বার্লিনের ডায়েরি
১২তম পর্ব
চিত্রা ভট্টাচার্য্য
(বার্লিনের পথে প্রান্তরে শহর থেকে উপকণ্ঠে।পরবর্তী অংশ )
উদাসী বাতাসে পাহাড়ের মাথা থেকে সাদাকালো মেঘ ভেসে আসে। বেড়াতে বেরিয়ে শ্রীময়ী ওর কৌতূহলী মনের অপার জিজ্ঞাসা নিয়ে নিমেষ হারা চোখে অপলক চেয়ে থেকে নীরবেই এগিয়ে চলে। এমনি এক মেঘলা দিনে রাস্তায় বেরিয়ে দুজনেই বড়ো অবাক হয়ে গিয়েছিল। স্টপেজে বাস দাঁড়াতেই চটপট বাসে উঠে পড়ে। ডায়েরির পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা সেদিনের সেই স্মৃতি আজ এ গল্পে না লিখলে ''বার্লিন ডায়েরি''র ভ্রমণের কাহিনী আগামীতে অসমাপ্ত থেকে যাবে।
বেশ কয়েকটি স্টপেজ পার হয়ে শহরের কেন্দ্রে অনেকটা জায়গা সবুজ ছড়ানো দেখে, প্রায় মধ্যবর্তী অঞ্চলে নেমে পড়েছে ওরা। তবে দূর থেকে রাস্তার মাঝখানে সবুজে সবুজ হয়ে আছে গাছ পালার সমারোহে। রাস্তায় পোস্টার দেখে থমকে দাঁড়ায় URBAN--KIEZ FARM.. শহরের ব্যস্ততম পথের মাঝখানে বিস্তর জায়গা জুড়ে ক্ষেতি বাড়ির কাজ চলছে। কর্মব্যস্ত পাকা রাস্তায় দূর্বার গতিতে চলছে গাড়ি। তবু ও এই অত্যাধুনিক শহরের মাঝে এমন এক ঘন সবুজে ভরা সব্জির বাগান কি করে গড়ে ওঠা সম্ভব? শ্রীময়ীর মনে অপার বিস্ময় ! একরাশ প্রশ্ন ,আকাশ পাতাল ভেবে ও উত্তরের কুল কিনারা পায় না। রাস্তার মোড়ে ছোট্ট সাজানো ফুলের বাগান দেখা গেলে ও এমন তাজা সব্জি ? বাঁধাকপি ,ব্রোকোলি ,ফুলকপি মটরশুঁটি ,শিম সব আনাজ গুলো দেশের মত।
ঋষভ এগিয়ে যেতে যেতে বলে ,এই হচ্ছে বার্লিনের উৎকৃষ্ট 'আরবান ফার্মিং।' ভাবতে পারো ? শহরের মাঝখানে এমন সব্জির বাগান আঠারোশো বর্গ মিটার এলাকার। এমন মনোহারিণী সজীব শাকসব্জি দেখে মন চমৎকৃত হয়ে ওঠে। আসলে এই ফার্মিংয়ের কাজে ব্যাপৃত থেকে শহর বাসীর মনে প্রকৃতি সম্বন্ধে চেতনা ও সংযোগ বারানো এবং প্রতিবেশীরা মিলে নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্যের সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কমিউনিটির একত্রিত হয়ে শহরের আশেপাশে চাষাবাদ করার পদ্ধতিকে আর্বান ফার্মিং বলে। এর ফলে সমাজের অৰ্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ লাভ ,এবং সম্প্রীতির উদ্দেশ্যে শহুরে এলাকায় ও আশেপাশে কৃষিকাজ করার বৃহত্তর সুযোগ পাওয়া যায়। শহরের মানুষ অতি সুলভে টাটকা ফল ও শাকসব্জি ,এমন কি মাছ ও পেতে পারে। সামনেই এক বড়ো মাছের চৌবাচ্চা ,সেখানে মাছেরা খেলে বেড়াচ্ছে। গ্রীনহাউসে জল সরবরাহ করা হচ্ছে আবার মাছ সংরক্ষণের জলাশয় থেকেই। এক অসাধারণ নিয়মে এই আর্বান ফার্মিং চলছে।
নীল সবুজে সুন্দরী বার্লিন
বার্লিনের আর্বান ফার্মিংয়ের গল্প ঋষভ প্রথম শুনেছিল মুম্বাই তে অফিস কলিগ মল্লার বোসের স্ত্রী বার্লিনের মেয়ে সিলিয়ার মুখে। পরবর্তী কালে মল্লার বোস পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে ও সিলিয়া কর্ম সূত্রে বার্লিনে ফিরে গিয়েছিল। এবং শ্রীময়ীর সাথে সিলিয়ার বন্ধুত্ব প্রথম দিকে বেশ কিছু দিন বিদেশী নীল লাল বর্ডারের খামে চিঠির মাধ্যমে অটুট থাকলেও সময়ের চাকায় পিষে ক্রমশ শিথিল হয়ে যায়। অদ্রিজার বার্লিনে আসার পর এবং বার্লিন সম্পর্কে মাতৃ মনে অজস্র প্রশ্ন ও কৌতূহল মেটাতে এফবির, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রায় ১৬ বছর পর আবার সিলিয়ার সাথে যোগসূত্র নিবিড় হলে প্রায় প্রতিদিনই আলাপ চলতে থাকে।
গল্পের ছলেই সিলিয়া বলেছিল বার্লিনে আর্বান ফার্মিংএ ওদের পারিবারিক ব্যবসা আছে এবং সেই সূত্রে ওখানেই সে কর্মরতা। প্রায়ই একটু অবসরে ম্যাসেজ আসতো। সিলিয়া ও শ্রীময়ী কাজের অবসরে মাঝে মাঝেই নিজেদের গল্পের ঝাঁপি খুলে বসতো এক মিশ্র ভাষায়। সিলিয়া বলেছিল ওর ছয় বছর বয়সে হারিয়ে ফেলা মাকে এতটা বয়সে ও ভুলতে পারে নি। শ্রীময়ী ও এক মা যে মেয়ের কথা সব সময়ে চিন্তা করে উতলা হয়ে ওঠে। শ্রীময়ীর উদ্বেগ সিলিয়া কে গভীর ভাবে স্পর্শ করতো। বলতো ''আমাদের এই দেশটা খুব সেফ তুমি মোটেই চিন্তা করোনা। ''
🍂
আরও পড়ুন 👇
নিরালায় বসে অন্যমনস্ক শ্রী ভাবে ,আসলে এই ইহজগতে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা টা খুব বিচিত্র। কে যে কখন কিভাবে কোন পরিচয়ের মাধ্যমে কার প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠবে কেউ সঠিক বলতে পারেনা। হয়তো স্বয়ং বিধাতার ও তা অগোচরে থাকে। এই বিশাল ফার্মিং এলাকায় সিলিয়ার একটু খোঁজ খবর করতেই এমন নাটকীয় ভাবে দেখা পাবে শ্রী তা স্বপ্নে ও কল্পনা করেনি। অনেক আগেই সিলিয়া ওর ঠিকানা ফোন নম্বর দিয়েছিল। ঋষভ ফার্মিং সেন্টারে এসে অনুসন্ধান অফিসে খোঁজ করা মাত্রএক জন বয়স্ক জার্মান সাহেব লালচে ফর্সা রঙের প্রায় ছয় ফুটের মত দীর্ঘাঙ্গী কৃশতণু ও বাদামী চোখের সোনালী লম্বা চুলের বিনুনি বাঁধা জিন্স টপ শ্যাওলা রঙা কোট পরিহিতা বছর ৫৫র সিলিয়া কে নিয়ে এলো। সিলিয়া কে দেখে শ্রী গভীর বিস্ময়ে আত্মহারা যেন বয়স টা থমকে গিয়েছে। বিদেশিনী সিলিয়া গভীর আবেগে শ্রী কে জড়িয়ে ধরে বলে তোমাকে দেখেই এক মুহূর্তে চিনতে পেরেছি । বেশ কিছু সময় ধরে খুশির বিনিময়ের পর ও গ্রীন হাউসটির অনেক টা অংশ ওরা ঘুরে দেখেছিলো। দুই বন্ধুর এমন অকস্মাৎ মিলনে আনন্দের আতিশয্যে বাস্তব ভুলে গল্প করতে গিয়ে অনেক রাত করে বাড়ি ফেরায় অদ্রিজাকে খুব চিন্তায় ফেলেছিল এবং কন্যাটি খুব রেগে ও গিয়েছিল। শ্রীর ,বড়ো বিস্ময় লাগে। ফেসবুক সাগরের ঢেউয়ের মত কিছুই হারিয়ে যেতে দেয় না সময়ের স্রোতে অজানায় ভেসে গেলেও চক্রাকারে তাকে মধুর আবেশে স্মৃতিতে ফিরিয়ে দেয়।
এমন স্বচ্ছ সবুজ লতা গুল্ম দিয়ে ভরে থাকা এমনি সব্জির বাগান,কোথাও সবুজ লাল হলুদ নানা রকমের ক্যাপসিকাম লেটুস পাতা। লাউ কুমড়ো পালঙ ,বেগুন ভেন্ডি শশা টমেটো ইত্যাদির অবাক করা বাগান দেখে আনন্দে মন ভরে গিয়েছিল। আদা রসুন ,পেঁয়াজকলি ,মেথী ,ধনেপাতা ,পুদিনা পালং পাতার অফুরন্ত সম্ভার ,লাউ কুমড়োর পুঁইয়ের পুরুষ্ট সবুজ লতা গুলো উদ্ধত ভঙ্গীতে এঁকে বেঁকে উঠছে কৃত্রিম মাচা জড়িয়ে। চিচিঙ্গা ,শসা,এমন কি ঝিঙে পর্যন্ত হলুদ ফুলের বাহার নিয়ে গাছ থেকে ঝুলে আছে। সিলিয়ার কাছ থেকেই জেনেছিল বার্লিন শহরের ঠিক মাঝখানে এই গ্রীন হাউস টি থেকে উৎপন্ন হয় বছরে প্রায় ৩৫ টন সব্জি। ও দেখিয়েছিলো মাছ সংরক্ষণের বড়ো বড়ো জলাশয় থেকে মাছেদের বর্জ্য একটি অর্গানিক ফিল্টার দিয়ে কেমন করে নাইট্রেটে পরিণত করা হচ্ছে এবং গ্রীন হাউস প্রকল্প গুলোতে সেই জল পাঠানো হচ্ছে। চাষের কাজে আরো কত খুঁটিনাটি নিখুঁত কৌতূহলী কান্ড।
শ্ৰীময়ীর বেশ মনে আছে আরবান মার্কেট ফল সব্জি কেনার ছলে প্রায়ই বেড়াতে এসে ,পথের ধারের কফি শপ টিতে ডিউটি শেষে সিলিয়া ও এসে ওদের সাথে সময় কাটাত। যদিও বহু পূর্ব পরিচয় ছিল তবুও এই বিদেশিনী মেয়েটি মায়ার জালে জড়িয়ে দেশকাল জাতপাতের বেড়া ভেঙে আপন গুনে কত কাছের হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীতে এমন নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের সম্পর্ক আজকের যুগে এক কথায় বিরল। আজ পরন্ত বিকেল শ্ৰীময়ী ঋষভের নিমন্ত্রণে সিলিয়া ডিনারে এসেছিল এবং কাইজার স্ট্রীটের বাড়ি বেশ গমগম করে উঠেছিল। শ্রীময়ীর হেঁসেলের তেল মশলাদার রান্না ফিশফ্রাই ,,চিকেন পকোড়া ,পালক পনির এখনো সিলিয়ার সমান পছন্দের। বার্লিন প্রসঙ্গে বিভিন্ন আলোচনা চলতে লাগলো। ও বলেছিল বার্লিনে প্রায় ৪০ লক্ষ্য জন সাধারণের বসবাস। এখানের বেশীর ভাগ লোক কৃষি প্রিয় চাষ আবাদ ভালোবাসে।এবং ওরা আর্বান বাগান গুলো খুব অদ্ভুত ভাবে যত্ন সহ তৈরী করে তোলে। ধরো , আগে কোনো পরিত্যক্ত পার্কিং লট ছিল ,এখন সেখানে বড় বড় কাঠের বাক্স তে মাটি ও নানা রকম জৈবিক সার ঢেলে বিভিন্ন প্রকারের শাক সব্জি বা ফল ফুলের চাষ করা চলছে। এমনি প্রচেষ্টায় শহরের মাঝে অনেক জায়গায় অর্গানিক চাষের কাজ হচ্ছে এবং টাটকা সব্জি ফুল ফল নিয়ে প্রায় শত খানেকের বেশী এমন আর্বান গার্ডেনিং গড়ে উঠেছে। যদিও এখানে মাইলের পর মাইল সবুজায়ন বা চাষ বাসের বিশাল ক্ষেত কর্মকান্ড অনেক জায়গায় ঘুরে ও তেমন কিছুই দেখতে পাওয়া গেলো না কারণ শীত টা বড্ডো জাঁকিয়ে আসছে। আর ক'দিন পরেই সব হয়তো বরফের সাদা চাদরে ঢাকা পড়ে যাবে।
আর এক উইকেন্ডে শনিবারের সকালে সিলিয়ার নিমন্ত্রন পেয়ে ওদের খামার বাড়ি দেখতে শ্রী সপরিবারে চলেছে শহরের উপকণ্ঠে ,ওদের ছোট্ট গ্রাম টি দেখতে। অদ্রিজার মনে গভীর সংশয় ! ওর বিশ্বাস হয় না , সোনালী চুল নীল চোখের, বিদেশীনী মেয়েরা কি এমন অতিথি পরায়ণ হতে পারে ? বার্লিনের গত তিন বছরের অভিজ্ঞতায় , এই জার্মান মেয়েদের মধ্যে কখোনো দেখেনি এমন আন্তরিকতা। --শ্রীময়ী বলে ,হয়তো প্রথম জীবনে ভারতীয় ছেলের সাথে ও ঘর বেঁধেছিল, তাই ও অন্যরকম। হয়তো আমরা ওর বন্ধু বলেই সিলিয়া সেই সময়ে মল্লারের সাথে যখন প্রথম ভারতে এসেছিল, মুম্বাইতে সে সময় ওর পরমাত্মীয় ,বন্ধু ঋষভ ছায়ার মত ওর পাশে ছিলো। এমন কি আট বছর বাদে মল্লার যখন রোড এক্সিডেন্টের শিকার হয়ে শেষ শয্যায় তিন টি মাস- হসপিটালে শয্যাশায়ী ,সে সময় সেই তার টানাপোড়নের দিন গুলো ,ওর পাশ থেকে কখোনো সরে যাইনি। সে স্মৃতি সিলিয়া প্রায় ৩০বছর বাদেও ছবির মত মনে করতে পারে।
সবুজে সবুজ ক্ষেতে।
ওর সেদিনের আন্তরিক আমন্ত্রনে ওরা তিন জনেই বেশ আপ্লুত হয়েছিল। বার্লিনের উপকণ্ঠের এক গ্রামে--বাউয়ার্ন গার্টেন বা ওদের পৈতৃক পরিবারের এক খামার বাড়ি দেখতে যাবার সময় শ্রীময়ীর খুশি উপচে পরে। ;বার্লিন শহরের উত্তর পূর্বে বের্নাও নামের অচেনা গ্রামটিতে (S -Bahn )-এস বান লাইনে যেতে হয়েছিল। যদি ও সাথে রোড ম্যাপ ছিল তবু ও সিলিয়া চমৎকার করে ঠিকানা এবং পথ নির্দেশ দিয়ে দেওয়াতে ওর গ্রামে সহজেই পৌঁছনো গেল । ট্রেনে কুড়ি মিনিট বাদে বের্নাও ভিলেজের স্টেশনে পৌঁছলে দেখে সিলিয়া তার চেরী কালারের গাড়িটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর ডর্ফ বা গ্রামের,খামার বাড়িতে ওদের নিয়ে যেতে। গাড়ি যত এগোচ্ছে অদ্রিজা শ্রী ভাবছে কোথায় গ্রাম ? সিলিয়া বলেছিলো এই তো গ্রামের পথের শুরু হলো।
শ্রী খুঁজে বেড়ায় সবুজ ভিজে ঘাসে মোড়া মাঠ ,মাটি মাখা মেঠো পথে ট্রাক্টরের চাকার দাগ থাকবে এবড়ো খেবড়ো গ্রামীণ রাস্তায়। পথের দুপাশে চার পাঁচ হাত লম্বা ভুট্টার শিসের মাথা শীতের হাওয়ায় দুলবে। কিন্তু তা নয়। একদম শহরের মত ঝকঝকে কালো রাস্তা, জল লাইট পোস্ট, ইন্টারনেট কানেকশন ওয়াই -ফাই থেকে শুরু করে ,খুব নিরিবিলি ঘন সবুজ গাছের ছায়ায় ভরা। ঋষভ অদ্রিজা আনন্দে হৈহৈ করে ওঠে --খুব বিস্মিত হয়ে বলে দেখো পথের ধারে কেমন সাদা কাশ ফুটে আছে। আমাদের দেশের পুকুর গুলোর মতই আকাশের ছায়ায় ঘেরা নীল জলের পুল গুলোতে সারি বদ্ধ রাজ্হাঁসের দল সপরিবারে সংঘ বদ্ধ , সতর্ক হয়ে চলেছে। ক্রমশঃ
0 Comments