জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —৩৩ /সুমিত্রা ঘোষ


লোকমাতা রানি রাসমণি —৩৩
সুমিত্রা ঘোষ

জানা যায় মা কালী রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কে স্বপ্নের মাধ্যমে দেখা দিয়ে বলেছিলেন তোর ভবসাগর ছেড়ে যাওয়ার আর বেশি দেরি নেই, তুই গদাধরকে তন্ত্রসাধনায় শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে যা। কারণ তোর অবর্তমানে গদাধর আমার পূজা করবে। রামকুমার  সেই মত গদাধরকে কালীঘরের পূজারির উপযুক্ত করে তোলার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। কিছুদিনের মধ্যেই গদাধরকে তন্ত্রসাধকের কাছে দীক্ষা দেওয়ালেন। সেই সময় গদাধর ভাবাবেগে মোহিত হয়ে গেলেন। ভাবাবস্থায় কিছু সময় আচ্ছন্নের মত রইলেন । আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হলেন।
রাধাগোবিন্দ মন্দিরে গোবিন্দের পা ভাঙার আগে থেকেই রানি রাসমণি ও জামাতা মথুরাবাবু গদাধর ঠাকুরের ভাব ও পূজা এবং তাঁর বিভোর অবস্থা দেখে বুঝতে পেরেছিলেন, এই মানুষটি সাধারণ কোনো পূজারী ব্রাহ্মণ নন, ইনি ভিন্নমাত্রার একজন কেউ যাকে ধরা ছোঁয়া যায় না। গদাধরকে তন্ত্রমন্ত্রে দীক্ষা দেওয়ার পর রামকুমার ঠাকুর রানি রাসমণিকে বললেন তিনি একবার কামারপুকুর ঘুরে  আসতে চান। ইতিপূর্বে কালীঘরের পূজারি নিযুক্ত হয়েছেন ছোট ভট্টাচার্য ঠাকুর। আর তাঁর সাহায্যকারী আছেন গদাধরের ভাগ্নে  হৃদয়রাম, বদনঠাকুর এবং অন্যান্যরা। রানি রামকুমারকে বললেন,আপনি কামারপুকুর যাবেন বলছেন তাতে আমার আপত্তি নেই তবে যত শীঘ্র সম্ভব দক্ষিণেশ্বরে ফিরে আসবেন। তখন রামকুমার বললেন ফিরে আসার কথা আমি কি করে বলব?  মা ভবতারিণী যা করবেন তাই হবে। ইতিপূর্বে মা-ভবতারিণী ভৈরবীর বেশ ধারণ করে রামকুমারকে দেখা দিয়ে বলেছেন তুই এবার মায়া মোহ ত্যাগ করে ইহলোক ত্যাগ করে যাওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করে নে। রামকুমার তখন গদাধরের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন আমি ওর জন্য চিন্তিত আর কিছুদিন সময় দেওয়া হোক ভাই-এর পাশে থাকার জন্য। তখন ভৈরবী মা রামকুমারকে বলেছেন তুই বৃথাই চিন্তা করছিস, গদাধর কোন সাধারণ মানুষ নয়, ও পৃথিবীতে মানুষের কল্যাণের জন্য আবির্ভূত হয়েছে।
ত্রেতা যুগের শ্রীরামচন্দ্র, দ্বাপর যুগের শ্রীকৃষ্ণ একত্রিত হয়ে কলিযুগে হবেন শ্রীরামকৃষ্ণ। রামকৃষ্ণ নবধর্মের উদ্ভাবন করবে এবং নবযুগের সূচনায় আলো দেখাবে। সর্বধর্মসমন্বয় সাধন করবে তোমার ভাই গদাধর।
🍂
 অতএব তুই মায়া ত্যাগ করে ভবসাগর ছেড়ে  চলে যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত কর। মা ভৈরবী আরও বললেন আমি তোকে ভবসাগর পার করে দেব। এই কথা বলে ভৈরবী মা রামকুমার ঠাকুরকে দিব্যচক্ষু দিয়ে বললেন তুই এবার দেখ তোর ভাই গদাধর জগতে কি জন্য এসেছে। রামকুমার ভৈরবী মার দেওয়া দিব্যচক্ষু দিয়ে গদাধরের কালী ঘরের পূজারি নিযুক্ত শুরু করে তাঁর ভক্তসমাগম, দিব্যোন্মাদ অবস্থা, দীক্ষা নেওয়া ধর্মপালন, কল্পতরু হওয়া ইত্যাদি সমস্ত কিছু রামকুমারকে দেখিয়ে দিলেন। রামকুমারকে ভৈরবী মা আরও বললেন তোর ভাই যতদিন পৃথিবীতে থাকবে ততদিন লোকের উপকার করে তাদের সঠিক পথের সন্ধান দেবে। ওর জন্য তোর চিন্তা করার কিছু নেই। রামকুমার  ভৈরবী মার আশ্বাসবাণী শুনে ভাবলেন, ভবতারিণী মায়ের আশ্রয়ে তাঁর ভাই গদাধর ভালই থাকবে। এরপর রামকুমার অনন্তলোকে পাড়ি জমালেন। তাঁর আর শেষবারের মত কামারপুকুর যাওয়া হয়নি। মাতৃহারা নিজ পুত্র অক্ষয়কে দেখার জন্য রামকুমার খুব উতলা হয়েছিল শেষের দিকে। রামকুমার ভাগ্যগণনা করতে জানতেন। তিনি নিজ সহধর্মিণীর ভাগ্যগণনায় জানতে পেরেছিলেন জন্মকালীন সময়ে তিনি মারা যাবেন। রামকুমারের ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল।

মা-বাপ মরা ছেলে অক্ষয় সতেরো বয়সেই মারা যায়। বিষ্ণু মন্দিরে পুজো করত। ধ্যান-নিষ্পন্দ হয়ে বসে থাকত দু-তিন ঘন্টা, নিজের হাতে রান্না করে খেত।সারা দিন ভগবদ্গীতা পাঠ করত। ভাইপো অক্ষয়ের মনে ভক্তিভাব দেখে শ্রীরামকৃষ্ণ অক্ষয়কে অত্যধিক স্নেহ করতেন। অল্প বয়সে অক্ষয় বিয়ে করে এবং তার পরেই শয্যা গ্রহণ করে আর ভাল হয় নি। হৃদয়কে ডেকে শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন অক্ষয় আর  বাঁচবে না। হৃদয় মামাকে তিরস্কার করল।

Post a Comment

0 Comments