পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ১০২
সো দোর ব্রত
ভাস্করব্রত পতি
পৌষ মাসের মকর সংক্রান্তির দিন সো দোর ব্রত লৌকিক উৎসবটি পালন করেন নারী পুরুষ নির্বিশেষে। তবে প্রধানত পুত্রের মা এটি পালন করেন। তবে কন্যার মা করেন না। কলাগাছের বাকলা দিয়ে তৈরি সাতটি ডিঙিতে গাঁদা ফুল দিয়ে ভালো করে সাজানো হয়। এরপর সুপুরি, এক জোড়া কলা, এক জোড়া পান, পৈতে এবং কড়ি দিয়ে ভরা হয়। এই উৎসবের উপচার মোতাবেক মকর সংক্রান্তির দিন উপোস করে থাকতে হয়। এবার পরের দিন ঐ ডিঙিতে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে জলে ভাসিয়ে দিতে হয়। এটি যে পালন করবে, সে তাঁর হারিয়ে যাওয়া আত্মীয় স্বজনদের খুঁজে পাবে। একে 'সুয়ো দুয়োর ব্রত'ও বলে। এটি মূলতঃ মা চণ্ডীর ব্রত বা মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত পালনপালন প্রক্রিয়া।
এই লৌকিক উৎসবের সাথে সুন্দর একটি কাহিনীর সন্ধান মেলে। কোনও একসময় এক দেশে এক বেণে সওদাগর ছিল। তাঁর নাম ছিল কৃষ্ণ। তাঁর। তাঁর সাত ছেলে এবং একটিমাত্র মেয়ে ছিল। মেয়েটি সবার বড়। তাঁর বিয়ের পর সে আর কখনও বাপের বাড়ি আসেনি। আর তাঁর বাবা মাও কখনও মেয়ের কোনও খোঁজ নেয়নি। কয়েক বছর পরে ঐ সওদাগর মারা যেতে তাঁর সাত ছেলে সাত ডিঙি ভরা সম্পদ নিয়ে বাণিজ্য করতে বেরুল বিদেশে। এইভাবে যেতে যেতে পথে তাঁদের পাঁচ মাস অতিবাহিত হল। একদিন তাঁরা এক ডাকাতের অতিথি হল। ডাকাতেরা কিন্তু খুব খাতির যত্ন করে তাঁদের সেবা করতে সচেষ্ট হল। তবে তাঁদের হাতে ভিজে কাঠ, ফুটো হাঁড়ি আর কিছু চাল ডাল দিয়ে রান্না করে খেতে বলে চলে গেল।
এমন সময়ে একটি সুন্দরী বউ এসে তাঁদের জিজ্ঞেস করল, 'তোমরা কোথা থেকে এসেছো'? তখন তাঁরা সমস্ত পরিচয় দিল ঐ বউকে। এটা শুনে বউটি খুব কাঁদতে লাগল। সবাই অবাক তখন। কাঁদতে কাঁদতে বলল, 'তোমরা আমার ভাই। মাকে বলবে যে, আমি এখনো মরিনি। তোমরা এখানে আর থেকো না। তোমাদের বিপদ হবে এখানে থাকলে'। এই বলে সকলকে প্রণাম করে বউটি চুপচাপ চলে গেল। একটু পরেই ঐ বউটির শাশুড়ি তথা ডাকাতের মা এসে বলল, 'তোমরা কেন এখানে এলে? তোমরা জানোনা, আমার পাঁচ ছেলে কিন্তু ডাকাত। এখনি তাঁরা এখানে এসে তোমাদের সব কেড়ে নেবে। আর তোমাদের সাবাড় করে মেরে ফেলবে। তোমরা তাড়াতাড়ি যা পারো কিছু একটা ফুটিয়ে খেয়ে নিয়ে শিগগিরই পালাও'।
তখন সওদাগরের সাত ছেলে আধসেদ্ধ ভাত খেয়ে ডাকাতের মা'কে প্রণাম করে মাঠের মাঝখান দিয়ে প্রাণপণে ছুটতে ছুটতে একেবারে নদীর ধারে এসে হাজির হল। সেখানে মাঝিদের ডেকে ডিঙিতে চেপে উত্তরদিকে পালিয়ে গেল সবাই।
এদিকে ডাকতদের মা সেই ফাঁকা ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে খুব করে চেঁচিয়ে ছেলেদের ডাকতে লাগলো। আর মড়াকান্না জুড়ে দিল। ডাকাতেরা আসতেই তাঁদের মা বুদ্ধি করে বললো, 'বাড়ির অতিথিগুলো ঘরে আগুন লাগিয়ে দক্ষিণ দিকে পালিয়ে গেছে। শীগগির যাও। ধরে নিয়ে এসো'। মায়ের কথা শোনা মাত্রই পাঁচ ডাকাত ভাই সবাই মিলে দক্ষিণদিকে তাঁদের ধরার জন্যে দৌড় লাগালো। কিন্তু অতিথিরা তো উত্তর দিকে গিয়েছিল। ফলে ডাকাতরা তাঁদের ধরতে পারে নি।
এদিকে সওদাগরের সাত ছেলে অন্য এক দেশে গিয়ে সাত জনে বিয়ে করে চৌদ্দ ডিঙা ধন সম্পদ নিয়ে নিজেদের দেশে হাজির হল। ঘাটে এসে ছেলেরা দেখল, তাঁদের মা ঘাটে সুয়ো দুয়োর ডিঙি ভাসাচ্ছে। মা তখন ছেলে ও ছেলেদের বউদের দেখে তাড়াতাড়ি পাড়ার পাঁচজন এয়ো মেয়েকে ডেকে এনে ছেলে বউদের বরণ করে ঘরে তুলল। তখন ছেলে বউ সুয়ো দুয়োকে প্রণাম করে ঘরে গেল।
একদিন কথায় কথায় ছেলেরা মাকে জিজ্ঞেস করল, 'মা! আমাদের কি কোনোও বোন নেই'? মা বলল, 'আছে বৈকি। বিলক্ষণ আছে। তোমাদের বোন পিসির বাড়িতে থাকতো। সেই পিসি এক ডাকাতের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। সেইজন্য আমরা আর তাঁকে ঘরে তুলতে চাইনি'। ছেলেরা তখন সেই ডাকাত ভাইদের এবং তাঁদের বোনের কথা মাকে শোনালো। শুনে মা অঝোরে খুব কাঁদতে লাগলো।
তখন সাত ভাই সেই ডাকাত জামাইয়ের বাড়িতে গিয়ে সকলকে নিমন্ত্রণ করল। আমন্ত্রণ পেয়ে জামাই, মেয়ে আর মেয়ের শাশুড়ি এলো। সওদাগর গিন্নী মেয়েকে বুকে করে নিয়ে খুব কাঁদতে লাগলো। তারপর মেয়ে জামাইকে ভাল করে খাইয়ে দাইয়ে সাত ডিঙি ধন দিয়ে পাঠিয়ে দিল তাঁদের বাড়ি। যাওয়ার সময় ডাকাত জামাই শাশুড়ির কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল, 'মা! আমি ডাকাতি করতে গিয়ে অনেক পাপ করেছি। এর থেকে মুক্তি পাবো কি করে'?
সওদাগর গিন্নী তখন বললেন, 'তোমরা মকর সংক্রান্তির দিন কলার বাগলার ডিঙি বানিয়ে তাতে গাঁদা ফুল দিয়ে সাজাবে। এরপর এতে জোড়া পান, জোড়া কলা, সুপুরী, পৈতে ও কড়ি দিয়ে সাজিয়ে সুয়ো দুয়োর পূজো করবে। সেদিন উপোস করতে হবে। তার পরদিন ঐ ডিঙিতে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে পুকুরে কিংবা নদীতে ভাসিয়ে দেবে। এটা করলেই সব পাপ থেকে মুক্তি পাবে'।
এটা শোনার পর তাঁরা দেশে চলে গেল। এরপর মকর সংক্রান্তিতে তাঁরা সওদাগর গিন্নীর দেওয়া উপচারগুলি নিষ্ঠা সহকারে পালন করতে লাগলো। সব পাপ থেকে মুক্তি মিললো অবশেষে। তাঁদের এই পালন পদ্ধতি দেখে অন্যান্য গ্রামে, শহরে সুয়ো দুয়োর পূজার কথা তথা সোদোর ব্রত প্রচারিত হতে লাগলো। উল্লেখ্য, এই লৌকিক উৎসবের উপচার পালনের সাথে ওড়িশার বিখ্যাত বালিযাত্রা লৌকিক উৎসবের অনেক মিল রয়েছে।
0 Comments