেট করে। ১৯৯১ সালে আমি যখন ইস্তানবুল যাই, তখন প্রথম তুরস্কের মসজিদ দেখি। স্থাপনার দিক থেকে এটা আমাদের দেশের মসজিদের মত নয়, একেবারেই ভিন্ন। কুল-শরীফও তাই। কাজানের অন্যান্য মসজিদ থেকে কুল-শরীফের স্থাপত্য একেবারেই ভিন্ন। উঁচু দালান বা টাওয়ারের প্রতি আমার বরাবরই দুর্বলতা, বিশেষ করে এসবের ছবি তুলতে। তাই বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে কুল-শরীফের প্রচুর ছবি তুলেছি বিভিন্ন সময়। শুধু বাইরের নয় ভেতরেরও। যদি গির্জার ভেতরে ছবি তুলতে অনুমতি লাগে বা অনেক সময় টিকেট কাটতে হয় কুল-শরীফের ভেতরে ছবি তুলতে সেরকম কিছু লাগে না। 

কুল-শরীফ তৈরি হবার আগে কাজান ক্রেমলিনের এই দিকটা দেখতে কেমন ছিল জানা নেই, তবে এখন এই জায়গাটা একটু অন্য রকম মনে হয়, মানে এর গঠনশৈলী অন্য অংশের থেকে একেবারেই ভিন্ন। মসজিদের সামনে বিশাল আঙিনা মত। এর পরে একটু দূরে বেজইমিয়ান্নি বা নামহীন টাওয়ার। আর এর পাশে ছিল সে সময়ের রাশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অস্ত্রাগার। এক সময় এখানে অস্ত্র তৈরি করা হত। কাজান অস্ত্রাগারের অস্ত্র ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে রাশিয়ার বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু ১৮১৫ সালে অগ্নিকান্ডের পর উৎপাদন হ্রাস পায়, ফলে ১৮৫০ সালে কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। 

কুল-শরীফ

এখান থেকে আমরা আবার ফিরে যাব ক্রেমলিনের মূল রাস্তায়। সেখান থেকে হেঁটে সামনের দিকে গেলে দেখা যাবে কাজানকা নদী, ক্রেমলিন সেতু আর দূরে সেন্ট স্যাভোইর গির্জা। আরও এগিয়ে গেলে ক্রেমলিন থেকে বেরুনোর গেট। এর পেছনে রাস্তার ডান দিকে তাতারস্তানের প্রেসিডেন্টের বাসভবন। সোভিয়েত আমলে অবশ্য এখানে সেরকম কিছু ছিল না। সে আমলে বিভিন্ন রিপাবলিক আর প্রদেশের প্রধান ছিলেন স্থানীয় সুপ্রিম সোভিয়েতের প্রধান আর কার্যত কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার প্রদেশগুলোর প্রধান কোথাও হন প্রেসিডেন্ট, কোথাও বা গভর্নর। জাতি রাষ্ট্র বিধায় তাতারস্তানের প্রধান হন প্রেসিডেন্ট। তখন প্রেসিডেন্টের বাসভবন ক্রেমলিনের ভেতরে নিয়ে আসা হয়। ক্রেমলিনের ভেতরে হলেও প্রেসিডেন্টের বাসভবন যেন আলাদা। গেট খোলা থাকলেও ঢুকতে মনে হয় পারমিশন লাগে। যেহেতু কখনই সেখানে ঢোকার চেষ্টা করিনি, তাই জানি না। তবে গেটের সাথেই টহল, তাই মনে হয় আগে থেকে অনুমতি না নিয়ে সেখানে হুট করে ঢোকা যায় না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্রেসিডেন্টের বাসভবন কাজানের খানদের রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের উপর স্থাপিত।    

কাজান ক্রেমলিন
http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=121


Post a Comment

0 Comments