জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৫৬

 ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা  ১৫৬
সম্পাদকীয়,
টুংকুরি বন্ধুর সঙ্গে পাইপে ঢুকে খেলছে। ঋপণ আঙ্কেলের তোলা এই ছবিটা দেখেই আমার মনে পড়ে গেল কদিন আগে টিভিতে দেখা একটা খবরের কথা। কি তোমাদেরও নিশ্চয়ই মনে পড়েছে?  হ্যাঁ ঠিক বলেছো, ৪১ জন কর্মী টানেল বানাতে গিয়ে আটকে পড়েছিল। আর পাইপ বসিয়ে অন্য কর্মীরা তাদের ১৭ দিন পর বার করে এনেছে। সেই আনন্দে এসো জগদীশ জেঠুর লেখা মজার ছড়া পড়ে নিই। জোড়াসাঁকোর রবি নয় অপুর গল্প বলেছে জয়ন্তী পিসি। বাসবদত্তা পিসির আমেরিকার হ্যালোইনের গল্পটা দারুণ না? সুকুমার জেঠুর কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাসটা এ সপ্তাহে শেষ। না মনখারাপ কোর না। কারণ পরের সপ্তাহে আবার চলে আসছে লাচুঙের নেকড়ে। সেই শুনে শ্রীপর্ণার কালো বিড়ালটাও অবাক।  হা হা হা।  - মৌসুমী ঘোষ।

ধারাবাহিক উপন্যাস 
ছোটোকাকুর কান্ডকারখানা 
সুকুমার রুজ
শেষ পর্ব


ছয়     
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর বিদেশী বিজ্ঞানী-কাকু দুজন বিশ্রাম নিচ্ছেন।  সুমন-তিতলির তো ঘুম আসছে না। কতক্ষণে যে ওই 'হেলিপ্লেন'-এ চড়বে! তখন স্কুলমাঠে ছবি তোলার দিকে ও বিজ্ঞানী দু'জনকে দেখার দিকে মন থাকায় বিমানটা ভালো করে দেখা হল না। 
  অল্প সময়ের জন্য পাইলট-কাকু এসে, খাওয়াদাওয়া সেরে এখন বিমানে ফিরে যাচ্ছেন। ওঁর সঙ্গে গেলে কেমন হয়!     
 যেমন ভাবা তেমন কাজ! সুমন ও তিতলি পাইলট-কাকুকে ম্যানেজ করে কাকুর সঙ্গে স্কুলের মাঠে। ওখানে তখন মানুষজনের ভিড় কমে গেছে।  সুমন ও তিতলি পাইলটের সঙ্গে বিমানের ভেতরে ঢুকে যায়। অন্যরা ওদের দেখে ভাবে, ওদেরকেও যদি ভেতরে ঢুকতে দিত!     
  ওরা দেখে, বিমানটার ভেতরে বেশি জায়গা নেই। তবে, বেশ ছিমছাম। পেছনে মালপত্তর রাখার জায়গা। সামনে দু’টো আর পেছনে চারটে সিট। সঙ্গে সিটবেল্ট। সাইডে ট্রে, পেপার কেস ইত্যাদি। সুমন তো সোজা গিয়ে পাইলটের সিটে বসে পড়ল। পাইলটও মজা পেয়ে হেডফোনটা ওর মাথায় বসিয়ে দিল। সত্যি সত্যি পাইলট মনে হচ্ছে ওকে। তিতলি ও পাইলট ঠিক যেন যাত্রী। 
  তিতলি বলে ওঠে — ইস! এসময় কেউ একটা ছবি তুলে নিলে দারুণ হতো। 
কথাটা শেষ হতে না হতেই পাইলট বলে — দাঁড়াও আমি সি সি ভি আর-টা চালিয়ে দিচ্ছি। তাহলেই সমস্তটা রেকর্ডিং হয়ে যাবে। 
  সুমন তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়ে বুঝে ফেলেছে সি সি ভি আর হলো — ক্লোজ সার্কিট ভিডিও রেকর্ডার। ও তখন সামনের ড্যাশবোর্ডে নানারকম বোতামগুলোতে আঙুল ছোঁয়াতে থাকল ছবি আরও ন্যাচারাল করার জন্য। 
সুমনের খুব ইচ্ছে করছে, বিমানটা যদি আকাশে এক  চক্কর মেরে আসত এখন, কী মজাটাই না হতো! কিন্তু এখন তো যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। ছোটকাকু অবশ্য বলেছে একদিন বিমানে চড়ে ঘোরা হবে।  
  বিমানের মধ্যে থাকতে থাকতে কখন যে ফুরুৎ করে ঘন্টাখানেক সময় পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ ওঁরা দেখে, কাকু এসে ডাকছে — এই যে খুদে বিজ্ঞানী! আর পাইলট সাজতে হবে না, নেমে এস।  
  আর তিতলি, একদিনে এতকিছু দেখলে তোমার ডায়েরির পাতায় আজ জায়গা কম পড়ে যাবে যে!   
ওরা বিমান থেকে গুটিগুটি পায়ে নেমে আসে। কাকুর সঙ্গে বাড়িতে ঢুকে দেখে, জম্পেশ আসর বসেছে। সুমন ও তিতলির জন্য আসে ফ্রুট-জুস।  
  চা-পর্ব শেষ হওয়ার পর সকলে ড্রয়িংরুমে। সবাই   সোফায় বসে আছে যেন সেমিনারে মনোযোগী স্টুডেন্ট। ওপাশে ডিভানে বিজ্ঞানী স্যামুয়েল জনসন যেন লেকচারার। আর পাশেই ঢাউস একটা যন্ত্রের সামনে বিজ্ঞানী আইভ্যান ডিক্সন এমনভাবে দাঁড়িয়ে যেন  ডিমনস্ট্রেটর। ছোটকাকু সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভূমিকা সেরে নেন — খুদে বিজ্ঞানী সুমন ওবেলায় যে প্রশ্ন তুলেছিল, তার উত্তর এবং সেই সঙ্গে আরও কিছু প্রয়োজনীয় কথা বলবেন আমার বন্ধুবর বিজ্ঞানী  জনসন। আর বিজ্ঞানী ডিক্সন হাতে কলমে তোমাদের বুঝিয়ে দেবেন।  
  জনসন বলতে শুরু করেন — ওবেলায় বলেছিলাম যে, কোনও কোনও দেশে ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনার, কুলার এসবরে ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। কেন হয়েছে তা আপনারা প্রত্যেকেই কমবেশি জানেন। দেখুন, আমরা নিজেরাই পৃথিবীকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছি। গ্রিনহাউস গ্যাস ওজোন-স্তরের  ব্যাপক ক্ষতি করছে। পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বিশ-পঁচিশ বছরের মধ্যে পৃথিবীর অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। মেরুপ্রদেশের বরফ গলবে, সমুদ্রতল ওপরে উঠবে। স্থলভূমি জলের তলায়  চলে যাবে। এ ব্যাপারে যে দেশ সচেতন হয়েছে, তারা গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকারী যন্ত্র ব্যবহার আইন করে বন্ধ করেছে। আমরা পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ওজোন-স্তরও রিপেয়ার করার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু তা সিন্ধুতে বিন্দুর মতো। বিশাল বায়ুমন্ডলের সুবিশাল ওজোনস্তর মেরামত করা প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ এবং তা করেই বা কী হবে! গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধ না করে ওটা করা, আর গাছের গোড়া কেটে আগায় জল ঢালা একই ব্যাপার। তাই আমরা উৎসমুখ বন্ধ করতে সচেষ্ট হলাম। কয়েকজন বিজ্ঞানীর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আমরা তৈরি করলাম এই  যন্ত্রটা। যার নাম ‘গ্রিনহাউস এয়ার রিফ্রেসার’।  সংক্ষেপে জি. এইচ. এ. আর বা এককথায় ‘ঘর’। ডিক্সন এখন এই নতুন যন্ত্রের কার্যপ্রণালী দেখাবেন।  
  বিজ্ঞানী ডিক্সন মিষ্টি হেসে 'বাও' করেন জাদুকরের মতো। যেন জাদু দেখানো শুরু করবেন এখুনি। তারপর ধীরে ধীরে যন্ত্রটার ঢাকনা খোলেন। কতকগুলো পাইপ ফিট করা নিরীহ ধরনের একটা পেটমোটা যন্ত্র। ডিক্সন বলেন, এটা একটা সহায়ক যন্ত্র। অন্য যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করে দিলে এ কাজ করবে।  ফ্রিজ, কুলার, এয়ারকন্ডিশনার কিংবা দূষিত গ্যাস-নির্গত মোটর এসব যন্ত্রের সঙ্গে বিশেষ পদ্ধতিতে এই যন্ত্র জুড়ে দেওয়া যাবে। নির্গত দূষিত গ্যাস এই সব পাইপগুলোর মধ্যে দিয়ে চলে আসবে এই চেম্বারে বা বিজারণ ঘরে। এখানে বিশেষ ধরনের রাসয়নিক আর নির্ধারিত কম্পাঙ্কের লেজার রশ্মি পাঠিয়ে দূষিত  গ্যাসকে কার্বন, হাইড্রোজেন, ফ্লোরিন, সালফার, ফসফরাস, নাইট্রোজেন ইত্যাদিতে ভেঙে ফেলা হবে। হাইড্রোজেন, অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে জলে পরিণত হবে। অন্যান্য অজৈব পদার্থগুলো গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে রাস্ট চেম্বারে জমা হবে। নির্ধারিত সময় পর পর সেগুলো বের করে ফেলা হবে। ব্যাস! গ্রিন হাউস গ্যাস জন্মিয়েই মৃত্যুপথে। ওজোন-স্তর অবধি আর যেতে হলো না ব্যাটাকে।  
  সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখছে যন্ত্রটাকে। এমন সময় বিজ্ঞানী জনসন আবার শুরু করেন — তাই আমরা চাই, মানুষ ওইসব অপকারী যন্ত্র ব্যবহার করুক ক্ষতি নেই। কিন্তু অবশ্যই ব্যবহার করার আগে এই উপকারী যন্ত্রটার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দিক। তাহলেই ব্যাটা জব্দ হবে। পৃথিবী মহাবিপদের হাত থেকে বাঁচবে।    
  ছোটকাকু উঠে দাঁড়িয়ে বলেন — অর্থাৎ ঘরে ঘরে ‘ঘর’ চাই। নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়ে ‘ঘর’ লাগানোর নির্দেশ জারি হোক। 
  সুমন তীক্ষ্ণ নজরে দেখছিল আর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল এতক্ষণ। হঠাৎ দেখি ওর চোখে উদাস দৃষ্টি। ঘরে বসে আছে, অথচ যেন ঘরে নেই। ও আপন মনে বিড়বিড় করছে — এ আবিষ্কারটাও হয়ে গেল!  
  ওর পাশেই আইপড হাতে তিতলি। ও সুমনের কথা শুনতে পেয়ে বলে — ভাই! তুই বিজ্ঞানী হতে হতে সমস্ত কিছুই আবিষ্কার হয়ে যাবে। তুই আর কী আবিষ্কার করবি?  
  বলেই দুষ্টু হাসি হাসে তিতলি। তখন ছোটকাকু বলে — এই যে খুদে বিজ্ঞানী! পৃথিবীতে অসংখ্য সমস্যা। এত বছর ধরে আমরা তার দশ শতাংশও সমাধান করতে পারিনি। প্রায় সমস্তটাই পড়ে রয়েছে তোমার মতো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের জন্য। তোমরাই তো পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। মন খারাপ করার কিছু নেই। চল, আমরা সবাই দূষণমুক্ত বিমানে চড়ে একটা চক্কর দিয়ে আসি। তাহলেই মন ভাল হয়ে যাবে। 
সুমন এবার লাফিয়ে উঠে বাতাসে ঘুসি ছুঁড়ে বলে ওঠে — ইয়া একাইনো ডারমাটেক্সিয়া আপিস্ থুপিস্। 

সাত
রাত্রিবেলায় ছোটকাকু ল্যাপটপে মেল-বক্স চেক করছেন। দেখেন, আবার একটা মেল এসেছে। পাঠিয়েছেন পল হ্যারি। লিখেছেনঃ
  ''প্রিয় বিজ্ঞানী শুভদীপ রায়, 
আমার নমস্কার নেবেন। আমার পাঠানো খুব গুরুত্বপূর্ণ চিঠির উত্তর আমি পেয়েছি। আপনি লিখেছেন, একমাস পরে ফ্লোরিডাতে ফিরে এসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।  
  কিন্তু আমার মনে হয়, এতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। কেননা, আমি একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি। প্রথম দিন চিঠিটার লিপি উদ্ধারের সময় ওইরকম একটা আশ্চর্যজনক চিঠি দেখে, আবেগ ও উত্তেজনায় ঘটনাটা সবাইকে বলে ফেলেছিলাম। প্রত্নতাত্ত্বিক রবিন চার্লের কানেও কথাটা গিয়েছিল।  
  দিন দুয়েক পরে উনি একটু ফুরসত পেয়ে আমার কাছে চিঠিখানা দেখতে চান এবং সেটার লিপি উদ্ধারের কপিও চান। আমি ওঁর আমন্ত্রণে ও অধীনে কাজ করছি। তাই চিঠির উদ্ধারলিপির কপি দিতে বাধ্য হই। 
  অর্থাৎ, ওই গুরুত্বপূর্ণ চিঠির বিষয় কিন্তু আর গোপন নেই। এখন রবিন চার্লের মাধ্যমে যদি চিঠির উদ্ধারলিপির কপি অন্য কোনও উদ্ভিদ-বিজ্ঞানীর হাতে  পৌঁছয়, তাহলে আমার স্বপ্ন অসফল হওয়ার একটা সম্ভাবনা থেকে যাবে। 
  তাই আমি চাই, যত শীঘ্র সম্ভব এ চিঠিতে লেখা ফরমুলা অনুযায়ী আপনি কাজ শুরু করুন। এটাই আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ।               
  আমি এখনও স্থির নিশ্চিত যে, এ ফরমুলাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষমতা আপনারই আছে। তাই আমি চাইছি, আপনি দেরি না করে ফ্লোরিডাতে ফিরে আসুন।  আপনার মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।''  
                           আপনার বিশ্বস্ত 
                              পল হ্যারি    
  হ্যারির চিঠিখানা পড়ার পর ছোটকাকু একটু যেন চিন্তায় পড়ে যান। একমাস ছুটির মধ্যে মাত্র পনেরো দিন হল। এখনও পনেরো দিন থাকার কথা। এখন যদি সুমন-তিতলিকে ওর ফিরে যাওয়ার কথা বলা হয়, ওদের খুব মনখারাপ হবে। আবার না গেলেও ওইরকম একটা অভূতপূর্ব আবিষ্কার থেকেও বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। দেখা যাক, কী করা যায়।  
 সুমন ওর পড়ার ঘরে আর তিতলি ডাইনিং-রুমে পড়ায় ব্যস্ত। ছোটকাকু একবার ছেলেমেয়েদুটোর দিকে তাকান। খুব মায়া হয়। ওরা ছোটকাকু বলতে অজ্ঞান। ওরা এই ছুটির মধ্যে কাকুর সঙ্গে আরও কত জায়গায় যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। এখন যদি ফিরে যেতে হয়, ওদের খুবই মনখারাপ হবে।  
  কী যে করা যায়! এমন ভাবতে ভাবতে বিজ্ঞানী ড. শুভদীপ রায়ের মনে পড়ে যায় স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউটের একটা পরিকল্পনার কথা। ‘ফ্লোরিডা  স্পেস রিসার্চ সেন্টার'-এর বিজ্ঞানীদলের একজন বিজ্ঞানী হওয়ার সুবাদে ইন্সটিটিউট একটা সুবর্ণ সুযোগের কথা সমস্ত বিজ্ঞানীকে মৌখিক ভাবে  জানিয়েছেন ইন্সটিটিউটের প্রধান। এবছরের মাঝামাঝি  পৃথিবী থেকে স্পেস সিটিতে পঞ্চাশ সিটের স্পেস-বাস সার্ভিস চালু হবে। প্রথম স্পেস-বাসে 'স্পেস রিসার্চ সেন্টার'-এর বিজ্ঞানীদলের সকলকে সপরিবারে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। অন্যান্য বিজ্ঞানীর সঙ্গে উনিও সে সুযোগ পাবেন। কেননা, স্পেস সিটিতে 'ডোম অরচারড' নির্মাণে তাঁর অবদান তো কম নয়! প্রথম পাড়িতে কুড়িটি আসন সংরক্ষিত থাকবে বিজ্ঞানী ও তাঁদের পরিবারের জন্য। বাকি ত্রিশখানা টিকিট বিক্রি করা হবে লটারির মাধ্যমে।  দশজনকে ওয়েটিং লিস্ট-এ রাখা হবে। কেউ শেষ মুহূর্তে টিকিট বাতিল করলে কিংবা মেডিক্যাল টেস্টে আনফিট্ হলে, ওই ওয়েটিং লিস্ট থেকে সুযোগ দেওয়া হবে। 
  এই পরিকল্পনা নিশ্চয় বাস্তবে রূপ পাবে। সে ক্ষেত্রে দাদা-বউদি ও সুমন-তিতলিকে স্পেস সিটিতে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কোনও অসুবিধা হবে না। এটা যদি সুমন-তিতলিকে বলা হয়, ওরা তো উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠবে। আর এই বেড়াতে যাওয়ার সুবাদে ওরা অন্যান্য পরিকল্পনা বাতিল করতে এক মিনিট ও ভাববে না।
  সুতরাং ওদেরকে যদি বোঝানো যায় যে, এসবের ব্যবস্থা করার জন্য, কয়েকদিনের মধ্যেই তাকে ফ্লোরিডায় ফিরে যেতে হবে, তাহলে ওরা আপত্তি করবে   না। আর ওদের মনখারাপও হবে না। এমন ভেবে ছোটকাকু সুমন ও তিতলিকে নিজের ঘরে ডাকেন।  
  ওরা তো তড়িঘড়ি চলে আসে। ক'দিন ধরে যা সব অবিশ্বাস্য ব্যাপার-স্যাপার ঘটে যাচ্ছে, আবার কাকু কী চমক দেবেন কে জানে! কাকু ওদের দিকে না তাকিয়ে, ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে বলেন — তোমাদের জন একটা দারুণ সুখবর আছে। 
  ওরা এবার সত্যিই লাফিয়ে ওঠে। কাকু বলেন — কয়েক মাসের মধ্যেই আমরা সবাই স্পেস-সিটিতে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। তোমরা কি যেতে রাজি আছো?
  দু'জনে প্রায় চিৎকার করে বলে ওঠে — হ্যাঁ, রাজি....! 
  কাকু এবার বলেন — তাহলে তোমাদেরকে আর একটা ব্যাপারেও রাজি হতে হবে। 
  ওরা থমকে যায়। আবার কী ব্যাপার!
  ছোটকাকু বলেন — এসবের ব্যবস্থা করার জন্য সামনের সপ্তাহেই আমাকে ফ্লোরিডায় ফিরে যেতে হবে। জরুরী মেল এসেছে। 
  সুমন ও তিতলি মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। তারপর তিতলি ক্ষীণ গলায় বলে — স্পেস-সিটিতে যদি যাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য যেতে হয়, তাহলে যেতে হবে। কী আর করা যাবে। 
  সুমন বলে — অরবিন্দ স্যার বলেছেন — বড় কিছু স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থকে ত্যাগ করতে হয়। ঠিক আছে কাকু, তুমি জানিয়ে দাও যে, তুমি পরের সপ্তাহেই ফ্লোরিডা ফিরে যাচ্ছ।
  ছোটকাকু দেখেন, ওদের দু'জনের চোখদুটো ছল ছল করছে। উনিও চোখের জল লুকোনোর জন্য বলেন — ঠিক আছে, এখন তোমরা গিয়ে পড়াশোনা করো। আমি ই মেল টা পাঠিয়ে দিই। 
  সুমন ও তিতলি ধীরপায়ে নিজের জায়গায় ফিরে যায়। আর ছোটকাকু নিঃশব্দে ল্যাপটপে পল হ্যারির ই-মেল-এর উত্তর টাইপ করতে থাকেন।    
(শেষ)
পেটুক 
জগদীশ শর্মা 

পেটুক নাচায় পেট
খোলাই থাকে 
হাঁ মুখের লকগেট 

এসব দেখে 
আলো যায় বেঁকে 

বাঁচান
বলেন যজমান 
লজ্জিত মাথা হেঁট।


অপুর বন্ধু
জয়ন্তী মন্ডল

কতই বা বয়স হবে অপুর। পাঁচ কি ছয়। এর মধ্যেই যেন বড়দার মতো হাব ভাব। 
বড়দার মতো হব বললেই হল। বড়দার তো এখন ক্লাস নাইন।
বড়দার মতো পথের পাশে গাছের পাতা কুড়িয়ে পেল তো অপু সেটা এনে বই এর মধ্যে গুঁজে দিল। 
কি না। শেকড় হবে।
কদিন পর শুকিয়ে আমচুর না হওয়া পর্যন্ত বই এর পাতার দফারফা।
গরমের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি এলো তো সারা দুপুর বাঁশ বাগানে টো টো করে  ঘুরে বেড়ানো আর বাঁশের পাতা, ডগা, কঞ্চি এনে উঠোন ভর্তি করা অপুর কাজ। 
কোনোদিন আবার ওদের ছোট্ট উঠোনে পেয়ারা গাছটার দিকে হাঁ হয়ে শালিখ পাখি গুলোর ঝগড়া দেখে সকালটা কাটিয়ে দিল।
মা বকা দিয়ে তখন বলেন, সারা সকাল শালিখ পাখি, আর দুপুরে বাঁশ বাগানে চরে  বেড়ানো। সন্ধ্যে হলেই ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু।
অপু ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, শালিখগুলো একটা পাকা পেয়ারা নিয়ে কেমন ঝগড়া করছিল। তুমি যদি দেখতে।
অমনি মা মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বলেন, বেশ। এবার চোখে জল দিয়ে এসে পড়তে বসো তো দেখি।
গ্রামের বাড়িতে অপুর এসব বায়না ঠিক ছিল। সমস্যা হল কলকাতায় এসে। জোড়াসাঁকোর বাগানে রবি ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষে ম্যারাপ বাঁধার সময় থেকেই গোল বাধল। জোড়াসাঁকোর বাগানে বাঁশ দিয়ে ম্যারাপ বাঁধছে যে লোকগুলো তাদের সঙ্গে এত ভাব হয়ে গেল অপুর। কিন্তু ওদের সঙ্গে এত ভাব ভালো লাগে না অপুর মায়ের।
দিন কাল ভালো নয় ভুলিয়ে নিয়ে যেতে কতক্ষন! 
কিন্তু অপুটার যে কি হয়েছে। একটু ফাঁক পেলেই ছুটে আসে জোড়াসাঁকোর বাগানে।
ম্যারাপ বাঁধার লোকগুলোর কাছে বসে বসে অপু টুক  টুক করে গল্প করে। কখনও আবার বড়দের মতো বাঁশ গুলোর গায়ে  এমন ভাবে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যেন ওদের সাথে কথা বলছে।
অপুর বাবা শিবতোষ একদিন গিয়ে দ্যাখেন একটা লোক ম্যারাপ বাঁধছে আর অপু বাঁশ গুলোর দিকে হাপুস নয়নে তাকিয়ে।
শিবতোষ বললেন অপু, কি দেখছ অমন করে?
অপু বাবার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, এগুলো আমাদের সেলাম পুরের বাগানের বাঁশ না বাবা?
শিবতোষ একটু অবাক হলেন। তারপর বললেন, আমাদের হোক বা অন্য কারো, কারো না কারো বাগানের বাঁশ হবে। বাড়ি এসো। মাস্টার মশাই আসার সময় হয়ে গেছে।
অপু বাবার পেছন পেছন গুটি গুটি পায়ে রওনা দিলেও মাঝে মাঝে পিছন ফিরে একবার করে দেখে নিচ্ছিল ম্যারাপ বাঁধার বাঁশগুলোর দিকে।
বিথীকার ছেলেকে নিয়ে হয়েছে এই এক সমস্যা।
বাড়িটাও হয়েছে একেবারে জোড়াসাঁকো বাড়ির লাগোয়া। অপুরা যে বাড়িটাতে থাকে সেটা সরকারি আবাসন। অপুর বাবা অফিস থেকে পেয়েছেন। তাই বীথিকাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এখানে থাকতে হচ্ছে।
জোড়াসাঁকোর বাগান উদ্যানে সারা বছরই কোনো না কোনো উৎসব লেগে থাকে। উৎসবের জন্য ম্যারাপ বাঁধতে কত রকমের যে লোক আসে।
তাদের খোঁজখবরও নিয়ে নেয় বীথিকা। কেমন লোক, কোথা থেকে এসেছে এসব নানা প্রশ্ন। আসলে অপু এই ম্যারাপ বাঁধা লোক গুলোর সঙ্গে খুব ভাব জমিয়ে ফেলে। 
তবে বীথিকা একবার একটু অবাকই হয়েছিল। জোড়াসাঁকোর বাগানে গিয়ে দেখে অপু একটা লম্বাটে  বাঁশের গায়ে ঠেশ দিয়ে আপন মনে কি যেন শুনছে? ঠিক যেন রেডিও তরঙ্গে ভেসে আসা খবরের মত।
বীথিকা অপু বলে ডাকতেই অপু একটু চমকে উঠল।
বীথিকা বলল, বাঁশটার গায়ে এমন ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে কি শুনছিলে?
অপু বলল, গল্প শুনছিলাম মা।
বীথিকা অবাক হয়ে বলল,  গল্প? কি গল্প শুনছিলে?
অপু বলল, বাঁশবাগানের বন্ধুদের গল্প শুনছিলাম।
বীথিকা আরো একপ্রস্থ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এখানে কোথায় বাঁশ বাগান পেলে তুমি? 
ম্যারাপ বাঁধার বাঁশ গুলোর দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে অপু বলল, এরাই আমার বন্ধু। বন্ধুরাই বলছিল সে কথা।
দুদিন পর পঁচিশে বৈশাখ। বীথিকা আর কথা বাড়াল না।
প্রতি বছরের মতো এবারেও বীথিকা, অপু সকাল সকাল স্নান সেরে বের হয়ে গেল। কবি গুরুর প্রতিকৃতিতে মাথা নুইয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই কলেজের এক বন্ধুর সঙ্গে বীথিকার দেখা। কলেজে অবশ্য বীথিকার সঙ্গে ওর তেমন মাখো মাখো ভাব ছিল না। অনেক দিনের পর দেখা। বন্ধুটির সঙ্গে মিনিট পাঁচেক কথা বলে পর বীথিকা অপুর হাত ধরার জন্য ডান  হাতটা বাড়াল। 
কিন্তু অপু তো হাত ধরল না। বীথিকা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল অপু ওর পাশে নেই। 
বীথিকা ভাবল অপুর এখানটা খুব চেনা জায়গা। ইতি উতি আছে নিশ্চয় কোথাও।
বন্ধুর সঙ্গে আরও মিনিট দুয়েক কথা বলে মনটা একটু চঞ্চল হয়ে উঠল বীথিকার।
অপু এখনো এলো না কেন? 
বন্ধুটিকে  বলল এখন আসি রে, ছেলেটা আবার কোথায় গেল দেখি বলে, সামনের দিকে এগিয়ে গেল। এদিক ওদিক একটু খোঁজ করে অপুকে দেখতে না পেয়ে বীথিকার একটু ভয়ই লাগল। 
তবে কি এতদিন যা ভাবছিল তাই হল!
ম্যরাপ বাঁধার লোকগুলোই শেষ পর্যন্ত…… এতটুকু ভেবেই বীথিকা অস্থির হয়ে মঞ্চের আশে পাশে ভিড়ের মধ্যে পা বাড়াল।
আজ জোড়াসাঁকোতে খুব ভিড়। ভিড়ের মধ্যে ছোট ছেলেকে ভুলিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ। তাই ওরা অপুর সঙ্গে ভাব জমিয়েছিল। চেনা মানুষ দেখে অপু সঙ্গ  নিতেও গররাজি হবে না। এসব নানা কথা কথা ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে বীথিকা ফটকে দাঁড়ানো পুলিশ অফিসারটিকে সব বলল।
সব শুনে অফিসারটি সেপাইদের ডেকে কিছু নির্দেশ দিতেই কতগুলো সেপাই ভিড়ের মধ্যে, কতগুলো সেপাই ফটকের বাইরের দিকে রওনা দিল।
বীথিকা উৎকণ্ঠা নিয়ে পুলিশ অফিসারের পাশে চেয়ারটায় বসে পড়ল। ঘন্টা খানেক পরে সেপাইগুলো জানাল আশ পাশে কোনো ছোট ছেলের খোঁজ পাওয়া গেল না। সেপাইগুলো অফিসারটিকে বলল লালবাজারে জানানো দরকার।
বীথিকা আর স্থির থাকতে পারল না। 
এদিকে প্রচণ্ড ভিড়। তারওপর মঞ্চ থেকে মাইক এ গানের আওয়াজ। বীথিকা প্রায় পাগলের মতো মঞ্চের কাছ পর্যন্ত কয়েকবার পাক খেয়ে শেষে হতোদ্যম হয়ে বসে পড়ল রবি ঠাকুরের প্রতিকৃতির পাশের বাঁধানো সিমেন্টে। 
পরক্ষণেই আবার উঠে দৌড়ে গেল মঞ্চের পিছনের দিকটায়। ওই দিকটায় সকলের প্রবেশ অবাধ নয়। শুধু মাত্র আমন্ত্রিত অতিথি শিল্পীদের ঘেরাটোপ। ওদিকে পা বাড়াতেই ভলেন্টিয়াররা এদিকে না, এদিকে না বলে ছুটে আসতেই ভলেন্টিয়ারদের গ্রাহ্য না করেই বীথিকা শিল্পীদের ঘেরাটোপের দিকে এগিয়ে গেল। এক লহমায় নীল রঙের পর্দাটা সরিয়ে লম্বা বারান্দায় পা ফেলতেই বীথিকার চোখ চলে গেল বারান্দার কোণে।
সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে সরু লম্বা একটা বাঁশে দুটো হাত ধরে দোল খাচ্ছে একটা ছোট্ট ছেলে! 
অপুই তো!
ছুটে গেল বীথিকা। বাঁশ থেকে হাত দুটো দ্রুত ছাড়িয়ে কোলে তুলে নিল অপুকে। তারপর গালে চুমো খেয়ে বলল, একা একা এখানে কেন এসেছো অপু।
অপু বলল, ওদিকে যে একটাও বাঁশ ফাঁকা নেই মা। সবেতেই ফুল দিয়ে সাজানো। আমি বন্ধুর সঙ্গে কথা বলব কি করে।
এদিক ওদিক তাকিয়ে ম্যারাপ বাঁধা লোকগুলোর কাউকে দেখতে না পেয়ে চোখ বড় বড় করে বীথিকা বলল, এখানে কে তোমার বন্ধু? 
যে বাঁশটা ধরে ঝুলছিল, সেই বাঁশটা দেখিয়ে অপু বলল, এই তো বন্ধু।
বীথিকার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে অপু বলল, জানো মা, এই বাঁশগুলো আমাদের সেলাম পুরের বাগানের বাঁশ। ওরা আমার সেলাম পুরের বন্ধু। জোড়াসাঁকোতে এসেছে।
বীথিকা বলল, কে বলল ওগুলো আমাদের বগানের বাঁশ।
যখন আমি দোল খাচ্ছিলাম লম্বা বন্ধু বাঁশই সেই কথা বলছিল। অপু আবার বলল, জানো মা বন্ধু বলছিল আর কিছুদিন অপেক্ষা করলে ওর চেহারাটা আর একটু ভালো হত। 
কিন্তু চোর গুলো রাতের অন্ধকারে ওদের আমাদের বাগান থেকে কেটে গাড়ি বোঝাই করে কলকাতায় নিয়ে এসেছে।
অপু অবাক হয়ে বীথিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বন্ধু আরো বলল, আমরা তোমায় প্রথম দিনেই চিনতে পেরেছি। তুমি সেলাম পুরের বাঁশ বাগানে বাঁশি বাজাতে। বসে বসে বই পড়তে। রোদ্দুর সইতে পারতে না। আমরা তোমাকে ছায়া দিয়ে আড়াল করতাম।
বীথিকা  অপুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে লাঠির মতো সরু বাঁশটার কাছে এসে দাঁড়াতেই বাঁশের ডগার বাঁধনটা খুলে ঠক করে পড়ে গেল বীথিকার পায়ের কাছে। যেন গড় হয়ে প্রণাম করল সে। 

🍂

ভ্রমণ
উৎসব মরশুমে আমেরিকাতে

বাসবদত্তা কদম

পর্ব ২ 

চোখ পিটপিটিয়ে আমি তখন দেখার চেষ্টা করছি, ভূতেরা কতদূর। দেখি কি এক ভূতের ছানা তার হুডি খুলে আমার চোখে মুখে জল ছেটাচ্ছে আর আন্টি আন্টি করে ভয়ে ভয়ে ডাকছে। তার হাতে দেখি আমার রান্নাঘরেরই জলের বোতল। ভূতের মুখে আন্টি শুনে একটু সাহস হলো। রান্নাঘরের থেকে জলের বোতল নিয়ে আমার মুখে ছিটে দিচ্ছে যখন, তখন এ ভূত চেনা ভূত তার ওপর আন্টি আন্টি ডাক!
এ হলো এদেশের বাচ্চাদের বহু পুরনো কায়দা। সব বাড়িতে গিয়ে গিয়ে বলে ট্রিক অর ট্রিট? ট্রিক আর কে সাধ করে দেখে? সবাই চকোলেট, কেক, পেস্ট্রি কিনে রাখে। এলেই হাতে দিয়ে বিদায়। তারপরেই দড়াম করে দরজা বন্ধ। কে ভূত কে মানুষ বলা যায়! চেহারায় তো ফারাক নেই। এরা সেদিন ভূত সেজে সবাইকে ভয় দেখায়। শোনা যায় নাকি সত্যিকারের ভূতেদেরও। শোনা যায় ভূতেরা সেদিন ফিরে আসে নিজেদের পুরনো বাসস্থানে। তারপর এমন সব ছানা পোনার দল দেখে তারা চিনতেই পারে না কে ভূত আর কে মানুষ। সব চোঁ চাঁ দৌড় দেয়। 
হ্যালোইন, চিত্রঋণ - বাসবদত্তা

ভেবে দেখো, জ্যান্ত ড্রাকুলা আমার মুখে জল ছেটাচ্ছিলো। আবার যে অজ্ঞান হই নি সে নেহাৎ ভূতের বাপের ভাগ্য খুব ভালো ছিলো। তারপর দেখি সে কুচো আমাদের পাশের বাড়ির জিম। ভাবা যায়। ইচ্ছে হয়েছিল দিই এক ঠাঁটিয়ে। অনেক কষ্টে ইচ্ছে দমন করে ওদের ভেতরে ডেকে সব চকোলেট কেক আর প্যাস্ট্রিগুলো দিয়ে দিলাম। 
পরদিন ভোর বেলায় আমাদের ফ্লাইট। যাবো পেনসিলভেনিয়া রাজ্যের ফিলাডেলফিয়া। সেখান থেকে দাদা বৌদি ভাইপোর সঙ্গে নায়েগ্রা জলপ্রপাত। দাদা আগেই তাড়া দিয়েছে। বলেও দিয়েছে আরো যদি দেরি হয় আসতে নায়েগ্রার দরজাও নাকি বন্ধ হয়ে যাবে। শুনে ভাবি, জলপ্রপাতেরও দরজা খোলা বন্ধ! 
বৌদি বললো, না নায়েগ্রা কি আর বন্ধ হয়! সে তো জলপ্রপাত। সেখানে ঘুরে বেরিয়ে যে লঞ্চগুলো নায়েগ্রা জলপ্রপাতকে দেখায় তাদের ঘুরে বেড়ানো কিছুদিন বন্ধ থাকে তখন, যখন নায়েগ্রার জল ভয়ঙ্কর ঠান্ডা হয়ে ধীরে ধীরে বরফ হতে থাকে। সাধারনত তারিখটা দোসরা না তেসরা নভেম্বর হয়। লঞ্চে না চড়লে নায়েগ্রাকে কাছ থেকে দেখা যাবে না কিছুতেই।
হিউস্টন শহর থেকে পেনসিলভেনিয়া প্লেনে যেতে লাগে প্রায় তিন ঘন্টা আর ফিরতে লাগে প্রায় চার ঘন্টা। ব্যাপারটা কিরকম অদ্ভুত না! শিবঠাকুরের আপন দেশ আমেরিকায় কত যে অদ্ভুত কান্ড! কি আর বলি। যে রাস্তায় যাবো, সেখান দিয়েই ফিরতে নাকি সময় বেশি লাগবে। তাও একটু আধটু না গুনে গেঁথে এক ঘন্টা। সময় নাকি বদলে যায়। এই ধরো নিউইয়র্কে যে সময়, হিউস্টনে সময় তার একঘন্টা পিছনে। আরো পশ্চিমে গেলে আরো পিছোবে। 
আমাদের দেশে কাশ্মীর থেকে কেরালা হয়ে কটক ঘুরে অরুণাচলে পৌঁছালেও সময় সকাল সাতটা তো সাতটা আর সন্ধে পাঁচটা/ছটা যাই হোক সে তাই। কোথাও সূর্য আগে ওঠে। কোথাও পরে। যেমন অরুণাচলে সূর্য ওঠে ধরো ভোর সাড়ে তিনটে আর গুজরাটে বেলা সাতটা কিন্তু তাবলে ঘড়ি তো আর আলাদা আলাদা সময় দেখায় না। ঘড়ি আমাদের দেশে এককথার লোক। না। ওদেশে তেমন হবার জো নেই। একটা দেশ কিন্তু সূর্যের ওঠা নামার ওপর নির্ভর করে কোথাও সকাল পাঁচটা আবার অন্য প্রান্তে তখন সকাল নটা’ও হতে পারে। 
দেশটা আয়তনে সত্যিই খুব বড়; আমাদের দেশের প্রায় তিনগুন। তাই তার অনেকগুলো টাইমজোন বা সময়ের ভৌগলিক সীমাক্ষেত্র। তাই দেশের পূর্ব আর পশ্চিমে সময়ের পার্থক্য অনেকখানি। 
আমরা পৌঁছালাম ফিলাডেলফিয়া। যখন প্রায় পৌঁছে গেছি, প্লেনে বসেই দেখতে পাচ্ছি নীচে সব রঙিন গাছ। গাছের পরে গাছ, পাতাগুলো কারা যেন রঙ করে দিয়েছে। কোনোটা হলুদ। কোনটা টকটকে লাল। কোনো গাছ আবার বেগুনী। কেউ হলুদ আর লালের মাঝামাঝি। কেউ খয়েরি। কেউ খয়েরি বেগুনীর মাঝামাঝি। 
অপূর্ব সব রঙ তাদের। কিন্তু আমাদের চেনা সবুজ পাতারা সব কোথায়? খুব কমই সবুজ পাতার গাছ দেখতে পাচ্ছি। আকাশে তখনো ফটফটে রোদ্দুর। এমন তো নয় এ নেহাৎ-ই কোনো লাইটিং এর কান্ড! আমরা এরকম কত দেখেছি দুর্গা পুজোর সময়! বেশ সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে গাছেদের মাপতে শুরু করলাম। 
কান্ডটা কি? এখুনি বুঝতে পারছি না। তবে ধরে ফেলবো ঠিক। এবার প্লেন নামছে হু হু করে, রঙ আরো বাড়ছে। বেড়েই চলেছে। 
(ক্রমশ)



Post a Comment

0 Comments