জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা/পর্ব- ২৩/গৌতম বাড়ই

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ২৩
গৌতম বাড়ই

মশালের লালচে আলোয় সিংহরাজের নজরে পড়ল গুহার এককোণে দাইমা তাতুলিকে বসে থাকতে। শীর্ণকায় একমাথা সাদা শণের মতন চুল নিয়ে পাথরের মেঝেতে নিজের বিছানাপত্র পেতে সুসীমাকে শুইয়ে দিয়ে তার গায়ে- মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তাতুলিকে এই বনজঙ্গল প্রদেশের সকলেই চেনে, সিংহরাজেরও এইভাবে এক- দুবার দর্শন ঘটেছিল দাইমা তাতুলির। তাই এই দাইমার ছবিটা মনের ভেতর স্পষ্ট ভাবে ধরা আছে। বুড়িটার বয়স যেন এক জায়গায় গিয়ে থমকে গেছে। কারণ,  কেউ বলে একশ, আবার কেউবা বলে দেড়শ। তবে আশ্চর্যের যে,  একে তো সে খবর দেয়নি। তবে খুব প্রয়োজনীয় এবং এক সত্যিকারের  উদ্ভূত  দরকারি সময়ে তিনি হাজির হলেন কী ভাবে? সে যেভাবেই হোক, সিংহরাজ আর ভাবতে চাইলেন না, জীবনের অনেককিছু রহস্যময় থাকে! এও রহস্যময় থাক! তাতুলিকে তার ভীষণ প্রয়োজন এ বৈদ্যরাজও বলে গিয়েছেন। মাঝরাত পেরিয়ে গিয়েছে। সুসীমা সিংহরাজকে খাবার খেয়ে নিতে ইশারা করলেন। ইশারা করে বোঝালেন যে, খাবার ওখানে বাসনপত্রের সাথে ঢাকা দিয়ে রাখা আছে। সিংহরাজ দাইমা তাতুলিকে এবার ঘুমিয়ে পড়তে বললেন। বললেন, এখন তো তিনি এসে গিয়েছেন, দাইমাবুড়ি নিশ্চিন্তে শয়নে যেতে পারেন। 


ভোরের আলো ফোটার মুখে সিংহরাজের এক দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে গেল। এই স্বপ্নটা তার কাছে দুঃস্বপ্নই বটে, যা কিছুদিন হল তাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে। ধড়মড় করে উঠে বিছানায় বসেই পড়লেন। তারপর চেয়ে দেখলেন দাইমা তাতুলি তখনও জেগে রয়েছেন। সিংহরাজ হাঁক পাড়লেন- "আরে এ বুড়ি তোর চোখে ঘুম নাই? তোকে তো বেঁচে থাকতে হবে এখন আমার জন্য। যা ঘুমিয়ে পড় । অভাগা কোথাকার!"

দাইমা তাতুলি বললেন সিংহরাজের দিকে মুখ তুলে না চেয়েই- " আমি একবছর বিনা আহার আর বিনাঘুমে বেঁচে থাকতে পারি! তোর তো ঠিকমতন আহার আর আয়েস না হলে তিনদিন পর মারা যাবি। সে তোর গায়ে গতরে যতটাই বল থাক আর ঐ দশাসই চেহারা হোক। "

-- " বড্ডো বকছিস বুড়ি। তুই কী আদতে বেঁচে আছিস? নাকি এ তোর প্রেতাত্মা? "

-- " এ আবার কী ধরণের কথা? এই তো বললি এখন আমাকে বেঁচে থাকতে হবেই তোর জন্য। আসলে তুই তোর নিজের স্বার্থের গণ্ডী ছাড়া পৃথিবীর আর কিছুই বুঝিস না। এর থেকে বেরিয়ে আয়, দেখবি জগত কত সুন্দর!মাদার গাছের পেঁচার রাতজাগা চোখের খবরে আমি এখানে সুসীমার কাছে এসেছি। তোর জন্যে আসিনি বদমাইশ। যে আসবে আমি জানি , সে ইতিহাস রচনা করবে , আর তুই দুষ্টু, বদমাশ, ইতিহাসে ঐ বদমাশ ঘৃণিত থেকেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবি। বুঝলি!"

সিংহ দেখল এই মুহূর্তে দাইমার সাথে আর তর্কে জড়ানো ভালো নয়। চুপ করে উঠে দাঁড়াল। সুসীমা এখনও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। অন্যদিন হলে ভোরে একবার উঠে পড়ে। দাইমার নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়ে হয়ত সে এখনও ঘুমোচ্ছে। গতরাতে সেও তো মাঝরাত পর্যন্ত জেগে ছিল। দাইমা উঠে গুহাআবাসের বাইরে গিয়েই আবার ফিরে এলেন আর এবার সুসীমার পাশে শুয়ে পড়লেন। সিংহরাজ নিশ্চূপ হয়ে সেই দুঃস্বপ্নটি আবার মনে করতে লাগলেন আর শিউরে উঠলেন। এ যদি সত্যি হয়!ধুত্তোর স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না। তবে ভোর রাতের স্বপ্ন না কি সত্যি ঘটেই জীবনে। সুসীমা তাকে বলেছিল।
*                               *                                 *
একপক্ষকালের কিছু বেশি হয়েছে। অমাবস্যা গিয়ে আবার শুক্লপক্ষ এসেছে। ভরা জোছনার রাত আসেনি। দাইমা তাতুলি সুসীমা বাহ্যে বেরোলেও সঙ্গে লাঠি হাতে ঠুক ঠুক করে যান। সিংহরাজকে আজ দুদিন হল বলেছেন, সে যেন খুব একটা দূরে না যায় আর আরও বলেছেন- " এ ভরাপেট পোয়াতী মাগী দু- চারদিনের মধ্যেই ছেলেপুলে বিয়োবে।" সে কথাই সত্য হল , শুক্লপক্ষের পঞ্চমীতে গুহাআবাস আলো করে সুসীমা এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। কেন দাইমা তাতুলিকে এ রাঢ়ের বনজঙ্গল এক ডাকে চেনে, সিংহরাজ বুঝতে পারলেন। তাই অনেকে বলেন তাতুলি আসলে এক দেবী, কোনও দূর্গম পাহাড়ের ওপর তার বাস। তিনি মানুষের অন্তরের ডাক শুনতে পান। 

দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে নিয়মিত : জ্বলদর্চি। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
🍂

সিংহরাজ নিজের পুত্রসন্তানের মুখ দেখতে পেয়েই আনন্দে অট্টহাসিতে ধ্বনি আর প্রতিধ্বনিতে এই নির্জন স্থান ভরিয়ে তুললেন। নিজের বংশধর পৃথিবীতে এনেছেন বলে। সিংহরাজ মৃত্যুর সাথে সাথে হারিয়ে যাবেন না। সেই অদৃশ্য দুঃস্বপ্নের মুখে মনে মনে লাথি কষালেন ঠিকই, তবুও তারপরক্ষণেই তার মুখে , খুব গভীর ভাবে খেয়াল করলে এক দুশ্চিন্তার ছায়া যে কোনও জন দেখতে পাবেন। 

দাইমা তাতুলি ন্যাকড়ার গরম পুঁটলি করে বাচ্চাকে সেঁকছিলেন। আর ফুটন্ত গরম জলে ফেলে রেখেছেন তার বাঁশের কাটারি। তিনি সুসীমার সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে দেখলেন, তারপর এক ক্রুর হাসিতে সিংহরাজের মুখের দিকে চেয়ে বললেন - " তোর ছেলেকে ঠিকভাবে দেখে রাখ পশুরাজ। তোর ভবিষ্যৎ ওরই হাতে। তোর নিষ্ঠুর আচরণের সমাপ্তি হবেই একদিন। রাজকন্যা সুসীমা একটু খাড়া হয়ে গেলেই আমি চলে যাব। আমাকে খুব শিগগিরই আর বিরক্ত করবি না। আমার যাওয়া আর আসা কেউ দেখতে পায় না। কোনো শক্তির সে ক্ষমতা নেই ।তুইও দেখতে পাবি না শয়তান! "

সিংহরাজ জবাব দেবেন না তা কি হয়! বুড়ি দাইমার দিকে তাকিয়ে বললেন- " তুই ভাগ তো বুড়ি। তোকে এখন আমার আর দরকার নেই। এখানে থেকে তুই আমাকে জ্ঞান দিয়ে যাবি আর শিখাবি। তার চে তোর চলে যাওয়া ভালো। "

তাতুলি বললেন- " ও এখন আমার আসল দরকারটি ফুরিয়েছে বল! " 

সুসীমা দেখল সিংহের কথায় দাইমার অন্তরে গিয়ে বারবার গভীর বেদনার আঘাত রেখে যাচ্ছে। সিংহরাজ নিজের ক্ষমতা আর অসীম দেহবলের জোরে কারোর মনের নরম জায়গাটার খবর রাখেই না , বা জানেও না।  তাই সে দাইমার কাছে এসে বসে পড়ল। আর বলল ছেলেকে সে একটু দেখবে। 


সন্তান জন্মানোর আনন্দে সুসীমার সারাশরীর মাতৃত্বের স্বাদে পুলকিত হল। এই আনন্দের মধ্যেও একটু বাদে নিজের আত্মজকে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে এক মন খারাপের বার্তাও দিল সুসীমার মনে। সুসীমা দেখলে, পুত্রসন্তানের হাত এবং পায়ের গঠন কিন্তু মানুষের মতন নয়,  তার পিতা সিংহরাজের  সাথে যথেষ্ট মিল আছে। তাই ছেলের নাম রাখা হল সিংহবাহু । তারপর কেটে গেল আরও কয়েকটি মাস।

সিংহরাজ এখন মাঝে- মাঝে পুত্রসন্তানকে শূন্যে তুলে লোফেন। আর সেই অদৃশ্যের খোঁজ করে চলেন। যে অদৃশ্য দুঃস্বপ্নে দৃশ্য হয়ে তাকে শঙ্কিত করে তুলছে বারবার। 

তারপর আবার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সুসীমা এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিলেন। এবারেও সেই নির্জন স্থান সিংহরাজের নাদে কম্পিত হয়ে উঠল। হাসিতে ফেটে পড়ল চারদিক। পশুর আনন্দম একেই বলে। রাঢ়ের সেই গুহাআবাসে সিংহরাজের সংসার যাত্রা পূর্ণগতিতে এগিয়ে যেতে থাকল। মেয়ের নাম রাখা হল সিংহসিবলী। ফুটফুটে মেয়ে। দুজনেই মেয়েকে দেখতে পেয়ে তার সৌন্দর্যে আনন্দিত হন। সুসীমার সাথে তার অনেকটা মিল রয়েছে , যারা দেখেছেন তারাই বলছেন। 

বঙ্গেশ্বরের কন্যা সুসীমার হুবহু একই যেন দেখতে তার কন্যা সিংহসিবলী। সবার কথা শুনে তার মন আরও আনন্দে মেতে ওঠে। 

এইভাবে কেটে যেতে থাকল সুসীমার গুহাবাসের দিনগুলি। সুসীমা কোনও গণ্ডীতে বদ্ধ থাকবার জন্য জন্মায় নি। এখন মাঝেমধ্যে সিংহরাজকে এই কথা মনে করিয়ে দেয়। 


ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments