জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৩০/বিজন সাহা


ভোলগা নদীর খোঁজে – ৩০

বিজন সাহা 

চেবোকসারি 

নিঝনি নভগোরাদ থেকে আমরা রওনা হলাম কাজানের পথে। রাস্তায় কয়েক ঘণ্টার জন্য যাত্রা বিরতি চেবোকসারিতে। চেবোকসারি – চুভাশ প্রজাতন্ত্রের রাজধানী। রাশিয়ায় তিন ধরণের প্রাশাসনিক ব্যবস্থা আছে। ইতিমধ্যে আমরা মাস্কভা বা মস্কো, তভের, ইয়ারোস্লাভল, কস্ট্রোমা, ইভানভা, নিঝনি নভগোরাদ এসব রিজিয়নের সাথে পরিচিত হয়েছি। এগুলো মূলত রুশ অধ্যুষিত এলাকা। এছাড়া আছে জাতি ভিত্তিক এলাকা যাদের রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র নামে অভিহিত করা হয়। এদের মধ্যে পড়ে চুভাশ, তাতারস্তান, বাশকিরিস্তান, চেচনিয়া, ইঙ্গুশেতি, মারি এল, মারদোভা, কালমিকি ইত্যাদি। আর আছে শহর যারা এই দুই ধরণের ইউনিটের মতই – যেমন মস্কো, সাঙ্কত পিতেরবুরগ, সেভাস্তোপোল। চুভাশ প্রজাতন্ত্রের জনগণ মূলত চুভাশ জাতি ভুক্ত। ১৯৯০ এর দশকে এখানকার প্রধান ছিলেন ফিওদরভ। খুব সক্রিয় রাজনীতিবিদ। তাই তাঁকে এখনও মনে আছে। স্থানীয় চুভাশ ভাষায় চেবোকসারির নাম শুপাশকার। যেখানে চেবোকসারি নদী ভোলগায় পড়ছে সেখানে ভোলগার ডান তীরে গড়ে উঠেছে এই জনপদ। 

নৃতাত্ত্বিক খননকার্য থেকে জানা যায় যে বর্তমান চেবোকসারির এখানে ত্রয়োদশ – চতুর্দশ শতকে বুলগার ও চুভাশদের বসতি ছিল। ভেনিসবাসী ফ্রান্সিস্কো ও ডোমিনিক পিজিগানি ভাইদের ১৩৬৭ সালের বৃহৎ মানচিত্রে ও ক্যাটালিনের ১৩৭৫ সালের এটলাসে চেবোকসারির জায়গায় জনপদের উল্লেখ ছিল, যদিও সেখানে কোন নাম লেখা ছিল না। ১৪৫৯ সালে পূর্ববর্তী মানচিত্র ব্যবহার করে পর্তুগালের রাজার জন্য তৈরি ফ্রা-মাউরোর মানচিত্রে চেবোকসারির ওখানে ভেদা-সুয়ার (চুভাশ ভাষায় ভাঁটা সাভার) নামে এক জনপদের উল্ললেখ আছে। রুশ দিনপঞ্জিতে চেবোকসারির উল্লেখ পাওয়া যায় সেনাপতি ইভান দ্মিত্রিয়েভিচ রুনার ১৪৬৯ সালে কাজান আক্রমণ করার সময় থেকে।     

১৫৫৫ সালের আগে প্রাচীন জনপদ চেবোকসারি নদীর মোহনার দুই ধারে অবস্থিত ছিল। যদিও সেই সময়ের কোন স্মৃতিস্তম্ভ সংরক্ষিত নেই, তবে নৃতাত্ত্বিক আবিষ্কার থেকে জানা যায় সেই সময় বাড়িঘর ছিল মূলত কাঠের, আর ইট ব্যবহার করা হত মূলত ভূগর্ভস্থ বা ঘরের আভ্যন্তরীণ চুল্লী তৈরির কাজে। রুশ জারদের দ্বারা চেবোকসারির কাঠের ক্রেমলিন নির্মাণ কাজ আরম্ভের মধ্য দিয়ে শহর নির্মাণের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত এই ধাপকে বলা হয় কাঠের স্থাপত্যের যুগ।   

১৫৫৫ সালের ২৩-২৪ জুলাই কাজান ও সভিয়াঝস্কের গির্জার প্রধান কাজান যাবার পথে চেবোকসারিতে যাত্রা বিরতি করেন এবং ইভান গ্রজনির নির্দেশ অনুসারে ভবিষ্যৎ ক্রেমলিনের জায়গা পবিত্র করেন। এছাড়া ভভেদেনস্কি সাবরের জায়গায় লিনেনের গির্জা স্থাপন করেন। সে বছরই ক্রেমলিন নির্মিত হয়। ক্রেমলিনের ভেতরে সেনানিবাস, খাজাঞ্চিখানা, কারাগার, গির্জা, দ্ভোরিয়ান বা এলিটদের বাসস্থান ইত্যাদি অবস্থিত ছিল। অগ্নিকান্ডে শহর প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে বিলুপ্ত হবার পর শুরু হয় নতুন পর্যায়। ১৬৬০ থেকে অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত এই সময়ে নির্মাণকার্যে পাথর ব্যবহার করা হতে থাকে। একে একে তৈরি হয় ভভেদেনস্কি সাবর, টাউয়ার সহ ত্রইস্কি গির্জা ও তলগস্কি গড মাদার গির্জা। এই পাথরের স্থাপনাগুলো আজও টিকে আছে। তবে পরবর্তী বিভিন্ন সময়ের অগ্নিকান্ডে কাঠের ক্রেমলিন বার বার পুড়ে গেলে ১৭০৪ সালে সেটা আর নতুন করে তৈরি না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। চেবোকসারির পাথরের গির্জাগুলো তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের অনুদানে।  বেশ কিছু গির্জা তৈরি হয় তাঁবুর স্টাইলে, আবার কিছু কিছু গির্জা ক্লাসিকবাদ ও বারোক স্টাইলে তৈরি হয়। অনেক গির্জার ভেতরের অংশ ফ্রেস্কো স্টাইলে সজ্জিত করা হয়। শহরের বনিকরা নিজেদের জন্য একতলা ও দোতলা পাথরের দালান তৈরি করতে শুরু করে। এসব ঘরবাড়ি ও পাথরের গির্জা চেবোকসারিকে ভিন্ন রূপ প্রদান করে। এই শহর ভ্রমণের পর সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ইয়েকাতেরিনা বলেন, আমার চোখে চেবোকসারি সব দিক থেকেই নিঝনি নভগোরাদের চেয়েও সুন্দর। ১৭৭৩ সালে চেবোকসারি নদীর ধারে কল কারখানা তৈরি নিষিদ্ধ করা হয়, যদিও সেই নিষেধাজ্ঞা শুধু আংশিক ভাবে কার্যকরী হয়েছিল। জানি না সেটা পরিবেশের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল কিনা, তবে সেই সিদ্ধান্ত যে সে যুগের জন্য যুগান্তকারী ছিল তাতে সন্দেহ নেই। ১৮২৯ সালে চেবোকসারির শহরের জন্য নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় যদিও সেই পরিকল্পনার খুব অল্পভাগই বাস্তবায়িত হয়েছিল। তবে সোভিয়েত আমলে ১৯৬৩ সালে কালিনিন সেতু, ১৯৬৯ সালে মস্কো সেতু, ১৯৭৩ সালে গাগারিন সেতু, ১৯৭৯ সালে সুগুত সেতু আর ১৯৮৫ সালে অক্টোবর সেতু তৈরি করার পরে শহর নতুন ভাবে সেজে ওঠে।   


চেবোকসারির দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল চুভাস ন্যাশনাল মিউজিয়াম, চুভাস রাষ্ট্রীয় আর্ট গ্যালারি, চাপায়েভ মিউজিয়াম, ইভানভ সাহিত্য যাদুঘর, মেমোরিয়াল পার্ক পাবেদা বা ভিক্টরি পার্ক, বেশ কিছু থিয়েটার ও অপেরা। এছাড়াও আছে স্থানীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির উপর ৯৭ স্থাপনা। আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীরদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশাল মেমোরিয়াল কমপ্লেক্স “সামরিক গৌরবের স্মৃতিসৌধ” এবং “মাত পাক্রোভিতেলনিৎসা” বা নগরলক্ষ্মী মা নামে এক বিশাল স্ট্যাচু। স্থানীয় কোন মহিলার আদলে এই বিশাল মাতৃ মূর্তি স্থাপিত হয় ২০০৩ সালে।     

চেবোকসারি আমরা যখন এসে পৌঁছুই তখন বেলা প্রায় দুটো বেজে গেছে। যদিও প্রচুর আধুনিক ঘরবাড়ি গড়ে উঠছে তারপরেও চুভাস জাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যও দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন পুরানো স্থাপনায়। আমাদের প্রথম বিরতি ছিল ভোলগার তীরে যেখানে একটা শিপ রেস্টুরেন্ট “রোল্যান্ড” স্বাগত জানাচ্ছে। হ্যাঁ, দুপুরের খাবার খাওয়া দরকার। গাড়ি থেকে নেমেই দেখি সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ইয়েকাতেরিনার স্ট্যাচু। একটু দূরে গির্জার কমপ্লেক্সের বাইরে পিওতর ও ফেভ্রোনিয়ার স্ট্যাচু। দ্বিতীয়টি সুখী পরিবারের প্রতীক। হাতের ডান দিকে আরেকটা ছোট গির্জা। আকাশী রঙের গম্বুজে বেশ সুন্দর লাগছিল। এটা উসপেনস্কি গির্জা। দূরে দেখা যাচ্ছে মাতৃসমা এক মহিলার বিশাল স্ট্যাচু। তবে আমরা প্রথমেই গেলাম রেস্টুরেন্টে। সেখান থেকেও শহরের বিভিন্ন দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে জাহাজের বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ছবি নিলাম। লেকের ওপারে দূরে সাদা ধবধবে ভস্ক্রেসেনিয়ে খ্রিস্তা গির্জা। আসলে এটা ঠিক লেক নয়, নদী বন্দর। মনে হয় শিপের পার্কিংএর জন্য অনেকটা ভেতরে নিয়ে আসা হয়েছে। আমার সব সময় ইচ্ছে করে কিছু স্থানীয় খাবার খেতে, তবে কেন যেন সব জায়গায় কমবেশি একই ধরণের মেনু – রুশ। হতে পারে একটু ঘুরলে স্থানীয় কোন ডিশ পাওয়াই যেত। খাওয়া শেষে আমরা গেলাম ভোলগার তীরে। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ঢুকলাম সভ্যাতো ত্রইস্কি ছেলেদের মনাস্তিরে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের এই মনাস্তিরের গড়ন অনেকটা তাঁবুর মত। সাদা দেয়ালের উপরে সবুজ ছাদ। এর স্থাপত্যের ভিন্নতা সহজেই চোখে পড়ে। সেখান থেকে আমরা হাঁটতে হাঁটতে গেলাম লেকের ধারে। সেখানে অদ্ভুত আকারের এক তিক চাকার সাইকেল, লেকের ধারে অ্যাংকর আর ওপারে থিয়েটার। একটু দূরে প্রশাসনিক স্থাপনা আর আরখাঙ্গেল মিখাইলের গির্জা। লেকের চারপাশে এসব ছড়িয়ে আছে। সেদিক থেকে আমরা মনে হয় খুব ভালো স্পটেই এসেছিলাম। এরপর আমাদের গন্তব্য ছিল সেই স্ট্যাচু – সেই মাতৃ মূর্তি। “মাত পাক্রোভিতেলনিৎসা” বা নগরলক্ষ্মী মা। জায়গাটা লেকের ওপারে, বেশ উঁচুতে। সেখান থেকে সমস্ত শহর যেন হাতের মুঠোয় চলে আসে। কিছু কিছু নির্মাণ কাজ চলছিল। অথবা হতে পারে পয়লা সেপ্টেম্বরের জন্য প্রস্তুতি। এদিনটা ছিল ৩০ আগস্ট ২০২১। আর পয়লা সেপ্টেম্বর এদেশে নতুন শিক্ষা বর্ষ শুরু। রাশিয়ায় পুরা গ্রীষ্ম মানে জুন, জুলাই, আগস্ট স্কুল ছুটি যাতে ছেলেমেয়েরা গ্রীষ্মে ভালো মত বিশ্রাম নিতে পারে, দীর্ঘ শীতের জন্য প্রস্তুত হতে পারে। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে গাড়িতে বসেই শহরের এদিক সেদিক একটু দেখে আমরা আবার পথে নামলাম। আমাদের লক্ষ্য কাজান। চুভাস রিপাবলিক থেকে আমরা যাব তাতারস্থান রিপাবলিকের দিকে। 

অনেক দিন পরে এক ছেলের সাথে মস্কো যাচ্ছিলাম। আমি সোমবার সেখানে ক্লাস নিই, তাই রোববার বিকেলে মস্কো যাই। কখনও বাসে, কখনও ট্রেনে আবার কখনও কারো সাথে প্রাইভেট কারে। কথায় কথায় জানলাম সে ছেলে, মানে যার গাড়িতে আমি যাচ্ছিলাম ও চেবোকসারি থেকে। ইভান ওর নাম। যদিও আমার চেবোকসারি ভ্রমণ ছিল মাত্র আড়াই ঘণ্টার – ওকে দেখে মনে হল কত পরিচিত। 

চেবকসারির ভিডিও 
https://www.youtube.com/watch?v=nXoDs_c9UJQ&t=6s

চেবকসারি ছবি
http://bijansaha.ru/album.php?tag=252

     

Post a Comment

0 Comments