রবীন বসু
ক'দিন ধরে এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। অনীশ বুঝতে পারে না কেন এসব হচ্ছে। মনের ভুল, না অজান্তে কিছু ঘটছে। রাস্তায় হাঁটছে, মনে হল কে যেন পিছন থেকে নামধরে ডাকল। মেয়েলি গলা। খুব চেনা মনে হল। ঘাড় ঘুরিয়ে যখন দেখে, ভিড়ের মধ্যে পরিচিত কাউকে দেখতে পায় না। আবার অপরিচিত কেউ যে ডাকছে এমন না। চেনা গলা। তাহলে সে কি ভুল শুনল! কিছুক্ষণ থ' মেরে দাঁড়িয়ে আবার চলতে শুরু করে।
বাড়ি ফিরে বাগানের লন দিয়ে হাঁটতে গিয়ে মনে হল, কেউ যেন পিছনে আসছে। স্পষ্ট পায়ের শব্দ। তারপর সব চুপচাপ। আর কোনও শব্দ নেই। বারান্দায় উঠে আন্ধকার বাগানের দিকে তাকাতেই দেখে, কাঁঠাল গাছের আড়ালে একটা ছায়ামূর্তি যেন দাঁড়িয়ে আছে। শাড়িপরা কোনও মেয়ে! কিন্তু কে ও? দূর থেকে চেনাই যাচ্ছে না।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে অনীশের মনে হয়, তার হাতে পায়ের আঙুলে বড় বড় নখ গজাচ্ছে। চুল খাড়া হচ্ছে। গায়ে বিচ্ছিরি বিসদৃশ কালো লোম ভরে যাচ্ছে। নিজেকে সে চিনতে পারছে না। একটা ভয়ানক জানোয়ার বলে মনে হচ্ছে। তার সেই ঘৃণ্য শরীর থেকে তখন আলাদা এক অনীশ বেরিয়ে যায়। সে কেমন নরম আর অনুতপ্ত। জানলার শিক ধরে বাইরে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। অসংখ্য তারার মালা। কালপুরুষের তরবারি। লুপ্তপ্রায় সভ্যতার কথা মনে হয়। মনে হয় এই দ্বিতীয় অনীশ যেন এ পৃথিবীর কেউ না। কাকে যেন সে খুঁজছে। কোনও বড় অপরাধ সে করেছে। যার সঙ্গে করেছে, তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
খুব ভোরের একটা লোকাল ট্রেনে চেপে বসল। ট্রেন শহর ছাড়িয়ে, শহরতলি ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে ছুটল। দু'পাশের গ্রাম, সবুজ মাঠ, গাছ-গাছালি সব যেন ভোজবাজির মতো পিছনে ছুটছে। মাঠে যারা চাষের কাজ করছে, তাদের মুখগুলো অস্পষ্ট। শীতল বাতাস এসে অনীশের মুখে ঝাপটা মারছে। সে ঘোরলাগা ভূতে-পাওয়া মানুষের মতো চেয়ে আছে। তার ভিতরের অনীশ যেন প্রাগৈতিহাসিক গুহার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। কিছু খুঁজছে। কোনও মুখ! কোনও স্মৃতি!
অনীশ তখন কলেজে পড়ে। পাশের পাড়ার অহনা প্রায় তার কাছে পড়া জানতে আসত। বোন পর্ণার বন্ধু। এক স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত। অঙ্কে কাঁচা ছিল। এসে বলত, অনীশদা, এই অঙ্কগুলো একটু করে দেবে! পারছি না।
আসলে সেটা যে একটা ছুতো ছিল পরে বুঝেছে। সদ্যকিশোরী মেয়ের উদ্ভিন্ন শরীরে অচেনা অসুখ। অযুত রহস্য। এক অনিবার্য বয়ঃসন্ধির টানে সে ছুটে আসত অনীশের ঘরে। অনীশেরও পছন্দ হত অহনার সান্নিধ্য। সেই সান্নিধ্য আস্তে আস্তে প্রেমে পর্যবসিত হল। কলেজে ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে, হাতে তিন মাস ছুটি। এক গ্রীষ্মের দুপুরে অহনা এল তার একলা দোতলার ঘরে। বোন পর্ণা সেদিন মাকে নিয়ে মামার বাড়ি গেছে। বাবা নিচের ঘরে ঘুমুচ্ছে। সেই নির্জন দুপুরে, সেই গ্রীষ্ম দাবদাহের দিনে, যুবক অনীশ ও কিশোরী অহনার সামনে আদিম শরীর- রহস্যের মায়া দরজা খুলে গিয়েছিল। তারা অনাস্বাদিত জাদুস্পর্শের পুলকে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের সন্ধান পেয়েছিল। চকমকি ঠুকে জ্বলে উঠেছিল আগুন। সে আগুন ধ্বংস না জীবন তারা বুঝে উঠতে পারেনি।
রূপকথার সেই আবেশ কেটে গিয়েছিল চার মাস পর। কঠিন বাস্তব আর অনিবার্য এক পরিণতি নেমে এসেছিল অহনার জীবনে। লজ্জা মারধোর শাসানির পর নার্সিং হোম ঘুরে যখন বাড়ি ফিরল অহনা, তাকে আর চেনা যাচ্ছিল না। সরল অনভিজ্ঞ কিশোরী মেয়েটা যেন অকস্মাৎ বাজপড়া নারকেল গাছ হয়ে গেছে। অগ্নিদগ্ধ হয়েও শত জিজ্ঞাসায় সে নাম বলেনি। আত্মগ্লানি আর অবিবেচনার শলাকায় তখন বিদ্ধ হচ্ছে অনীশ। ভিতরে ভিতরে রক্তাক্ত হয়েও সে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
আজ এত বছর পর ঘুমের মধ্যে একটা শিশুর মুখ ভেসে ওঠে। কচি কচি দুটো হাত জলের মধ্যে উপরে তোলা। যেন একটা আশ্রয় খুঁজছে। কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চাইছে। বাঁচার অবলম্বন! সেই নিরপরাধ শিশুকে যেন সে খুন করেছে। খুনি সে।
দুপুর গড়িয়ে যখন অপরাহ্ণ, ট্রেন তার শেষ গন্তব্যে এসে দাঁড়ায়। ফাঁকা শুনশান স্টেশন। দু’চারজন যারা নেমেছিল তারা একে একে গ্রামের পথ ধরে। একটাই চায়ের দোকান। অনীশ ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ভাঙা বেঞ্চে বসে। মধ্যবয়স্ক দোকানদার একবার দেখে বলে, চা খাবেন বাবু?
—হ্যাঁ, কড়া করে একটা চা দিন। সঙ্গে বিস্কুট।
অনীশ পকেট থেকে একটা খামটা বের করে। দশ বছর আগের চিঠি। অবহেলায় পড়ে ছিল ড্রয়ারে।
ভিতরের কাগজটা খুলে পড়ে। অহনা লিখেছিল, অনিদা, আমি বাড়ি ছেড়ে বহুদূরে এক গাঁয়ের স্কুলে চাকরি নিয়ে চলে এসেছি। বাড়ির সবাইয়ের ঘৃণা আর তাচ্ছিল্য সহ্য হচ্ছিল না। হয়তো আর বাড়ি ফিরব না। শুধু একবার তোমাকে দেখতে চাই। পারলে সময় করে একদিন এসো। আমি এখানে স্কুলের কোয়ার্টারে থাকি। নিচে আসার পথ নির্দেশ দিলাম।
অনিশ তখন ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়ে আসাম। কলকাতার ঠিকানা থেকে রি-ডাইরেক্টেড হয়ে ঠিঠি পৌঁছেছিল শিলচর আসামে। নতুন চাকরি, ব্যস্ত অনীশ উত্তর দেবে ভেবেও ভুলে গিয়েছিল। দেখা করা তো দূরের কথা। আজ দশ বছর পর সে এসেছে সেই মদনপুর স্টেশন। অহনা যেখানে থাকে। চিঠির নিচে পথনির্দেশ দেখে অনীশ। স্টেশনে নেমে ভ্যানরিক্সা করে পলাশপুর। সেখানে রাজকন্যা বালিকা বিদ্যালয়।
—বাবু, চা।
🍂
অনীশ চিঠিটা বুক পকেটে রেখে চায়ের গ্লাস হাতে ধরে। বিস্কুট নেয়। দোকানদারের কাছে জানতে চায়, আচ্ছা, এখান থেকে পলাশপুর কত দূর হবে?
—সামনে একটু এগিয়ে ভ্যান পাবেন। আধঘন্টা লাগবে, বাবু।
চা শেষ করে দাম মিটিয়ে অনীশ স্টেশনের বাইরে আসে। ডিসেম্বরের মরা বিকেল তখন যায় যায় করছে। একটা ভ্যানরিক্সায় চেপে বসে। আরও একজন উঠেছে। সরু ইট বিছোনো গ্রামের পথ। দু’ পাশে ছোট ছোট গুমটির মতো দোকানঘর। স্টেশন চত্বর ছাড়াতেই সবুজ মাঠ আর বড় বড় গাছ। মরা বিকেলের রাঙা আলো গাছগাছালির মাথায়। অ্যাবর্টের পর অহনার শীর্ণ মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। কী করুণ আর অসহায় ছিল। অনীশ বুঝতে পারে সে মারাত্মক অন্যায় করে ফেলেছে। সে অন্যায়ের কোনও ক্ষমা নেই। এক সরল কিশোরীর নারীত্বকে সে চরম অপমানের মধ্যে ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল। কাওয়ার্ড সে। প্রতারক। আবার চোখ না-ফোটা এক শিশুর খুনিও।
অনীশ মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, অহনার কাছে ক্ষমা চাইবে। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। সব অসম্মান অপমান থেকে তাকে নিষ্কৃতি দেবে। অহনাকে বিয়ে করবে!
“এই যে বাবু আপনার রাজকন্যা স্কুল।”
ভ্যানওয়ালা দাঁড়িয়ে পড়েছে। অনীশ নেমে ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে যায়। বড় রাস্তার বাঁদিক ঘেঁষে একটা সরু রাস্তা ঢুকে গেছে। তার শেষ প্রান্তে দোতলা স্কুল বাড়ি। লোহার গেটে কাউকে দেখতে পেল না। ভিতরে ঢুকে কোয়ার্টারগুলো কোনদিকে খোঁজ করতে অন্ধকার ফুঁড়ে অহনা এগিয়ে এল। পরনে সাদা শাড়ি। মুখ আবছা বিষণ্ণ। অন্ধকারে ঠিক ঠাওর হচ্ছে না। তবু সে বুঝতে পারল, অহনা আর সেই কিশোরী নেই। এখন সে রমণী।
“শেষ পর্যন্ত তুমি এলে, অনিদা!” ক্ষীণ কণ্ঠ।
“হ্যাঁ। এলাম। তুমি কেমন আছো, অহনা?”
“ভালো তো। এই চাকরিটা পেয়ে আমি পালিয়ে বেঁচেছি।”
“আমাকে তুমি ক্ষমা করো, অহনা। আরও আগে আমার আসা উচিত ছিল। ভুল করে ফেলেছি।” অনীশ অনুতপ্ত।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর অহনা বলে, “এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলবে! চল, কোয়ার্টারে যাই।”
“হ্যাঁ, চল।”
অহনা এগিয়ে, অনীশ পিছনে। ডানপাশে স্কুল বাড়ি ফেলে ছোট মাঠ পেরিয়ে একটা একতলা কোয়ার্টারের সামনে এসে দাঁড়ায় তারা। বারান্দায় উঠে অহনা ডাকে, “উঠে এসো।”
চারপাশ কেমন অন্ধকার। আলো নেই। বোধহয় লোডশেডিং। ঘরের তালা কী করে খুলবে অহনা! অনীশ মোবাইলে টর্চ জ্বালে। একটু আলো হতেই দেখে অহনা নেই। সে যেন ভোজবাজির মতো উবে গেছে। কোথায় গেল! এই তো চোখের সামনে ছিল! জোরে ডাকে, “অ-হ-না, অ-হ-না -আ-আ…
অহনার কোনও সাড়া নেই। অনীশ দেখল, দূরে স্কুল বাড়ির দিক থেকে কেউ একজন আলো হাতে এগিয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে একজন গ্রাম্য মধ্যবয়স্ক লোক তার সামনে উপস্থিত হল। বোধহয় নাইট গার্ড হবে। “কে বাবু আপনি? কাকে খুঁজছেন?”
“এই তো এই কোয়ার্টারে যিনি থাকেন, তোমাদের অহনা দিদিমণি। আমার সঙ্গেই ছিল। কোথায় যে গেল।” অনীশ উত্তর দেয়।
“কী বললেন আপনি! অহনা দিদিমণি! তাঁকে দেখেছেন! আপনার সঙ্গে ছিলেন!” লোকটি কেমন ভীত আর আতঙ্কগ্রস্ত মনে হচ্ছিল।
“হ্যাঁ। ঠিক বলছি। আমি কলকাতা থেকে এসেছি। আমার আত্মীয়। উনিই তো আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন এই কোয়ার্টারে।”
“কী বলেন বাবু! অহনা ম্যাডাম আপনাকে নিয়ে এসেছে!” সে যেন বিশ্বাসই করছে না।
“সত্যি বলছি।” অনীশ গলায় দৃঢ়তা।
“তা কী করে সম্ভব বাবু ! অহনা ম্যাডাম যে আজ ছ’বছর হল মারা গেছেন।”
“মারা গেছেন!” অনীশের গলায় অবিশ্বাস।
“হ্যাঁ, উনি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন এই কোয়ার্টারে। শুধু একটা কাগজে লিখে গিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।”
অনীশের মাথা ঘুরছে। সামনের অন্ধকার পৃথিবী আরও অন্ধকার হয়ে গেল। নিরেট সে অন্ধকার। ক্ষমাহীন। একবুক অনুতাপ লজ্জা আর হাহাকার নিয়ে অনীশ মৃতা অহনার কোয়ার্টারের বারান্দায় আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল!
1 Comments
আন্তরিক ধন্যবাদ আর অভিনন্দন জানাই।
ReplyDelete