জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —৩০ /সুমিত্রা ঘোষ

লোকমাতা রানি রাসমণি —৩০

সুমিত্রা ঘোষ

এল সেই স্নান যাত্রার দিন। সে এক মহা উৎসবের দিন। দীর্ঘ সাত বৎসর  পর রানি রাসমণির স্বপ্ন সফল হতে চলল। মন্দিরে মাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারছেন না এ দুশ্চিন্তা রানিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এদিকে রানির বয়স বেড়ে যাচ্ছে সে চিন্তাও রানিকে পীড়া দিছিল কারণ এত বড় মহৎ কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন কি পারবেন না এই ভাবনা ছিল। যাই হোক শুভ দিন এল, দক্ষিণেশ্বরের আকাশ-বাতাস আনন্দে মুখরিত। 'দীয়তাং ভূজ্যতাং'। অকাতরে অর্থব্যয়। দূর-দূরান্তের ব্রাহ্মণ পণ্ডিত প্রবর ও মান্যরর অতিথিরা যথাসময়ে রানি রাসমণির আমন্ত্রণপত্র পেয়েছেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই দক্ষিণেশ্বরে ভাগীরথী তীরে দেবালয় নির্মাণের খবর পেয়ে আনন্দিত হয়েছেন ও  মহা উৎসবের দিনে মা ভবতারিণী দেবীর প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে দক্ষিণেশ্বরে এসেছেন জানা যায় তখনকার দিনে এই মহতী উৎসবে প্রায় 'ন' লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন রানি রাসমণি। এই টাকা ছাড়া দুলক্ষ ছাব্বিশ হাজার টাকায় ত্রৈলোক্যনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁ মহকুমার অন্তর্গত শালবাড়ি পরগণাটি কিনে দেবসেবার জন্য দানপত্র লিখে দিয়েছিলেন।
🍂
দক্ষিণেশ্বরে এই দেবালয় প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে রানির ত্যাগের মহিমা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।দেবীমূর্তির নির্মাণ যেদিন থেকে শুরু হল সেইদিন থেকেই রানি কঠোর তপস্যা শুরু করছিলেন। ত্রিসন্ধ্যা স্নান, হবিষ্যান্ন ভোজন, মাটিতে শয়ন ও যথাশক্তি জপ-ধ্যান ও পূজা। এভাবে দীর্ঘসময়  অতিবাহিত করা সহজসাধ্য নয়। রানি কিভাবে এমন সংযম পালন করেছেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। দেবালয় প্রতিষ্ঠার আগেই রামকুমার  জানবাজারের জমিদার বাড়িতে এসে রানির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গেলেন। যাঁকে নিয়ে তৈরি হবে কালের ইতিহাস, সর্বধর্ম সমন্বয়ের নতুন অভিযান, যে কথা পৃথিবীর লোক শুনে মোহিত হবেন _ মা-ভবতারিণী স্বপ্নে রানিকে সেই দিব্যপুরুষের কথা বলেছিলেন এবং যথাসময়ে গদাধরকে এনে রানির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়।

একটা বিশেষ ঘটনার কথা প্রিয় পাঠকদের জানা দরকার। (যাঁরা জানেন না তাঁদের জন্য) গদাধনের বড়দা শ্রীযুক্ত রাজকুমার চট্টোপাধ্যায় সাধারণ মানুষ ছিলেন না। পিতৃদের ক্ষুদিরাম ঠাকুরের (চট্টোপাধ্যায়) উত্তরাধিকারী হিসেবে একজন ভক্ত হচ্ছে উঠেছিলেন। শ্যামা মায়ের গানে বিশেষ অভিজ্ঞ ছিলেন। কামার পুকুরে থাকা কালীন সময়ে যজমানি ও নিজগৃহে পূজা-পাঠ করতেন। জানা যায় রামকুমার লোকের ভাগ্যগণনাও করতে পারতেন। যদিও এই কাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেননি। তবে নিজের সহধর্মিণীর ভাগ্য গণনায় জেনেছিলেন প্রথম সন্তানের জন্মদান কালে তাঁর স্ত্রী মারা যানেন এবং তাঁর ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিলো। রামকুমারের মৃত্যুকালীন সময় উপস্থিত হওয়ার পূর্বেই শ্যামা মা স্বপ্নে জানিয়েছিলেন, রামকুমারের সময় ফুরিয়ে আসছে তিনি যেন তাঁর ভাই গদাধরকে মায়ের পূজারি হওয়ার উপযুক্ত করে গড়ে তোলেন। রামকুমার চট্টোপাধ্যায় স্বল্পায়ু ছিলেন। দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণী দেবীর পূজারি পদে মাত্র এক বছর ছিলেন। এরপর অকস্মাৎ ইহলোক ত্যাগ করেন।
ইংরাজী ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩১ মে, বৃহস্পতিবার, স্নানযাত্রার দিন মা ভবতারিণী বেদিতে স্থাপিত হবেন। স্বপ্নাদিষ্ট মন্দির স্থাপিত হয়েছে। কে ভবতারিণীকে প্রতিষ্ঠা করবে ? মৃন্ময়ীকে চিন্ময়ী করবে কে? পুরোহিতকুল মন্দিরে দেবীমূর্তি প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করছে, হিন্দুধর্মে জাতিভেদ প্রথা পথ আগলে আছে। ব্রাহ্মণ পূজারি সেবার ভার নেবে না, অন্নভোগ হবে না। রানি পড়লেন সমস্যায়। সমাধান দিলেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। এরপর রামকুমারের সঙ্গে মন্দিরে প্রবেশ করলেন গদাধর চট্টোপাধ্যায়। রামকুমার বিধান দিলেন, রানি যদি ওই সম্পত্তি কোন ব্রাহ্মণকে দান করেন এবং সেই ব্রাহ্মণ ওই মন্দিরে দেবী প্রতিষ্ঠা করে অনুভোগ ব্যবস্থা করেন তাহলে শাস্ত্রের নিয়ম লঙ্ঘিত হবে না  এবং ব্রাহ্মণেরা অন্ন ভোগ গ্রহণ করতে পারবেন । শ্রীযুক্ত রামকুমারের পরামর্শে মেনে তিনি দেবালয় তাঁর গুরুকেই অর্পণ করলেন। আর রামকুমারকেই পূজারীর পদে বরণ করলেন।
ক্রমশ  

Post a Comment

0 Comments