লোকমাতা রানি রাসমণি —২৭
সুমিত্রা ঘোষ
এই ব্যাপারে দ্বিমত আছে, কেউ কেউ বলেন প্রবল বন্যায় বাঁধানো ঘাট চূর্ণ- বিচূর্ণ হয়ে যায়। অপর মতে জানা যায় রানির দেওর অভয় চরণ দাস রাতে কুঠিবাড়িতে গিয়ে বাজে মাল-মশলা রেখে আসল মাল লোক দিয়ে সরিয়ে এনে নিজের কবজায় রেখেছিল। রানি লোক মারফৎ জানতে পেরে আকারে ইঙ্গিতে অভয়কে তিরস্কার করতে দ্বিধা করেননি। তবে যেই কে সেই — একই ব্যাপার, ঘরশত্রু বিভীষণ এতটুকু পালটায়নি. রানির তদারকিতে পুনরায় ঘাট বাঁধানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবার রানি সিদ্ধান্ত নিলেন দেশি কারিগর দিয়ে ঘাট বাঁধাবেন না। বিদেশী কোম্পানীকে দায়িত্ব দিতে হবে। যে কোম্পানী এই দায়িত্ব নিল সেই কোম্পানীর নাম মেকিনটস কোম্পানী। তাঁরা ঘাট পুননির্মাণ করলেন। এরপর রানি মন্দির নির্মাণের কাজে মন দেবেন ঠিক করলেন। গঙ্গার তীরে ঘাট বাঁধানোর কাজ শেষ হলে মন্দির তৈরির নির্দিষ্ট জমিতে পুজো করা হল নিয়মনিষ্ঠা মেনে। এরপর মন্দির তৈরি শুরু হল। মন্দির তৈরিতে হাজার রকমে বাধা আসতে লাগল সমাজের তথাকথিত উচ্চবর্ণের লোকদের পক্ষ থেকে। তাদের এক কথা একে বিধবা তাতে ছোট জাতে মেয়ে, মন্দির প্রতিষ্ঠা করলে দেশ রসাতলে যাবে। রানি নিন্দা বিদ্রূপ সব অকপটে হজম করে এক লক্ষ্যে স্থির হয়ে আছেন। মা ভবতারিণী স্বপ্নে বলেছেন তিনি ভাগীরথীর তীরে রানির তৈরি মন্দিরে বসবাস করবেন এবং নিত্যপূজা সেবা গ্রহণ করবেন। যিনি গোটা সাম্রাজ্যের অধীশ্বর তার কথাকেই গুরুত্ব দেন রানি। মা-ভবতারিণী মন্দির তৈরির জায়গাও দেখিয়ে দিয়েছেন রানিকে। রানি একদিন ভোরের দিকে স্বপ্ন পেলেন মা-ভবতারিণী রানিকে ডেকে বলছেন এই দ্যাখ রানি এই জায়গা, তুই এখানে আমার মন্দির প্রতিষ্ঠা কর। স্বপ্ন পেয়ে যখন রানি কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছেন, তখনই অন্য বিপদ মাথা চাড়া দিয়ে রানিকে চিন্তাগ্রস্ত করেছে।
🍂
ইতিমধ্যে রামকুমার চট্টোপাধ্যায় যার সঙ্গে রানির প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিলো ভাগীরথীর তীরে, যেখানে রানির বজরা থেমেছিল এবং কেউ কেউ বলেন রানিকে মা-ভবতারিনী স্বপ্নে বলেছিলেন তুই ঘরে ফিরে যা, কাশী যাওয়ার দরকার নেই। এই ভাগীরথীর পশ্চিম উপকূলে আমার মন্দির প্রতিষ্ঠা কর। কথায় বলে ভাগীরথীর পশ্চিমকূল বারানসী সমতুল। রামকুমার চট্টোপাধ্যায় ওখানে বসে শ্যামা মায়ের গান গাইতেন। ঐদিনও তিনি একটা গাছের নীচে বসে শ্যামাসঙ্গীত গাইছিলেন। রানির বজরা যখন মায়ের নির্দেশে ওখানে থেমে গেল তখন রানি গঙ্গার তীরে নেমে ইতস্তত পায়চারী করার সরায় রামকুমারের সাক্ষাৎ পান এবং তাঁর কণ্ঠে মায়ের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে পরিচয় জানতে চান। পরিচয় পর্বে রামকুমার বলেন, তাঁর বাড়ি কামারপুকুরে, কলকাতায় ঝামাপুকুরে ভাড়াবাড়িতে বাস করেন এবং একটি টোল খুলে ছেলেদের শিক্ষা দান করেন। যথাসময়ে রানি সদলবলে জানবাজরের বাড়িতে ফিরে গেলেন এবং স্বপ্নের কথা নিজের পরিবারের লোকদের বললেন। বড় মেয়ে পদ্মমণি সর্বদা বিপদের আঁচ বেড়াত। সে ভাবল মন্দির তৈরি করতে প্রচুর টাকা খরচ হবে। তাছাড়া কানাঘুষো শুনতে পাচ্ছে মন্দির প্রতিষ্ঠা হলে সমাজপতিরা রানির পরিবারকে একঘরে করে দেবে। সমাজের যারা মাথা সেই ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় বহুবার রানির কাজের বিরুদ্ধাচরণ করে এসেছে। এবার সমস্যা আরও গুরুতর আকার ধারণ করবে, মা যদি মন্দির তৈরি করিয়ে দেবীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে। সুতরাং পদ্মর শান্তি বিঘ্নিত হতে লাগল। স্বামী রামচন্দ্র আটা উন্নত মনের মানুষ সে শাশুড়ির স্বপ্নকে প্রাধান্য দিলেও স্ত্রীর মুখের ভয়ে মুখে কিছু বলতে পারেনি। তবে রামচন্দ্র চালচলনে বুঝিয়ে দিয়েছে সে রানির কাজকে পূর্ণমাত্রায় সমর্থন করবে। অপর মেরুতে মথুরামোহন বিশ্বাস ঠাকুর বিশ্বাস না করলেও শাশুড়ি মায়ের স্বপ্ন দেখা এবং মন্দির তৈরি, মা- ভবতারিণীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি সমস্ত কাজকে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সমর্থন করেছে এবং রানির নির্দেশে সমস্ত কাজ করেছে। রানি রাসমণিকে মথুর শ্রদ্ধা-ভক্তি সহকারে অত্যন্ত ভালবাসত। কোন কথা অমান্য করেনি মথুর।
ক্রমশ
ক্রমশ
0 Comments